নিবেদিতা #পর্ব_২৭ #মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

0
87

#নিবেদিতা
#পর্ব_২৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
নিবেদিতারা যখন ঢাকায় গিয়ে হাসপাতালে পৌঁছাল তখন করিডরে বসে ছিলেন নাদিম হোসাইন ও বিউটি বেগম। তাদের কাছ থেকেই জানা গেল নয়ন ও নির্ণয় বাইক রাইড নিয়েছিল। সেখানেই ঘটে দুর্ঘটনা। নয়নের তেমন কিছু না হলেও বাইকার ও নির্ণয়ের অবস্থা গুরুতর। নির্ণয়ের এক হাত প্রায় ভে’ঙে গেছে। এছাড়া পায়ের আঘাতটাও জোরালো। ঘুম সম্ভবত নির্ণয় একা কয়েক মাস হাঁটতেও পারবে না। এগুলো বলতে বলতেই বিউটি বেগম বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললেন। তাকে সামলানোর চেষ্টা করছেন নাসিমা বেগম।

নিবেদিতার দুচোখ বেয়ে নোনাজল পড়ছে। নির্ণয়কে এখন ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাই আগে সবাই নয়নের সঙ্গে দেখা করল। হাতে ও পায়ে ব্যান্ডেজ। নয়ন বাইকে মাঝখানে বসেছিল বলে ওর আঘাত কম লেগেছে। তবুও কম নয়। নাকেও ব্যান্ডেজ ওর। নিবেদিতা এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেলল। তার ভাইয়েরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে না জানি নির্ণয়ের কী অবস্থা হয়েছে! নয়ন ওকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল।

কয়েক ঘণ্টা পার হওয়ার পর নির্ণয়ের ঘুম ভাঙে। রুমে এত মানুষজন দেখে অবাক হলো না সে। বরং শরীরের যন্ত্রণা টের পাচ্ছে ঘুম ভাঙার পর থেকে। সবার মধ্য থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই নির্ণয়ের চোখ আটকাল নিবেদিতার দিকে। কান্না করে চোখ-মুখ একদম ফুলিয়ে ফেলেছে। লাল হয়ে আছে পুরো মুখ। হঠাৎ করেই নির্ণয়ের শরীরের ব্যথা যেন মনে রূপান্তর হলো। নিবেদিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল,

‘পাগলি মেয়ে, এত কাঁদছ কেন? আমার তো কিছুই হয়নি।’

কিন্তু সবার সামনে সেটা বলা সম্ভব হলো না। সারাদিন প্রায় কারো না কারো আনাগোনা ছিল ওর রুমে। হাসপাতাল থেকে ছাড়বে আরো দুদিন পর। এই কয়েকদিন সবাই নির্ণয়দের বাড়িতেই থাকবে। বাড়িতে না বলে হাসপাতালেই বলা যায়। এত মানুষ হাসপাতালে এলাউ করবে না ডাক্তাররা এটাই স্বাভাবিক। এদিকে দেশে এসে সাবিহা এখনো নিজের বাড়িতে যায়নি। তাই নিবেদিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে পলকে সাথে নিয়ে রাতে বাড়িতে চলে গেল। তার বাড়িও ঢাকাতেই। সে দিনে আসবে আবার নির্ণয়কে দেখার জন্য। অন্যদিকে রাদিন ও তুবার মাত্র নতুন বিয়ে হয়েছে। এখনো কত নিয়ম-কানুন, আচার-রীতি বাকি আছে। সব তো আর চাইলেও এড়িয়ে চলা যায় না। তাই নির্ণয় ও ওর বাবা-মা এক প্রকার জোর করেই তুবা, রাদিন এবং বড়ো ও ছোটো মামা-মামিকে আজকের রাতটা নির্ণয়দের বাড়িতে থেকে কাল সকালে গ্রামে চলে যেতে বলেছে।

বিউটি বেগম নিবেদিতাকেও তুবাদের সাথে রাতে বাসায় যেতে বললেন। কিন্তু নিবেদিতা যায়নি। সেও বাবা-মা ও ভাইয়ের সাথে হাসপাতালেই থেকে গেছে। একটা ওয়ার্ডে দুটো বেড। এক বেডে নির্ণয় ও অন্য বেডে নয়ন আছে। নাদিম হোসাইন এবং রতন আহমেদ করিডরেই রাত কাটিয়ে দিলেন। মা, ভাই ও খালার জন্য নির্ণয়ের সাথে আলাদা কথা বলার কোনো সুযোগ পেল না নিবেদিতা। এত কাছে থেকেও যেন কত দূরে। মনটা শুধু ছটফট করছিল একটাবার মানুষটাকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য। নির্ণয়ও ব্যাকুল ছিল নিবেদিতাকে একটু কাছে পাওয়ার জন্য। একটু কথা বলার জন্য। কিন্তু সেই ব্যাকুলতা সে মুখে প্রকাশও করতে পারল না। হাই ডোজের ওষুধ খাওয়ার জন্য না চাইতেও দুচোখ ঘুমে বুজে আসছিল। এক সময় নির্ণয় ঘুমের কাছেই হার মেনে যায়। নয়নও ঘুমাচ্ছে। মা ও খালা ক্লান্ত ভীষণ। তারাও সোফায় বসে ঘুমিয়ে গেছে। কেবলমাত্র নিবেদিতাই ঘুমজড়ানো ক্লান্তচোখে নির্ণয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
.
.
মিদহাদ বসে আছে বারান্দায়। তাদের এখানে এখন দিন। লন্ডনে পৌঁছানোর পরই সে নয়ন ও নির্ণয়ের দুর্ঘটনার খবর পেয়েছিল। খবর নয়ন নিজেই দিয়েছিল। ঐসময়ে তৎক্ষণাৎ-ই আবার বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া অসম্ভব থাকলেও সে ভেবেছিল পরের ফ্লাইটের টিকিট কাটবে আবার। কিন্তু নয়ন বারণ করে দিয়েছে। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করে এবং কষ্ট করে আবার আসার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া গুরুতর কোনো সমস্যা হলে নয়ন নিজেই আসতে বলবে জানিয়েছে। তাই মিদহাদও আর যায়নি। এখন এদেশে বসে বসে দুশ্চিন্তা করছে। মনটা যেন দেশেই পড়ে আছে।

ফোনের রিংটোনে মিদহাদ ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো। সূবর্ণলতা ফোন করেছে। সে ফোন রিসিভ করে বলল,

“হ্যালো।”

“সূবর্ণলতা বলছিলাম।”

“বলুন। নাম্বার সেইভ করা আছে।”

সূবর্ণলতা কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,

“আর কোনো খবর পেয়েছেন ওদের?”

“নয়নকে কল দিয়েছিলাম কয়েকবার। রিসিভ করেনি।”

“হয়তো দেখেনি। নিবেদিতাকে কল দিয়ে দেখতেন। ওর নাম্বার নেই?”

“আছে। ওকে কল দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি।”

“এই মুহূর্তে কিন্তু ওর সত্যিই সাপোর্ট প্রয়োজন।”

মিদহাদ চুপ করে রইল। সূবর্ণলতা বলল,

“এটলিস্ট শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তো…”

পুরো কথা বলার আগেই থামিয়ে দিয়ে মিদহাদ বলল,

“সূবর্ণলতা, আমি যে প্রাণের শুভাকাঙ্ক্ষী এটা প্রাণ জানে। আর প্রাণ যে নির্ণয়কে ভালোবাসে আমি এটা জানি। সূতরাং, কিছু একটা অজুহাতে বারবার ওর কাছে যাওয়া বা কথা বলার চেষ্টা করাটা অন্যায়। আমি সেই অন্যায়টা করতে চাই না। প্রাণ আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। আমি চাই না কোনো কারণে আমার প্রতি থাকা সেই সম্মানটুকু নষ্ট হোক। যেখানে আমার উপস্থিতির প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করব, সেখানে আমি অবশ্যই যাব।”

“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। রাগ করবেন না প্লিজ!”

“আমি আপনাকে ভুল বুঝিনি। আর রাগও করছি না। শুধু আমার দিক থেকে বিষয়টা ক্লিয়ার করছি। তাছাড়া আপনি প্রাণকে চেনেন না। ওকে কাছ থেকে দেখলেও হয়তো এক পার্সেন্টও চিনতে পারেননি। প্রাণের আত্মসম্মানবোধ অনেক বেশি। আপনি ভাবতে পারেন একটা মেয়ের মধ্যে ঠিক কতটুকু আত্মসম্মান ও পজিটিভ জেদ থাকলে সে ভালোবাসার উপেক্ষা নিতে না পেরে দেশ ছাড়তে পারে? প্রাণ হচ্ছে সেই মেয়ে। নির্ণয়কে মনের কথা জানানোর পরও যখন নিজের ভালোবাসা পায়নি তখন কিন্তু ও থেমে থাকেনি। উপেক্ষা সহ্যও করেনি। বরং নিজেকে এবং নিজের ভালোবাসাকে সম্মান করেই দূরে চলে গেছে। আর ওর এই আত্মসম্মান ও ভালোবাসার টানেই কিন্তু নির্ণয় নিজেও দেশ ছেড়েছে। শুধুমাত্র নিবেদিতাকে পাওয়ার জন্য।”

সূবর্ণলতা চুপ করে আছে। মিদহাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“সূবর্ণলতা শুনুন, প্রাণ আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। দেখা হওয়ার পরও পাশাপাশি থেকেও কখনো প্রাণ আমাকে লক্ষ করেনি, আমার দিকে সেভাবে তাকায়নি, কথা বলার চেষ্টা করেনি। তারপরও ওর চোখের ভাষা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি একটুও। প্রাণ যে নির্ণয়কে ভালোবাসে সেটা আমি ওর চোখ দেখেই বুঝেছিলাম। সেখানে আপনি আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে। কাছাকাছি ছিলেন, পাশে এসেছেন, কথা বলেছেন। আপনি যে আমাকে পছন্দ করেন কিংবা ভালোবাসতে শুরু করেছেন সেটা আমি বুঝিনি ভেবেছেন? আমি জানি সব। আর তাই হয়তো না চাইতেও প্রাণকে নিয়ে আপনার একটা আশঙ্কা কাজ করে। তবে আমার কিন্তু মোটেও নির্ণয়কে নিয়ে কোনো শঙ্কা কাজ করে না। কেন জানেন? কারণ আমি জানি, আমি যতটা না প্রাণকে ভালোবাসি নির্ণয় তারচেয়েও বেশি ভালোবাসে প্রাণকে। ভালোবাসায় কখনো হিংসা-বিদ্বেষ রাখতে নেই। তাছাড়া প্রাণ এমন একটা মেয়ে সে নির্ণয়কে না পেলে একা থাকবে তাও আমার সঙ্গে জড়াবে না। হয়তো অন্য কোনো ছেলের সঙ্গেও নয়। তাছাড়া ভালোবাসলেই কি তাকে পেতে হয় বলুন?”

সূবর্ণলতা এতক্ষণ সব মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে ভাবছিল কী জবাব দেবে সে মিদহাদকে। মিদহাদ যখন জেনেই গেছে ভালোবাসার কথা তখন তো আর কোনো রাখঢাক রাখার প্রয়োজন নেই। মিদহাদের শেষ প্রশ্নটা শুনে সে নিজেও কথার প্রসঙ্গ খুঁজে পেয়ে জিজ্ঞেস করল,

“তাহলে কি আপনি সারাজীবন একাই থাকবেন বলে ভেবে রেখেছেন?”

ফোনের অপর প্রান্তে নিরবতা। শুধু দীর্ঘশ্বাসের ভারী শব্দ ভেসে আসছে। মৌনতা কাটিয়ে মিদহাদ বলল,

“হয়তো সেটা আমি চাইলেও সম্ভব না। আমি প্রাণকে ভালোবাসি এ কথা যেমন সত্য, তেমনই আমার পরিবারকেও আমি খুব ভালোবাসি। পরিবারকে তো আমি উপেক্ষা করতে পারব না। আমি তাদের একমাত্র ছেলে। আমাকে নিয়ে তাদের অনেক শখ, স্বপ্ন আছে। আমি নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাইনি বলে যে পরিবারের ভালোবাসার দাম দেবো না তা তো হতে পারে না।”

“তার মানে আপনি বিয়ে করবেন? কিন্তু সেটা কবে?”

“এখন বরং এসব কথা থাক।”

“আমি জানতে চাচ্ছি।”

“আমি আপাতত এসব নিয়ে আর কোনো কথা বাড়াতে চাচ্ছি না।”

সূবর্ণলতা বুঝল জোর করে লাভ নেই। তাছাড়া জোরজবরদস্তি করে তো আর ভালোবাসা আদায় করা যায় না। প্রয়োজনে সে উপেক্ষা সহ্য করেই না হয় অপেক্ষা করবে। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“ঠিক আছে। ওদের আর কোনো খোঁজ পেলে আমাকে জানাবেন। রাখছি।”

“আল্লাহ্ হাফেজ।”

_______

নির্ণয়ের জন্য ওষুধ বের করছিল নিবেদিতা। নয়নকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিউটি বেগম ও নাসিমা বেগমও বাসায় গিয়েছেন রান্নাবান্না করে আনার জন্য। নিবেদিতা, সাবিহা ও পলকে রেখে গেছে। সাবিহা পলকে নিয়ে একটু বাইরে গেছে কেনাকাটা করার জন্য। কারণ তাদের ডেনমার্কে ফিরে যাওয়ার সময় প্রায় চলে এসেছে। আর মাত্র দুদিন আছে। নির্ণয়ের মাথায়ও বিষয়টি আসতেই সে মনে মনে কঠিন হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

নিবেদিতা নির্ণয়কে ওষুধ এগিয়ে দিয়ে বলল,

“ভদ্র ছেলের মতো ওষুধগুলো খেয়ে নিন তো।”

নির্ণয় ওষুধ খেয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

“তোমার কোনো কেনাকাটা থাকলে করে ফেলছ না কেন?”

“কীসের কেনাকাটা?”

“প্রয়োজনীয় কিছু যদি কেনার থাকে। ফ্লাইটের তো আর মাত্র দুদিন বাকি।”

নিবেদিতা মাথা নত করে চুপ করে আছে। নির্ণয় জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে? চুপ করে আছো কেন?”

নিবেদিতা মাথা নত করেই বলল,

“আমি ডেনমার্কে যাব না।”

নির্ণয় খুব ভালো করেই জানত যে, নিবেদিতা এমন কিছুই পরিকল্পনা করবে। কারণ নির্ণয়ের এই অবস্থায় ডেনমার্কে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। আর নিবেদিতাও ওকে রেখে যেতে চাইবে না। তাই মনে মনে কঠিন কিছু কথা নির্ণয় বলার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। সে প্রায় কিছুটা রাগীস্বরেই বলল,

“যাবে না মানে?”

“আপনাকে রেখে আমি কোথাও যাব না।” নির্ণয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল নিবেদিতা।

নিবেদিতার এমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখে মন নরম হয়ে যাচ্ছিল নির্ণয়ের। কিন্তু এখন নরম হলে চলবে না। সে পূর্বের স্বরেই বলল,

“তোমার মাথা ঠিক আছে নাকি নষ্ট হয়ে গেছে? কীসব আবেগি কথাবার্তা বলছ? আমি কি ম’রে যাচ্ছি? নাকি তুমি দেশে না থাকলে আমি ম’রে যাব?”

নিবেদিতা আহত দৃষ্টিতে তাকাল। নির্ণয়ের কষ্ট হচ্ছিল। তবুও সে ধমকের সুরে বলল,

“দয়া করে কোনো সিনক্রিয়েট কোরো না, নিবেদিতা। তোমার জন্য খালা-খালুর পরিশ্রমের টাকাগুলো নষ্ট হতে দিও না। তাছাড়া এখানে তোমারও ক্যারিয়ার জড়িয়ে আছে। আবেগ দিয়ে সব না ভেবে বিবেক দিয়ে ভাবো। আর মাথায় যেসব উলটা-পালটা চিন্তা ঢুকিয়েছ সেসব ঝেড়ে ফেলে ডেনমার্কে যাওয়ার জন্য তৈরি হও।”

“আপনাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কীভাবে যাব?”

“প্রথমবার যেভাবে গিয়েছিলে সেভাবেই যাবে। এমন তো না যে তুমি পথ ভুলে গেছ, হারিয়ে যাবে। সেই ভয় থাকলেও সমস্যা নেই। এখন সাবিহা আর পল আছে সাথে। ওরা তোমাকে সাথে করে নিয়ে যাবে।”

“আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? শান্ত থাকুন। সমস্যা হবে আপনার।”

“আমি রাগ করছি না। শুধু চাচ্ছি, তুমি ডেনমার্কে ফিরে যাও।”

নিবেদিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

“বেশ! যদি ডেনমার্কে ফিরে যেতেই হয় তাহলে আপনাকে বিয়ে করেই যাব।”

“কেন?”

“কেন মানে? এমনটাই তো কথা ছিল।”

“কথা তো কত কিছুই থাকে। সব কি পূরণ হয়? আর তোমার কি মনে হয় আমি খুব সুখে আছি? আনন্দে আছি? নাচতেছি আমি বিয়ে করার জন্য? আমি এখন কোনো বিয়েটিয়ে করতে পারব না।”

নির্ণয়ের এসব আচরণে নিবেদিতা কষ্ট পেলেও চুপ করে রইল। তার চোখ টলমল করছে। নির্ণয় দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিল। না জানি কখন মিথ্যে অভিনয় ধরা পড়ে যায়। নিবেদিতাকে এভাবে কাঁদতে দেখলে তো সে পারবে না নিবেদিতাকে শক্ত করতে। কিন্তু সে চায় না, তার জন্য নিবেদিতার ভবিষ্যৎ খারাপ হোক। নিবেদিতাকে এখন সামনে থেকে সরাতে হবে। সে বুকে পাথর রেখে বলল,

“আমার সামনে কাঁদবে না। অসহ্য লাগছে! এমনিতেই আমি মানসিক ও শারীরিক অশান্তিতে আছি। তুমি আর অশান্তি বাড়িয়ো না প্লিজ। তোমার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, বাড়ির কাউকে এই মুহূর্তে বিয়ের কথা বোলো না। আর তুমি যে আমাকে দয়া দেখিয়ে বিয়ে করতে চাচ্ছ ঐটাও আমি জানি। তোমার করুণার কোনো প্রয়োজন নেই আমার। যদি পারো তাহলে আমাকে সবার কাছে অপরাধী না বানিয়ে ডেনমার্কে ফিরে যাও।”

নিবেদিতার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ। সে শক্ত কণ্ঠে বলল,

“আমি চলে গেলেই আপনি খুশি?”

নির্ণয় অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল,

“হ্যাঁ।”

“বেশ! তাই হবে।”

এরপর চোখের পানি মুছতে মুছতে নিবেদিতা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। টলমল দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে নির্ণয় রুদ্ধশ্বাসে বলল,

“সরি নিবেদিতা!”

এই ঘটনার পর নিবেদিতা গ্রামে চলে গেল। ডেনমার্কে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। নির্ণয় যখন জানতে পারল, নিবেদিতা গ্রামে চলে গেছে তখন তার মন কষ্ট পেলেও এটা ভেবে খুশি হলো যে নিবেদিতা কোনো ভুল সিদ্ধান্ত আর নেবে না। নির্ণয় জানেনা এখন তার ভবিষ্যৎ কী বা কীরকম হবে। কিন্তু সে চায় না তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য নিবেদিতার উজ্জ্বল, সুন্দর ভবিষ্যৎটা নষ্ট হোক। এর মাঝে অনেকবার সে নিবেদিতাকে ফোন বা ম্যাসেজ করতে গিয়েও করেনি। যদি আবার মেয়েটা পিছুটানে পড়ে যায় তখন? তারচেয়ে বরং নিরবে সে একাই কষ্ট পাক এবং অন্যদিকে নিবেদিতা শক্ত হোক।
.
.
আজ নিবেদিতার ফ্লাইট। সারারাত নির্ণয় ঘুমাতে পারেনি। তাকে এখন বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। একই তো শরীরের ক্ষ’তের ব্যথা, অন্যদিকে মনে অস্থিরতা। নিবেদিতার চলে যাওয়ার আসন্ন সময়টা একদম নিকটে চলে আসায় মনের অস্থিরতা কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গিয়েছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে,

“আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ! আমি তোমাকে ভালোবাসি, নিবেদিতা।”

বলা হয় না। সে বলতে পারে না। মনের সাথে যু’দ্ধ করতে করতে ভোরের দিকে সে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে তার ঠিক পাশেই বিছানায় নিবেদিতা বসে আছে। তার এক হাতে নির্ণয়ের হাত ধরা এবং অন্য হাত নির্ণয়ের গালে রাখা। নির্ণয় বিস্ময় ও মুগ্ধ হয়ে নিবেদিতাকে দেখছে। কী স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে! ঘোরের মধ্যেই নির্ণয়কে ধরে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল নিবেদিতা। জিজ্ঞেস করল,

“কেমন আছেন?”

ঘোর ভাঙল নির্ণয়ের। সে ভেবেছিল সারারাত ধরে নিবেদিতাকে নিয়ে ভেবেছে বলে হয়তো এখন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু এটা স্বপ্ন নয় বাস্তব বুঝতে পেরেই নিজেকে আবার গুটিয়ে নিল নির্ণয়। এইযে সারারাতের অস্থিরতা, ঘুমাতে না পারা, মনের সুপ্ত ইচ্ছে; সমস্তকিছুই এখন এক লহমায় অদৃশ্য কিছু দিয়ে বন্দি করে নিয়েছে নির্ণয়। কারণ তীরে এসে সে তরী ডোবাতে চায় না। কোনো পিছুটানে ফেলতে চায় না সে নিবেদিতাকে।

নির্ণয়ের থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নিবেদিতা বলল,

“কথা বলবেন না? আজ তো আমি চলে যাচ্ছি। আজও এমন করবেন?”

নির্ণয় ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,

“সাবধানে যেও।”

”ব্যস এইটুকুই?”

নিবেদিতার মুখের দিকে তাকাল নির্ণয়। মৃদু হাসল নিবেদিতা। ইশ! মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে কেন? নির্ণয়ের মুগ্ধতার রেশ কাটার পূর্বেই নিবেদিতা ওকে জড়িয়ে ধরল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,

“আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনার খারাপ সময় বলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন, আমার থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখবেন তাহলে আপনি ভুল। আপনি কি ভেবেছেন আপনার রুড আচরণের কারণ আমি জানিনা? আমি সব জানি। আপনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত নয়; নিশ্চিত সুন্দর ভবিষ্যৎ। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। আমরা আবারো একসাথে পথ চলব হাতে হাত রেখে। আমি ফিরে যাচ্ছি এখন আপনার জন্য, আমার পরিবারের জন্য। কিন্তু আমি ফিরে আসব। খুব শীঘ্রই আপনার কাছে ফিরে আসব। ততদিন আমার জন্য অপেক্ষা করবেন প্লিজ? করবেন না অপেক্ষা আপনার নিবেদিতার জন্য? আপনার চাঁদ আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। আলো হয়ে চাঁদের সাথে থাকবেন না? পাশে থাকবেন না? আমার আজকের বিষাদের প্রস্থান একদিন সুখের আগমন হয়ে আপনার জীবনে ফিরে আসবে দেখবেন। ততদিন পর্যন্ত নিজের খেয়াল রাখবেন, যত্ন নেবেন, সুস্থ হয়ে উঠবেন দ্রুত।”

এইটুকু বলে নির্ণয়কে ছেড়ে দিল নিবেদিতা। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে নির্ণয়ের দুগালে হাত রেখে বলল,

“আর হ্যাঁ, নিবেদিতার হয়ে থাকবেন।”

এরপর সে ঠোঁট ছোঁয়াল একে একে নির্ণয়ের কপালে, দুচোখের পাতায়, নাকের ডগায়, দুগালে, থুঁতনিতে এবং পরিশেষে শুষ্ক ঠোঁটে। অস্ফুটস্বরে বলল,

“আপনার নিবেদিতা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে।”

চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here