#নিবেদিতা
#পর্ব_৩৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_______________
মিদহাদের মনে এখন উথালপাতাল ঝড় চলছে। সে বুঝতে পারছে না কীভাবে নির্ণয়কে মানাবে। কীভাবে সত্যিটা বোঝাবে কিংবা আড়াল করবে। হতাশায় মূর্ছা যাচ্ছে সে। তার কারণে যদি নিবেদিতার সুখের জীবনটা তছনছ হয়ে যায় তাহলে নিজেকে সে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। জীবনে বেঁচে থাকতে কোনোদিনও নিবেদিতার মুখোমুখি হতে পারবে না সে। তার প্রাণের মন থেকে তার জন্য থাকা সমস্ত সম্মান-শ্রদ্ধা সব এক নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। ভেতর থেকে অনেক কিছু বলতে চাইলেও মুখ ফুটে সে একটা কথাও নির্ণয়কে বলতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল কেউ তার কণ্ঠস্বর জোরপূর্বক চেপে ধরে রেখেছে। মিদহাদের উ’দ’ভ্রা’ন্ত, দিশেহারা অবস্থায় তাকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল নির্ণয়। এক নিমিষেই শান্ত হয়ে গেল মিদহাদ। ভেতরে বয়ে চলা কালবোশেখি ঝড়টাও যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল। অথচ নির্ণয় তাকে মুখে কিছুই বলেনি। একটুখানি জড়িয়ে ধরায় সব কিছু এতটা স্বাভাবিক হয়ে গেল?
মিদহাদ নির্বাক, নিশ্চুপ ও স্তব্ধ। চোখের পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেছে সে। নিঃশ্বাস ঠিকমতো চলছে শুধু। তার বিস্ময়ের রেশ কাটা পর্যন্ত নির্ণয় জড়িয়ে ধরেই রাখল। এরপর ছেড়ে দিয়ে মিদহাদের দুই বাহু চাপড়ে বলল,
“রিল্যাক্স ব্রো!”
মিদহাদ দরদর করে ঘামছিল। চোখে-মুখে তার আতঙ্ক। নিজের জন্য নয়। নিবেদিতার জন্য। অথচ নির্ণয় কত সুন্দর করে হাসছে। যেন কিছুই হয়নি। তাহলে কি সে কিছু দেখেনি? মিদহাদ কি অযথাই ভয় পাচ্ছিল? না বলা সকল প্রশ্ন যেন নির্ণয় মিদহাদের ঘোলাটে চোখেই দেখতে পাচ্ছিল। নির্ণয় আবারও মৃদু হাসল। নিজেই জবাব দিয়ে বলল,
“আমি দেখেছি সব। তবে সব কথা শুনিনি। শুধু শেষের কথাটা শুনেছি। ‘তাকে নিজের করে নিন’ এটাই তো বলেছিল তাই না? তাকে বলতে নিবেদিতা বোধ হয় সূবর্ণলতাকে মিন করেছে রাইট?”
মিদহাদ তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিতে পারল না। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“তুমি ওকে ভুল বুঝো না।”
“কাকে? নিবেদিতাকে?”
মিদহাদ দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নির্ণয় বলল,
“নিবেদিতাকে আমি ভুল কেন বুঝব?”
একটু থেমে বলল,
“ওহ আচ্ছা! ও তোমাকে জড়িয়ে ধরেছে তাই?”
এবার একটু শব্দ করেই হাসল নির্ণয়। মিদহাদের পাশাপাশি দাঁড়াল এবার সে। কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“নিবেদিতাকে আমি চিনি, মিদহাদ। আমার কিংবা আমাদের ভালোবাসা তো এত ঠুনকো নয়। যদিও আমি শুনতে পারিনি ও তোমাকে কী কী বলেছে তবে এতটুকু বুঝেছি ও তোমাকে কেন জড়িয়ে ধরেছে। এইযে কিছুক্ষণ আগেই আমি তোমায় যেই কারণে জড়িয়ে ধরলাম! তুমি অসহায়বোধ করছিলে এটা ভেবে যে, আমি হয়তো নিবেদিতাকে ভুল বুঝব। ওকে ছেড়ে যাব। এই বিয়ে করব না। তাই না? তোমাকে অভয় দিতেই তো আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরলাম। আশ্বস্ত করলাম যে এমন কোনো কিছুই আমি করব না। দেখো ব্রো, একটা ট্রু হিউম্যান ন্যাচার কী জানো? কম্ফোর্টজোন, সিম্প্যাথি। ধরো একটা মানুষ মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছে, ডিপ্রেশনে আছে, তাকে মুখে কিছু বলেও আশ্বস্ত করা যাচ্ছে না, একটুখানি মানসিকভাবে ভরসা দেওয়া যাচ্ছে না তখন কী করা উচিত জানো? তাকে জড়িয়ে ধরা। জড়িয়ে ধরার মাঝেও ফারাক আছে। আমি আমার বাবা-মাকেও জড়িয়ে ধরি। নিবেদিতাকেও জড়িয়ে ধরেছি। তোমাকেও জড়িয়ে ধরেছি। এখন এই তিনটা জড়িয়ে ধরার অনুভূতি কি একই রকম? নিশ্চয়ই না। সূতরাং নিবেদিতা আমাকে যেমন ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে তোমাকে সেভাবে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেনি। তোমার খারাপ সময়টা ও অনুভূতিকে সম্মান ও সমবেদনা জানিয়ে একটুখানি ভরসা দিতে জড়িয়ে ধরেছে। তাহলে ওকে কেন আমি ভুল বুঝব বলো তো? আমি নিবেদিতাকে চিনি, আবার তোমাকেও চিনি। হয়তো নিবেদিতার থেকে কমই চিনি তোমাকে। তবে আজকের ঘটনার পর থেকে এইটুকু তো আমি শিওর যে, নিবেদিতার কাছে তুমি অন্যরকম সম্মানজনক একজন ব্যক্তি। কারণ আমার নিবেদিতাকেও আমি এতটুকু চিনি যে, সে সমবেদনা জানাতে যাকে তাকে জড়িয়ে ধরবে না। ব্রো, ওর হাতে অনেক অপশন ছিল, ওয়ে ছিল আমার থেকে বেটার কাউকে চ্যুজ করার। কিন্তু করেনি। আমার খারাপ সময়েই যেই মেয়ে আমাকে ছেড়ে যায়নি সেই মেয়ে এতদূর অবধি এসে আমাকে চিট করবে? এটা তো আমাকে কেউ ম’র’তে ম’র’তে বললেও আমি বিশ্বাস করব না।”
মিদহাদকে খাটের ওপর বসাল নির্ণয়। পড়ার টেবিলের ওপর থেকে নয়নের পানির বোতলটা নিয়ে এগিয়ে দিল। মিদহাদ বিনা বাক্যব্যয়ে পানি পান করল। নির্ণয় এরপর ওর পাশে বসল। বলল,
“তুমি যে নিবেদিতাকে ভালোবাসো এটা কিন্তু আমি জানি।”
মিদহাদ বিস্ময় নিয়ে তাকাল। নির্ণয় মৃদু হেসে বলল,
“উঁহুঁ, আমাকে কেউ বলেনি। নিবেদিতা কিংবা সূবর্ণলতা কেউই না। তুমি যেমন একজন ছেলে, আমিও তেমন একজন ছেলে। একজন ছেলে হয়ে আরেকজন ছেলের মানসিকতা, চোখের ভাষা চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি। তোমার চোখই বলে দিত তুমি নিবেদিতাকে ভালোবাসো। তুমি যে সেদিন আমাকে ছাদে মিথ্যা বলেছিলে সেটাও আমি সেদিনই ধরে ফেলেছিলাম। কিন্তু কিছু বলিনি। কারণ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, তুমি চাও না এই বিষয়টা আমি কিংবা নিবেদিতা কেউ জানি। এবং এটা তুমি নিবেদিতার ভালোর জন্যই চাওনি এটাও জানি। আমি যাতে এই বিষয়ে আর কোনো কনফিউশন না রাখি এজন্য তুমি আরো একটা মিথ্যা কথা বলেছ যে, তুমি সূবর্ণলতাকে ভালোবাসো। অথচ তোমার চোখে আমি সূবর্ণলতার জন্য কোনো অনুভূতিই দেখিনি কখনো। তোর চোখ সর্বদা নিবেদিতাকে খুঁজত, তোমার মন সর্বদা ব্যাকুল থাকত শুধু নিবেদিতার জন্যই। আর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ কী জানো? তোমার সম্বোধন। প্রাণ! তোমার এই ডাকে যে কতটা মায়া, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে এটা বোঝার জন্য আলাদা করে কাউকেই ব্রেইন খাটানোর প্রয়োজন নেই। নিবেদিতাকে ভালোবাসি তো তাই প্রথম প্রথম একটু হিংসেই হতো। ভয়ও হতো নিবেদিতাকে হারানোর। পরে একা একা অনেক ভেবেছি। আমার আসলে হিংসা অথবা ভয় দুটোই অনর্থক। তোমাকে হিংসা করার কোনো কারণ ছিল না কারণ তুমি নিবেদিতার এত বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী যে এতটা ভালোবেসেও কখনো স্বীকার করোনি। মনের ভেতর রেখে দিয়েছ। এমনকি নিবেদিতা আমাকে ভালোবাসে এটা জানার পর নিজেই দূরে সরে গেছ। তখন তোমাকে হিংসা করার বদলে তোমার প্রতি আমার সম্মানটা বেড়ে গেছে। আর নিবেদিতাকে হারানোর ভয় কেটেছে এটা জেনে যে, পুরো দুনিয়া আমার বিপক্ষে চলে গেলেও আমার নিবেদিতা কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না।”
মিদহাদ অবাক হয়ে দেখছে নির্ণয়কে। সব জেনেও নির্ণয় কতটা অজানার ভান ধরে থাকত। প্রতিটা কথায় মিশে আছে নিবেদিতার প্রতি তার ভালোবাসা ও সম্মান। সত্যিই নিবেদিতা ভুল কাউকে ভালোবাসেনি। সঠিক মানুষটাকেই সে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। বুকের ওপর থেকে ভারী পাহাড়টা নেমে গেল মুহূর্তেই। আতঙ্কিত চোখেমুখে ভেসে উঠল হাসির ঝিলিক। আনন্দিত হয়ে সে জড়িয়ে ধরল নির্ণয়কে। নির্ণয়ও তাকে জড়িয়ে ধরল। মিদহাদ বলল,
“বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, তোমরা মেইড ফর ইচ আদার। আল্লাহ্ তোমাদের একজনকে আরেকজনের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। নিবেদিতার জীবনে তোমার চেয়ে পার্ফেক্ট কেউ আর কখনো হতেই পারে না, ব্রো।”
নির্ণয় মিদহাদের পিঠ চাপড়ে বলল,
“আমি জানি, তোমার কথায় কোনো ছল নেই। কিন্তু মনে কষ্ট আছে। থাকবে। স্বাভাবিক। তবুও বলব ভাই, জীবনটাকে সুযোগ দাও প্লিজ! নতুন করে বাঁচতে শেখো। হাসি-খুশি মিদহাদকে দেখতে চাই আমরা।”
মিদহাদও নির্ণয়কে আশ্বস্ত করে বলল,
“ইন-শা-আল্লাহ্, আমার ভাই।”
নির্ণয় হেসে বলল,
“এবার তাহলে বউটাকে সারপ্রাইজ দিতে যাই কী বলো?”
“শিওর, শিওর।”
দরজার আড়াল থেকে সূবর্ণলতা ও তুবা ওদের দুজনের সব কথা শুনছিল। শেষ কথাটা শুনেই দৌঁড়ে দুজনে নিবেদিতার রুমে ঢুকে গেল। সূবর্ণলতা এসব আগে থেকেই জানত বিধায় তার এসব কথা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে না। তবে তুবা সম্পূর্ণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। সে অবিশ্বাসী কণ্ঠে সূবর্ণলতাকে বলল,
“এসব সত্যি? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না!”
সূবর্ণলতা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, সত্যি। এসব কথা আবার নিবেদিতাকে জিজ্ঞেস কোরো না এখন। এমনকি নির্ণয় ভাইয়া কিংবা মিদহাদকেও না। বিয়েটা আগে সুন্দরমতো হয়ে যাক।”
তুবার অবাক হওয়া হয়তো আরো বাকি ছিল। বিস্মিত হয়ে বলল,
“এর মানে কী? আপনিও এসব জানতেন? আগে থেকেই?”
“হ্যাঁ।”
“ওহ মাই গড! একমাত্র আমিই কিছু জানতাম না।”
“বাদ দাও তুবা। এসব কথা জানা না জানায় কী আসে যায় বলো? বরং এইমাত্র যা শুনলে সব আবার ভুলে যাও। ধরে নাও আগের মতোই তুমি কিছু জানো না।”
তুবা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“সেটাই!”
হঠাৎ বাইরে থেকে সবার একত্রে চিৎকার শুনে দুজনেই চমকে উঠল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে সবাই নির্ণয়কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নিবেদিতা মুখে হাত দিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্ণয়ের দিকে। সবাই তাহলে নির্ণয়কে দেখেই অবাক হয়ে চিৎকার করেছে। তুবা তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“এই আপু চলেন, চলেন। এত সুন্দর মুহূর্ত নষ্ট করা চলবে না। চলেন।”
সূবর্ণলতার হাত ধরে দৌঁড়ে দুজনে বাইরে গেল। নির্ণয়কে নিবেদিতার কাছে যেতে দিচ্ছে না কাজিনরা। তারা টাকা চাচ্ছে। মিদহাদ ও নির্ণয়ের বন্ধুরা তখন নির্ণয়ের পক্ষ নিয়ে বলল,
“এখন কীসের টাকা? টাকার দর কষাকষি আগামীকাল হবে। হাতে শরবত, মিষ্টি নিয়ে গেট ধরবেন তখন টাকা দেবো। এখন পথ ছাড়েন সবাই।”
তুবা এসে তখন উপস্থিত হলো। যারা পথ আটকে ধরেছে ওদের পক্ষ নিয়ে বলল,
“আগামীকালের চিন্তা আগামীকাল করা যাবে। আজকের হিসাব আজকে হবে।”
মিদহাদ বলল,
“এখানে তো ওরা হিসাব করতে আসেনি। এসেছে সারপ্রাইজ দিতে।”
“খুবই ভালো কথা। নিবেদিতার সাথে আমরাও সারপ্রাইজড হয়েছি। এখন শ্যালক-শ্যালিকা হিসেবে তো আমরা দুলাভাইয়ের কাছে কিছু আবদার করতেই পারি তাই না?”
নির্ণয়ের এক বন্ধু তখন বলল,
“কী নি’ষ্ঠু’র! তোমরা তো নির্ণয়েরও ভাই-বোন হও। এমন স্বৈ’রা’চা’রী আচরণ করছ কীভাবে?”
তুবা ভেংচি কাটল। নির্ণয় বন্ধুদের থামিয়ে নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নিবেদিতার কাছে যেতে যদি স্বৈ’রা’চা’রী’দে’র প’ত’ন ঘটাতে হয় তাতেও আমার আপত্তি নেই। ওদের আর্জি মঞ্জুর কর। সকল কিছুর বিনিময়ে হলেও আমার নিবেদিতাকে চাই।”
নির্ণয়ের এই কথায় চারপাশ হাত-তালিতে মুখরিত হয়ে উঠল। কয়েকজন শিসও বাজাল। নিবেদিতা লজ্জায় দুহাতে মুখ লুকাচ্ছে তখন।
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]