কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ১৮|

0
1

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ১৮|

সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে আর কুঞ্জ ভাই আমার সাথে কথা বলেননি। আমি কিছু বলতে গেলেই উনি কেবল চোখ রাঙিয়েছেন। ব্যাপারটি আমার ছোট্ট ও অবুঝ মস্তিষ্কে ঢুকল না। হয়তো ঢুকবেও না। দেখতে দেখতে দুটো দিন পেরিয়ে গেল। আজ আমার দিদির গায়ে হলুদ। উৎসবের আমেজে পুরো বাড়িটা জমজমাট হয়ে আছে। আব্বুরা কাল রাতেই এসেছে।
এখানে বড়ো মামারা থাকেন না, তবুও বাড়ি করে রেখেছেন। পাশাপাশি তিনটে এক তলা বিল্ডিং, আমার তিন মামার; মাঝখানের উঠোনকে ঘিরে বানানো হয়েছে। ছোটো মামার বাড়িতে অতিথিদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে, বাড়ির অন্যান্য সকলে মেজো মামার বাড়িতে রইল।
আর আমরা, ইয়াং জেনারেশনের সবাই রইলাম বড়ো মামার বাড়িটিতেই। ওহ্, হ্যাঁ! সে রাতে সবাই একসাথে শুয়ে যেই আফসোস করেছিলাম, তা আর করতে হয়নি। আমি, আপি আর রাহী বিগত রাতগুলো রাহীদের বাড়িতে, ওর রুমেই থেকেছি। দিদি, নীতি, সুপ্তি, দিয়া আরেক রুমে। আরেকটিতে কুঞ্জ ভাই, আসিফ ভাই আর আকাশ ভাই।

আমি ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশটা দেখলাম। কী সুন্দর লাগছে সবটা! আমি লোক-সমাগম তেমন সহ্য করতে পারি না, তবুও ভালো লাগছে। উঠোনটা ভীষণ আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো হয়েছে, পুরো বাড়ির মধ্যস্থানে হলুদের আয়োজন। দূরের ওই বাগানের একপাশে দেখা যাচ্ছে, খাবার রান্নার ব্যবস্থা করে হচ্ছে। আমার আর রুমে থাকতে ইচ্ছে হলো না। ঘড়িতে তাকালাম, সময় এখন: ছয়টা বিশ। আলগোছে উঠে পড়লাম। আমার পাশের ঘুমন্ত মহিলাগুলো এখনই উঠবে না। এরা তো ওই ধাঁচেরই না।

উঠে ফ্রেশ হলাম না। ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উঠোনের এক কিনারায় নানুমা বসে আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই নানুমা বলে উঠলেন, “কী গো, নানা! এই ব্যাহানায় ঘুম ভাঙল কিয়ারতে? রাইতে ঘুম হয় নাই?”

আমার নানুমা আমাকে আদর করে ‘নানা’ বলে ডাকেন। বড্ড প্রশান্তিময় এই ডাক। আমি সামান্য হেসে বললাম, “ঘুম হয়েছে। বাড়িতে বিয়ে, এত বেলা করে কি ঘুমোনো ঠিক, বলুন?”

নানুমা পানখাওয়া মুখ থেকে মাটিতে পানের পিক ফেলে হেসে বললেন, “পোলাপানগুলা বুঝবারই চায় না। এত এত কাম, হাত লাগাইব তো নাই; নিজেগোর লগে আনন্দ-ফুর্তি করব, তাও করে না।”

“একটু ঘুমাক, এরপর দেখবেন, পুরো বাড়িতে কেমন শোরগোল শুরু হয়ে যায়!”

নানুমা শুধুই হাসলেন। আমি শুধালাম, “নানাভাই কোথায়? ওঠেননি?”

“তোমার নানাভাই তো ফজরের ওয়াক্তে উঠসে। এহন দ্যাহো, পচ্চিমেত্তে গেসে।”

আমি ব্রাশ করতে করতে পশ্চিম দিকে, বাগানের ওদিকে গেলাম। ওখানে আমার আব্বু, বড়ো মামা, খালুজান, নানাভাই, সবাই আছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলাম। সবাই হেসে সালামের জবাব দিলেন।

নানাভাই তখন বললেন, “গুড মর্নিং, সুইটহার্ট।”

আমি ছোটো করে হাসলাম। বিনিময়ে বললাম, “সুপ্রভাত, নানাভাই।”

নানাভাই অধর এলিয়ে বিশাল করে হাসলেন, “হু আর ইউ, ডিয়ার লেডি?”

আমি ভ্রু বাঁকা করে ফেললাম। এক সময় আমার নানাভাই গ্রামের স্কুলের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু, বয়সের তালে তালে ইংরেজি সব প্রায় গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছেন। তবুও থামেনি তাঁর ভুলভাল ইংরেজি বলা!

নানাভাইয়ের ‘হু আর ইউ’ শুনে সবাই অবাক চোখে তাকালেও, আব্বু কেশে উঠলেন। শুধরে দিতে বলে উঠলেন, “আব্বা, ওটা ‘হু আর ইউ’ না, ‘হাও আর ইউ’ হবে।”

নানাভাই আব্বুর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে হাতের তর্জনী আঙ্গুল তুলে বললেন, “ইউ গণ্ডমূর্খ!”

আব্বু মিটিমিটি হাসলেন এবং বললেন, “আজ্ঞে, শ্বশুরমশাই। এই গণ্ডমূর্খের হাতেই নিজের প্রাণপ্রিয় কন্যাকে তুলে দিয়েছিলেন, ভুলে গেছেন?”

নানাভাই দাঁত কিড়িমিড়ি করে বললেন, “ইচ্ছা করে করসি? আমারে ভালা মানুষ পাইয়া তো সেই খেলা খেলসিলা। কী মনে করসো? ভুইলা গেসি?”

আমার মনে পড়ে গেল কাহিনি। আব্বু আর নানাভাইয়ের দুষ্ট-মিষ্টি তর্কাতর্কির মাঝে হাসতে হাসতে প্রস্থান ঘটালাম। নানাভাইয়ের প্রিয় মেয়ে ছিল, আমার আম্মু। সেজন্য ছোটো থেকেই ভীষণ আদরে, আবডালে সকল বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখতেন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চমাধ্যমিকের কলেজটা ছিল পাশাপাশি। কীভাবে যেন আব্বু উচ্চমাধ্যমিকের পর প্রশংশাপত্র আনতে গিয়ে পাশের স্কুলের সেই মেয়েটিকে (আমার মা) দেখে পিছলে যান। আম্মু তখন সবে অষ্টমের ছাত্রী। এরপর আব্বু নানাভাইয়ের চেয়েও যত্নে আম্মুকে রাখা শুরু করলেন। লোক দিয়ে ব্রেক-টাইমে টিফিনের ব্যবস্থা, সিনিয়র আপুদের বলে রাখা– সমস্যা হচ্ছে কি না খেয়ালে রাখতে, রাস্তাঘাটে যেন কখনও কেউ আম্মুকে উত্যক্ত করার সাহস না পায়, সে ব্যবস্থাও করেছেন।
আব্বুর ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাবার তিনি পরপরই গ্রাম ছেড়ে চলে যান, রেখে যান তাঁর প্রাণনাশিনীকে, আমার আম্মুকে। ধীরে ধীরে আম্মু ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর শহরের একটা ভার্সিটিতে চান্স পেলে, ওখানেই চলে যায়, হোস্টেলে ওঠে। মেয়ে-মন অদ্ভুত, বড্ড অদ্ভুত। সেখানে একটা ছেলের সাথে আম্মুর সম্পর্ক হয়, যখন আম্মু সেকেন্ড ইয়ারে ছিল। এদিকে আব্বুর পড়াশোনা তখন শেষ, একটা জবও পেয়েছেন।
আম্মুর পেছনে যে আব্বু লোক লাগিয়েছিলেন, তার কাছ থেকে আম্মুর প্রেমজনিত বিষয় জানতে পেরেই অফিস থেকে এক সপ্তাহের লিভ নিয়ে টাঙ্গাইল চলে আসেন আব্বু। এসেই নানাভাইকে বলেন, “স্যার, আপনার কাছে কিছু চাইব।”

নানাভাই তখন আব্বুর প্রতি সামান্য দূর্বল, তার উপর নানাভাইয়ের প্রাক্তন প্রিয় ছাত্র ছিলেন আব্বু। এই সুযোগটাই হয়তো আব্বু কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিফলে গেল সেই পরিকল্পনা। নানাভাই বলে দিলেন, “আমার সাধ্যিতে না থাকলে দিবার পারতাম না।”

আব্বু তখন হেসে বললেন, “আমি শুধু চাচ্ছি, দেওয়া না দেওয়াটা আপনার ব্যাপার। আমি প্রেশারাইজড করছি না।”

নানাভাই জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কী চাও?”

আব্বু কোনো ভনিতা না করেই বলেছিলেন, “আপনার বড়ো মেয়ে, নীলুকে চাই।”

নানাভাই প্রস্তাব প্রত্যাখান করে দেন। তার মতে, তিনি রাজি ছিলেন, কিন্তু আব্বুকে সামান্য ঘাটাতে চান। নানাভাই একবাক্যে ‘না’ করে দেওয়াতে আব্বু আম্মুর প্রেমঘটিত ব্যাপারটি নানাভাইয়ের কাছে খুলে বললেন। অবশেষে জানালেন, “মেয়েকে যদি এরপর চোখের দেখা দেখতে চান, তবে বিয়ে দিয়ে দিন নয়তো আমি গুম করে দেব। পরে আমাকে পুলিশে দিলেও মেয়ের খোঁজ আপনি পাবেন না।”

অতঃপর মেয়েভীতু নানাভাই আমার আব্বুর ব্যাপারটা ভেবে মনে মনে খানিকটা প্রসন্ন হেসেই বিয়ের প্রপোজাল একসেপ্ট করে ফেলেন। প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়াটা যে শুধু হুমকির জন্য ছিল, তা নয়। মেয়ে যথেষ্ট বড়ো হয়েছে, ছেলেও ভালো; তার চেনা; তার প্রিয়। অথচ মেয়ে তার বড্ড বোকামি করে ফেলেছে, অবুঝ-সরল মেয়েটা একটা টাউট শ্রেণীর ছেলের প্রেমে পড়েছে। এরপর আম্মুকে জানানো হলে, আম্মু বিয়েতে নাকচ করে। আব্বু একপ্রকার তুলে নিয়েই বিয়েটা করেন। আব্বুর ভাষ্যমতে, আম্মু যদি ভালো কোনো ছেলের সাথে প্রেম করত, তবে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিতেন। কিন্তু আম্মু তো একটা নেশাখোর, জুয়ারি, বখাটের প্রেমে পড়েছিল। এর হাতে তো আর নিজের প্রাণ তুলে দিতে পারেন না!

এতসব কথা আমি দাদিবুবুর কাছ থেকে জেনেছি। আব্বু অনেকটা বুদ্ধি ও গায়ের সংমিশ্রিত জোর খাটিয়েই আমার আম্মুকে বিয়ে করেন। নানাভাই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন, তবে একটা শর্তও দিয়েছিলেন। শর্তটি ছিল— ‘আমার মেয়েকে রাজি করাতে হবে’। আব্বু প্রচেষ্টা করেছিলেন, আম্মু মানেননি। তাই জোরপূর্বক বিয়েটা হয়েছিল। এজন্য আজও নানাভাই ক্ষেপে আছেন।

হাঁটতে হাঁটতে বাগানের ভেতরের দিকটায় চলে এলাম। দূরের এক জাম গাছের কাছে কিছু নজরে পড়ল। এগিয়ে যেতেই চোখের ক্যানভাসে ধরা দিলো এক সুঠাম দেহের পুরুষের পৃষ্ঠদেশের অবয়ব। বাঁ পাশের বাহুটা গাছের উপর হেলে প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা এবং ডান হাতটা কানে, যার মাঝে মুঠোফোনটা আঁকড়ে রাখা আছে। পরনে শুভ্র রঙা টি-শার্ট আর গাঢ় নীল ট্রাউজার। আরও কিছুটা এগোতেই মুঠোফোনের ফাঁকফোকর দিয়ে আমার সম্মুখে কুঞ্জ ভাইয়ের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি বিশিষ্ট গালের আংশিক নজরে এলো। সূর্যের কিরণ পিঠে পড়েছে ওঁর। পকেটে পুরে নেওয়া হাতটা উঠিয়ে মাথার পেছনের চুলগুলো আলতো হাতে চুলকে নিলেন। এত গম্ভীর ও থমথমে মুখে কার সাথে কথা বলছেন, বুঝতে পারলাম না।

কিছুটা এগোতেই কানে এলো ওঁর কথাবার্তার কিছু অংশ। ভয় পেয়ে গেলাম। এভাবে কাকে শাসাচ্ছেন?

আবারও ফোনের ওপাশের ব্যাক্তিকে বললেন, “তোদের দিয়ে কিছুই হচ্ছে না। আমি না থাকলেই কেন এরকম হয়? ঘাস খাচ্ছিস তোরা? হ্যাঁ? ঘাস খাচ্ছিস? আই সোয়্যার অরুণ, তোদের সবকটাকে আমি পুঁতে ফেলব!”

ভয়ে শুকনো ঢোক গিললাম। তাঁর এমন চওড়া মেজাজ, কণ্ঠের দৃঢ়তা আমায় ভীত করছে। এগিয়ে যাব না কি পালাব, বুঝে উঠতে পারলাম না, এর আগেই কুঞ্জ ভাই সামান্য ডানে মুড়তেই আড়চোখে আমার উপস্থিতি লক্ষ করলেন। তবে তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অরুণ নামের ওই লোকটিকে পুনরায় বললেন, “আই’ল কল ইউ ব্যাক, লেটা(র)। জাস্ট হ্যান্ডেল ইট, আনটিল আই কাম।”

কুঞ্জ ভাই পুরোপুরি মুড়লেন না। কল রেখে সেভাবেই দু’হাত পকেটে পুড়ে জামগাছটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সামান্য কিছু সময় অতিবাহিত হতেই আমার কর্ণে ভেসে এলো প্রিয় পুরুষের গম্ভীর-ভরাট স্বর, “অন্যের পার্সোনাল কনভার্সেশন শোনা উচিত নয়, উইদাউট পার্মিশন তো একদমই নয়।”

হুট করে বলা এমন কথার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এভাবে যে বলবেন, তাও বুঝতে পারিনি। কথাটা আমার সামান্য খারাপও লেগেছে। তবুও ব্যক্ত করলাম না আমার মন খারাপের রেশটা। মিনমিনে কণ্ঠে কেবল বলে গেলাম, “স্যরি। আমি ইনটেনশ্যনালি কথাগুলো শুনিনি। আসলে, মানে, আব্…”

“নো এক্সকিউজ, প্লিজ!”

আমি চুপ মেরে গেলাম। অবাধ্য মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল। এভাবে বলার কী আছে? এদিক-সেদিক চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে আসা অশ্রুকণা আলগোছে শুষে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম, সফল অবশ্য হলামও। তবে এখানে থাকার সকল প্রকার আগ্রহ-অনাগ্রহ যা আমার ছোট্ট হৃদয়টিতে বসত গেড়েছিল, তা ঝেড়ে ফেলে প্রস্থান করার জন্য পা বাড়ালাম।

তখনই কুঞ্জ ভাই পিছু মুড়লেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই নজরে বহ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে আমার হৃদয়জনিত সকল সমস্যা। এই সমস্যাগুলোর ভস্মরূপ কি আমার-ওঁর জন্য ঠিক? হয়তো না।

চলবে…

[ভীষণ ব্যস্ততায় সময় পার করছি। দুঃখিত আমার এমন অনিয়মিত হবার জন্য। আগামী পর্ব শনিবার দেব। এত দেরি করার পরও পাশে থাকার জন্য ভালোবাসা❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here