কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ১৯|

0
147

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ১৯|

“ওই! অসহায়ের মতো মুখ লেটকিয়ে বসে আছিস কেন রে? রেডি হ। বি ফাস্ট, নবু।”

আপির কথায় আমি চোখ তুলে দর্পণের দিকে নজরবদ্ধ করলাম। আপি নাকের নথ ঠিক করতে করতে উক্ত বাক্যটি বলেছে। তার গায়ে সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়ি। পাশে রাহী আর সুপ্তিও আছে, তাদের পরনেও একই শাড়ি। নীতি আর খালামণি দিদির সাথে পার্লারে গেছে। তারা ওখান থেকেই সেজে আসবে। কেবল দিদির শাড়িটা গোলাপি পাড়ের হলুদ কাতান। বাকিদের একরকম দেখতে শাড়ি। সবার সাজও একই রকম।
আমি চোখ দুটো ভরে আপিকে দেখতে লাগলাম। কী সুন্দর লাগছে আমার আপিকে! ইশ! পুরোই চোখ ধাঁধানো। আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে আপি চোখজোড়া সামান্য কুঁচকে ফেলল, পরপরই একই অবস্থায় হেসে দিয়ে রাহীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এর কী হলো, দ্যাখ রে, রাহু! তৈরি হয়ে নিতে বল তো!”

রাহী আপিকে বলল, “আমার মনে হয় কী রজনীপু, জানো? এর ঘুম পাচ্ছে।”

আপি বোধহয় রাহীর কথাটা মেনে নিল। তাই তো বলল, “এ্যাই, নবু! ভুলেও না। ঘুমাবি না একদম। বেড সাইড টেবিলের উপর দ্যাখ একটা ব্যাগ আছে। ওখানে তোর শাড়ি আর অর্নামেন্টস সব রাখা আছে। জলদি রেডি হ।”

আপি আমাকে আরও কিছু কথা বলতে বলতেই আম্মুর ডাক এলো। আপি চলে গেল। এদিকে রাহী আর সুপ্তিরও হয়ে গেছে। ওরা ছবি তুলতে বাগানে চলে গেল। আমি উঠে ব্যাগটা থেকে আমার শাড়ি বের করলাম। সেদিন মলে সবাই সেইম শাড়ি কিনলেও, আমার চোখ গিয়ে আটকায় সেই কাঁচা হলুদ রঙের জামদানি শাড়ির উপর। কিনেও নিলাম এটা। মুচকি হেসে শাড়িটা পরে নিলাম, অবশ্যই আটপৌরে করে, কনুই অবধি স্লিভের লাল ব্লাউজের সাথে। মাঝসিঁথি করে খোপা করা চুলের এক পাশে গুঁজে নিলাম তিনটা লালগোলাপ, একটু আগেই দিয়াকে দিয়ে বাগান থেকে ফুলগুলো আনিয়েছি।

ঠোঁটে লাল টকটকা লিপস্টিক, চোখ ভর্তি কাজল, মুখে মেকআপের সামান্য কারুকার্য, কানের দু’পাশ থেকে আলগোছে নেচে বেড়ানো ক’গাছি চুল, পায়ে নূপুর, হাতে মোটা বালা, কানে ভারি কানপাশা, গলায় সরু চিক, খোপায় বড়ো কাঁটা, কপালে লাল টিপ আর নাকে একটা টানা নথ। নিজেকে আয়নায় দেখে চোখ ফেরাতে পারছি না। ইশ, নবু! ইশ! আজকে তো তোর কুঞ্জ ভাই শ্যাষ। এক্কেবারে তালব্য শ, এ-কার— শেষ! সেদিন কুঞ্জ ভাইয়ের ওমন কাজ আমি মোটেও ভুলিনি। এর শাস্তি তো পাবেনই উনি।

___________
সময়টা দ্বিপ্রহর। উঠোনের একদম মাঝখানেতে বসে আছে দিদি। সবাই আলতো হাতে হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে। আর “কাল সাজবে বধু” আজ লাজে রাঙা হচ্ছে। গোলাপি পাড়ের হলুদ শাড়ির সাথে ম্যাচিং আর্টিফিশিয়াল ফ্লাউয়ারের অর্নামেন্টসে দিদিকে চমৎকার লাগছে। ভেবেই মুচকি হেসে রাহীকে খুঁজতে বাড়ির পেছনের দিকে যেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম কুঞ্জ ভাইয়ের কথা। সেই যে সকালে ওভাবে রাগ দেখালেন, এরপর তো আর দেখাই দিলেন না! এভাবে কীভাবে একটা মানুষ বাচ্চা মেয়েকে রাগ দেখায়? দয়া-মায়া হয় না?

ফোনের মৃদু কলিং ট্যুনে সচকিত হয়ে ফোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। স্ক্রিনে ভেসে আসছে একটি নাম— মেহেদী ভাই!

রিসিভ করেই বিশাল বড়ো একখান সালাম দিলাম মেহেদী ভাইকে। সে সালামের জবাব দিয়ে আমাকে শুধাল, “ওপাশের খবর কী, ছোটো বউ?”

আমি ব্যাপারটা ধরে ফেলে বললাম, “উহুম! উহুম! ওপাশের না কি কেবল দিদির?”

সে সামান্য হেসে বলল, “দিদিরটাই বলো।”

“ভালো গো, ভীষণ ভালো। তবে আজ প্রচুর লজ্জা পাচ্ছে তোমার বউটা।”

“ইশ রে! এখন তো দেখতে ইচ্ছে করছে।”

“অবুঝ হয়ো না, দেখার জন্যই তো কল দিয়েছ। কী ভেবেছ, বুঝি না কিছুই?”

“হুম, হুম। বুঝদার মেয়ে! এখন আমার বউটার দর্শন দাও তো!”

আমি খিলখিল করে হেসে বললাম, “ভিডিয়ো কল দিচ্ছি।”

কল কেটে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিয়ো কল দিলাম। মেহেদী ভাই আমাকে দেখেই বলল, “বাহ! এত সাজ! আজ তো তোমার জন্য হাজব্যান্ড মহাশয় খোঁজার এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব না নিলে চলেই না।”

“এহ, নাহ! আমার বর রেডি আছে, খুঁজতে হবে না। তুমি তোমার বউকে দ্যাখো।”

“দেখাও। চোখ দুটো তোমার দিদিকে দেখার জন্য চকচক করছে রে, ভাই।”

আমি হেসে ব্যাক ক্যামেরায় দিদিকে দেখালাম। দিদি আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বলল, “কী?”

আমি জোরেশোরেই বললাম, “ছবি তুলছি গো। একটু হাসো-না!”

দিদির লাজ ভাবটা কমে এলো এলো করেও কমল না। চটজলদি লাজের মিথ্যে ভান করে পোজ দিতে লাগল। এপাশে মেহেদী ভাই মুগ্ধ নয়নে নিজের হবু বউকে দেখতে লাগল। যেন, এ দেখার শেষ নেই। হঠাৎ টুটটুট শব্দ করে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। ফোনটাও আজ বেঈমানী করল! দিদির দিকে মেকি হাসি ছুড়ে দিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম, এখনই চার্জার কানেক্ট করতে হবে। দু’পা এগোতেই দৃষ্টি গেল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় পুরুষটির নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে থাকা নেত্রপানে। পরনে হলুদ কুর্তা, সাদা পাজামা, হাতা কনুই অবধি ফোল্ড করা, বাঁ হাতে ব্ল্যাক ওয়াচ আর অনিমেষ নেত্রপানে ছেয়ে আছে এক অন্তরীক্ষ সমান মুগ্ধতা। এক দৃষ্টিতে এটুকু দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি তাকাক আমার দিকে, তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ গলে যাক; আমার কী? সকালে যখন ওমন ব্যবহার করলেন, তখন মনে ছিল না? মনে ছিল না যে, আমিহীনা তাঁর গন্তব্য নেই। অদৃশ্য ভেঙচি কেটে আমি আবারও পা বাড়ালাম। ওমনিই পেছন থেকে মেজো মায়ের ডাক শোনা গেল, “নবনী!”

আমি পেছন ফিরে বললাম, “জি, মেজো মা! বলো।”

“কই যাইতেছ?”

“এই তো, এখানেই।”

“একটু কাজ কইরা দেও তো, মা।”

“হ্যাঁ, করছি। বলো।”

“আমাদের রান্নাঘরে দ্যাখো, পানের ডালা আছে। আইনা দেও একটু কষ্ট কইরা।”

আমি পা বাড়ালাম সেদিকেই। রান্নাঘরে যেতেই পেছন পেছন আরও একজোড়া পা সেখানে প্রবেশ করল। ম্যানলি স্মেলটার জন্য বুঝতে বেগ পোহাতে হয়নি, এটা কে। তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালামা না। ডালা হাতে তুলতে তুলতে একবার উনার দিকে তাকালাম। তাঁর চাহনি আমি ভীষণ ইনজয় করছি। বহুত রাগ ঝেড়েছ, বাছা! আজ আর নবু তোমার কাছ ঘেঁষবে না। সো, বসে বসে মুড়ি খাও।

কুঞ্জ ভাই হয়তো কিছু বলার জন্য হাঁসফাঁস করছেন, কিন্তু বলতে তো পারছেন না। আমিও পানডালা নিয়ে সরে যেতে উদ্যত হলাম। উনি কিছু একটা ভাবছেন, খেয়াল করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার রাস্তা আটকালেন। আমি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বা পাশের খোলা অংশ দিয়ে বেরোতে লাগলাম। উনি এতেও সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি আবারও ডানে এলাম। এবারও একই কাজ করতেই আমি আমার তীক্ষ্ণ চাহনি ওঁর অক্ষিপটে বদ্ধ করলাম। সেখানে আছে তীব্রাকাঙ্ক্ষা!

কঠোর কণ্ঠে বললাম, “যেতে দিন।”

ওপাশ থেকে এবার প্রিয় পুরুষটির অপরিচিত, অচেনা, অন্যরকম এক আওয়াজ এলো, যা এর আগে কখনোই শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছয়নি, “ধরে রেখেছি কি?”

বড্ড শীতল, মোহাচ্ছন্ন সেই আওয়াজে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হলাম। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললাম, “উঁহু, পথ আটকেছেন।”

“উঁহু, মন আটকেছি।”

“মন?”

“হু। তোমার মন।”

“কীভাবে?”

“মনের সাথে মনের সন্ধি ঘটিয়ে। আর…”

“আর?”

“বোঝো না?”

“না।”

“অবুঝ তুমি?”

“খানিকটা।”

“তবে তো বোঝাতেই হয়।”

“কী বোঝাবেন?”

“প্রে-ম…”

“ছি! ছি!”

কুঞ্জ ভাই তার ঘোর লাগানো দৃষ্টি সরিয়ে এবার বেশ শব্দ করেই হাসলেন। হয়তো তাঁর ঘোর লাগানো সেই দৃষ্টি আমার মাঝে কনভার্ট হলো। আমাকে তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুঞ্জ ভাইয়ের হাসি থেমে গেল। দু’কদম এগিয়ে এসে বললেন, “কী দেখছ?”

আমার সহজসরল স্বীকারোক্তি, “আপনাকে।”

“দেখে?”

“প্রেম বুনছি।”

“আর, কত?”

“এই তো, সামান্য!”

“বুনন শেষ কবে হবে?”

আমি এবার আরও এক কদম এগিয়ে ওঁর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললাম, “যবে সে প্রেম-নিবেদন করবে।”

“বিনিময়ে কী পাবে?”

“বিনিময়ে আমি তাঁকে এত যত্নে বোনা এই প্রেম দেব।”

উনি আর কিছু বললেন না। আড়চোখে দেখলাম, উনি মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসছেন। আমি প্রস্থান ঘটাতে চাইলাম, তখনই কানে মাতাল করা সেই ঘন স্বরটা এলো, “তবে তা-ই হোক…”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here