#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২০|
বড়ো মামার বাড়ির ছাদে মেহেদীর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেখানে ধুমসে চলছে আড্ডার আসর। হলুদের পোশাক বিকেলের দিকে পরিবর্তন করে সবাই খানিকক্ষণ জিড়িয়ে নিয়ে নয়া রূপে, পুরোদস্তর নয়া সাজে সজ্জিত হয়েছি। দিদি একটা সুতির শাড়ি পরে আছে, আর বাকি মেয়েরা, আমরা কুর্তা-সালোয়ার পরে আছি।
আমাদের কাজিনদের মাঝে দিদি সবচেয়ে ভালো মেহেদী দেয়। প্রতিবার গ্রামে এসে আমরা সবাই ওর কাছ থেকে মেহেদী দেবার জন্য রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠি। কিন্তু এবার! নিজের বিয়ের মেহেদী নিজের দু’হাতে কী করে দেবে?
তাই আমিই দিচ্ছি। মোটামুটি ভালোই পারি, মেহেদীর নকশা বুনতে। আর কিছু পারি বা না পারি, এসবের প্রতি আগ্রহ থাকে বিধায় বেশ পারি!
ঘণ্টা দুয়েক ধরে দিদির দু’হাতে মেহেদী দিয়ে দিতে লাগলাম। আপি বাকিদের দিয়ে দিচ্ছে। মেহেদী দেবার এক পর্যায়ে রজনী আপিকে উদ্দেশ্য করে আসিফ ভাই প্রশ্ন ছুড়ল, “তুমি মেহেদীও দিতে পারো, রজনী?”
আপি মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে এক দল ছেলেদের মাঝে এক কিনারায় বসে থাকা আসিফ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “না পারলে ভালো হতো বুঝি?”
আসিফ ভাই তড়িৎ গতিতে বলে উঠল, “না-না! তা নয়! আসলে তুমি ঝগড়া বাদে যে এসবও পারো, তার ধারণা আমার ছিল না তো!”
আপি এবার পুরোপুরি পিছু মুড়ল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল, “আসিফ! তুমি এখন আমার সাথে কথা বলবে না একদম। নয়তো এটা মেহেদী-আড্ডা থেকে খুনখারাবি হয়ে যাবে, বলে দিলাম!”
আসিফ ভাই দু’ঠোঁটের অগ্র ভাগে তর্জনী আঙ্গুল ঠেকিয়ে দু’কাঁধ নেড়ে বলল, “অ্যাজ ইওয়োর উইশ, মহারানি!”
পরক্ষণেই সকলে দমফেটে হাসতে লাগলাম। আপি মুখ ভেঙিয়ে আবারও নীতিকে মেহেদী লাগাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠল। আমি দিদিকে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছি আর ফাঁকে ফাঁকে এসবের দিকে নিজের সুক্ষ্ম নজরটি এলিয়ে রাখছি। বড়োরা কেউ এখানে আসেনি। তবে আসবে। কিছুটা সময় বাদে খালামণি আসবে। তাঁকে দু’হাতে, দু’পায়ে ভরে ভরে মেহেদী লাগিয়ে দিতে হবে। পাঁচ ভাই-বোনের মাঝে সবচেয়ে ছোটো হওয়ায় কৈশোর থেকেই ভীষণ শৌখিন সে; এ-বয়সে এসেও যার বিন্দুমাত্র কমেনি। আমি আবারও মেহেদী থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এদিক-ওদিক তাকালাম। কুঞ্জ ভাই কোথায়?
সেই-যে! সেএএইই যে দেখা হলো! এরপর থেকে কই গুম হলেন? রান্নাঘর থেকে তখন তড়িঘড়ি করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিছুটা লজ্জা, বাকিটা তাঁর মতিগতি বুঝে ফেলার সঙ্কোচে। কিন্তু, আমি কি বলেছি, দূরে যান? বলেছি কি? এখন আমার বদলে, ওই ডায়ারির মেয়েটা হলে কি এমন করতেন? হুহ!
চরম মেজাজ নিয়ে এসব ভেবে ভেবে মেহেদীর নকশা তৈরি করতে লাগলাম, তখনই দিদি হঠাৎ করে আমাকে থামতে বলার পর বলল, “বিয়ে বিয়ে ফিল আসছে না, গাই’স!”
পাশ থেকে আপি বলে ওঠল, “এখন তোমার বিয়ে বিয়ে ফিল পাওয়ানোর জন্য কি নাচতে হবে আমাদের?”
নীতি বলে ওঠল, “আমিই নাচতাম… কিন্তু হাতে মেহেদী নিয়ে এখন নাচলে মেহেদী ছড়িয়ে যাবে। আচ্ছা। তোমরা এখন এত ইনসিস্ট করছ, না নেচে পারা যায়?”
দিদি তখন বলল, “এএএ! তুই বাদ। তোর নাচা বাদ।”
নীতি ঠোঁট উলটিয়ে বলল, “কেন? কেন? আমি নাচলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, হ্যাঁ?”
“টিকটকারদের পারফরম্যান্স আমার বিয়েতে এলাউ না।”
নীতি ঠোঁট উলটিয়ে তাকাল। আমি হেসে দিয়ে বললাম, “দিদি, একমাস ওর টিকটক বানানো আর দেখা বন্ধ, ভুলে গেছ?”
দিদি ভেবে নিয়েই বলল, “ওহ্, হ্যাঁ! এখন তো তুই সিভিলিয়ান! ওকে! নাচিস।”
নীতি মুখ ফিরিয়ে বলল, “হুহ! জুতো মেরে গোরু দান! আমার বয়েই গেছে নাচতে!”
আপি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “তবে, দুলাভাইকে বলি, এসে নেচে তার বউ-এর মনরঞ্জন করে যেতে!”
আকাশ ভাই সিটি বাজিয়ে বললেন, “সে-ই ভালো হয়, আপি, দিদি, ভাইগন্স অ্যান্ড বইন্স! কী বলো?”
দিদি মেহেদীতে বোনা হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভান করে বলল, “নাহ! সে তো বিয়ের পর প্রতিদিনই নাচাব!”
কিছুক্ষণ দিদির দিকে তাকিয়ে থেকে ফিক করে হেসে উঠলাম আমি। আমার হাসি সকলের মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ধীরে ধীরে সেই হাসি অট্টহাসিতে পরিণত হতে মোটেও সময় নিল না। এরই মাঝে আকাশ ভাই দ্রুত পা চালিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের ঘর থেকে ওঁর গিটারটা এনে ফেললেন। অভ্যস্ত আঙুলগুলো দ্বারা টুং-টুং শব্দে মাতিয়ে তুললেন পরিবেশ, সাথে আপি আর আসিফ ভাই গান জুড়ে দিল…
প্রেমে হাসিয়া ভাসিয়া উতলা হাওয়ায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
মেঘে উড়িয়া ঘুড়িয়া ভিজিয়া ছলায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
পরানে শয়নে নয়নে নয়নে,
তুমি শুধু মনে।
প্রেমে হাসিয়া ভাসিয়া উতলা হাওয়ায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
মেঘে উড়িয়া ঘুড়িয়া ভিজিয়া ছলায়,
চল নিরালায়! চল নিরালায়!
গ্রীষ্মের তপ্ত রাতে মাঝে-সাঝে বয়ে চলা শীতল হাওয়ার সাথে কাজিনদের মহা আলাপন চলছে খুবই চমৎকার ভাবে। বাগানের হাসনাহেনা ফুলের সুবাস নিঃশ্বাসের সাথে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ে তৈরি করল এক তুমুল নেশা, শান্তি। ভুলিয়ে দিলো দিন-দুনিয়ার পাওয়া না-পাওয়া সকল চাওয়া। একটাই তো জীবন! কেবল উপভোগ করো এই জীবনটিকে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে। শুধু পাওয়া নিয়ে নয়, না-পাওয়া সকল অনুভূতিকে, জাস্ট ইনজয় ইট-না?
বাতাসের তেজে মাথা থেকে ওড়না সরে গেল। কপালের সামনের চুলগুলো এলোমেলো হতে লাগল। দিদির হাতে মেহেদী লাগানো প্রায় শেষ। আমি বাঁ হাত দিয়ে উড়তে থাকা অবাধ্য চুলগুলো অতি সন্তর্পণে কানের পিঠে গুঁজতে গুঁজতে বামে তাকালাম। ঠিক ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হলুদের সেই একই পোশাক পরিহিত কুঞ্জ ভাই। চেহারায় সারাদিনের ক্লান্তি লেপ্টে আছে, এর সাথে অনিমেষনেত্রে ছেয়ে আছে অদ্ভুত সেই দৃষ্টি, যা আমাকে হুটহাট কাঁপিয়ে তোলে। এই যে– যেমনটি এখন হচ্ছে। তাঁর সেই চোখে আমার চোখ পড়তেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল; এ-কি আমার ইচ্ছাকৃত? মোটেও না। গালে সদ্য ফুটে ওঠা রক্তিম আভা বহু চেষ্টায়ও আটকাতে পারলাম না। লূকোনোর জন্য মাথা নিচু করে ফেললাম। মুখ ফসকে বেরিয়ে আসা লাজুক হাসিটা কি ওঁর চোখে পড়েছে?
মিনিট খানেক অতিক্রম হতেই মনের অভ্যন্তরীণ লাজুক রসায়ন সব সাইডে সরিয়ে আবারও বামে তাকালাম সেই ভয়ঙ্কর নজরে দৃষ্টিবদ্ধ করতে, খুবই সন্তর্পণে, খুবই শান্তভাবে, সাথে খানিকটা সংকচ নিয়েই।
ভয় কেবল ভীতিকরই নয়, ভয় সুন্দরও হয়; ভয়ঙ্কর সুন্দর হয়। আর উনি আমার কাছে ভয়ঙ্কর সুন্দর এক পুরুষ। যার গাঢ় বাদামি চোখের নির্লজ্জ, সুদৃঢ়, আত্মপ্রত্যয়ী দৃষ্টি আমায় বড্ড টানে। ইশ! চোখে চোখ মেললেই আমি লাজবতী লজ্জায় ছেয়ে যাই, স্থান-সময় ব্যয় না করেই দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য হই। কিন্তু এমন লজ্জা তো বারেবারেই পেতে ইচ্ছে হয়, খুব করেই!
সেই হিসেবে আবারও চোখ চলে গেল ঠিক সে-জায়গাটায়, যেখানটায় কুঞ্জ ভাইয়ের ক্লান্ত শরীরটা দেয়ালের ভরে দাঁড়িয়ে ছিল; চোখে ছিল তীব্রাকাঙ্ক্ষা; আমার জন্য কি? কিন্তু এবার আর লাজ ধরা দিলো না আমার দু’চোখের পাতায়, বরং চোখদুটো নিমিষেই তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠল। ছাদের দরজার এপাশ-ওপাশটায় চোখ বুলালাম।
হুট করে যেভাবে এলেন, সেভাবেই যেন আবারও হারিয়ে গেলেন; মাঝে যে ওঁকে দেখে কেউ চক্ষু তৃষ্ণা মেটানোর জন্য মরিয়া হয়ে আছে, তার খেয়াল কি রেখেছেন?
খুব নিকটে চেয়ার টানার শব্দ পেতেই আমি সেদিকে চোখ ফেরানোর জন্য মনোনিবেশ করলাম। তার আগেই কর্ণে ভেসে এলো খুব চেনা, খুউব প্রিয় সেই ঘন স্বর, “শ্যামা আপু! তোমার বিয়েটা আরও ক’বছর পরে করা উচিত ছিল, বুঝলে?”
পাশ ফিরে দেখলাম, আমার ঠিক পাশটায় চেয়ার টেনে বসে আছেন কুঞ্জ ভাই। উফফ! তার মানে হারিয়ে যাননি! দিদি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “মাথায় কী ঘুরছে রে? বলে ফেল তো!”
উনি ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। হাসি থামিয়েই বললেন, “বাড়ির মুরুব্বিরা সবাই পারে না আজই আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। কীভাবে যে ফিরলাম ওখান থেকে! উফফ! ছাড়ছিলই না!”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দিদি মুখে হাত রেখে হেসে উঠল। রজনী আপি বলল, “আগে বলবে না, ভাইয়া? আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। আম্মু আছে না ওখানে? আম্মুর সামনে জাস্ট একবার তারা মনে করিয়ে দিক, মেয়ে বড়ো হয়েছে! বাকিটা আ’ল ম্যানেজ।”
আসিফ ভাই চোখ পাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। এরপর তোমার আম্মু তোমাকে অন্য বাড়িতে দিয়ে আসুক, আর এদিকে আমি তাকিয়ে তাকিয়ে মুড়ি খাই। তাই-না?”
আপি ভেঙচি দিয়ে বলল, “ব্যাপার নাহ। সবার পছন্দমতো বিয়ে করব। কাউকে হতাশ করব না। আমি ভীষণ বড়ো মনের মানুষ কি না!”
এরই মাঝে দিদি কুঞ্জ ভাইয়ের বাহুতে হালকা থাপড় দিয়ে বলল, “তুই বললে আজই দিয়ে দিই?”
কুঞ্জ ভাই তৎক্ষনাৎ আমার দিকে তাকালেন। চোখে চোখ মেলল, সময় থমকে গেল। ঠিক কতটা সময় এই নয়নে নয়নে সাক্ষাৎকার চলল, হিসেব করিনি। তবে আগে উনিই চোখ ফেরালেন। মাথা সামান্য নিচু করলেন, সেকেন্ড তিনেক পরপরই আবারও আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা আগে করা দিদির প্রশ্নটির উত্তর হিসেবে মাতালকরা সেই আওয়াজটা মেলে বললেন, “বউটা বাচ্চা। আমার রাগ বোঝে, অভিমান বোঝে না। আমার শাসন বোঝে, কিন্তু সেটা যে তাকে আগলে রাখার কারণমাত্র; তা বোঝে না। ও প্রেমিকা ম্যাটারিয়াল, দাম্পত্য জীবনের কী বুঝবে? সেই তো, দু’দিন যেতেই বিচ্ছেদের বাহানা খুঁজে নেবে, বুঝলে? তার চেয়ে ভালো, ও বড়ো হোক, আর একটু ম্যাচ্যিউরড হোক! ও প্রেমে পড়ার মতোই মেয়ে। অনেকটা অবুঝ, অভিমানী, প্রেমময়ী! অথচ বউদের তো অনেক দায়িত্ব; সংসার না বুঝলেও, স্বামীকে একটু বুঝুক। এইটুকু বড়ো অন্তত হোক। এরপর না হয়…”
মুহূর্তেই সবাই হৈচৈ করে উঠল। কেবল, কেবল মাত্র আমিই অবুঝ পানে তাকিয়ে রইলাম। ওঁর কথাটা আমার বোধগম্য হলো না। বউ কে? বাই এনি চান্স, উনি সেই ডায়েরিওয়ালির কথা বলছেন না তো? এটা ভাবতেই আমার রাগ হলো। আমার সামনেই আমার ‘না হওয়া সতীন’-কে নিয়ে কীভাবে বলছে এসব? মানে? লজ্জা-শরম সব গুলে খেয়েছে নাকি?
চোখের সামনে উড়ে বেড়ানো চুলগুলো এবার একটু বেশিই বিরক্ত করছে। বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে হাত উঠিয়ে চুল ঠিক করার পূর্বেই এক দমকা হাওয়া আমার মুখশ্রীতে এসে লাগল, বড্ড আদুরে ভাবে। চোখ দুটো বুজে এলো প্রশান্তিতে। হাওয়ার উৎস বোঝার জন্য চোখ খুলতেই সম্মুখে কুঞ্জ ভাইকে অদ্ভুত নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুকটা ধুক করে উঠল। তড়িঘড়ি করে এদিক-ওদিল চাইলাম। নাহ! কেউ দেখেনি।
চলবে…