#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ১৪+১৫|
সে রাতে আর আমার ঘুম হলো না। ওভাবেই জেগে জেগে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। জাগ্রত আমিটার বন্ধ দু’চোখের পাতায় তখন ছিল প্রিয় মানুষটাকে নিয়ে অজস্র স্বপ্ন। তাঁর ভালো লাগা, না লাগা, অভ্যেস, চলন, সবগুলো ভাবতে লাগলাম। ভেবে ভেবে নিজেকে হুট করেই পরিবর্তনের চিন্তা মাথায় এনে ফেললাম। উনি নিশ্চয়ই একটা ম্যাচিউরড মেয়ে চান। আমায় কি পছন্দ করবেন?
ছোটো থেকেই রাজধানীতে বড়ো হওয়া সত্ত্বেও আমি ছিলাম ভীষণ বোকা-সোকা একটা মেয়ে, সাধারণ ভাবে থাকতেই যেন বেশি ভালোবাসতাম, কথা-বার্তায় কখনও চঞ্চলতা ছিল না। সামান্য যা হয়েছি, সবটাই ওই একটা মানুষের সামনেই।
পুরুষেরা নারী-জাতির রহস্যময়ী চাহনিতে আটকে যায়, ফেঁসে যায় সেই নারীর চাল-চলনে, মুগ্ধ হয় তার প্রতিটি কার্যকলাপে। তারপর! তারপর ভালোবাসার মায়ায় বন্দী হয়ে যায়। এগুলোর একটাও কি কুঞ্জ ভাই আমার মধ্যে পেয়েছেন? নাহ্! হয়তো পাননি। পাবেনই বা কী করে? আমি তো প্রদর্শনই করিনি।
আমার চাহনি অত্যধিক সরল। আমার চোখে কেউ কোনো রহস্যের জাল পাবে না, পাবে শুধু চিকচিক করতে থাকা মুক্তোর দানার ন্যায় অশ্রু। আমার চাল-চলন মোটেও আকর্ষণীয় না। আমি নিজেকে আকর্ষণীয় দেখাতে চাইনি কোনোদিনই। আমার কর্যাকলাপও মুগ্ধ হবার মতো নয়। কুঞ্জ ভাই তো রীতিমতো এসবে বিরক্ত হন। আমাকে গাঁধি বলেন, পাগল বলেন। কখনও তো আদুরে কোনো নামে সম্বোধন করেননি, কখনও ভালোবেসে একটা ফুল দেননি, কখনও বিমুগ্ধ চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেননি।
আর, আমি সেই পুরুষেই আটকে আছি; যার আমার প্রতি বিন্দু মাত্র ঝোঁক নেই।
সে রাতটা এসব ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল। সকাল হবার পরপরই বাসায় আবারও কুঞ্জ ভাই চলে এসেছিলেন। সেই দিনটা আমার সাথেই ছিলেন। দু’জনের মাঝে তেমন কোনো কথা হয়নি। তবুও যেন পুরোটা দিনই আমরা একে-অপরের সাথে বকবক করে গেছি, অত্যন্ত চুপিসারে, মনে মনে।
এভাবেই কেটে গেল আরও একটা সপ্তাহ। কুঞ্জ ভাই মাঝে মাঝেই কল দেন, কথা হয়। হুট করেই কলেজ শেষে দেখি, কুঞ্জ ভাই কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মাঝে মাঝেই কোচিং থেকে আমাকে নিয়ে শহরের রাস্তায় ঘুরতে বেড়িয়েছেন। এগুলো আমাকে কতটা খুশি করে দেয়, বোঝাতে পারব না।
এসব ভাবতে ভাবতেই নীতি চিৎকার দিয়ে ডাকল আমাকে, “বুবুউউউ!”
আমি ভড়কে উঠে বললাম, “কী?”
“তুমি কোন খেয়ালে ডুবে আছ?”
“কেন, কী হয়েছে?”
“ডাকছি যে!”
“ওহ্! শুনিনি।”
“শুনবে কী করে!”
তখনই বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে আধশোয়া হয়ে বসে থাকা রজনী আপি বলে উঠল, “প্রেম-টেম করে তো মাইয়া উল্টিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে খবর থাকবে কী করে?”
আমি আপির দিকে ছোটো ছোটো চোখে তাকিয়ে বললাম, “তা এখন বলবে না, আমার বর রেডি আছে, প্রেম-টেম চলবে না?”
আপি হাই তুলতে তুলতে বলল, “তোর বরের পারমিশন আছে। তাই নিষেধ করলাম না।”
আমি হতাশ শ্বাস ফেললাম। তখনই আমার ফোনে একটা অচেনা নম্বর থেকে কল এলো। শব্দে ইতোমধ্যে নীতি, আপি আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। তাদের চোখ প্রশ্ন করছে আমায়, ‘কে কল দিল?’
আমি উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো, “কেমন আছ, মিস. শালিকা?”
আমি চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে ফেললাম, যখনই আওয়াজদাতাকে চিনতে পারলাম। আমাকে ‘শালিকা’ বলে সম্বোধন করেন দু’জন পুরুষ। আসিফ ভাইয়া আর…
আমি বুঝতে পেরেই খানিকটা উচু স্বরেই বললাম, “মেহেদী ভাই?”
“ইয়াপ! ছোটো বউ!”
“ভীষণ ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?”
উত্তরে কেবল হাসল। তার সেই হাসিই তার মন ভালোর সীমানাটা বুঝিয়ে দিল। আমি ভ্রু- কুঁচকে বললাম, “দিদিকে গোপনে বিয়ে করে ফেলোনি তো? এত খুশি কেন?”
মেহেদী ভাই আবারও হেসে বলল, “করিনি গো। তোমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিলে পরে আমার বউকে কিডন্যাপ করে নিয়ে বলবে— ‘এই বিয়ে মানি না। বোন দেব না তোমার কাছে’। তাই করিনি।”
“ঠিক ধরেছ।”
“হ্যাঁ, এজন্য আগেই তোমাকে জানিয়ে নিলাম।”
“মানে?”
“বিয়ের ডেইট ফিক্সড করে ফেলেছে বড়োরা।”
এবার আগের বারের চেয়েও জোরে চিৎকার করে উঠলাম, “মানে!”
“মানে সামনের মাসের ৫ তারিখে তোমার দিদিকে নিয়ে চলে যাব আমার রাজত্বে। তোমরা পরশুদিন আসছ সবাই। ফুপাদের সাথে কথা হয়েছে।”
আমি কিছুক্ষণ কিংকর্ত্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। অবাকের সাথে সাথে কিছু বিস্ময়ও আমাকে জেঁকে ধরল। ব্যাপারটা আমাকে আরও বুঝিয়ে বলল মেহেদী ভাই। দু’সপ্তাহ আগেই বিয়ের প্রপোজাল পাঠিয়েছে। এতদিন দেখা-শোনা, কথা-বার্তা চলছিল। কাল রাতেই ফাইনাল হলো। সবাই জানে এটা, কেবল আমি বাদে। এই ব্যাপারে খানিকটা উদাসও হয়ে গেলাম।
মেজো মামার দু’টো মেয়ে। বড়ো মেয়ের নাম শ্যামা। মামি শ্যামাপাখির সাথে মিলিয়েই এই নাম রেখেছিল। আর আমরা ছোটোরা সবাই তাকে দিদি বলে ডাকি। অনেকে অবশ্য অনেক কিছুই ভাবে এতে! তো ভাবুক। দিদির সাথে বিগত ছ’বছর যাবত মেহেদী ভাইয়ার একটা প্রেমের সম্পর্ক আছে। আর সেই সম্পর্কটা এভাবে হুট করেই বিয়ে অবধি গড়িয়ে যাবে, সেটা জেনে ভীষণ বেশিই অবাক হয়েছি। আরও কিছুক্ষণ মেহেদী ভাইয়ের সাথে কথা বলে কল রেখে দিলাম। আজ ২৫ তারিখ। তারমানে দেড়-সপ্তাহ বাদেই বিয়ে! এত জলদি করতে বলেছিল কে? এই ছয় বছর যেভাবে ধীরে ধীরে এগোল, আর একটা মাস এগোতে পারল না?
দিদিকে কল দিয়েই বকবক করা শুরু করলাম। শুরুতে ছিল একরাশ অভিযোগ। এই আমাকে ভালোবাসে সে! নিজের বিয়ে, অথচ আমাকেই জানায়নি।
রাগ দেখিয়ে এক পর্যায়ে বললাম, “আমি যাবই না বিয়েতে। এতদিন জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি যেহেতু, আজও না জানালেই পারতে। ওহ্! তুমি তো জানাওনি। জানিয়েছে তো মেহেদী ভাই। যাব না আমি বিয়েতে। হুহঃ!”
দিদি আমাকে সামলাতে বলল, “আরে আরে, পাগলী মেয়ে! সারপ্রাইজ ছিল তোর জন্য এটা।”
“জঘন্য সারপ্রাইজ ছিল। আগে বললে কী এমন হতো? আচ্ছা! মেহেদী ভাই তোমাদের বাড়িতে এসেছিল?”
“হ্যাঁ, যখন দেখতে এসেছিল ওঁরা; তখন সাথে ও এসেছিল।”
“বাহ! চমৎকার। আগে বললে না কেন? কত কিছু মিস করে গেলাম! আচ্ছা! মামাকে কী বলে ম্যানেজ করেছ? উনি তো এরকম প্রেম-ভালোবাসা পছন্দ করে না।”
দিদি তখন অট্টহাসিতে মেতে উঠল। হাসি থামাতে থামাতে বলল, “আমাদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হচ্ছে।”
“কী বলছ? তোমাদের না ছয় বছরের প্রেম!”
“হ্যাঁ। সেটা শুধু তোরা জানিস। আম্মা-আব্বা তো জানে না!”
“ক্লিয়ার করে বলো তো। বুঝতে পারছি না। মাথা ঘুরাচ্ছে।”
“ওর আম্মা আমাদের সম্পর্কের কথা জেনেই ঘটক পাঠিয়েছে বাড়িতে। বাড়ির সবাই ছেলে, ছেলের পরিবার পছন্দ করেছে। খোঁজ-খবর নিয়েছে। এরপর বিয়ে ফাইনাল।”
“তার মানে তোমরা মামা-মামিকে ধোঁকায় রেখেছ?”
“হয়। জানিস? যেদিন ওঁরা আমাকে দেখতে এলো, আমার আম্মু আমার রুমে এসে আমাকে বোঝাল, ‘দ্যাখ, মা! ছেলে ভালো। পরিবার ভালো। তুই সুখী হবি। আমাদের উপর ভরসা রাখ।’ আরও কত কথা। কী করে যে নিজের হাসি থামিয়েছিলাম! কিন্তু শাড়ি পরে আধহাত ঘোমটা দিয়ে যখন মেহেদীর সামনে গেলাম, আর হাসি থামাতে পারিনি। ইট ওয়াজ দ্যা ফানিয়েস্ট ইনসিডেন্ট, আই হ্যাভ ফেইস, ইয়েট!”
আমি এগুলো শুনে নিজেও নিজের হাসি থামাতে পারিনি। কল কেটে দিয়ে পাশ ফিরতেই নীতিকে দেখলাম। আমাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ও দাঁত কেলিয়ে হাসল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটাই ছিল সেই বড়ো সারপ্রাইজ?”
নীতি সেভাবেই মাথা উপর নিচ করল। আমিও হেসে দিলাম। এখন অনেক কাজ। সবচেয়ে উপরে আছে শপিং।
__________
আরও চারদিন পেরোল। যাবার কথা দু’দিন পরে হলেও সেটা গিয়ে ফিক্সড হলো চারদিনের মাথায়। আব্বু এবং মামার অফিসের কারণে, মণি আর আম্মু যেতে পারবে না। তারা আছে বিধায় খালামণিও থেকে যাবে। একসাথেই সামনের সপ্তাহে যাবে।
এখন যাব শুধু আমরা ছোটোরা— আপি, নীতি, রাহী, আমি আর কুঞ্জ ভাই। কুঞ্জ ভাইদের গাড়িতেই যাব আমরা।
ঘড়িতে এখন সকাল ৯টা বেজে ১২ মিনিট। বেরোব এখনই। খেয়ে রেডি হয়েই বাসা থেকে বেরোলাম আমরা। এগিয়ে দিতে আম্মু আর খালামণিও এসেছে। নিচে নেমে দেখি গেটের সামনেই গাড়ি পার্ক করা আর কুঞ্জ ভাই পাশের চায়ের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের আসতে দেখে উনি এগিয়ে এলেন। ওঁর সাথে এগিয়ে এলো আরও একজন লোক। চেহারা দেখেই আমি তব্ধা খেলাম। ঘটনার আগা-গোড়া আমার কাছে মোটেও পরিষ্কার নয়।
কুঞ্জ ভাইয়ের সাথে আসিফ ভাই এগিয়ে এলো। আম্মু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকাল। কুঞ্জ ভাই তাতে বলল, “আমার ফ্রেন্ড ও। আমাদের সাথেই যাবে।”
এতে আম্মু মুচকি হেসে বলল, “নিজের বাড়ি মনে করে থেকো, বাবা। কোনো সমস্যা হলে কাউকে জানিয়ো। ও বাড়ির সবাই ভীষণ ভালো। বিশেষ করে মেজো ভাবি।”
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “আসিফ ভাই আপনার কবেকার ফ্রেন্ড, কুঞ্জ ভাই?”
আপি সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ে পাড়া দিল। আমি ‘আউচ’ টাইপের সাউন্ড করে দিলাম। কুঞ্জ ভাই আম্মুকে সামলাতে বলল, “আমার ফ্রেন্ডদের সব খবর তোর কাছে থাকার কথা নাকি?”
তারপরই আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমার মেয়ে নিজেকে যে কী মনে করে!”
আম্মু আমাকে চোখ রাঙিয়ে বলল, “ও বাড়িতে যাচ্ছ, ভদ্র হয়ে থেকো। কেউ যেন খারাপ না বলতে পারে।”
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে আবারও বলা শুরু করলাম, “তোমরা এভাবে বলছ কেন? আসিফ ভাই তো আপি…”
আর কিছু বলতে পারলাম না। আপি আমার মুখ চেপে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল। চোখে চোখের ইশারায় ব্যাপারটা বোঝাল। আম্মু আর খালামণি এবিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামাল না। আসিফ ভাই ওই বাড়িতে কুঞ্জ ভাইয়ের বন্ধু বেশেই থাকবে।
____________
ড্রাইভ করছে কুঞ্জ ভাই। তাঁর পাশের সিটে আসিফ ভাই বসেছে। মাঝে আপি ও নীতি। আর একদম শেষে বসেছি আমি আর রাহী। সবাই একে অপরের সাথে ননস্টপ বকবক করে যাচ্ছে। চুপ আছি কেবল আমি আর কুঞ্জ ভাই। উনি নির্বিকার হয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছেন। আর আমি ফোন চেপে যাচ্ছি।
এবার ফোন রেখে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কিন্তু এভাবে ভাল্লাগছে না। তাই কুঞ্জ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “কুঞ্জ ভাই! এসিটা অফ করে দিন না!”
উনি যেন আমার কথা শুনতেই পারলেন না। সেভাবেই রইলেন। আসিফ ভাই এসি অফ করে আমাকে বলল, “শালিকা তো ফাঁসিয়েই দিচ্ছিলে আমাকে!”
আমি জানালা খুলে দিয়ে বললাম, “আমাকে এই প্ল্যানে না জড়ানোর পানিশমেন্ট এটা।”
“এই যে, শালিকা সাহেবা! আমি নিজেও কাল রাত অবধি জানতাম না, তোমাদের সাথে এখন, একসাথে, তোমাদের মামার বাড়ি যাব, বিয়ে খেতে। সব তো তোমার বোনের মেহেরবানী। মাঝ রাতে কল দিয়ে এই প্ল্যান বলল। আর সকাল সকালই চলে আসতে হলো।”
আমি মিটিমিটি করে হাসলাম। আসিফ ভাই আরও অনেক কথাই বলল; যা আমার কানে গেল না। পুরো মনোযোগ এই জানালার বাইরেই। প্রকৃতি কী সুন্দর! এই প্রকৃতি যদি আমার নামে হতো বা আমার কুঞ্জ ভাইয়ের ভাইয়ের নামে হতো! উঁহু, যদি আমাদের নামে হতো!
পৌঁছতে পৌঁছতে বেজে গেল দু’টো। সবাইকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছিলাম আমরা। দিদি, তার ছোটো বোন– সুপ্তি, ছোটো মামার মেয়ে– দিয়া; সবার সাথে এতদিন পর দেখা হওয়ায় নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে বাগানের পাশে আমাদের সেই পুরোনো আড্ডা ঘরটিতে গিয়ে বসলাম, আড্ডা জুড়লাম। এর মধ্যে দিদির লাজে রাঙা মুখ দৃষ্টিগোচর হয়নি। আড্ডার বিষয়াদির মাঝে রজনী আপির এমন সুকৌশলে তার প্রেমিককে এই বিয়েতে নিয়ে আসাটাও ছিল। ছিল নীতির চাঞ্চল্যতা, রাহীর আঁতলামি, আমার এমন হুট করেই পালটে যাওয়া। সবার ধারণা– অবশেষে নবু ইজ ইন লাভ; যদিও এটা আংশিক সত্যি। পুরোদমে সত্যি কি না, তা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
__________
সন্ধ্যের দিকে সবাইকে ফেলে রেখে আমি বাগানের পেছনের রাস্তার দিকে গেলাম। ছোটো-সরু কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তার শেষ মাথায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সচরাচর জনমানবের দেখা মেলে না। বড্ড শান্ত এই রাস্তাটাকে অকারণেই আমার খুউব ভালো লাগে।
ধীরপায়ে হেঁটে সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে গেলাম। একটা দোলনা ঝুলানো আছে। ছোটো বেলায় গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে এসে, আমি নীতি আর রাহী এটা করেছিলাম। এখনও আছে। তবে সেই বাচ্চা কালের মতো একজন দোল খায় না কিংবা অপরজন দোলনা ধাক্কা দেয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই দোলনাটিতে গিয়ে বসলাম।
চোখ বন্ধ করে মাটির উপর পায়ের ধাক্কা দিয়ে দোল খেতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম সেই ছোটো বেলার ঘটনাগুলো। আমি তখন গ্রামে ছিলাম, মামার বাড়িতেই। ছোটো-বড়ো বোনদের সাথে কী আনন্দই না করতাম! এরপর একদিন আম্মু-আব্বুর সাথে শহরে পাড়ি জমালাম। তখন বয়স আমার সবে তিন। ছোটো বেলার বলতে আবছা আবছা কিছু ঘটনাই মনে আছে। এরপর শহরে একাকী কাটাতে লাগলাম। রজনী আপি দিদির সাথে গ্রামেই থেকে গেল, সামনে আপির ক্লাস থ্রির প্রমোশনাল এক্সাম ছিল যে! ঢাকা আসার কিছু সময় পর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল আব্বু আমাকে। সেখানে কোনো বান্ধবী বানাতে পারিনি। এরপর আব্বুর ট্রান্সফার হলো উত্তরায়। সেখানে ছয় বছরের আমিটা জানতে পারি, আমার বড়ো মামার একটা ছেলে আছে। বাচ্চা ছিলাম তো! এর আগে এতসব খেয়াল করিনি। তার উপর মামারা গ্রামে যেতেন না। গেলেও কুঞ্জ ভাই কখনও যেতেন না। ছুটিতে গ্রামে গেলে, মাঝে মাঝে রাহীর সাথে দেখা হতো। ও আবার গ্রাম পছন্দ করত যে! আমার সমবয়সী হবার দরুণ, আমাকেও বেশ পছন্দ করত। কিন্তু কুঞ্জ ভাইকে দেখিনি কখনোই।
সেবার নতুন বাসায় আসার পর, রাহী এবং মণি এসেছিল। তাদের চিনতাম আমি। বাচ্চামো কথা-বার্তায় রাহী ও মণির সাথে গল্প করতে লাগলাম। বাসা গোছানোর জন্য আমাকে আর আপিকে রাহীদের বাসায় দু’দিন থাকতে হবে। যেহেতু আমার ডাস্ট অ্যালার্জি, তাই এটা বলা হয়। এদিকে মণি আম্মুকে সহায়তা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায়, কাকে যেন কল দিয়ে বলল, আমাকে, আপিকে আর রাহীকে এসে নিয়ে যেতে। মিনিট দশেকের মাঝেই একটা এগারো-বারো বছরের ছেলে আমাদের বাসায় এলো। আম্মু জানালো, ইনিই আমার কুঞ্জ ভাই।
ওঁকে দেখে সেদিন প্রথমবারেই বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখেছিলাম। এখনও দিনটা বেশ ভালো ভাবেই মনে আছে আমার। চেহারায় কেমন একটা গম্ভীর ভাব। মনে হচ্ছিল, উনি রেগে আছেন। ইশ! কোনো বাচ্চা মানুষের মুখেও বুঝি গম্ভীরতার ছোপ পাওয়া যায়!
আমি সেদিন পেয়েছিলাম। দৌড়ে গিয়ে মণিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “এঁর সাথে যাব না, মণি। আমাকে বেঁচে দেবে। আম্মু বলেছে, ছেলেধরারা এসব বাচ্চাদের দিয়েই কিডন্যাপ করায়। এঁদের কাছে যেতে নেই। আমি যাব না।”
তখন সবাই কী যে হেসেছিল! একমাত্র কুঞ্জ ভাই হাসেননি। আমার কথায় বেশ অবাক হয়েছিলেন। সাথে রেগেও গিয়েছিলেন। আর আম্মুকে বলেছিলেন, “ফুপি, তোমার মেয়েটা কার মতো হয়েছে গো?”
আম্মু কাজ করতে করতেই বলেছিল, “জানিসই তো! তোর ফুপার মতো। শুধু চেহারা না; হাবভাব দেখেও যে কেউ এটা বলতে পারে।”
কুঞ্জ ভাই আম্মুকে সায় দিয়ে তখন বলেছিলেন, “এজন্যই। তোমার মতো যদি ১% ও হতো! হয়েছে আস্ত একটা গর্ধব।”
সেদিন উনি আমাকে না নিয়েই নিজের বাড়ি চলে গেছিলেন। ওঁর সেভাবে কথা বলায় বাচ্চা নবু ঠোঁট উলটে কেঁদেছিল। আমাকে আর সেদিন, ও বাড়িতে কেউ নিয়ে যেতে পারেনি। এরপর থেকে তো ওঁর সামনেই যেতে চাইতাম না। ইশ! ছোটো বেলার কাহিনিগুলো, অকারণের সেই অভিমানগুলো, কতই না সুখের ছিল!
ভাবতে ভাবতে আনমনে হেসে ফেললাম। প্রথমে যাকে দু’চোখে দেখতে পারতাম না, আজ তাকে কিছু সময় দেখতে না পেলেই আমার চোখ দু’টো আঁকুপাঁকু করে। একেই বুঝি বলে, সময় মানুষকে নিয়েই পালটায়!
কিছুক্ষণ বাদেই আমার নাকে কুঞ্জ ভাইয়ের পারফিউমের সেই কড়া স্মেলটা ভেসে এলো। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। বুঝতে পেলাম, কুঞ্জ ভাই আমার আশে-পাশেই আছেন।
পেছন থেকে তাঁর ভরাট কন্ঠে ভেসে এলো, “ভোর-সন্ধ্যেয় এখানে কী করছিস?”
আমি কথা বললাম না। বলতে পারলাম না। কিছু কিছু সময় এমন হয়, চুপচাপ প্রকৃতি উপভোগ করে যেতেও ইচ্ছে হয়। তখন পাশে কোনো বিশেষ একজনের উপস্থিতি খুশি ঢের বাড়িয়ে দিলেও, মুখ নেড়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। চুপ করে কেবল উপভোগ করে যেতেই ইচ্ছে হয়।
কুঞ্জ ভাই আবারও বললেন, “কথা বলছিস না কেন?”
এবার যেন কিছু বলার জন্য মুখ আপনাআপনিই খুলে গেল। বললাম, “দোলনায় ধাক্কা দিন-না, কুঞ্জ ভাই!”
কুঞ্জ ভাই দিলেন না। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দোলনার দু’পাশে হাত রেখে এর গতি আটকে ফেললেন। আমি চোখ খুলে ওঁর দিকে তাকালাম। তাতে উনি সামান্য আমার দিকে ঝুঁকলেন। চোখ খুলতেই সামনে ওঁর মাদকাচ্ছন্ন দৃষ্টি যেন আমার সব লন্ডভন্ড করে দিল!
চলবে…