কল্পকুঞ্জ_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ৫|

0
163

#কল্পকুঞ্জ_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৫|

সকাল আটটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ দু’টো আলতো ভঙ্গিতে খুলে সিলিংয়ে স্থির করলাম। ঘুম ভেঙে গেছে বললে ভুল হবে; তন্দ্রা ও জাগরণের মাঝামাঝি ছিল আমার অবস্থান। সবকিছু অনুভব করতে পারছি; কখন কে কী বলল, সব শুনতে পারছি। এই যে মিনিট বিশেক আগে আপি তৈরি হয়ে বেরোল, এটাও আমার সুপ্ত মস্তিষ্ক টের পেয়েছে। আধ জাগরণের মাঝে অবস্থান করছিলাম। তবে আজ কোনো তড়িঘড়ি নেই। সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাগিদ নেই। মায়ের এত বকা শুনেও সকালের ঘুম ভাঙার মানে নেই। কেননা, আজ কলেজে অফ। কিছু বিশেষ কারণবশত আজ কলেজ অফ।

সিলিংয়ে স্থির রাখা দৃষ্টি নিজের মন-মতলবি কাহিনি গড়া শুরু করল। আজ কী কী করব, মুহূর্তেই তার একটা ছোটো-খাটো হিসেব কষে ফেলল। চোখের পাতা খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ করতেই কাল রাতেই সেই দৃশ্য ভেসে উঠল। কুঞ্জ ভাই যখন আমার হাত ধরেছিলেন!

তিরতির করে কাঁপছিল আমার পাতলা ওষ্ঠদ্বয়। চাহনি অস্থির; কখনো নিচে, কখনও ডানে, কখনও বামে। আবার কিছু সময় অবাধ্য মনটা নিষেধ এড়িয়ে তাকিয়েছিল আমার ঠিক সামনে দণ্ডায়মান সেই পুরুষটির দিকে। কিছু বলতে পারছিলাম না। অথচ সেই লোকটা! সেই লোকটা দিব্যি নির্বিকার ছিল। থাকতে পারছিলাম না কেবল আমিই। অশান্ত, অবাধ্য, ছটফট করতে থাকা হৃদয়টা চাচ্ছিল এক্ষুনি বেরিয়ে আসতে।
অন্যদিকে সেই স্পর্শ! কেন এভাবে ছুঁলেন আমায়, আমার মনকে? কেন বুকের ভেতরে বিষাদের এক জ্বালা ধরিয়ে দিলেন? আমি শুধু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর ঐ ভয়ঙ্কর সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেই তাকানোতে প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি কেন আমার কাছে অন্য রকম? সব পুরুষের চেয়ে অন্যরকম?’
তবে উনি বুঝতে পারেননি এই প্রশ্ন। হয়তো ভেবেছিলেন, আমার চোখে জ্বলজ্বল করতে থাকা প্রশ্নটা এই ছিল, ‘কী জন্য হাত ধরলেন? আটকালেন কী জন্য?’

তাই তো তৎক্ষণাৎ শক্ত হয়ে থাকা হাতের বাঁধন ঢিলে করে দিয়েছিলেন। আর কয়েক পলকের মাঝেই তা ছেড়েও দিয়েছিলেন। তারপর আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, “আর ইউ ড্রাংক?”

প্রশ্নের মানে বুঝেছিলাম আমি। মাঝরাতে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের ঘরে একটা যুবতী মেয়ে কেন এলো! এই সমাজ এসব অন্য নজরে দেখে, সে নজর যে বড্ড বিচ্ছিরি! তবে কিশোরী হৃদয় থোড়াই না সমাজের তোয়াক্কা করে!
সেই সময় হয়তো বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ‘হ্যাঁ! আপনার মাতাল করা সেই চাহনিতে আমি মাদকাচ্ছন্ন। ইয়াপ্… আ’ম ড্রাংক।’
কিন্তু সে কি আর বলতে পারি? বলিনি। নিশ্চুপ, স্থির, অবিস্তৃত হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জবাব দিতে পারিনি।
কুঞ্জ ভাই কী ভাবছিলেন, তা আমার অজানা ছিল। কেননা ওঁকে আমি দেখতেই পারিনি। তবে ক্ষণিক সময়ের মধ্যেই কুঞ্জ ভাই ভরাট গলায় বলে ওঠেন, “সোজা রুমে গিয়ে ঘুমা।”

ব্যাস! সেই এক কথা। অনুমতি পেয়েই আমি ছুটে চলে এসেছিলাম নিজের রুমে। গা এলিয়ে দিয়েছিলাম নিজের প্রিয় জায়গায়, সুপরিচিত বিছানায়। ঘুম কি আর চোখে ধরা দেয়?
সেই যে রাত বেজেছিল তিনটে। এরপর এখন আটটে! মুচকি হাসলাম আমি। লোকটার সামনে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তাঁর শান্ত স্বভাব অন্যদের জন্য। আমার সামনে তো উনি একটা বজ্জাত লোক! সেভাবেই থাকুক না!
কেন যে পালটে যায়! ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললাম। অদ্ভুত! কুঞ্জ ভাই ভারি অদ্ভুত একটা লোক!

আমার ভাবনার মাঝেই ফোন রিং হলো। শব্দ পেয়ে ফোন খোঁজা শুরু করলাম। কাল রাতে কোথায় রেখেছি, মনে পড়ছে না। শব্দ অনুসরণ করে দেখলাম ফোনটা বেডসাইড টেবিলের ফ্লাওয়ার্ভাসের পেছনে। হাতে নিয়ে দেখলাম কল এসেছে। উজ্জ্বল স্ক্রীনে ভেসে আসছে একটা নাম, ‘নীতি’!

মুহূর্তেই মুচকি হাসি আমার ওষ্ঠ দখল করে নিল। রিসিভ করে কানে তুলে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

ওপাশ থেকে নীতি বলল, “বুবু! কেমন আছো?”

আমি মিষ্টি হেসে বললাম, “ভালো আছি, জান। তুমি কেমন আছো? খালামণি কেমন আছে?”

“মা ভালো আছে। আমিও খুউব ভালো আছি।”

“খেয়েছ সকালে?”

“হ্যাঁ, বুবু। তুমি?”

“উঠিনি এখনও। তো! কী মনে করে এত সকালে কল দিলে?”

ওপাশ থেকে নীতির মিটিমিটি হাসির আওয়াজ এলো। আমার কপাল কুঁচকে গেল, তবে অধরে এখনও খেলা করছে সেই হাসি।

নীতি বলল, “সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”

“কী সারপ্রাইজ?”

“সেটা বলে দিলে সারপ্রাইজ হলো নাকি!”

নিজের বোকামি ক্যাটাগরির প্রশ্নের জন্য হেসে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ নীতি আর খালামণির সাথে কথা বলে কল কেটে দিলাম। আর মিনিট দশেক ওভাবেই শুয়ে থেকে উঠে পড়লাম। অস্বস্তি লাগছে। ছুটির দিনে বেলা করে ঘুমোতে ইচ্ছে করলেও আর হয়ে ওঠে না।

__________
শাওয়ার নিয়ে গুনগুন করতে করতে ডাইনিংয়ে চলে এলাম আমি। সবার খাওয়া হয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছি আমি আর আম্মু। এটা নতুন না। গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। তারপর আম্মুর দিকে তাকিয়ে ডাক দিলাম আম্মুকে।

আম্মু তাকাতেই হেসে দিলাম। আমার এই স্বভাব তার চেনা, খুব ভালো করেই জানে। তাই আর কিছু না বলে পরোটা ছিঁড়ে খাইয়ে দিতে লাগল। আমিও আরামসে মায়ের হাতে খেতে লাগলাম! আহা! এই চেয়ে শান্তি নেই। মনে হচ্ছে যেন অমৃত খাচ্ছি।

তবে হুট করেই আমার মনের মাঝে কিছু একটার অভাব অনুভব করলাম। সাথে বুঝলাম, আমার চোখ এদিক-সেদিক কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কী?
সময়ের তালে এটাও বুঝলাম, আমি কুঞ্জ ভাইকে খুঁজছি। খেতে খেতেই আম্মুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কুঞ্জ ভাই কোথায়?”

আম্মু নিজেও খাচ্ছে আর বলছে, “সকালে সবার সাথেই খেয়েছে। এখন রুমেই আছে।”

আমি আর কিছু বললাম না। আম্মু আবারও বলল, “তোর কোনো কাজ আছে আজ?”

আমি কিছু একটা ভেবে বললাম, “না।”

আম্মু যেন হালকা হাসল, “ভালোই হলো। একটু বড়ো ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে তোকে। ভাবি যেতে বলেছিল।”

“ঠিক আছে। খেয়েই যাব।”

“আচ্ছা। কুঞ্জর সাথেই যাস।”

মুহূর্তেই যেন ডাইনিংয়ে ছোটো-খাটো বিস্ফোরণ হলো। ওঁর সাথেই কেন যেতে হবে? এখান থেকে এখানে, আমি একাই তো যেতে পারব!
এই কথাগুলো অগোছালো ভাবে আম্মুকে বললাম। কিন্তু আম্মু বুঝল না। তার একটাই কথা, আলাদা যাওয়ার কী আছে? একই বাসা থেকে বেরোবে, একই বাসায় যাবে, সেখানে আলাদা আলাদা কেন?
আর কী বলব আম্মুকে? খাওয়া শেষ করে উঠে নিজের রুমে চলে এলাম। আমি ভাবিইনি, কাল যা কাহিনি করলাম, তার পরও ওঁর সামনে কী করে যাব!

_____________
বাসা থেকে বেরিয়েছি। ঢাকার ব্যস্ত সড়কে হেঁটে চলছি। আমার ঠিক পাশেই, একটু সামনে দিয়ে হাঁটছেন কুঞ্জ ভাই। সেই যে রাতে কথা হয়েছিল, এরপর আর দু’জনের একজনও কোনো কথা বলিনি। আচ্ছা! আমি না হয় লজ্জা পাচ্ছি, তবে উনি কেন কথা বলছেন না! বাচাল লোক একটা! এভাবে তো সারাদিন বকবক করতেই থাকেন! আর এখন যখন চাচ্ছি, তখন কথাই বলছেন না!
সে যাক গিয়ে! আমি এক দৃষ্টিতে ওঁকে পেছন থেকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। কুঞ্জ ভাই হোয়াইট টিশার্ট পরে আছেন। মাঝে মাঝে হালকা বড়ো হওয়া চুলগুলো এক হাতে ছুঁয়ে যাচ্ছেন।
আমি ওঁর পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছি। তিন মিনিটের এই রাস্তা। প্রথমে একসাথে আসা নিয়ে ঘোর আপত্তি করলেও এখন বলতে ইচ্ছে করছে, “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?”

আমার অজান্তেই গানটা মুখে এনেছি। গুনগুনিয়ে গেয়েই যাচ্ছি। হঠাৎ কুঞ্জ ভাই পা দুটো থামিয়ে দিলেন। হতবিহ্বল নেত্রে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম।

উনি দু’কদম পিছে এসে আমার পাশাপাশি দাঁড়ালেন। ওঁর চাহনি আমার চোখের মাঝেই সীমাবদ্ধ। এক, দুই, তিন! তিন সেকেন্ড ছিল। দ্রুত অন্যদিকে সরিয়ে দিলেন। যেন আমার চোখে আর কিছুক্ষণ তাকালেই ওঁর মন ভস্ম যাবে! কুঞ্জ ভাইয়ের অকস্মাৎ পরিবর্তন আমি মেনে নিতে পারছি না।

“ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ। শেষে কি না এই অবস্থা!”

হ্যাঁহ! এখন কী করলাম? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকাতেই উনি বললেন, “তুই এত সাংঘাতিক কী করে হতে পারলি, নবু? এই ভরা রাস্তায় আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খেতে লজ্জা লাগে না?”

খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। তবুও নিজের হয়ে বললাম, “আমার বয়েই গেছে!”

“হুম, হুম, হুম। তা তো দেখতেই পাচ্ছি! তুই বরং একটা কাজ কর, চোখ দুটো ঐ যে রিকশা দেখছিস, ওর চাকার নিচে ফেলে দিয়ে আয়। এই চোখ বড়োই সর্বনাশা।”

কথাটা বলেই আবারও বললেন, “কীভাবে দেখছিলি আমায়। বাসায় ফিরেই শাওয়ার নিতে হবে। উফফ! কোথায় কোথায় যে এই লুচু মহিলা চোখ দিয়ে ছুঁয়েছে!”

“দেখুন, কুঞ্জ ভাই! আপনি এভাবে বলতে পারেন না। আমি মোটেও আপনাকে ওভাবে দেখিনি। কখনো দেখিও না।”

“তো! দেখিস না কেন? আমি কি দেখতে খারাপ?”

এখন এটার কী জবাব দেব? ধুর! উনি আগেই ভালো ছিলেন। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলেছি। ঠিক তখনই আমার ভেতরের সত্তা আমাকে বলল, “নে! চেয়েছিলি না এটাই? বজ্জাতটা চুপ ছিল, তখন তো তোর সহ্য হয়নি। নে এখন। খুশি হ! এই খুশিতে গিয়ে মাঝরাস্তায় লুঙ্গি ড্যান্স দে।”

কুঞ্জ ভাই আবারও বললেন, “হুঁ?”

মনের অগোচরে লুকায়িত, অবাধ্য, অকথ্য কিছু কথা বেরিয়ে এলো, “না! ভয়ংকর। ভীষণ ভয়ংকর। তাই তো ঘুমোতে যাওয়ার আগে আপনাকে ভেবে ঘুমোনো হয় এবং দিনের শুরুটা আপনাকে দেখেই হয়!”

বড্ড ফিসফিসিয়েই বললাম। বাসায় চলে এসেছি। কুঞ্জ ভাইকে এক প্রকার এড়িয়েই বাসার ভেতরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু এরপর কী হবে? ধীরে ধীরে এভাবে কীভাবে এতটা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারি আমি?

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here