#নিবেদিতা
#পর্ব_২৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। চারদিকে ছিড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য তারা। বিশাল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মিদহাদ ও সূবর্ণলতা। সূবর্ণলতার জেদের কাছে পরাজিত হয়েই মিদহাদকে ছাদে আসতে হয়েছে। নতুবা কখন কার কানে এ কথা চলে যায় বলা যায় না। সূবর্ণলতা দুহাত গুটিয়ে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে মিদহাদ। তার মুখ গম্ভীর। তবে সূবর্ণলতাকে বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন মিদহাদ নিজ থেকে কিছুই বলছিল না তখন সূবর্ণলতা নিজেই বলল,
“এখানে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
মিদহাদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। বলল,
“কী জানতে চান?”
“আপনি নিবেদিতাকে ভালোবাসেন?”
“এটা জানা কি খুব জরুরী আপনার জন্য?”
“না। তবে তাও জানতে চাই। কারণ পুরো বিষয়টায় এখন আমিও জড়িয়ে আছি।”
“কীসের বিষয়?”
“আপনার ভালোবাসার। বলুন এখন, ভালোবাসেন নিবেদিতাকে?”
মিদহাদ আর কোনো লুকোচুরি করল না কিছু। নির্লিপ্তি কণ্ঠে বলল,
“হ্যাঁ।”
“নিবেদিতা জানে?”
“না।”
“কখনো বলেননি?”
“না।”
“কেন?”
“কারণ নিবেদিতা নির্ণয়কে ভালোবাসে।”
সূবর্ণলতা এবার চুপ হয়ে গেল। যদিও সে নিবেদিতা ও নির্ণয়ের সম্পর্কের কথা জানত না। কিন্তু ওদের হাভভাব দেখে কিছু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছিল। এখন এটাও বুঝতে পারল যে, মিদহাদ কেন নির্ণয়কে বলেছে সে সূবর্ণলতাকে ভালোবাসে। তবুও সে মিদহাদের থেকে জবাব পাওয়ার প্রয়াসে জিজ্ঞেস করল,
“বেশ! কিন্তু আপনি নির্ণয় ভাইয়াকে কেন আমার কথা বলেছেন?”
“কারণ নির্ণয় সন্দেহ করতে শুরু করেছিল যে, আমি নিবেদিতাকে ভালোবাসি।”
“এতে দোষের কী আছে? ভালোবাসা তো কখনো বলে-কয়ে আসে না। যার প্রতি ভালোলাগা, ভালোবাসা কাজ করবে মানুষ তো তাকেই ভালোবাসবে।”
“দোষের কিছুই নেই। কিন্তু আমি চাই না, আমার জন্য ওদের সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরুক। নিবেদিতা নির্ণয়কে অনেক বেশিই ভালোবাসে।”
“আসল কথা হলো আপনি চান না নিবেদিতা কোনোভাবে একটু কষ্ট পাক।”
মিদহাদ চুপ হয়ে গেল। তার কাছে জবাব আছে। কিন্তু দিচ্ছে না। ওর নিরবতাতেই সূবর্ণলতা নিজের জবাব পেয়ে গেছে।
.
.
এত শব্দের মধ্যে নিবেদিতার হঠাৎ করে মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। হট্টগোল, গান-বাজনা, শব্দ কোনো কিছুই তার ভালো লাগছিল না। মাথাব্যথা যেন ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল। সে সবার থেকে একটু দূরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসল। এখন নাচের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। সবাই সেদিকেই ব্যস্ত। পরিচিত কাউকেও নজরে পড়ছে না। হঠাৎ করে যেন সে চোখেও ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে।
ভিড়ের মাঝে নিবেদিতাকে না দেখে নির্ণয় ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। মানুষের আনাগোনা পেরিয়ে দূরে নিবেদিতাকে মাথা ধরে বসে থাকতে দেখে ওর বুকে ধ্বক করে উঠল। তড়িঘড়ি করে সে এগিয়ে গেল নিবেদিতার কাছে। নিবেদিতার পায়ের কাছে বসে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“নিবেদিতা, কী হয়েছে?”
নিবেদিতা ক্ষীণস্বরে বলল,
“হঠাৎ করেই খুব মাথাব্যথা করছে।”
নির্ণয় আর কথা বাড়াল না। নিবেদিতাকে পাঁজাকোলে তুলে নিল। নিবেদিতা হকচকিয়ে বলল,
“করছেন কী!”
“ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি।”
“আমাকে নামিয়ে দিন। আমি হেঁটে যেতে পারব।”
নির্ণয় কোনো প্রত্যুত্তর করল না। তাকে এখন খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। কাউকে কিছু না জানিয়েই নিবেদিতাকে নিয়ে সে ডাক্তারের কাছে রওনা দিল।
আর কেউ না জানলেও কিংবা না দেখলেও ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে থাকা সূবর্ণলতা দেখতে পেল এক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত প্রেমিক তার ভালোবাসার মানুষটাকে কীভাবে বুকে আগলে নিয়ে রিকশায় উঠল। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল মিদহাদের দিকে। দৃশ্যটা দেখলে কি মিদহাদের বেশি কষ্ট হতো? নাকি নিবেদিতার কী হয়েছে এটা জানার জন্য সে বেশি উতলা হয়ে পড়ত? সঠিক উত্তর সূবর্ণলতার জানা নেই। তবে সে একটা স্বার্থপরতার মতো কাজ করল এখানে। নিবেদিতার অসুস্থতার ব্যাপারে সে মিদহাদকে কিছুই বলল না। সেও চায় না মিদহাদ কষ্ট পাক। এটা উপলব্ধি হতেই সূবর্ণলতার ভেতরে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল। সে কেন চায় না? কেন সে মিদহাদের জন্য এত ভাববে? তবে কী…
“চলুন, আমরা নিচে যাই। কেউ ছাদে চলে এলে আবার সমস্যা। কী না কী ভেবে বসবে পরে!”
মিদহাদের কথায় সূবর্ণলতার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে। নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে সে। অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, চলুন।”
_______
রাত- ২টা ১০ মিনিট
“আপনি শুধু শুধু এত চিন্তা করছেন। এখন আমি ঠিক আছি। মাথাব্যথাও ভালো হয়ে গেছে।”
“খুবই ভালো। এখন লক্ষ্মী মেয়ের মতো ফোন রেখে ঘুমাও।”
“এমন করেন কেন? আর একটু কথা বলি?”
“না। কাল সারাদিন যত পারো কথা বোলো। এখন ঘুমাও।”
“কাল মানে? রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। তার মানে আমি এখনই কথা বলব।”
নির্ণয় ধমক দিতে গিয়েও পারল না। নিজের কাছেই কেমন খারাপ লাগছে। নিবেদিতার সরল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এত মায়া যে কেন লাগে মেয়েটার জন্য! ডাক্তারের কাছ থেকে নিবেদিতাকে নিয়ে সোজা বাড়িতে ফিরে এসেছিল নির্ণয়। খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে। এরপর নিজে একটা চেয়ার নিয়ে উঠানে বসে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ করে মনে হলো নিবেদিতাকে না পেয়ে সবাই চিন্তা করতে পারে। তাই সে নাসিমা বেগমকে ফোন করে জানিয়েছে নিবেদিতার অসুস্থতার কথা। খবর পেয়ে নাসিমা বেগম একা তখনই চলে এসেছেন। নিবেদিতা তখন ঘুমুচ্ছিল। একটু আগে তার ঘুম ভেঙেছে। ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় গিয়ে নির্ণয়কে ফোন করেছে। প্রথমে ভেবেছিল এত রাতে কল করবে না। কিন্তু মনটা খুব ছটফট করছিল একটুখানি কথা বলার জন্য। তাই মনের ইচ্ছেকেই সে প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু সে দিলে কী হবে? নির্ণয় তো দিচ্ছে না।
নির্ণয়কে চুপ থাকতে দেখে নিবেদিতা বলল,
“কী হলো? কথা বলবেন না?”
নির্ণয় শান্তকণ্ঠে বলল,
“এত জেদ কেন করছ, নিবেদিতা? তোমার শরীর ভালো না। ঘুমাও এখন।”
“ঘুমাব তো। আরেকটু কথা বলেই ঘুমাব। প্লিজ?”
নির্ণয় বুঝল আর বলে লাভ নেই। তাছাড়া তারও তো ইচ্ছে করছে নিবেদিতার সাথে কথা বলতে। কিন্তু অসুস্থ বলে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে ঘুমাতে যেতে বলছে। তুবার বিয়েটা হয়ে গেলেই বাড়িতে এবার নিবেদিতার কথা বলতে হবে। বিয়ে করে সারাক্ষণ কাছে কাছে রাখবে। তখন আর এত চিন্তা নেই।
“শুনছেন?”
নিবেদিতার ডাকে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল নির্ণয়ের। বলল,
“হু, বলো।”
“আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।”
নির্ণয় মুখ টিপে হাসছে। নিবেদিতাকে বুঝতে না দিয়ে বলল,
“তাই?”
“হু।”
“আচ্ছা। চোখ বন্ধ করো।”
“কেন?”
“আগে করো।”
নিবেদিতা চোখ বন্ধ করে বলল,
“করেছি।”
“এবার ফিল করো আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছি।”
নিবেদিতা শব্দ করে হেসে ফেলল। নির্ণয় বলল,
“ফিল করেছ?”
“হু! কিন্তু এভাবে দূর থেকে ফিল করার মানে কী? একটা হাগ কি দেওয়া যেত না এখন?”
“যেত। তুমি অবশ্য একটা হাগ পাও এমনিতেও। সকালে দিয়ে দেবো যাও।”
“কেন পাই?”
“এইযে তুমি একটু সিক্। অসুস্থ হলে সবাই বেশি বেশি ভালোবাসে, আদর করে দেখো না?”
নিবেদিতা হেসে বলল,
“হুম, সেটাই।”
“এখন যাও জান, ঘুমাও।”
“ঠিক আছে। আপনিও এখনই ঘুমাবেন।”
“হ্যাঁ।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
ফোন রাখার পরও নিবেদিতা অনেকক্ষণ বারান্দায় একা একা বসে রইল।
“কী করছ?”
আচমকা নিবেদিতা ভয় পেয়ে আঁতকে উঠল। সূবর্ণলতা ওকে ছুঁয়ে বলল,
“আমি, আমি! ভয় পেও না।”
নিবেদিতা ধাতস্থ হলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
“আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছি।”
সূবর্ণলতা পাশে বসে বলল,
“সরি।”
“আরেহ্ ব্যাপার না। আপনি ঘুমাননি কেন?”
“ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভেঙে গেছে। আজকের চাঁদটা কত সুন্দর দেখো।”
বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিবেদিতা আকাশের চাঁদ দেখল। আসলেই আজকের চাঁদটা অসম্ভব সুন্দর। সূবর্ণলতা দেখছে নিবেদিতাকে। নিবেদিতা সূবর্ণলতার দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। অপ্রস্তুতবোধ করল নিবেদিতা। চোখ সরিয়ে নিল সে। সূবর্ণলতা স্থির দৃষ্টিতে তখনো তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে হেসে বলল
“তুমি খুব মায়াবী, নিবেদিতা।”
“আর আপনি সুন্দরী।”
“মায়া আর সুন্দরের মাঝে তফাৎ আছে। সৌন্দর্য হারাতে পারে, কিন্তু মায়া কখনো হারায় না।”
“মানুষ কিন্তু সুন্দরের পূজারী।”
“হ্যাঁ, কিন্তু দিনশেষে মানুষ মায়াতেই আটকায়।”
নিবেদিতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসল। সূবর্ণলতা ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
“যেমন তোমার মায়ায় আটকে গেছে আমারও এক প্রিয়জন।”
নিরবতা কাটিয়ে সূবর্ণলতা ডাকল,
“নিবেদিতা?”
“হু?”
“সবকিছু কি চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব?”
নিবেদিতা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“অবশ্যই। না হলে আমরা দেখব কীভাবে?”
সূবর্ণলতা নড়েচড়ে বসে বলল,
“মনের চোখ দিয়ে। এমন কিছু জিনিস থাকে যেগুলো মনের চোখ দিয়ে দেখতে হয়। তোমার আশেপাশেই হয়তো কতকিছু ঘটে কিন্তু তুমি দেখো না, বোঝো না। অবশ্য বাচ্চা মানুষ তো! যাই হোক, ঘুম পাচ্ছে হঠাৎ। ঘুমাব। তুমিও চলে এসো। বেশি রাত জাগা ভালো না। গুড নাইট।”
সূবর্ণলতা উঠে দাঁড়াল চলে যাওয়ার জন্য। নিবেদিতা পেছন থেকে রহস্যজনক হাসি দিয়ে বলল,
“বাচ্চারাও মাঝে মাঝে বাস্তবতা এত বেশি বোঝে যে, কিছু ভালো রক্ষার উদ্দেশে মনের চোখটাকে কালো কাপড়ে বেঁধে রাখে।”
রূপালী চাঁদের আলোয় সূবর্ণলতার সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে স্পষ্ট হলো নিবেদিতার হাসি।
চলবে…
[কপি করা নিষেধ।]