#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ২|
আমি আর এখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কোনো মতে এগিয়ে এসে রুমের মাঝ বরাবর দাঁড়ালাম।
তখনই কুঞ্জ ভাই বললেন, “পা দুটো ম্যাচম্যাচ করছে। টিপে দে!”
আমি বিস্ফোরিত নেত্রে ওঁর দিকে তাকালাম। এতে উনি হাই তুলে বললেন, “এত ভুল যে কীভাবে করিস! তোর ভুলের জন্য তোকে টানা দু’ঘণ্টা পাহারা দিতে হয়েছে, উফফ! পা ব্যাথা করছে। টিপে দে। বরের সেবা করা বউয়ের ধর্ম। কাজে লেগে যা, অকর্মা নবু।”
“এখানে বর কে? বউ কে?”
“তোকে একাদশে ওঠাল কে? তার চাকরি খাব আমি।”
আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তাতে কুঞ্জ ভাই বললেন, “সিরিয়াসলি নবু! তুই লিঙ্গ ভেদ বুঝিস না? কেমনে একাদশে উঠলি?”
“আপনি একদম যা-তা বলবেন না, বলে দিচ্ছি।”
“ফ্রী তে শিক্ষা দিচ্ছি, কিপ্টে মেয়ে, শোন! বর হচ্ছে– পুরুষবাচক শব্দ আর বউ হচ্ছে– স্ত্রীবাচক শব্দ। এখানে বর নামক কচি খোকা আমি আর বউ নামক মহিলাটা হচ্ছিস– তুই।”
“কুঞ্জ ভাই!”
“চোখ রাঙাচ্ছিস কেন? আচ্ছা যা, তুই মহিলা নোস, বাবুর আম্মু। ওকে?”
“দেখুন, কুঞ্জ ভাই! আজেবাজে বকবেন না। মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে।”—কথাটি বলেই আবারও বললাম, “বাই দ্যা ওয়ে! আপনি আমার কোন জন্মের বর?”
কুঞ্জ ভাই বাঁকা হেসে বললেন, “এই জন্মেরই, ভবিষ্যত কালের। ফর এক্সাম্পল– এই যে আজকের এই ভিডিয়োটা আমি গিয়ে ফুপিকে দেখাব। এতে ফুপি তোকে বকতে আসবে। তখন তুই ফুপিকে বলবি,‘আম্মু, কুঞ্জ ভাই এগুলো এডিট করেছেন।’
এরপর প্রশ্ন আসবে, ‘কেন? কুঞ্জর মতো অতিভদ্র ছেলেটা এমন করবে কেন?’
আমরা জানি– গাঁধি ইজ ইক্যুয়াল টু নবনী। সেই সূত্রানুসারে তুই বলবি, ‘তোমাদের কাছে আমাকে খারাপ বানানোর জন্য।’
এতে সবাই আরও ভড়কে যাবে। কেউ কেউ ধরেও নেবে যে, তোর আর আমার মাঝে ইয়ে ইয়ে আছে। মনোমালিন্যের কারণে আমি এসব করছি। আর তোর যা ধুরন্ধর বাপ! ব্যাস! এই রাতেই কাজী ধরে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেবে।
রাতেই তুই আমাকে সালাম করে বলবি, ‘আজ থেকে আপনি আমার পতিপরমেশ্বর।’ তো! হলো না?”
ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল উঁচিয়ে বললাম, “কুঞ্জ ভাই! বেশি হয়ে যাচ্ছে! আমি কিন্তু মণিকে বলে দেব!”
“আমাকে বিয়ে করার এতই তাড়া! আম্মু তো তোকে অলরেডি মনে মনে ছেলের বউ হিসেবে মেনেই নিয়েছে। এখন কি আমার বেডরুমও দখল করতে চাস! এ্যাই! ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন…”
“চুপ! চুপ! চুপ!”
কান দুটো চেপে ধরে একথা বললাম। মণি আর মামা তো যথেষ্ট শালীন! তাদের ঘরে এই নির্লজ্জটা কী করে এলো? নাহ্! এটা আমার মামাতো ভাই হতেই পারে না। নিশ্চয়ই মণি ওঁকে পালতে নিয়ে এসেছে। আমি মনে-প্রাণে এক্ষুনি এই বেলাজটাকে ভাই হিসেবে ত্যাজ্য করলাম। ত্যাজ্য! ত্যাজ্য! ত্যাজ্য! হুঁঃ!
“নবু বেইবি, এসো বেইবি, পা টিপে দিয়ে যাও, বেইবি।”
আমি চোখ রাঙালাম কুঞ্জ ভাইকে। তার আর কিছু বলার আগেই টেবিলের উপর থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা খুললাম।
কুঞ্জ ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কী করতে চাচ্ছিস?”
আমি সেসবে পাত্তা না দিয়ে বক্স থেকে তুলো ছিঁড়ে দু’কানে গুঁজে নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। এখন আর ওঁর এসব কথা শুনতে হবে না। উফফ! কান দুটো পঁচে যাচ্ছিল। কী অশ্লীল!
বিছানায় বসে শান্ত ভঙ্গিতে ওঁর পা টিপতে লাগলাম। মিনিট তিনেক যেতেই কুঞ্জ ভাই আমার কানের তুলো সরিয়ে দিলেন। আমি ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলাম, যার অর্থ– কী হলো এটা?
কুঞ্জ ভাই দু’হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে বললেন, “এভাবেই তুই বুঝিস কম, চিল্লাস বেশি। তার উপর কানে তুলো গুঁজে আরেক ধাপ বেশি বোঝার ধান্দা। আমার ‘বোন’ ডাককে ‘বউ’ শুনে আমার সুইট আম্মুটাকে এত জলদি দাদি বানানোর ফন্দি এটেছিস, না? ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ।”
আমি কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমার নির্বিকার থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ইশ! অসহায়ত্বের উপর যদি কোনো ডিগ্রি থাকত! তবে আমি অবশ্যই পিএইচডি করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করতাম। কিন্তু আফসোস! আমি এই বিষয়েও অসহায়।
হঠাৎ ইচ্ছে হলো এই লোকটাকে একটু জ্বালাতে। এমনি আজ ওঁকে দেখে মেজাজ গরম হয়ে গিয়েছিল আমার। দীর্ঘ তিন মাস পর দেখা দিলেন, আর এসেই শুরু হয়ে গিয়েছে! মানলাম উনি না থাকলে, ওঁকে একটু মিস করেছি। আচ্ছা! একটু না, প্রচুর মিস করেছি। বাড়ি থেকে বেরোলেই চাইতাম, রাস্তায় যেন ওঁর সাথে দেখা হয়ে যায়! আজ হলোও! কিন্তু, দিন দিন এই লোকটা এতটা নির্লজ্জ হয়ে পড়বে, বুঝিনি। বুঝলে কি আর চাইতাম, উনি আসুক?
আমার ভাবনার মাঝেই অবচেতন মন আমায় বলে উঠল, “মিথ্যে বলে নিজেকে একদম সান্ত্বনা দিবি না। তোর কুঞ্জ ভাই আগে থেকেই এমন ছিল।”
আমি এর বিপরীতে আর উত্তর দিতে পারলাম না। সব ভাবনা ছুঁড়ে ফেলে কুঞ্জ ভাইকে জ্বালানোর প্ল্যান কষলাম।
পা টিপতে টিপতেই কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি ফোন ঘাটছেন আর মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমার চাহনি নিজের চোখে স্থির থাকতে দেখে উনি পরপর দু’বার ভ্রু উঁচু করলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে দাঁত কেলালাম। এতে যেন উনি সামান্য ভড়কে গেলেন।
আমি চওড়া হাসি দিয়ে বললাম, “কুউউউঞ্জ ভাইইই!”
“এভাবে তাকাবি না, নবু। তোর মতিগতি ভালো ঠেকছে না।”
আমি প্রশস্ত হাসি দিলাম। উনি আড়চোখে আমাকে দেখে বললেন, “বলে ফেল।”
“বলছি, আপনার গলা ব্যাথা করে না?”
কুঞ্জ ভাই ফোন ঘাটতে ঘাটতে বললেন, “স্বামী হত্যা মহাপাপ। ও চিন্তা বাদ দে।”
আমি কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত থেকে ওঁকে গভীরভাবে অবলোকন করে ডাকলাম, “কুঞ্জ ভাইইই!”
উনি অদ্ভুত ভাবে তাকালেন। মনে মনে হাসছি আমি। ওঁর তাকানোতে বুঝতে পারছি, আমার এই ডাকে উনি বেশ অসন্তুষ্ট।
আমার আবারও ডাকাতে উনি হালকা কেশে বললেন, “বারবার ডাকবি না, নবু। বুকে লাগে।”
আমি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলাম। উনি মনোযোগ অন্যদিকে দিয়ে বললেন, “কী বলবি, বল।”
“আপনাকে দেখলেই না আমার ইয়ে ইয়ে পায়।”
কুঞ্জ ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন, “কী পায়?”
আমি লাজুক হেসে ওঁর একটু কাছ ঘেঁষে বললাম, “ইয়ে মানে, প্রেম পায়।”
অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার পুরো পৃথিবী ঘুরতে লাগল। আল্লাহ! ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? এ্যাই! আমি কথা বলতে পারছি না কেন? আমার ডান গাল অবশ হয়ে আছে। বুক ফেঁটে চিৎকার আসছে আমার। মরে-টরে গেলাম নাকি?
আমার অবচেতন মনের ধ্যান ধারণাকে দূরে ঠেলে কুঞ্জ ভাই বললেন, “গা ঘেঁষিস কেন, নবু? তোর মতলব সুবিধার না রে। আমি বইন পিউর ভার্জিন। আর তুই আমাকে নিয়ে এসব ভাবিস! ছিঃ! নবু, ছিঃ! শ্যেইম অন ইউ।”
এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম, আমার গালটাতে এই বজ্জাতের হাত পড়েছে। মুখশ্রীর ডান অংশটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কী জ্বলছে! এভাবেও কেউ মারে! এত হাত চলে কেন ওঁর? কী বলেছিলাম আমি? সামান্য মজাই তো করেছিলাম! তাই বলে এভাবে মারবেন? এভাবে?
উনিও তো কত আজেবাজে কথা বলেন। আমারও তো ইচ্ছে হয়, ওঁকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। ইশ! আব্বু! আফসোস! আফসোস! এই বংশের মহিলা বিয়ে করে তোমার পুরো লাইফটাই আফসোস!
পিউর বাঙালি জাতির মতো কেঁদে কেঁদে “মা মা” বিলাপ করা শুরু করলাম। কুঞ্জ ভাই খাটে হেলে শুয়ে ছিলাম। আমার আওয়াজ পেয়ে, উঠে ঠিক করে বসলেন।
অস্থির চিত্তে শুধালেন, “নবু, কী হয়েছে?”
যাক! উনি এতক্ষণে একটু সিরিয়াস হলেন। আমার কান্না সার্থক। ওঁর আহ্লাদে আমি ঠোঁট ফুলিয়ে পূর্বের সুরে আরও শব্দ করে কান্না করতে লাগলাম।
কুঞ্জ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা সবাই জানি, তুই একটা ছাগল। প্রুভ করার জন্য কেউ ম্যা ম্যা করতে বলেনি। খিদে পেলে, যা। গিয়ে ঘাস খা।”
আমার কান্না নিমিষেই থেমে গেল। নাহ্! আর একটা মুহূর্তও এখানে থাকব না। আ’ম ড্যাম শিউর, এই লোকটা একটা বদ্ধ উন্মাদ।
চলবে…