#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ১০+১১|
“এখন বল তো, কাহিনি কী?”
চিত্রার প্রশ্নে নৌশি ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “কী আবার হবে! হারামিটাকে কোন পোলায় যেন প্রপোজ করছে, আর সে আমাদের না জানাইয়া ধেইধেই কইরা নাইচা সেলিব্রেশন করতেছে।”
চিত্রা অবাক হলেও তা হজম করে নিয়ে জানতে চাইল, “ঐ ফাটা কপাল কে রে?”
রাহী ননস্টপ মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। সেটা দেখতে পেয়ে নৌশি রাহীকে বাহুতে মেরে জিজ্ঞেস করল, “ঐ তুই দাঁত ক্যালাস ক্যা?”
রাহী হাসতে হাসতেই বলল, “মজা পাচ্ছি, তাই।”
চিত্রা রাগ দেখিয়ে বলল, “হয়েছেটা কী, কেউ আমাকে বলবি?”
রাহী কথা বলল না। চুপচাপ কাহিনি দেখায় মনোযোগী হলো। নৌশি এবার মুখ খুলল, “মেইন কালপ্রিটকে ধর।”
কথা শুনে আমিও রাহীর মতোই খিলখিল করে হেসে দিলাম। নৌশি ও চিত্রা বলার জন্য তাগিদ দিতেই আমি বললাম, “তোরাও সেলিব্রেট কর। খুব জলদি দুলাভাই পাবি।”
নৌশি কিছুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল, তারপর কপাট রাগ দেখিয়ে বলল, “তাহলে কাল সন্ধ্যায় ওরম অবুঝ ভান করতেছিলি কেন? শয়তানে কামড়ায়?”
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম, “হ।”
চিত্রা তার নিজ সত্তায় প্রবেশ করে ফেলেছে। কথা বলার ভাষা হারিয়ে হা করে রইল। আমি যেন কারো প্রপোজাল একসেপ্ট করে গিনিস বুকে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছি, এমন আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল। আচ্ছা! আমি কি প্রেম করতে পারি না? এদের এরূপ ধারণা এলো কোত্থেকে? সবগুলো আশ্চর্য!
নৌশি রাহীকে জিজ্ঞেস করল, “ঐ, রাই! তুই কি চিনোস নাকি ঐ চিকনারে? প্যারা নাই চিল মুডে আছস কেমনে?”
রাহী হাসি থামিয়ে বলল, “প্যারা নেবার টাইম আছে, মাম্মা? ঐ চিকনা যেই হোক না কেন, যেখানেই থাকুক না কেন, আজকের মধ্যেই এক্কেবারে খাল্লাস!”
আমি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোরা ওঁকে চিকনা বলছিস কেন? আজব! সে মোটেও চিকন না।”
রাহী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কেন? তোর মায়া লাগছে? মায়া বাড়াস না কিন্তু।”
নৌশি বিরক্তি ঝেড়ে বলল, “হ্যান্ডু পোলারে শুদ্ধ ভাষায় চিকনা বলা হয়। এগুলাও এখন শিখান লাগব তোরে? ঐ, রাই! তুই কন্টিনিউ কর।”
রাহীকে আমরা ‘রাই’ বলে ডাকি। আর চিত্রাকে ‘চিতি’। নৌশির নাম নৌশিন। আমরা ছোট্ট করে ‘নৌশি’ ডাকি। আর আমাকে সবাই ‘নবু’ ডাকে। সবাই মানে সব্বাই। ফেমাস-শেমাস নাম তো!
রাহী নৌশির সাড়া পেয়ে আবারও বলা শুরু করল, “আরে! আমার রকিং ভাই আছে না? একটা ছেলে নবুর পিছে লেগেছে, তার উপর আবার নবুও পাত্তা দিয়েছে; ভাইয়া কী করবে ভেবেছিস? সোজা হসপিটাল। এইবার বোধহয় বেচারাটা এক মাসের আগে ডিসচার্জ পাবে না। আমার না সত্যিই মায়া লাগছে এবারের বলির পাঠার উপর।”
আমি শব্দ করে হেসে উঠে ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। চিত্রা এবার যেন সংবিৎ ফিরে পেল। সেও আমার হাসির কারণ বুঝতে না পেরে বাকি দু’জনের মতো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
কলেজের করিডোরের উপর ফেলে রাখা অবহেলিত হাইবেঞ্চ দু’টিতে মুখোমুখি বসে ছিলাম আমরা চার বান্ধবী। আমার আর রাহীর অপজিটে চিত্রা ও নৌশি।
হাতের উপর ভর দিয়ে আলগোছে হাইবেঞ্চ থেকে নেমে পড়লাম। হাত দুটো ঝাড়তে ঝাড়তে রাহীর উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারলাম, “ঐ চিকনা কিন্তু তোরই ভাই, রাই।”
আমার মুখ নিঃসৃত এই বাক্যটা যেন সাধারণ কোনো বাক্য ছিল না; অ্যাটম বোম ছিল। মুহূর্তেই কলেজ ক্যাম্পাসের ৩০৮ নং ক্লাসরুমের সামনে ছোটো-খাটো একটা বিস্ফোরণ হয়ে গেল। সবগুলো কেমন চুপ মেরে গেল। কারো মুখে কোনো রা নেই। সবগুলোর মুখ হা হয়ে গেছে।
আমি বাঁকা হেসে বললাম, “ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, চল।”
ওরা নড়ল কী চড়ল না, আমার জানা নেই। আপন মনে গুনগুন করতে করতেই ক্লাসে প্রবেশ করলাম। হয়তো ওদের নিজেকে সামলাতে সময় লাগবে। আমি সোজা গিয়ে লাস্ট বেঞ্চে বসে পড়লাম।
সেকেন্ড বিশেক যেতেই চিত্রা, রাহী, নৌশি দৌড়িয়ে চলে এলো। ওদের দৌড়ানোতে ইতোমধ্যে ক্লাসের সকলের মধ্যমণি হয়ে উঠেছে। তবে সেটা সেকেন্ড পাঁচেকের জন্যই। তারপরই সবাই নিজ নিজ আড্ডায়, খাওয়ায়, পড়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠল।
চিত্রা এসে আমার পাশে বসল, নৌশি ও রাহী আমার সামনের বেঞ্চটিতে আমারই দিকে ঘুরে বসল।
রাহী তড়িৎ গতিতে প্রশ্ন করল, “কেমনে কী, ভাই? ভাইয়া! মানে কাহিনিটা কী হয়েছে?”
নৌশিও তাল মেলাল, “হুঁ, হুঁ। কেমনে কী? জাতি জানতে আগ্রহী।”
চিত্রা তো পারে না কেঁদে দিতে। এমনভাবে বলল, “আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না, দোস্ত। আমি এখনও চুলের জট খুলতে না পারলে কাঁচি দিয়ে কেটে দিই। বলে দে না, জান্টুস!”
আমি মুচকি হেসে বিগত দু’দিনের সব ঘটনা বলে গেলাম, কেবল মাত্র কাল রাতের সেই ঘটনাটা স্কিপ করে। ওটায় আমার মান-ইজ্জত মিশে আছে।
সব শুনে চিত্রা আবারও যেন হতভম্ব হয়ে চুপ মেরে গেল। নৌশি বলল, “বাহ! চমৎকার! তলে তলে এত কিছু! আর এই হারামিটা সব চাইপা গেছে। ও মরে গেলেও তো চল্লিশার দাওয়াত দিব না। পরে কইব, ‘দোস্ত, ভুলে গেছি’। নাহ্! এটা হতে দেওয়া যায় না।”
রাহী আফসোসের সুরে বলল, “আমার দিকেও কেউ তাকা। আমার নাকের নিচ দিয়েই এই কাহিনি হলো! আমারই ভাই, আমারই বোন + বেস্ট ফ্রেন্ড! আর আমি! আমি জানতেই পারলাম না। ইচ্ছে হচ্ছে এই নবুর চুল ছিঁড়তে। কিন্তু টেকো ভাবি পছন্দ না বলে বেঁচে গেল।”
আরও কিছুক্ষণ এই নিয়ে আফসোস বয়ে গেল।
আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের চারজনই আলাদা আলাদা কোয়ালিটি সম্পন্ন। একজন অপরজন থেকে পুরোই ভিন্ন। তবুও কোথাও একটা এক সুতোয় বাঁধা।
রাহী– সবচেয়ে ভদ্র আর ইনোসেন্ট মেয়ে। ক্লাসের টপার সে। ভীষণ ইমোশনালও। অল্পতেই কেঁদে ভাসায়, অভিমান জমায়। তবে রাগটা ভীষণ কম। প্রচুর হাসে সে। সে যেন হাসতেই ভালোবাসে।
নৌশি– একে গুন্ডি বললে ভুল হবে না মোটেও। মারামারি করে প্রচুর। সেবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে টিজ করতে থাকা একটা ছেলেকে নৌশি বেধড়ক মেরেছে। নৌশির নাকি এসব ছেলে দেখলেই মারার জন্য হাত চুলকায়। চেহারার মিষ্টতায় কেউ বুঝবেই না এই মেয়েটা এমন; তবে ভীষণ মিশুকও।
চিত্রা– অতিরিক্ত অবুঝ যেটাকে বলে, তার আরেক নাম খুব সম্ভবত চিত্রা। প্রতিটি ক্লাসে এমন একজন স্টুডেন্ট থাকে, যখন স্যার জিজ্ঞেস করেন, “এটা বুঝতে পেরেছ?”; তখন সেই স্টুডেন্টটি বলে, “না, স্যার”। আর এ’কথার জন্য আবারও পুরো ক্লাসকে ঐ লেকচারটা শুনতে হয়। চিত্রা হচ্ছে সেই একজন। ধৈর্য কম মেয়েটার। সেদিন তো কোচিং-এ স্যারের আসতে পাঁচ মিনিট লেট হয়েছিল বিধায়, ও সেখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আর ওর একটা রোগ আছে। হালকা বিস্ময়েই হা হয়ে যায়। কথা বলতে পারে না। শুধু অন্যের কথা গিলে খায় তখন।
হুট করেই ক্লাসের সবাই দাঁড়িয়ে গেল। কী জন্য দাঁড়িয়েছে, দেখার প্রয়োজন মনে করলাম না। আমরা চারজনও তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলাম, ব্রেক আওয়ার শেষ হয়েছে। স্যার এসেছেন। কিন্তু, এখন তো বায়োলজি সেকেন্ড পেপার ক্লাস!
আমি চিত্রাকে গুঁতো দিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, চিতি! কোন সাবজেক্ট এখন?”
চিত্রাও আমার মতো ফিসফিসিয়ে বলল, “কেমিস্ট্রি সেকেন্ড পেপার। দেখছিস না, পিকে স্যার এসেছেন?”
তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে রুটিনটা চেক করলাম। আমি ভুলে বুধবারের বদলে মঙ্গলবারের রুটিন দেখে এসেছি। এবার? হোমওয়ার্ক আনিনি তো! পানিশমেন্ট ইজ ওয়েটিং ফর ইউ, নবু!
হয়তো চিত্রা আমার ব্যাপারটা বুঝল। সে রাহী আর নৌশির সাথে কথা বলল। তারপর আমাকে চোখ মেরে বাকিটা বোঝাল। ক্লাসের সবাই বসে পড়েছে, কেবল আমরা চারজন দাঁড়িয়ে আছি।
স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
নৌশি তখন বলল, “স্যার, কিছু কথা আছে।”
স্যার তখন বললেন, “ঠিক আছে। সামনে এসো।”
আমরা চারজন বের হয়েই সামনে এলাম। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার? চারজন একসাথে? একজন একজন করে বললেই হবে।”
রাহী তখন ওর ইনোসেন্ট ফেইসে স্যারকে বলল, “স্যার, আমাদের একই সমস্যা। তাই একসাথে এসেছি।”
স্যার বিশ্বাস করলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, “কী সমস্যা, জলদি বলো। আমি হোমওয়ার্ক দেখব।”
এরপর সবার উদ্দেশ্যে আবার বলল, “তোমরা হোমওয়ার্ক বের করে সামনে রাখো। আমি আসছি।”
রাহী দরজার বিপরীত দিকের জানালার দিকে হাত তুলে বলল, “স্যার, ঐ যে! দেখুন। ঐ যে জানালার ওপাশে।”
স্যার সেদিকে তাকাতেই চিত্রা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। স্যার এবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওখানে কী?”
রাহী বলল, “স্যার, দেখুন। ওখানেই একটা বিড়াল।”
স্যার আবার তাকাতেই নৌশি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। ক্লাসের প্রায় সবাই মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। কেউ এ’ব্যাপারে কিছু বলছে না। আসলে বলার সাহস নেই। বললেই নৌশির হাত চলবে, এই ব্যাপারে সবাই অবগত।
স্যার সবার উদ্দেশ্যে বলল, “সাইলেন্ট! সাইলেন্ট!”
এরপর আবারও রাহীকে বলল, “কোথায়? ওখানে তো কোনো বিড়াল নেই।”
রাহী এবার উঁকি দিয়ে বলল, “যাহ, বাবা! চলে গেছে! স্যার, আসলে ওটা বড্ড অদ্ভুত ছিল, বুঝলেন। গায়ে একটা সাদা শার্ট ছিল, কালো প্যান্ট ছিল। প্যান্টটা পেটের অনেক উপরে উঠিয়ে ইন করে পরা। মাথায় কালো চুল ছিল, ঠিক মাথার মাঝখানে টাক ছিল। আপনিই বলুন, বড্ড অদ্ভুত বিড়াল না?”
“অদ্ভুত তো বটেই। ভীষণ অদ্ভুত। আবার দেখলে বোলো।”
স্যারের কথায় আমার এখন পেটফেটে হাসি পাচ্ছে। রাহীর দেওয়া বর্ণনাটা তো আপনারই ছিল, স্যার। স্যার, আপনি বুঝলেন না!
রাহী তখন আবার বলল, “আচ্ছা, স্যার। বলব। স্যার, শুনুন। আমাদের একটু ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন, স্যার।”
স্যার বললেন, “দু’জন যাবে? যে-কোনো একজন যাও।”
আমি মুখ খুললাম, “স্যার! ইট’স ইমারজেন্সি! বলে-কয়ে তো আসে না। এখন একসাথে এলে কী করব? স্যার, যাই?”
“ওকে, ওকে। যাও।” —স্যার কথাটা বলেই আবারও ভ্রু- কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা না চারজন ছিলে? বাকি দুটো গেল কই?”
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম, “স্যার! ওরা তো পেছনে গিয়ে বসেছে। একসাথে এত জন থাকার কোনো মানে হয়! স্যার, যাই তবে আমরা।”
“যাও যাও।”
আমি আর রাহী সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। স্যারের চোখের আড়াল হয়েও অট্টহাসিতে মেতে উঠলাম দু’জন। স্যারের নাম হচ্ছে পিযুষ কান্তি মল্লিক। আমরা সংক্ষেপে, স্যারের অগোচরে ওঁকে ‘পিকে স্যার’ নামেই সম্বোধন করে থাকি। অবশ্য নামটা ওঁর সাথে যায়। একেবারে সেই রকমেরই স্যার। এরপর চারজন মিলে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরতে লাগলাম। আহা! শান্তি!
_______________
কলেজ থেকে ফিরে বাসায় আসতেই চমকে গেলাম। চমকের দরুণ আমি স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বসার ঘরের সোফায় খালামণি বসে আছে। এটার মানে কী? খালামণি কখন এলো?
আমাকে আসতে দেখেই মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ, নবনী?”
আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে খালামণিকে জড়িয়ে ধরে বলি, “ভীষণ ভীষণ ভালো। তুমি?”
“আমিও ভালো।”
“কখন এসেছ? আর নীতি! ও কোথায়? ওকে নিয়ে আসোনি?”
“এনেছি, এনেছি। তোমার রুমেই আছে। গিয়ে দ্যাখো।”
আমি দ্রুত পা চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। নীতি আমাকে দেখিয়েই মুচকি হেসে এগিয়ে এলো। আমি কাঁধের ব্যাগটা ফেলে রেখেই ওকে জড়িয়ে ধরলাম। জড়িয়ে ধরেই নীতিকে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা সারপ্রাইজ? আমি সত্যিই ভীষণ সারপ্রাইজড হয়েছি। তিন সত্যি।”
নীতি হেসে বলল, “এটা ছোটো সারপ্রাইজ, বুবু। বড়োটা বাকি আছে।”
আমি নীতিকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, “আর কী?”
নীতি হেসে বলল, “পরে বলব। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো তো।”
ফ্রেশ হয়ে মিনিট দশেক পর নীতিকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম, “এবার তো বল।”
নীতি শুধু হেসে গেল। আমি আর শোনার জন্য তাগিদ দিলাম না। বিছানার উপর বসে আড্ডা দিতে লাগলাম। নীতি আমার একমাত্র খালার একমাত্র মেয়ে; ক্লাস নাইনে পড়ে। বেস্ট ফ্রেন্ডও বলা চলে। বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ ভীষণ আপন হয়ে যায়, না? নীতি হচ্ছে তেমনই।
আড্ডা দিতে দিতে নীতিকে কুঞ্জ ভাইয়ের ব্যাপারটাও বলে দিলাম। নীতি খুব একটা অবাক হয়নি। পুরোটা বলার পর, ও শুধু বলেছে, “ওহ্ আচ্ছা!”
ওর এই একটা কথা আমার মেজাজ খারাপ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। আচ্ছা! এটা কি কোনো শকিং নিউজ ছিল না?
নীতির কাছে জানলাম, কুঞ্জ ভাই বাসায়ই আছেন, তার রুমেই। নীতির সাথে কথা শেষে সেদিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই ও বলল, “এখনই ভাইয়াকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারো না। বিয়ের পর তো মনে হয় রুম থেকেই বেরোবে না।”
আমি ওকে একটা ধমক দিতে গিয়েও দিলাম না। মেয়েটা সবেই এসেছে। কিছু বলাও যাবে না। দু’দিন থাকুক, এরপর এর শাস্তি দেব। আপাতত মনে রাখলাম এটা।
এখনকার মতো ওকে একটা কড়া চাহনি দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।
__________
দরজা নক করতেই ভেতর থেকে কুঞ্জ ভাই বললেন, “হুম, নীতি। এসো।”
দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। এত সুন্দর করে তো আমাকে ডাকেন না! সমস্যা কী ওঁর? আমি কি মানুষ না? একটু সুন্দর করে আমাকে ডাকলেও তো পারেন। রাগ হচ্ছে। অস্বাভাবিক হারে রাগ লাগছে আমার।
কুঞ্জ ভাই আমাকে দেখে বললেন, “বাইরে যা।”
আমি গেলাম না। ভেতরে গিয়ে কুঞ্জ ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম, “যাব না।”
কুঞ্জ ভাই আমার দিকে দু’কদম এগিয়ে এসে বললেন, “বের হ সামনে থেকে।”
আমিও আরও এক কদম এগিয়ে বললাম, “কক্ষনো না।”
কুঞ্জ ভাই ডান হাত উঁচু করে দরজার দিকে ইশারা করে বললেন, “থাপ্পড় খেতে না চাইলে বের হ।”
এবার কুঞ্জ ভাইয়ের হাত দেখলাম। ব্যান্ডেজ করা হাত। সকালে যেভাবে মুখ চেপে ধরেছিলেন, উপায়ন্তর না পেয়ে কামড়ে দিয়েছিলাম আমি। কামড়ের জোর এতটাই বেশি হয় গিয়েছিল যে, বাকিটা এখন সামনেই দেখা যাচ্ছে; ব্যান্ডেজ করা লেগেছে।
আমি সেদিকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বললাম, “আমাকে মারবেন?”
কুঞ্জ ভাই মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে বলল, “অবশ্যই।”
আমি কুঞ্জ ভাইয়ের আরও কাছে চলে এলাম। মাঝে হয়তো দুই ইঞ্চির দূরত্ব! ছলছল চোখে কুঞ্জ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বড্ড কোমল স্বরে বললাম, “পারবেন আমাকে মারতে?”
কুঞ্জ ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই দূরে সরে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “কী বলবি, জলদি বল। আমার হাতে সময় নেই। কিছুক্ষণ বাদেই চলে যাব।”
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “কোথায় যাবেন?”
কুঞ্জ ভাই যেন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “ভার্সিটিতে।”
আমি আরও কিছুটা অবাক হলাম। বেশ জোরে-সোরেই প্রশ্ন করলাম, “আজই!”
“হুম।”
“আপনি যাবেন না।”
আমার কথায় কুঞ্জ ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”
রাগ হচ্ছে আমার। একদম অকারণেই রাগছি। রাগী স্বরে বললাম, “আমি বলেছি, তাই। যাবেন না আপনি।”
কুঞ্জ ভাই কিছুক্ষণ অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর হেসে দিলেন। আমি রাগছি আর উনি হাসছেন! নাহ্! এ যে ভারি অন্যায়! কেন হাসবেন? এবার তো আমার কান্না পেয়ে গেল।
কুঞ্জ ভাই তখন বললেন, “পড়াশোনা ছেড়ে দেব? হুঁ?”
“না।”
“তবে? যাব না?”
“আমার ভালো লাগছে না। যাবেন না আপনি।”
কুঞ্জ ভাই এবার শান্ত হয়ে আমাকে নিয়ে বিছানায় বসালেন। এরপর নিজে হাঁটু মুড়ে আমার সামনে বসে আমার দু’হাত নিজে হাতের মুঠোতে নিয়ে বললেন, “হঠাৎ মন খারাপ হলো কেন?”
আমার কান্না পাচ্ছে। তবুও কান্না গিলে নিলাম। ভেজা স্বরে বললাম, “জানি না।”
কুঞ্জ ভাই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি মাথা নিচু করে ধরে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। ওঁর দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি, উনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর কুঞ্জ ভাই বলে উঠলেন, “এই শহরেই তো আছি। যখন দেখতে ইচ্ছে হবে, কল দিবি; চলে আসব আমি।”
আমি মিনমিনে কণ্ঠে বললাম, “আপনাকে কল দিলে আপনি রিসিভ করেন না।”
কুঞ্জ ভাই হাসলেন, “এবার থেকে করব।”
আমি তবুও মলিন মুখে তাকিয়ে রইলাম। কুঞ্জ ভাই একহাত আমার গালে রেখে আমার মুখটা উপরে তুললেন। আমি ওঁর দিকে তাকাতেই উনি মুচকি হেসে বললেন, “সাবধানে থাকবি। ঠিকমতো পড়াশোনা করবি। ফুপিকে বেশি জ্বালাবি না। রাস্তায় এদিক-ওদিক যাবি না। সোজা বাসা-কলেজ-কোচিং। মনে থাকবে?”
“আমি খুব খারাপ, না? সবসময় উলটা-পালটা কাজ করি, সবাইকে ডিস্টার্ব করি। হুঁ?”
“কে বলেছে? আমার নবনী ভীষণ ভালো মেয়ে। সবার খেয়াল রাখে; শুধু নিজের বাদে। নিজের খেয়াল রাখিস, আর তো কিছু সময় মাত্র। তারপর…”
“তারপর কী?”
“কিছু না। নিজের খেয়াল রাখবি তো?”
“হুম, রাখব।”
“এই তো! গুড গার্ল।”
অতঃপর আবারও বেশ কিছুক্ষণ-এর নিরবতা। কুঞ্জ ভাই চুপিসারে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। হয়তো দেখে যাচ্ছেন দু’চোখ ভরে; আবার কবে দেখা হবে, তা তো একদমই অজানা।
আমি এবার আমার গালের উপর রাখা কুঞ্জ ভাইয়ের হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললাম, “আবার কবে দেখা হবে?”
“বললাম তো। যখন ডাকবে, তখনই।”
আমি অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে রইলাম। তাঁর ব্যবহারের এই মিষ্টতা আমার অন্তরআত্মা কাঁপিয়ে তুলছে। উনি কী বুঝতে পারছেন না?
চলবে…