নিবেদিতা #পর্ব_২৬ #মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

0
4

#নিবেদিতা
#পর্ব_২৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
নিবেদিতা তুবার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। বউ সাজে কী সুন্দর লাগছে ওকে! তুবার সাজা হয়ে গেলে নিবেদিতাকে জিজ্ঞেস করল,

“আমাকে কেমন লাগছে বল তো?”

নিবেদিতা তুবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“অসম্ভব সুন্দর! ভাইয়া আজ তোর দিক থেকে চোখই ফেরাতে পারবে না দেখিস।”

“যেভাবে নির্ণয় ভাইয়া তোর দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না সেভাবে?”

নিবেদিতা হকচকিয়ে গিয়ে তুবার মুখ চেপে ধরল। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,

“চুপ, চুপ! কী বলিস এসব?”

তুবা নিবেদিতার হাত সরিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,

“আমার লিপস্টিক!”

“কিচ্ছু হয়নি তোর লিপস্টিকের। ঠিক আছে।”

আয়নায় নিজেকে দেখে তুবা বলল,

“হু, ঠিক আছে। শোন, তুই আর নির্ণয় ভাইয়া যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস আমি সেটা জানি।”

“তুই কীভাবে জানিস?”

“ঠিক জানি বললে ভুল বলা হবে। বুঝি আরকি! তোরা ডেনমার্ক থেকে আসার পর থেকেই সব লক্ষ করছি। তাছাড়া ভাইয়া হঠাৎ করে ডেনমার্কেই কেন গেল সেটাও এখন বুঝতে পেরেছি। এখন বল আমার ধারণা ঠিক নাকি ভুল?

নিবেদিতা রয়েসয়ে বলল,

“ঠিক। কিন্তু এসব এখনই কাউকে বলিস না প্লিজ!”

“ওমা কেন? তোরা বিয়ে করবি কবে?”

“করব সময় হলেই। সে আগে বাসায় কথা বলুক। ততদিন পর্যন্ত তুই তোর মুখটা বন্ধ রাখিস।”

“না চাইলেও মুখ বন্ধ রাখতে হবে আপাতত। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তো আর বকবক করতে পারব না।”

নয়ন তখন ফোন দিয়ে তাড়া দিল তাড়াতাড়ি বের হওয়ার জন্য। সবার তৈরি হওয়া শেষ তাই আর সময় নষ্ট না করো বেরিয়ে পড়ল। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছানোর পর সবাই তুবাকে দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ভিড়ের মাঝে হাতে মৃদু চাপ পড়তেই নিবেদিতা চমকে তাকাল। দেখল তার পাশেই নির্ণয় দাঁড়িয়ে আছে। নিবেদিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়ুন।”

নির্ণয় দৃষ্টি সামনে রেখেই বলল,

“আমার মানুষের হাত আমি ধরব না তো কে ধরবে?”

“তাই বলে এখানে?”

“পুরো পৃথিবীর সামনেও ধরব।”

তুবার ডাক পড়ল তখন। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও নিবেদিতার হাত ছেড়ে দিল নির্ণয়। বর আসার আগ পর্যন্ত ফটোগ্রাফার সবার ছবি তুলছিল। কিছুক্ষণ পর সবার হৈ-হুল্লোড়ে জানা গেল বর আসছে। মেয়েরা সবাই মিলে গেইট ধরেছে। বরপক্ষের সাথে কনেপক্ষের টাকা নিয়ে তুমুল দর কষাকষি হচ্ছে। বরের বন্ধুরা কনের বোন ও বান্ধবীদের সাথে রসিকতা করতে ভুলল না। সব কিছুই দূর থেকে দেখছিল নির্ণয়। বিষয়টা তার ভালো লাগেনি মোটেও। পল এসব কিছু বুঝতে পারছে না। সে সরল মনে নির্ণয়কে জিজ্ঞেস করল,

“ব্রো, ওরা ঝগড়া করছে কেন?”

নির্ণয়ের এমনিতেই মেজাজ খারাপ। তার ওপর পলের প্রশ্ন শুনে আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই ছেলেও তো নিবেদিতা বলতে অজ্ঞান একদম! সে কঠিন ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। রাগ হজম করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

“আমি জানিনা, ব্রো।”

এরপর সে প্রস্থান করল। পল ঠোঁট উলটে তাকাল মিদহাদের দিকে। নির্ণয়ের রাগ পল না বুঝলেও সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। অবশ্য সত্যি বলতে, তার নিজেরও কেমন যেন বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে। কে যে এইসব গেইট ধরার নিয়ম বের করেছিল কে জানে!

তুবার বিদায়ের আগ পর্যন্ত নিজেকে নিবেদিতার থেকে একদম গুটিয়ে রাখল নির্ণয়। সারাক্ষণ মেহমানদের আপ্যায়ন করা নিয়েই ব্যস্ত থাকল। নিবেদিতা যেচে কথা বলতে গেলেও ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিল নির্ণয়। নিবেদিতাও আর ঘাটায়নি নির্ণয়কে। সে ভেবে নিয়েছে নির্ণয় আসলেই ব্যস্ত। এজন্য নির্ণয়ের আরো মেজাজ খারাপ হলো। মেয়েটা এত বোকা কেন? কোনটা রাগ আর কোনটা ব্যস্ততা এইটুকুও কেন বোঝেনা?

তুবার বিদায়বেলায় সবাই উপস্থিত। বাচ্চাদের মতো কাঁদছে তুবা। নির্ণয় এমনিতে শক্ত মনের মানুষ। কারো কান্না তাকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু তুবা যখন নিবেদিতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল এবং নিবেদিতাও কান্না শুরু করল তখন নির্ণয়ের মনটা কেমন জানি করে উঠল। অস্থির লাগা শুরু করেছে তার। সারাদিনের সব রাগ গলে পানি হয়ে গেছে। ইচ্ছে করছে এখন মেয়েটাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে।

তুবাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েও নিবেদিতা কাঁদছিল। নয়ন তখন বোনকে জড়িয়ে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। পুরো কমিউনিটি সেন্টার যেন হঠাৎ করেই গুমোট হয়ে গেল। নিস্তব্ধতায় ভরে গেল চারদিক। শুধু তুবার কাছের মানুষদের কান্নার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বাড়িতে ফিরেও সবাই একদম চুপ হয়ে গেল। কেউ খাচ্ছেও না ঠিক মতো। নিবেদিতার এসব দেখে আরো বেশি মন খারাপ হয়ে গেল। তার বিয়ে হয়ে গেলে তখন ওর বাবা-মা’ও কি এমন মনম’রা হয়ে থাকবে? অবশ্য বিয়ে না হলেও এখনো তো থাকেই। তুবা তো তাও এখন দেশে আছে। কিন্তু নিবেদিতা তো পরিবার ছেড়ে খুব দূরে।

নিবেদিতার ম্যাসেজটোন বেজে উঠল। নির্ণয়ের ম্যাসেজ,

“ছাদে আসো।”

নিবেদিতা লুকিয়ে ছাদে চলে গেল। নির্ণয় তখন ছাদে পায়চারি করছিল। নিবেদিতাকে দেখেই এগিয়ে এলো সে। জিজ্ঞেস করল,

“মন খারাপ?”

নিবেদিতা উপর-নিচ মাথা দুলিয়ে বলল,

“একটু।”

“তোমায় একটু জড়িয়ে ধরি?”

নিবেদিতা এবার চোখ তুলে তাকাল নির্ণয়ের দিকে। কোনো জবাব দিল না। বরং সে নিজেই নির্ণয়কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। নির্ণয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কাঁদছ কেন?”

“আমার মনটা কেমন জানি করছে! কেন আমি বাবা-মাকে রেখে দেশের বাইরে চলে গেলাম বলেন তো?”

নির্ণয় অপরাধীর মতো করে বলল,

“আমার জন্য! এখানে আমারই দোষ।”

“আপনার কোনো দোষ নেই। আপনি তো আর আমাকে যেতে বলেননি। তুবার বিয়ে হয়ে গেছে দেখে সবার কত মন খারাপ দেখেছেন? আমি যখন না থাকি তখন তো আমার বাবা-মায়েরও খুব মন খারাপ থাকে তাই না?”

“এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার, চাঁদ। কদিন পরই ঠিক হয়ে যাবে সব।”

নিবেদিতা ছোটো করে বলল,

“হু।”

“একটা কথা বলি?”

“বলেন।”

“আমি ছাড়া অন্য কোথাও, অন্য কারো সাথে তোমায় খুশি দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয় নিবেদিতা। আমি জানি এটা খুব জেলাসি টাইপ কথা। কিন্তু, সত্যিই আমার খুব কষ্ট হয়। আজ যখন বরপক্ষের ছেলেগুলোর সাথে হেসে কথা বলছিলে তখনো আমার খুব কষ্ট লেগেছিল।”

নিবেদিতা বিস্মিত হয়ে বলল,

“এজন্য আজ সারাদিন ব্যস্ত থেকেছেন?”

“হু।”

“আপনি তো দেখছি ভীষণ হিংসুটে।”

“সবার জন্য নয়। শুধু তোমার ক্ষেত্রেই।”

নিবেদিতা নির্ণয়কে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

“ঠিক আছে। আপনি কষ্ট পান এরকম কোনো কিছু আমি আর কখনো করব না।”

“না, আমি তোমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তোমার যা ভালো লাগে তুমি করবে। আমি এডজাস্ট করে নেব।”

“যেসবে আপনি কষ্ট পান, সেসব ভালো এবং স্বাধীনতা আমি চাই না।”

“ভালোবাসো খুব?”

“ভীষণ!”

“এত কেন ভালোবাসো?”

“তা তো জানিনা। শুধু জানি অনেক বেশিই ভালোবাসি আমি আপনাকে।”

নির্ণয় আলতো করে চুমু খেল নিবেদিতার মাথায়। নিজের সাথে আলিঙ্গন বদ্ধ করে রাখল নিজের প্রেয়সীকে।
.
.
তুবার বউভাতে গিয়ে নিবেদিতা যতটা পারল নিজেকে রাদিনের বন্ধু-বান্ধব, কাজিনদের থেকে গুটিয়ে রাখল। যতটুকু কথা না বললেই নয় শুধু ততটুকুই বলেছে। তবে কথা বাড়াতে দেয়নি। দূর থেকে এসব লক্ষ করে মনে মনে হাসছে নির্ণয়। একবার সুযোগ পেয়ে বলে গেছে,

“কষ্ট পাই বলে একেবারে সবাইকে এড়িয়ে চলো না আবার। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দিও।”

নিবেদিতা জবাবে মাথা নাড়িয়েছে। সে এখন একটা টেবিল দখল করে একাই বসে আছে। একটুপর সবাই তুবা ও রাদিনকে নিয়ে যাবে। সূবর্ণলতা এসে বসল নিবেদিতার সাথে। জিজ্ঞেস করল,

“তোমার কি মন খারাপ?”

নিবেদিতা বলল,

“কই না তো! কেন?”

“একা বসে আছো তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“ওহ।”

“তুমি ডেনমার্কে ফিরবে কবে?”

“সামনের উইকে।”

“ওহ তাহলে তো সময় আছে। আমরা কাল ফিরে যাচ্ছি লন্ডনে।”

“এত তাড়াতাড়ি?”

সূবর্ণলতা হেসে বলল,

“মৌটুসীর ভাইয়ের যে কাজ আছে তাই।”

“ওহ আচ্ছা। মিস করব আপনাদের।”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

“আমিও মিস করব তোমাদের সবাইকে। বিশেষ করে তোমাকে।”

নিবেদিতা হেসে ফেলল। বলল,

“কেন?”

“কারণ তুমি বিশেষ কেউ।”

নিবেদিতা কথার অর্থ বুঝতে পেরে আর কথা বাড়াল না এই প্রসঙ্গে। শুধু বলল,

“আমাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববেন না দয়া করে।”

সূবর্ণলতা ভ্রু কুঁচকে বলল,

“মানে?”

নিবেদিতার দৃষ্টি ফ্লোরে। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা। সূবর্ণলতা যে মিদহাদকে পছন্দ করে কিংবা ভালোবাসে এটা সে খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু সে যে অযথা ওকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে মনের অজান্তেই এটাই নিবেদিতার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। সে জবাব দেওয়ার পূর্বেই মিদহাদ সেখানে চলে এলো। নিবেদিতার উদ্দেশে বলল,

“প্রাণ, তোমাকে তুবা ডাকছে।”

নিবেদিতা তখন উঠে চলে গেল। মিদহাদ বসল পাশের চেয়ারে। সূবর্ণলতা বিস্মিত হয়ে বলল,

“প্রাণ! আপনি ওকে প্রাণ ডাকেন?”

মিদহাদ এ কথার জবাব দিল না। উলটো বলল,

“কেন ওকে ঘাঁটাচ্ছেন?”

“ওকে ঘাঁটাচ্ছি মানে?”

“মানেটা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। আমার কেন জানিনা মনে হয়, আপনি ওকে হিংসা করেন।”

“আপনার এরকমটা কেন মনে হলো?”

“কারণ আপনাকে যখনই আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে দেখি, তখনই দেখি আপনার মুখের এক্সপ্রেশন একদম অন্যরকম থাকে।”

সূবর্ণলতা চুপ করে আছে। মিদহাদ উঠে দাঁড়াল। চলে যাওয়ার পূর্বে বলল,

“দয়া করে প্রাণ হার্ট হয় এমন কিছু বলবেন না।”

সূবর্ণলতা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিদহাদের দিকে। হঠাৎ করেই তার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। খুব কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু কেন? সে কি সত্যিই নিবেদিতাকে হিংসা করে? সত্যিই?

_______

সূর্য উদিত হওয়ার সময়টা অসম্ভব সুন্দর। আকাশে দিগন্তের ছোঁয়া। পাখিদের উড়ে চলা। সকালের শান্ত, স্নিগ্ধ বাতাস মনে ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে আসে। বাড়ির সবাই আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। মিদহাদরা আজ চলে যাবে লন্ডন। নির্ণয়রাও ঢাকায় ফিরে যাবে। তাই সকাল সকাল উঠে রান্নাবান্নার আয়োজন করছে সবাই। ভোর পেরিয়ে সকাল হলে সবাই একসাথে আজ নাস্তা করতে বসেছে। নতুন বউ ও নতুন জামাই থাকায় আজকের নাস্তার আড্ডা জমে উঠেছে। কিন্তু নিবেদিতার ভীষণ মন খারাপ লাগছিল। নির্ণয়কে আজই কেন চলে যেতে হবে? আর ক’টা দিন থেকে গেলে কী এমন হতো?

নিবেদিতার মন খারাপ দৃষ্টি এড়াল না নির্ণয়ের। সে সবার আগে খাওয়া শেষ করে নিবেদিতার রুমে গেল। নিবেদিতা তখন মন খারাপ করে বিছানায় বসে ছিল। নির্ণয়কে দেখে সে ভয় পেয়ে বলল,

“আপনি এখানে!”

“তুমি খাবার শেষ না করেই চলে এসেছ কেন?”

“ক্ষুধা নেই তাই।”

“মন খারাপ?”

“হলেও বা? আপনার কী তাতে?”

“বুকে আসো।”

“আদিখ্যেতা করবেন না একদম।”

নির্ণয় হেসে ফেলল। জোর করেই জড়িয়ে ধরল নিবেদিতাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“চলে যাচ্ছি এটা দেখছ। আর কেন যাচ্ছি সেটা বুঝতে পারছ না?”

নিবেদিতা অভিমানী কণ্ঠে বলল,

“না, পারছি না।”

“তোমার এবং আমার বিয়ের কথা বলতে। এখানে তো আর এসব কথা বলা যাবে না। বাড়িতে ফিরে বাবা-মাকে সব বলব। তারপর মা তোমার বাসায় জানাবে। যাতে করে ডেনমার্কে ফিরে যাওয়ার আগেই বিয়েটা করে ফেলতে পারি এজন্য আজই চলে যাচ্ছি। আমাদের হাতেও তো খুব একটা সময় নেই, জান।”

এবার মন ভালো হয়ে গেল নিবেদিতার। নির্ণয় বলল,

“তোমাকে বউ সাজে দেখার জন্য কত কষ্ট করে অপেক্ষা করে আছি তা তো জানো না।”

নিবেদিতা নির্ণয়কে ছেড়ে দিয়ে বললে,

“জানতে হবে না। এখন আপনি যান। কেউ এসে দেখলে সমস্যা হবে।”

“হুম, ঠিক বলেছ। তার আগে বলো এখন তো আর মন খারাপ নেই?”

নিবেদিতা হেসে দুদিকে মাথা নাড়াল। নির্ণয়ও হেসে নিবেদিতার মাথায় হাত রাখল। তারপর বলল,

“যাচ্ছি।”

“যান।”

দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এলো নির্ণয়। নিবেদিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কতক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে আচমকা নিবেদিতার ঠোঁটে গাঢ় চুমু খেল নির্ণয়। নিবেদিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নির্ণয় আবার চলে গেল। কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল নিবেদিতা। কী হলো কিছুই যেন বুঝতে পারল না সে। পরক্ষণে দৃশ্যটা চোখে ভাসতেই লজ্জা রাঙা হয়ে উঠল তার মুখখানা।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হলে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে সবাই বের হলো চলে যাওয়ার জন্য। মিদহাদ বারবার নিবেদিতার দিকে তাকাচ্ছিল, যেন কত কিছুই তার বলার আছে। কিন্তু অদৃশ্য একটা দেয়াল থাকায় সে কিছুই বলতে পারছে না। শুধু যাওয়ার পূর্বে মনে মনে বলে গেল,

“ভালো থেকো, প্রাণ। সবসময় খুব বেশিই ভালো থেকো। তোমার সুখে কারো নজর না লাগুক। তোমার ঠোঁটে সুন্দর হাসি সর্বদা বজায় থাকুক।”

হঠাৎ সূবর্ণলতা এসে নিবেদিতাকে জড়িয়ে ধরল। ফিসফিস করে বলল,

“আমি তোমায় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবি না, নিবেদিতা। তুমি ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার কোনো আচরণে কিংবা কথায় যদি কষ্ট পেয়ে থাকো তাহলে ক্ষমা করে দিও।”

নিবেদিতা বলল,

“ছি! এসব বলবেন না। আপনি আমার বড়ো আপুর মতো। আমি দোয়া করি, আপনার মনের আশা পূরণ হোক।”

সূবর্ণলতা নিবেদিতার গাল ছুঁয়ে মৃদু হাসল। মনে মনে বলল,

“এজন্যই হয়তো মিদহাদ তোমায় এতটা ভালোবাসে!”

নিবেদিতা দূর থেকে নির্ণয়কে বিদায় জানাল। নিবেদিতার বিষাদিত মুখটা সকলের দৃষ্টি আড়ালে মন ভরে দেখে নিল মিদহাদ। তার এই তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি বুকে ব্যথার সৃষ্টির উদয় করল সূবর্ণলতা। হায়রে ভালোবাসা! কী নিদারুণ চক্রাকার!
.

নিবেদিতার একই সাথে কষ্ট হচ্ছিল আবার খুশিও লাগছিল। ওদের বিয়েটাও হয়তো এবার খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ওরা চলে যাওয়ার পর নিবেদিতা, সাবিহা, পল, তুবা ও রাদিন মিলে গল্প করছিল। কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ওদের। ঠিক করা হলো দুপুরের লাঞ্চ ওরা কোনো রিসোর্টে গিয়েই করবে। সাথে ঘোরাও হয়ে যাবে। তাই সবাই কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে রেডি হতে চলে গেল। রেডি হয়ে বের হওয়ার পূর্বে নিবেদিতা নির্ণয়কে টেক্সট করে আপডেট জানিয়ে দিল। নির্ণয়ও রিপ্লাই করে বলল,

“সাবধানে যেও। আমি বাবা-মাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে এখন ওদের সাথে এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। তারপর নয়নকে নিয়ে বাড়িতে ফিরব।”

নিবেদিতা রিপ্লাই করল,

“আপনিও সাবধানে যাবেন। ভালোবাসি।”

“ভালোবাসি, চাঁদ।”

নিবেদিতা রেডি হয়ে তুবাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। ওদের গ্রামেই নতুন একটা রিসোর্ট হয়েছে। এখনো যাওয়া হয়নি। গুগল ঘেটে দেখেছে জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। সুইমিং পুলে সবাই সুইমিং করবে বলে আলাদা জামা-কাপড় নিয়ে নিয়েছে। বাড়ি থেকে রিসোর্টের দূরত্ব মাত্র বিশ মিনিট। তাই যেতে সময় লাগল না। তাছাড়া গ্রামের রাস্তা তাই জ্যামও নেই।

রিসোর্টে পৌঁছে ওরা হালকা নাস্তা করে লাঞ্চে কে কী খাবে অর্ডার দিয়ে সুইমিংপুলে গেল সুইমিং করার জন্য। রাদিন এবং পল ওদেরকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে। ফোন সুইমিংপুলের একপাশে রেখে তুবা, সাবিহা ও নিবেদিতা পানিতে নেমেছে। তাই নিবেদিতার ফোন যে অনবরত বেজে চলেছে সেদিকে খেয়ালই নেই কারো। রাদিন তখন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল,

“সবাই তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলো।”

তুবা অবাক হয়ে বলল,

“আরে কেন? কী হয়েছে?”

“নয়ন ভাইয়া আর নির্ণয় ভাইয়া এক্সি’ডেন্ট করেছে।”

এ কথা শুনে নিবেদিতা শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়েছে। সে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধরলে তড়িঘড়ি করে তুবা এবং সাবিহা নিবেদিতাকে ধরে ফেলল। নিবেদিতা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। ওরা দুজনে মিলেও নিবেদিতাকে সামলাতে পারছিল না। শেষে রাদিন পানিতে নেমে নিবেদিতাকে উঠিয়ে আনলো এবং শান্ত করতে বলল,

“কেঁদো না। কিছু হয়নি ওদের।”

নিবেদিতার অবুঝ মন সেসব মানতে নারাজ। মাথায় মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে বারি দিচ্ছে। কেমন দপদপ করছে মাথার ভেতরটা। দুজন কাছের মানুষের এই দুর্ঘটনা সে মানতেই পারছে না।

চলবে…

[কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here