নিবেদিতা #পর্ব_২৮ #মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

0
5

#নিবেদিতা
#পর্ব_২৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
নিবেদিতার পরনে বেবি পিংক কালার একটা গাউন। চুলগুলো পিঠজুড়ে ছড়িয়ে রাখা। পেলব ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক। সেই সাথে ঠোঁটে মিশে আছে একটা মিষ্টি হাসি। নির্ণয় অনেকক্ষণ যাবৎ নিবেদিতার এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে মুখটা। মনে হচ্ছে চোখদুটোও যেন হাসছে। কী মিষ্টি লাগছে! এই ছবিতে নিবেদিতাকে আরো পিচ্চি পিচ্চি লাগছে। নির্ণয় মৃদু হাসল। ফোনটা কাছে এনে স্ক্রিনে নিবেদিতার ছবিতে চুমু খেল। ছবিতে হাত বুলিয়ে স্বগতোক্তি করে বলল,

“মিস ইউ, নিবেদিতা।”

নির্ণয়ের বুক থেকে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এখনো সে একা একা চলাচল করতে পারে না। মায়ের সাহায্য দরকার হয়। সারাটা দিন রুমে বন্দি হয়ে থাকতে তার খুব বিরক্ত লাগে। সময় কাটে না। মাঝে মাঝে নিবেদিতার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কল করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে জানে, নিবেদিতা সেখানে কত ব্যস্ত সময় কাটায়। তার মতো অবসর মেয়েটার নেই। চাইলেই ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলারও সুযোগ নেই। কিন্তু তবুও কি নিবেদিতা তার জন্য কম করছে? প্রতিদিন মেয়েটা সকালে ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে সেদিনের একটা করে তোলা নতুন ছবি এবং ভয়েস ম্যাসেজ দেয়। সেখানে অনেক নিয়ম-নিষেধ মেনে চলতে বলা হয়। আর সবশেষে বলে ‘ভালোবাসি’। এই ভালোবাসি কথাটা শোনার জন্যই পুরো ভয়েস ম্যাসেজটা নির্ণয় মনোযোগ দিয়ে শোনে। ঘুম থেকে উঠে সে সবার আগে তাই ফোন চেইক করে। নিবেদিতার ছবি দেখে, কণ্ঠ শোনে। মনে হয় দূূরে থেকেও কত কাছে! এছাড়া সময় পেলেই কখনো নিবেদিতা কল করে তো, কখনো আবার ম্যাসেজ করে। বাসায় ফিরে রান্না করতে করতে কিংবা পড়ার সময়ও নির্ণয়কে ভিডিয়ো কলে রাখে। পড়ার সময় নির্ণয় কোনো কথা বলে না। শুধু নিশ্চুপ হয়ে ক্লান্ত নিবেদিতাকে দেখে। সবকিছু কত সুন্দর করে মেয়েটা সামলায় ভেবেই অবাক হয় সে। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে খুব অস্বস্তি হয় তার। নিজেকে নিবেদিতার যোগ্য মনে হয় না এখন আর। মাঝে মাঝে তার এটাও মনে হয় যে, সে হয়তো নিবেদিতার জীবনটাকে নষ্ট করছে।

“নির্ণয়, বাবা? কী করছিস?”

ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটল নির্ণয়ের। বাবা এসেছে। তাকে আজ বেশ প্রাণবন্ত লাগছে। ফোন রেখে নির্ণয় বলল,

“কিছু না। ভেতরে এসো।”

নাদিম হোসাইন ভেতরে ঢুকে নির্ণয়ের একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

“এভাবে রুমে বসে বসে বোর হয়ে যাস তাই না?”

নির্ণয় বিষাদমিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল,

“কী আর করার!”

“করার আছে। তোকে নিয়ে আজ বাইরে হাঁটতে বের হবো চল।”

“মানে? আমি হাঁটব কীভাবে?”

“তুই হাঁটবি না তো। দাঁড়া।”

নাদিম হোসাইন রুমের বাইরে গিয়ে আবার তৎক্ষণাৎ ফিরে এলেন। সাথে নিয়ে এলেন বিউটি বেগমকে এবং একটা হুইল চেয়ার। নির্ণয় বিস্মিত হয়ে বলল,

“হুইল চেয়ার?”

বিউটি বেগম প্রত্যুত্তরে বললেন,

“হ্যাঁ, তোর বাবা গতকাল কিনে নিয়ে এসেছে। সারাদিন বাসায় বসে বসে বোর হোস। তাই হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা। সকালে আর বিকেলে তোকে নিয়ে বের হবো। বাড়ির ভেতরেই মাঠে ঘুরিয়ে আনব। ভাগ্যিস, নিবেদিতা বুদ্ধিটা দিয়েছিল।”

শেষ কথাটা শুনে আপনা-আপনি নির্ণয়ের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটা তাকে নিয়ে এত কেন ভাবে?

নাদিম হোসাইন এবং বিউটি বেগম মিলে নির্ণয়কে হুইল চেয়ারে বসিয়ে বাইরে নিয়ে গেলেন। বাড়ির সামনেই বিশাল জায়গা। সকালে অনেকে হাঁটতে বের হয়। আবার বিকেলেও লোকজন হাঁটতে আসে। মূলত বিকেলেই লোকজন বেশি আসে। আজ কতদিন পর নির্ণয় বাইরে বের হলো বলতে পারবে না। মনে হচ্ছে, বহু বছর পর সে মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছে। গাছপালা, প্রকৃতি, আকাশ সমস্তকিছু এত সুন্দর লাগছে তার চোখে! সে মনে মনে বলল,

“ধন্যবাদ, নিবেদিতা। ভালোবাসি তোমাকে। ভীষণ ভালোবাসি। তোমার মতো করে কেউ কখনো আমায় বুঝবে না।”
.
.
বেকারিতে আজ কাজের চাপ অনেক বেশি ছিল। নির্ণয়কে লাস্ট ম্যাসেজ করার সুযোগ হয়েছিল আরো দুই ঘন্টা আগে। সে বের হয়েই আগে পকেট থেকে ফোন বের করল। হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে নির্ণয়কে কল করতে যাবে তখন পাশ থেকে একজন বলল,

“এক্সকিউজ মি?”

নিবেদিতা পাশ ফিরে তাকাল। লম্বা, চওড়া সুন্দর একটা ছেলে। এক কথায় যাকে বলে সুদর্শন পুরুষ। ছেলেটাকে নিবেদিতা চিনে। আতিক, তার ক্লাসমেট। নিবেদিতা নিয়মিত ক্লাস করলেও ছেলেদের থেকে একটা দূরত্ব সবসময়ই মেইনটেইন করে চলে বলে ক্লাসের কাউকেই সেভাবে চেনে না সে। আতিককেও সে আগে চিনত না। কিছুদিন ধরে নোটিশ করে দেখছে, আতিক তাকে ফলো করে। ক্লাসেও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। সময়ে, অসময়ে পড়ার কোনো টপিক নিয়ে আলোচনা করতে চলে আসবে। প্রথম প্রথম নিবেদিতা বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবে নিলেও এখন আর বিষয়টি স্বাভাবিক নেই। কারণ আতিকের চোখের ভাষা ভিন্ন। নিবেদিতা বুঝতে পারে, এই ভাষার নাম ভালোবাসা। এটা বোঝার পর থেকেই সে আতিককে এড়িয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আজ হঠাৎ এইভাবে যে ওর বেকারির সামনে চলে আসবে এটা আশা করেনি।

নিবেদিতা ফোনটা আবার পকেটে রেখে বলল,

“তুমি এখানে?”

“তুমি আমাকে ইগনোর করছ কেন?” আতিকের পালটা প্রশ্ন।

“ইগনোর করছি মানে?”

“হ্যাঁ, করছ। আগের মতো এখন আর কথা বলো না। এড়িয়ে এড়িয়ে চলো।”

“প্রথমেই একটু সংশোধন করে দেই, আগেও আমি তোমার সাথে আহামরি কোনো কথা বলিনি। আমার মনে পড়ে না যে, পড়ার টপিক ছাড়া তোমার সাথে কোনো কথা বলেছি।”

“এখন তো সেটাও বলছ না।”

“প্রয়োজন মনে করছি না তাই।”

“ইগনোর করার কারণ জানতে পারি?”

“আগে বলো, আমার ইগনোর করায় না করায় তোমার কী আসে যায়?”

“আসে যায়। তুমি খুব ভালো করেই জানো যে, আমি তোমাকে পছন্দ করি।”

“এই কারণেই ইগনোর করছি। দেখো আতিক, আমি তোমাকে স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছি, আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করো। আমার ভালোবাসার মানুষ আছে।”

“তুমি রিলেশনশিপে আছো?” আতিকের চোখেমুখে বিস্ময়। যেন কথাটা সে হজম করতে পারছে না।

নিবেদিতা সময় না নিয়েই বলল,

“হ্যাঁ।”

“কে সে?”

“সেটা তো তোমার জানার প্রয়োজন নেই।”

“সেই মানুষটা কি পল?”

“আশ্চর্য! পল হতে যাবে কেন?”

“একমাত্র পল ছাড়া তো আর কোনো ছেলের সাথে তোমায় মিশতে দেখিনি।”

“না, সে পল নয়। সে আমার কাজিন। তুমি তাকে চিনবে না। এনিওয়ে, প্লিজ আমার পেছনে টাইম ওয়েস্ট করো না। বেটার কাউকে পাবে তুমি। গুড লাক।”

নিবেদিতা আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। পেছনে বেদনাহত দৃষ্টিয়ে তাকিয়ে আছে আতিক। নিবেদিতা পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে নির্ণয় কলে। সে অবাক হয়ে গেল। চাপ লেগে কখন কল চলে গেছে! ফোন কানে নিয়ে নিবেদিতা বলল,

“হ্যালো?”

“কার সাথে কথা বলছিলে?”

“আমার ক্লাসমেট। আতিক।”

“এই সময়ে এখানে?”

প্রশ্নটা করেই তৎক্ষণাৎ বলল,

“বাদ দাও। কী করছ? বাসায় যাচ্ছ?”

“হ্যাঁ। আপনর কী অবস্থা বলেন? শরীর ভালো এখন কিছুটা?”

“হু। নিবেদিতা?”

“হ্যাঁ? বলেন।”

“মিস ইউ।”

নিবেদিতা কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“মিস ইউ টু!”

“ভালোবাসি।”

“ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”

“আচ্ছা নিবেদিতা, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?”

“তা কী করে বলব? ভালোবাসা কি পরিমাপ করা যায়? তবে এতটুকু বলতে পারি, আপনি ছাড়া আমি নিঃস্ব।”

“যদি আমরা এক না হই?”

নিবেদিতা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,

“এসব কী ধরনের কথাবার্তা? আমাকে আর ভালো লাগে না?”

নির্ণয় হেসে ফেলল। বলল,

“মজা করেছি। রাগ কোরো না।”

“হু। সামনে নেই বলে কিছু বললাম না। না হলে খবর ছিল।”

দুজনে কথা বলতে বলতে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে নিবেদিতা। বাড়ির লক খোলার সময় নির্ণয় বলল,

“আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর কল দিও।”

“ঠিক আছে।”

“আর শোনো?”

“বলেন।”

“থ্যাঙ্কিউ?”

নিবেদিতা অবাক হয়ে বলল,

“কেন?”

“আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য। আজ কতদিন পর সকালে বাইরের জগৎটা দেখেছি জানো না!”

নিবেদিতা মৃদু হাসল। বলল,

“ভালোবাসি।”

নির্ণয় আবেশিত কণ্ঠে বলল,

“ভালোবাসি নিবেদিতা।”

এরপর ফোনে একটা চুমু দিয়ে বলল,

“ফ্রেশ হয়ে কল দাও।”

“ঠিক আছে।”

কল কেটে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল নিবেদিতা। হুইল চেয়ারের আইডিয়াটা মিদহাদের ছিল। গত পরশু সে নিবেদিতাকে কল করেছিল। নির্ণয়ের টপিক নিয়েই কথা হয়েছিল দুজনের। তখন কথার প্রেক্ষিতে আইডিয়াটা দিয়েছে মিদহাদ। এ কথা নির্ণয়কে বলতে গিয়েও পরক্ষণে নিজেকে দমিয়ে নিয়েছে নিবেদিতা। পাছে নির্ণয় আবার কষ্ট পায়! সে চায় না, কোনোভাবে নির্ণয় নিজেকে ছোটো ভাবুক, ফেলনা মনে করুক। কিন্তু নির্ণয় যে বাইরে বের হতে পেরে, ঘুরতে পেরে ভীষণ খুশি এটার সম্পূর্ণ ক্রেডিট তো মিদহাদের; তার নয়। সে ফোন নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মিদহাদকে ছোটো একটা ম্যাসেজ দিল,

“থ্যাঙ্কস।”

এরপর সে ফোন রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠতেই আনমনে ফোনটা হাতে নিল মিদহাদ। সে ল্যাপটপে তখন অফিসের কাজ করছিল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে অনিহায় চোখ বুলাল। ম্যাসেজ প্রদানকারীর নাম ‘প্রাণ’ দেখে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল এবার। ম্যাসেজ দেখে মুচকি হাসল সে। ধন্যবাদের কারণ নিবেদিতা বিস্তারিত না বললেও সে জানে। হঠাৎ এই ম্যাসেজ করার কারণটাও বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। রিপ্লাই করল,

“মাই প্লেজার, প্রাণ।”

চলবে…

[কপি করা নিষেধ। অনেকদিন পর গল্প নিয়ে এলাম, সবাই রেসপন্স করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here