কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ৩২|

0
131

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ
|পর্ব ৩২|

ফেরার পর থেকে কুঞ্জ ভাইয়ের রুমের বারান্দায় বসে আছি। আকাশে মস্ত বড়ো একটি চাঁদ, যার সৌন্দর্যে সবাই মজে থাকে। আর কেউ জানেই না– আমার বুকের মাঝেও এক চাঁদের বসত, যাকে কেবল আমিই ভালোবাসি… খুব ভালোবাসি। আকাশ যেমন তাঁর চাঁদকে আগলে রেখেছে, আমিও আমার নিজস্ব চাঁদকে বুকের গভীরে স্বযতনে লুকিয়ে ভালোবাসছি। অথচ, আকাশের মতো চাইলেও নিজের চাঁদকে নিজের বলতে পারছি না, নিজের করে নিতে পারছি না।

বুক চিরে বেরিয়ে এলো সুগভীর দীর্ঘশ্বাস। আজ যখন আবারও গিয়ে কুঞ্জ ভাইকে জড়িয়ে ধরলাম, শক্ত করে তার বুকের মাঝে নিজেকে পিষে নিয়ে শুধালাম, “আমায় বিয়ে করবেন কবে?”

উনি তখন বাঁধন আরও দৃঢ় করেছিলেন। শরীরের প্রায় সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন, বোধহয়। তারপর অনেকটা সময় পেরোয়। উনি কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে, খুবই আলতো স্বরে বলে ওঠেন, “খুবই শিঘ্রই।”

এরপর আর কোনো কথা হয়নি। কেউ কিচ্ছুটি বলিনি। সময়টা হঠাৎ থমকে গিয়েছিল আমাদের দুজনের নিবিড় আলিঙ্গনে। ইশ! চাঁদ বুঝি ঈর্ষান্বিত হচ্ছিল খুব! সে যে একা!

আমার মনটা আজ খারাপও না, ভালোও না। খারাপ না হওয়া কারণ হচ্ছে– আজ সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি; যা আমাকে বিগত রাতগুলোতে ঘুমোতে দেয়নি। আর ভালো না হওয়ার কারণ হলো– কুঞ্জ ভাইয়ের সাথে আবার কবে দেখা হবে, তার ইয়াত্তা নেই। দূর আকাশের দিকে নির্বাক হয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম। আকাশ! আমরা একই আকাশের নিচেই তো আছি। তবে দূরত্ব কোথায়?

_________
সকালে ঘুম ভাঙতেই রাহীর রুমে গিয়ে নামাজ আদায় করে, ওখানেই শুয়ে পড়লাম। রাহী মিনিট খানেক বাদেই উঠে নামাজ পড়ে, বই নিয়ে বসল। আমি খেয়াল করেছি, তারপর আবার দুচোখ বুঁজে, ঘুমিয়ে পড়েছি। এই ঘুম ভাঙল সকাল ৯ টার দিকে, রাহীর ডাকে। পিটপিট করে তাকিয়ে বললাম, “কী?”

রাহী বলল, “রাতে কী কী করলি রে তোরা?”

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী করলাম? আর কে কে? কখন?”

“হুহ! ঢং! যেন মেয়ে হয়েও বড়ো একটা ফুচকা একেবারে মুখে নিতে পারে না!”

চোখ মুখ কুঁচকে শুধালাম, “কী হয়েছে?”

রাহী বসতে বসতে বলল, “ফিরলি কখন তোরা?”

এতক্ষণে বিষয়টা আমার বোধগম্য হলো। নিশ্চয়ই রাতে আপি কিংবা রাহীর কাছেই উনি জেনেছেন, আমি এই বাসায়। হাঁই তুলে বললাম, “ঘাস কাটলাম। দুজনে মিলে ঘাস কাটার কম্পিটিশনে নেমেছিলাম। দেখছিলাম– কে, আগে, ক-কেজি ঘাস কাটতে পারে। উইনার অবশ্য আমিই হয়েছি; মানুষ না আমি? আর ওদিকে তোর ভাই তো আস্ত এক গোরু। আমি ঘাস কেটে দেব। আর উনি কুটুস কুটুস করে চিবাবেন।”

রাহী হাঁ হয়ে গেল। চুপ থেকে ব্যাপারটা হজম করে সরে দাঁড়াল। সে বুঝেছে– ভুল জায়গায়, ভুল মানুষের কাছে, সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে।

আমিও উঠে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলাম। এক ফাঁকে আপিকে কল দিয়ে ওই বাসার আপডেটও জেনে নিলাম। এখন গতদিনের আমদানিকৃত সেই নয়ামালটাকে সাইজ করতে হবে। কোচিং-এ না গিয়ে আবারও চারজন মিলে কলেজ ক্যাম্পাসে চলে গেলাম। আইসিটি ভবনের পিছনে একটা ছোট্টো বিল আছে। আমাদের প্রায়শই এখানে আসা হতো। আজও চলে এলাম। ব্যাগগুলো ঘাসের উপর ফেলে, শুকনো ঘাসের উপর চারজনেই বসে পড়লাম।

নৌশি বলে উঠল, “এবার বল– কী করবি।”

চিত্রার জম্পেশ ঠান্ডা লেগেছে। বসার পরপর সে দু’খানা হাচিও দিয়ে দিয়েছে। টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে মুছতে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। বল– কী করবি?”

রাহী কিছু বলছে না। ভাইয়ের জাত না? বসে বসে ফোন টিপছে। ভেঙচি কেটে চিত্রা আর নৌশির উদ্দেশ্যে বললাম, “মিশন ফ্লার্টিং..”

ওরা অবাক হয়ে তাকাল। রাহীও ফোন ছেড়েছে, চোখ পড়েছে আমার দিকে।

আমি ‘উহুম! উহুম!’ করে কেশে বললাম, “নৌশি! একটা প্রেম করবি?”

ও মেজাজ তুঙ্গে তুলে চড়া গলায় বলল, “আলে-গালে থাপ্রাইয়া একেবারে কবরের চেহারা দেখিয়ে নিয়ে আসব। সোজা কথায় আয়।”

নৌশির কথায় হেসে উঠলাম। বললাম, “আকিবকে চিনিস?”

রাহী শুধাল, “তোর বিয়ের কাহিনি-কিচ্ছা করা ব্যাডা?”

“হুঁ। আমার কাছে একটা এক্সট্রা সিম আছে। এটা দিয়ে কল দেব। আর…”

বাকি কাহিনি ওদের বুঝিয়ে দিলাম। সবাই হাসতে হাসতে ঘাসের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রাহী জিজ্ঞেস করল, “কন্ট্যাক্ট নম্বর পাবি কই?”

আমি ব্যাগে থেকে ফোনটা বের করে আপির ইনবক্সে ঢুকলাম। লাস্ট কনভারসেশন এমন ছিল—

“আপি, হাদার নম্বরটা দাও তো।”

“কী করবি?”

“ভাগাব। এত পেইন সহ্য হচ্ছে না।”

“কিন্তু আমি কোথায় পাব?”

“আব্বুর ফোনে দ্যাখো, হাদার বাপের নম্বরটা আছে। আপাতত ওটাই দাও।”

“ওকে ওয়েট।”

মিনিট খানেক বাদে আবারও আপির ম্যাসেজ, “০১৯৮৩৬*****”

চিত্রা বলল, “এটা তো বাপের নম্বর!”

আমি হেসে এটাতেই কল লাগালাম। ওরা সবাই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি স্পিকারে দিলাম। তিনবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ইয়াসিন আঙ্কেল সালাম দিয়ে বলে উঠলেন, “ক্যাডা?”

আমি বিনম্র ভঙ্গিতে সালামের জবাব দিয়ে বললাম, “আমি সাদিয়া, আকিবের বান্ধবী, আঙ্কেল। কেমন আছেন?”

আমার কথা শুনে সামনের বিচ্ছুগুলোর চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম। আমি “কিছুই হয়নি”– এমন একটা ভাব নিলাম। ওপাশ থেকে ইয়াসিন আঙ্কেল বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ রাখসে ভালোই।”

“আসলে, আঙ্কেল… ফোন রিসেট দেওয়ায় সব নম্বর চলে গেছে। সামনে তো ইয়ার ফাইনাল। রুটিন দিয়েছে, এটা জাননানোর জন্য কল দিতে গিয়ে দেখি– ওম্মা! কোনো নম্বর নেই। এরপর অনেক ঘেটে-টেটে আপনার নম্বরটা পেলাম। কী কাণ্ড, বলুন তো!”

“হেইডা বুজলাম, কিন্তু ফেসবুক/মেসেঞ্জার নাই?”

“কী যে বলেন না আংকেল! প্রচুর পড়া, ওসবের সময় কই? তাছাড়া আঙ্কেল, আব্বু বলেন– ভালো মেয়েদের ফেসবুক চালাতে নেই। আমি ছোট্টবেলা থেকে আব্বুর সব কথা মেনে চলেছি, আজও চলি। নয়তো পড়াশোনা থেকে সেই কবেই ঝরে পড়তাম!”

“তাইলে ভালো মাইয়াদের পোলা বন্ধু থাকে?”

হাসি পেল খুব। তবুও যথাসম্ভব হাসি গিলে নিলাম। কণ্ঠে শতভাগ অসহায়ত্ব ঢেলে বললাম, “থাকে না বুঝি? আমারও তেমন একটা নেই– জানেন? তবুও আমি তো চাই– ডিপার্টমেন্টের সবাই ভালো রেজাল্ট করুক; এজন্যই তো নিজ থেকে সবাইকে জনে জনে এক্সামের ব্যাপারে জানাচ্ছি।”

আঙ্কেল কি এখন গললেন? হয়তো হ্যাঁ। তবুও কণ্ঠে কাঠিন্যতা বজায় রেখে বললেন, “এর আগে কয়জনরে কল দিসো?”

ফটাফট বললাম, “ছ’জন।”

“তয়, এই ছয়জনের কাছেই তো নাম্বার চাইতে পারতা।”

“চাইনি কি? দু’জন কাছে চেয়েছিলাম– বুঝলেন? আফসোস! কেউ দিতে পারল না। বারবার সবার কাছে চাইতে সংকোচ বোধ হচ্ছিল। তাছাড়া, আপনার নম্বরটা ছিল আমার কাছে, এজন্যেই… বিরক্ত হলেন কি খুব? স্যরি আঙ্কেল, নম্বর দিতে হবে না। আপনি আকিবকে বলবেন– কালকে এসে যেন রুটিন নিয়ে যায়। আবারও স্যরি। আমি কাউকে বিরক্ত করতে চাইনি। আমি তো ভালোই চেয়েছিলাম, না?”

শেষ দিকে কন্ঠটা কাঁদো কাঁদো করলাম। ফাইনালি বোধহয় গললেন! বড্ড স্নেহময় কণ্ঠে বললেন, “আরে মা, কান্দে না। আমি কি বকছি তোমারে? হ্যাঁহ্?”

“না আঙ্কেল, তবে বিরক্ত তো হয়েছেন। আমি সত্যিই দুঃখিত। ভীষণ ভীষণ ভীষণ দুঃখিত।”

“না-গো মা, বিরক্ত হই নাই। এত ভদ্র-সদ্র মাইয়া আজকাল পাওন যায় না। মাইনষে কয়– অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। তাই এত কিছু জানবার চাইলাম। বুঝছ, মা?”

“জি। বুঝেছি, আঙ্কেল।”

“নাম্বারডা ম্যাসেজ কইরা দিতাছি। আর হুনো, ভালোমতো পড়ালেখা কইরো। বাপের নাম উজ্জ্বল কইরো। অনেক বড়ো হইবা তুমি।”

“জি, আঙ্কেল। দোয়া করবেন।”

“তা তো করমুই।”

“ভালো থাকবেন তবে। রাখি, হ্যাঁ? আল্লাহ হাফেজ।”

“খোদা হাফেজ, আম্মু।”

কল কেটে দিতেই আমার সামনে বসে থাকা তিন জোড়া হাভাতে দৃষ্টি আমার ইস্পাত ন্যায় কঠিন হৃদয়কে বিগলিত করল। মায়া দেখালাম। বলে উঠলাম, “ওহে বৎস! আমি রহিয়াছি না? আমি থাকিতে এত চিন্তা-দুঃখ কীসের? সবার সব পেরেশানি দূর করিয়া দিব। ক’দিনের অনাহারী গো তোমরা? আমি তোমাদিগের লাগিয়া অন্ন আনিব। ক’কেজি খাইতে চাও? সংকোচ না করিয়া, আমারে বলিয়া ফালাও।”

সঙ্গে সঙ্গে নৌশি জুতো খুলে আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। সময় বিলম্বিত না করে সরে আসাতে ওর ধারালো জুতো আমার গা ছুঁই ছুঁই করেও ছুঁলো না। আহ! বেঁচে গেলাম। কিন্তু শেষ রক্ষে হলে তো!
নৌশি জুতোয় না পেরে, হাত দিয়ে মারা শুরু করল আমায়। আমি ‘আহ’ উচ্চারণ করে খানিকটা পিছে সরলাম।

চিত্রা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “দে তো, দে আরও দুইটা।”

নৌশি আমাকে মারতে মারতে বলল, “বালডারে দেইখা আমারও হাতের কুরকুরি উঠে গেছে, বাল।”

রাহী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এত নাটক আসে কোত্থেকে রে? ভাইয়া জানে?”

আমি দু‘হাতে নৌশিকে থামাতে থামাতে বললাম, “আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ। নিজের সংসারে, নিজের এত গুনের প্রশংসা কেমনে করি? আর তোর যা গিরগিটি ভাই, এই আমাকে পাবার জন্য লাফালাফি শুরু করল; তো এই আমাকে পাবার পর হলুদ-মরিচ দিয়ে কষানো মাংসের মতো পচানো শুরু করল। নিজেকে পচানোর আরেকটা পয়েন্ট দেব নাকি? পাগল?”

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই, চিত্রা বলল, “যাই বলিস, ইয়াসিন আঙ্কেল কিন্তু হেব্বি চালাক!”

নৌশি কথার তাল মিলিয়ে বলল, “ব্যাডা শেয়ানা আছে। নইলে কেবল পোলার নাম্বার চাওয়াতে এত প্রশ্ন কে করে?”

চিত্রা শুধাল, “তুই সাদিয়ার নাম কেন বললি? দুনিয়াতে নামের অভাব?”

আমি মিটমিটিয়ে হেসে বললাম, “বাংলাদেশের সব স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে একটা করে সাদিয়া মাস্ট আছে।”

রাহী চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। এখন আবার সে-ও বলল, “ভাইয়াকে না জানিয়ে এসব করা কি ঠিক হবে?”

আমার রাগ বাড়ল। ভাই! এটা কি আদোও আমার ফ্রেন্ড? ঘাসের উপর রাখা রাহীর ব্যাগটা হাতে তুলে, দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বললাম, “ওই যে, রাস্তা। দেখেছিস রাস্তা? সোজা যাবি। একদম এদিকে তাকাবি না। বাড়ি গিয়ে ‘ভাই, ভাই’ জপতে জপতে মুখের ফ্যানা তুল্ব ফ্যাল। যা, ভাগ এখান থেকে।”

থেমে বাকিদের উদ্দেশ্যে বললাম, “এই মালডারে আমাদের সার্কেলে কে জায়গা দিলো রে? ভাইয়ের চামচি, যাহ! ভাগ!”

রাহী উঠে ব্যাগটা এনে আবারও আগের জায়গায় বসে পড়ল। মুখে সবসময়ের মতো নির্লিপ্ততা! এতক্ষণে ফোনে ম্যাসেজ এলো। নম্বরটি দেখতে পেয়েই আমাদের সকলের মুখে বিজয়ের হাসি লক্ষনীয় হলো। কালবিলম্ব না করেই কল লাগালাম সে নম্বরে। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেল। দ্বিতীয়বার রিং হচ্ছিল। ফোন স্পিকারে, নৌশির হাতে। আমাদের প্ল্যানিং অনুসারে, কথা সব নৌশিই বলবে। আমিও বলতে পারতাম, তবে সেটা অবশ্যই নাটকীয় হতো; যেটা আকিব ভাই ধরে ফেলতেন।

শেষ রিং হতেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে নম্র কণ্ঠে সালাম দিয়ে বলে উঠলেন, “জি, কে আপনি?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here