কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী লেখনীতে: নবনীতা শেখ |পর্ব ২৩|

0
137

#কল্পকুঞ্জে_কঙ্কাবতী
লেখনীতে: নবনীতা শেখ

|পর্ব ২৩|

“ওখানে আমার একমাত্র আমানত তুমি। মেয়ে, নিজের প্রতি এত রাগ কীসের? তোমার না হলেও আমার একমাত্র আমানতের খেয়াল রেখো। যেভাবে রেখে এসেছিলাম, সেভাবেই আমার চাই। আর বেশি সময় না। একটু। একটু নিজের খেয়াল রেখো। তারপর তো তুমি আমারই। সম্পূর্ণরূপে, সমগ্র অধিকারে…”

অগণিত-বার চিরকুটটি পড়লাম। কতবার যে কাগজের পৃষ্ঠে অধর ছুঁইয়েছি, তার ইয়াত্তা নেই। আপি রাতের খাবার খাইয়েই কিছু মেডিসিন দিয়েছিল। হয়তো তারই প্রভাবে ঘুমেরা এই অশ্রুসজল নেত্রে বাসা বেঁধেছে, অনেক আগেই। তবুও জোরপূর্বক চোখ মেলে রেখেছি। এই চিরকুটটি যে আমায় পড়তে হবে আরও অনেকবার। স্পেসিফিকালি বলা যাবে না— ঠিক কতবার! কিছু জিনিস থাকুক না, অনির্দিষ্ট… অসঙ্গায়িত!

_________
পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, সে খেয়াল আমার নেই। শেষবার ঘড়িতে দেখেছিলাম, তিনটে বিশ বাজে। সেই হিসেবে ঘুম ভাঙার কথা বেলা এগারোটার পর। কিন্তু না! তার বেশ আগেই, ফোনের কলিং টিউনে ঘুম আমার উবে গেল। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ডান হাত দিয়ে ফোন খুঁজতে গেলেই ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। ভুলেই গেছিলাম এর কথা। গোপনে নিজেকে শাসাতে লাগলাম। কার হতে গোপন করতে— তা জানা নেই।

ওদিকে মুঠোফোনটা বাঁজখাঁই আওয়াজে ননস্টপ বেজে চলেছে। থামার কোনো নামগন্ধও নেই। ইচ্ছে করছে, ফোনের ভেতরে ঢুকে ওপাশের ব্যক্তিটির গলা চেপে দেয়ালে ঠেসে ধরে আলে-গালে চার-পাঁচটা চড়-থাপ্পড় বসিয়ে সিংহী আওয়াজে বড্ড বিনম্র ভঙ্গিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে, “ওহে ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা! আপনাকে যদি আদা-জিরার সাথে ব্লেন্ড করি, আপনি কি কিছু মনে করবেন? কিছু মনে করবেন না, প্লিজ! আমি আপনার পেস্ট তরকারিতে দিয়ে সুস্বাদু করে রান্না করে বড্ড আয়েশের সাথে চিবাব। আপনাকে ভোজ করতে পেরে আমি হব আনন্দিত অ্যান্ড দ্যি গ্রেট নবুর ভোজন হতে পেরে ইউ শ্যুড বি গর্বিত, ভদ্রলোক/ভদ্রমহিলা। নিন, আরেক থাপ্পড়।”

উফফ! এখনও বেজেই চলেছে। বিরক্তিকর ভঙ্গিমায় বাঁ হাতটি বিছানায় হাতড়িয়ে ফোনটা পেলাম। কলার আইডি চেক না করেই কল রিসিভ করলাম। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম, “হ্যালো! পাবনা থেকে বলছি, স্যার, শুধু আপনার জন্য না কি আপনার হোল ফ্যামিলির জন্য সিটের বুকিং দিতে হবে? স্যার, কাইন্ডলি জানাবেন— আপনার ফ্যামিলি মেম্বার্স ক’জন। ধন্যবাদ।”

প্রতিটি শব্দের মাঝে আমার কঠোর বিরক্তিভাব প্রকাশ পেয়েছে। ওপাশ থেকে সেকেন্ড পাঁচেকের নিরবতার পরপর চাপা হাসির শব্দ ভেসে এলো। যা শুনতেই আমার সর্বাঙ্গ বয়ে কিছু একটা উঠল। পুরোপুরি ভাবে ঘুম আমার চোখ থেকে নিমিষেই কোথাও একটা উধাও হয়ে গেল। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। চোখ দু’টো কাঁটাকাঁটা লাগছে, কেমন যেন জ্বলছে। ঠোঁট দু’টো সামান্য প্রসারিত হয়েছে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলাম, “কুঞ্জ ভাই!”

ওপাশের হাসির শব্দ থেমে গেল। কেউ কোনো কথা বলছি না। কথা খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবলাম— হয়তো আর কথাই হবে না। বরাবরের মতোই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন কাটার জন্য উদ্যত হলাম।

কিন্তু, নাহ! উনি কথা বললেন, “কেমন আছ?”

আমি ফোনটা স্পিকারে দিয়ে রেখেছিলাম আগেই। আমি সবসময় ইয়ারফোন নিয়ে কিংবা স্পিকারে দিয়ে কথা বলি। ফোন কানে নিয়ে কথা বলার অভ্যেস আমার নেই। তাই স্পিকারে রাখা ছিল। ওপাশের কথা শুনতেই আমি হাত থেকে ফোনটা খানিকটা দূরে বিছানার উপর রেখে দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে উঠলাম, যাতে কান্নার আওয়াজ উনি না শুনতে পারেন। এত এত অশান্তির মাঝে রেখে আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে— কেমন আছ! উনি কি জানেন না নাকি– তাঁকে ছাড়া আমি কেমন থাকতে পারি? জানেন না? আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি, এই ব্যথা ওঁকে না দেখানোর।

নিজেকে খানিকটা সামলে নিতেই ওপাশ থেকে কুঞ্জ ভাই আবারও বলে উঠলেন, “কাঁদবে না, নবনী।”

আমি নাক টানতে টানতে বললাম, “হুহ! মোটেও না। কে কাঁদছে, হ্যাঁ?”

“ব্যথা করছে?”

“কীসের ব্যথা? কোনো ব্যথা নেই। দিব্যি আছি।”

“হুম, বুঝলাম।”

“কী?”

“শরীরের ব্যথার চেয়ে মনের অভিমানটা তীব্র।”

“ছাই বুঝেছেন।”

“তোমাকে বুঝেছি।”

“হাসালেন।”

“তাচ্ছিল্যের?”

“আদৌ বুঝেছেন?”

“তোমার আগা-গোড়া আমি মুখস্ত করে নিয়েছিলাম।”

“তাই তো ভুলে গেছেন। বুঝে নিতেন আমাকে, আজন্ম আমি আপনার হয়ে থাকতাম।”

“এখন বুঝি অন্য কারো?”

“এক পুরুষের প্রেমে কাতর রমনী অন্যত্র সুখ পায় না।”

“সেই পুরুষের কাছে আরও বেশি অসুখী সে, যুগে যুগে।”

“প্রিয় পুরুষটির দেওয়া অসুখও হাজার সুখের চেয়ে দামি।”

“যদি সে সাক্ষাৎ মরণঘাতি কোনো অসুখ হয়?”

“আমি মরতে রাজি সহস্রবার।”

“জেনেশুনে?”

হাসলাম আমি। কিছুটা সুর করেই বলে উঠলাম, “জানিয়া-শুনিয়া আমি বিষ করিয়াছি পান। বিষের তরে শপিয়াছি প্রাণ।”

“সবটা জানো না তুমি।”

“জানি না?”

“উঁহু।”

“বেশ। তবে আরও ভালো।”

“ভালো?”

“হু…”

“কী করে?”

“তাঁকে জানার ইচ্ছে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকর্ষণও প্রত্যহ বেড়ে চলবে। সেই সাথে বাড়বে জিবনভর একসঙ্গে কাটানোর ইচ্ছে। আর, জিবনের শেষদিনে গিয়েও দেখব— আগ্রহ কমেনি। বুঝলেন?”

“হুম… বুঝলাম।”

“কচু বুঝেছেন।”

“একবার ছাই, একবার কচু। তুমিবাদে কি আমি পুরো দুনিয়ার বাকি সব কিছু বুঝে ফেলেছি?”

খিলখিল করে হেসে বললাম, “তবে তাদের সাথেই সংসার পাতুন।”

“তারা অভিমান করতে জানে না যে!”

“এটা তো সুবিধা।”

“তবে কার অভিমানী দৃষ্টিতে আমার বক্ষ কম্পিত হবে? কার জন্য ভোরবেলা শহর খুঁজে বেলি ফুলের মালা খুঁজব? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কার বাসার ছাদে উঠব? কাকে খুশি করার জন্য, ছাদ থেকে তার ব্যালকনিতে ফুলের মালার ছোড়াছুড়ি করব?”

“মানে?”

“অভিমানীনির অভিমান আমার বড্ড প্রিয়, সাথে স্বয়ং অভিমানীনিও। বারান্দায় গিয়ে দেখো, দুটো মালা আছে। তিনটে কিনেছিলাম। কিন্তু… যাই হোক।”

হঠাৎ কী যেন হলো, আমি কাঁপতে লাগলাম। ভেজা সুরে শুধালাম, “আ.. আপনি এসেছিলেন?”

মুহূর্তেই ওপাশ থেকে হট্টগোলের আওয়াজ এলো। উনি ফোন কেটে দিলেন। ফোনটার দিকে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। খুব ইচ্ছে করছে, তাঁকে একটুখানি জড়িয়ে ধরতে।

তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। চোখের পানি মুছে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। সেখানে লেখা,

“আমাকে যে আসতেই হতো। সে যে জেনেশুনে বিষ পান করেছে। মরণযন্ত্রণা ভোগ করবে না?”

___________
ঘড়িতে বাজে সকাল ৮টা। কুঞ্জ ভাই ফোন করেছিলেন ৭টায়। ফোন রাখার ২০ মিনিট পর উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছি। পরনের পোশাকও পরিবর্তন করে নিয়েছি। রুম থেকে বেরোতেই ডাইনিংয়ে আব্বুকে দেখে এগিয়ে গেলাম। আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখেই আব্বু বলে উঠলেন, “এই যে! শুভ সকাল, মা।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “শুভ সকাল, আব্বু। শুভ সকাল, আম্মু।”

আব্বু ভ্রু-কুঁচকে বললেন, “এত আগে তৈরি হয়েছেন যে! কোথায় যাবেন? কোচিং তো ১০টা থেকে।”

“আসলে একেবারেই রেডি হয়ে নিলাম। খেয়ে মামার বাসায় যাব। এরপর কোচিং।”

“ওহ্! আচ্ছা। বসুন পাশে।”

আমাকে এটুকু বলেই আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মেয়েকে পরোটা দাও তো।”

আম্মু পরোটা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, “রজনী কই? এখনও ওঠেনি?”

আমি রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বললাম, “না মনে হয়।”

“আচ্ছা, খেতে থাকো। আমি ডেকে আনছি।”

আম্মু যেতেই আব্বু বলে উঠলেন, “মন খারাপ আমার মায়ের?”

আমি জোরপূর্বক হেসে বলে উঠলাম, “না-না! বেশ আছি। পড়ালেখার একটু প্রেশ্যার, এই যা!”

আব্বু সামান্য হাসলেন। বললেন, “আমাকে মিথ্যা বলার চেষ্টা করছেন?”

আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। আব্বু আবারও কিছুটা হাসলেন। এই হাসতে হাসতেই চমৎকার এক উপদেশ দিয়ে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কানে শুধু আব্বুর কথাটিই বেজে চলেছে, “প্রতিটি মানুষের জিবনে প্রবলেম’স আসে। কেউ কেউ তা সইতে পারে না, ডিপ্রেশনে চলে যায়। কিন্তু, মা! আমি আপনাকে খুব স্ট্রং করে মানুষ করেছি। আপনাকে বিপদের মোকাবিলা করতে শিখিয়েছি। সমস্যাগুলোকে ফেইস করতে হবে। বুঝলেন? ইউ হ্যাভ টু ফেইস ইট।”

আব্বুর কথাটি আমি বুঝলাম কি না জানি না। তবে এটুকু বুঝেছি যে, আই হ্যাভ টু ফেইস হিম। উনি আমার কাছে না-ই বা আসলেন। আমি তো যেতেই পারি!

________
বাসা থেকে বেরিয়েছি। ব্যাগ থেকে বেলিফুলের মালা দুটো বের করে বা হাতে জড়িয়ে নিলাম। ওঁর সাথে সকালে কথা শেষে ছুটে ব্যালকনিতে গেছিলাম। গ্রিলে একটা মালা, আরেকটা ফ্লোরে পড়ে ছিল। দুটো বুকে চেপে যে কতক্ষণ বসে ছিলাম! খুব, খু-ব অনুভব করছিলাম ওঁকে।

এগারো নম্বর রোডটির এপাশে মানুষের আনাগোনা বড্ড কম। এর ডান দিকে মামার বাসা। আমি বাঁ দিকে গেলাম। তিন কদম এগোতেই সামনে একটা বেলি ফুলের মালা ধুলোমাখা রাস্তার কিনারায় পড়ে থাকতে দেখলাম। সামান্য হেসে এটাও তুলে ব্যাগে পুরে নিলাম। এটা ঠিক আমার ব্যালকনির নিচ বরাবর রাস্তা। যৌক্তিক হিসেবে, যখন কুঞ্জ ভাই ছাদ থেকে আমার ব্যালকনিতে ফুলের মালা ছুড়ছিলেন, এটা বাতাসের ভূমিকায় অন্যদিকে পড়ে গেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা এগিয়েই বাসে উঠে পড়লাম আমি। গন্তব্য হচ্ছে আমার মি.প্রবলেম…

চলবে…

[সবাই রেসপন্স করবেন। দীর্ঘদিন গল্প না দেওয়ায় রিচ কমে গেছে। রেস্পন্সের উপর ভিত্তি করে পরের পর্ব আসবে।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here