#প্রিয়_বিকালফুল(০২)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
“রাস্তা কি বে*শ্যাখানা মনে হয়? রাত দুপুরে চুম্মাচাটি করতেছেন? ঘর ভাড়া নিলেই তো পারেন। এইখানে তো আর কাপড় খুলতে পারবেন না। নাকি কু*ত্তার মতো স্বভাবও আছে।”
পাশে থেকে আরেকজন বলে উঠল,“বিয়ের আসর থেকে মেয়ে তুলে এনে এখানে ফষ্টিনষ্টি করছেন? মেয়ের পোশাক দেখে বউ বউ মনে হলেও আপনাকে দেখে তো বর বর মনে হচ্ছে না।”
অন্যদিকে থেকে আরেকজন নিতুর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে বলল,“মাইয়ার হয়তো দোষ নাই। এই লোকই হয়তো জোরজবরদস্তি করেছে। মাইয়ার চোখে পানি। সাথে গাড়ি আছে, পোশাকও বড়লোকের, দেখে ভদ্রলোকই মনে হয় তাহলে ব্যবহার এমন কেন? নোংরামি বের করছি দাঁড়া।”
লোকটা আরেকজনকে ডেকে বলল,“এই কাজি সাহেবকে ডেকে আন তো। নষ্টামি এখানে চলবে না। আর এই যে আপনি, টাকা পয়সা যা আছে ফেলেন নাহলে দেখা যাবে মেয়েকে রেখে পালিয়ে যাবেন।”
কথাগুলো যেন উৎসর শরীরে কাঁটার মতো বিঁধলো। দাঁতমুখ শক্ত করে বলল, “সমাজ পরিষ্কারের দায়-দায়িত্ব কি আপনারা নিয়ে বসে আছেন? এখানে যে আমরা দুইজন নষ্টামি করছিলাম তার প্রমাণ কী? গাড়ি থাকতে, গাড়ির বাহিরে এসেই বা নষ্টামি করব কোন দুঃখে?”
উৎস পিছিয়ে গিয়ে নিজের গাড়ির ভেতরে থেকে লাইসেন্সকৃত ব্যক্তিগত পি*স্তল এবং আইডি কার্ড বের করে এনে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,“এখানে যে যে নিজের কথায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে সে সে বাদে সবগুলোর লা*শ পড়ে যাবে।”
উৎস আকাশের দিকে একটা ফাঁকা গু*লি ছুঁড়ে বলল,“বিশ-বাইশ বছরের বাচ্চাছেলে পেয়েছ? ধমক দিলে প্রশ্রাব করে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলব, রাস্তায় বসে হাত-পা ছুড়ে কান্নাকাটি করতে করতে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাব? দলবেঁধে অ*রাজকতা চালাও একেকজন আর এখন এসেছ বিয়ে দিতে? টাকা খাওয়ার শখ জেগেছে? তোমরা তো পারো সেটা করতে। লোকজনকে জি*ম্মি করে হাজার হাজার টাকা খাওয়া তোমাদের কাজ। গ্রামের মোড়ল, মাতব্বর সাজতে এসেছ না? সবকয়টাকে চেনা আছে আমার। কার কার টাকা লাগবে এগিয়ে আয়, যেদিক যেদিক দিয়ে টাকা দেওয়া সম্ভব হবে সবদিক দিয়ে টাকা ভরে দেব আজ।”
সব চুপ হয়ে গেল। একে অপরকে দেখতে থাকল। উৎস একজনের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাথায় রিভলবার দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,“কী দেখে মনে হয়েছে যে রাস্তাটারে বে*শ্যাখানা বানিয়ে ফেলেছি? বলার সুযোগ পাইলে কোন হা*রামজাদা থামতে চাস না তাই না? অন্যের জীবনে খুব মাতব্বরি করার শখ না? একটা একটা করে দানা ভরে দেব মুখে। মেজর উৎস আমার নাম। আমার নাম শুনলে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে পানি খায় আর তোরা এসেছিস আমাকে গা*লি দিতে? তোদের একেকটারে যে এখনো গিলে ঢেকুর তুলিনি এটাই তোদের ভাগ্য, মাদারচো**”
কথাগুলো বলেই শক্ত হাতে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল উৎস। ছেলেটা টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। নিতু দৌঁড়ে এসে উৎসকে সরিয়ে নিয়ে এলো। ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল,
“আসলে বাতাস উঠেছিল। ধুলো চোখে যাওয়ায় উনি বের করে দিচ্ছিলেন। আপনারা ভুল বুঝেছেন। আমাদের মধ্যে সেরকম কোন সম্পর্ক নেই। প্লিজ আপনারা এখন আসুন।”
লোকগুলোর মধ্যে একজন গলার স্বর নরম করে বলল,“আসলে মাঝেমধ্যেই এরকম ঘটনা ঘটে এদিকে তাই ভেবেছিলাম…”
উৎস থামিয়ে দিয়ে বলল,“কয় জোড়াকে বিয়ে দিতে পারলেন?”
লোকটা আমতা আমতা করে বলল,“একটাও না।”
উৎস ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সংযত করে বলে উঠল,“গেলি এখান থেকে?”
লোকগুলো আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। একজন আরেকজনকে টেনে নিয়ে এগোতে থাকল। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা বলাবলি করতে করতে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যে রতনও ফিরে এলো একজনকে সাথে নিয়ে। উৎস তখনও রাগে ফুঁসছে। নিতু চুপচাপ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরপর উৎসকে আঁড় চোখে দেখছে সে। কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। এখান থেকেই সে একা কোথাও চলে যাবে নাকি উৎস তাকে অন্যকোথাও নামিয়ে দেবে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এদিকে রাত বাড়ছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো লাগলো গাড়ি ঠিক করতে। রতন টাকা মিটিয়ে দিয়ে উৎসর কাছে এসে চাপাস্বরে বলল,
“আব্বা, গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। চলেন ফেরা যাক।”
উৎস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রাগিস্বরে বলে উঠল,“আর একবার বাড়ি পৌঁছানোর আগে গাড়ি থামলে গাড়িসহ আপনাকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসব বলে দিলাম আমি।”
সোজা বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে নিতু আমতা আমতা করে বলল,“রেলস্টেশন এখান থেকে পায়ে হেঁটে গেলে পনেরো-বিশ মিনিট৷ গাড়ি থামালে হয়তো আবার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমি এখান থেকে হেঁটে চলে যাই?”
উৎস গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল,“সোজা গিয়ে সিটে বসবেন। আগামীকাল আমি নিজে আপনাকে স্টেশনে পৌঁছে দেব। এত রাতে একটা মেয়েকে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়ার মতো অমানুষ আমি নই।”
নিতু মাথা নিচু করে নরম গলায় বলল,“আমি অনেকের জন্য ভীষণ আনলাকি। আমার জন্য আপনার আবারও কোন বিপদ হতে পারে। তাই বলছিলাম কী…..”
নিতুকে কথা শেষ করতে উৎস বলে উঠল,“যা হয় আমি দেখে নেব। গাড়িতে উঠতে বলেছি আপনাকে। কথার অবাধ্য হবেন না। মাথা প্রচন্ড গরম আছে।”
বাড়তি কোন কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল নিতু। পরপরই উৎস গিয়ে পাশের সিটে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করল। এবার কোনমতেই গাড়ি থেমে যাওয়া যাবে না। রতন খুব সাবধানে একটানে দ্রুত পথ শেষ করে বাড়ি এসে পৌঁছল। বাড়ির এক পাশে গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা করা। উৎস আর নিতুকে আগেই বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে রতন গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
নিতু এখন দোতলা একটা সুন্দর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। সাদা চকচকে দেয়াল। বিভিন্ন জায়গায় সাদা পাথরের কাজ করা৷ বাহিরে আলো জ্বলছে। মনে হচ্ছে না এটা রাত। একমাত্র আকাশের দিকে তাকালেই তারাগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা রাত। নিতু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে চারপাশে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। উৎস বাড়ির ভেতরে ঢুকবে তখনই নিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল,
“কী হলো? আসুন।”
উৎস ভেতরের দিকে রওয়ানা দিল। নিতু পিছন পিছন ধীর পায়ে হাঁটছে। লম্বা একটা করিডোর মতো পার করে ড্রয়িংরুমে পৌঁছলো দুজন। সোফায় আত্মীয়, অনাত্মীয় বেশ কয়েকজনের দেখা মিলল। উৎসর বুকটা প্রথমে কেঁপে উঠল। মনে মনে ভাবল- আম্মা খুব বেশি অসুস্থ নয়তো? পরক্ষণেই তাদের বেশভূষা দেখে সন্দেহ হলো তার। কিছুতেই মনে হলো না যে তারা অসুস্থ কাউকে দেখতে এসেছে। এদের দেখলে যে কেউ নিশ্চিত হবে এটা ভেবে যে, তার নিশ্চয়ই বিয়ে খেতে এসেছে।
উৎসকে দেখে একজন উঠে দাঁড়ালো। হেসে উৎসর দিকে এগিয়ে এসে কিছু বলবে তখনই তার পিছন দিকে নিতুকে দেখে মুখে থমথমে ভাব চলে এলো। ভাঙা ভাঙা শব্দে শুধু বলল,
“ এ এটা ক কে উৎস?”
উৎস মায়ের রুমের দিকে যেতে যেতে বলল,“সেসব পরে বলব। আম্মা কই? শরীর কেমন?”
নিতুও সেখানে এত মানুষের সামনে না দাঁড়িয়ে শাড়ি দুই পাশে ধরে একট উঁচু করে দৌঁড়ে উৎসর পিছু নিল৷ এ বাড়ির কিছুই সে বুঝতে পারছে না। উৎস ছাড়া এখানে পরিচিত মুখ আর একটাও নেই।
উৎস মায়ের রুমের দরজায় নক করতেই কিছুক্ষণ পর একজন এসে দরজা খুলে দিল। উৎস আর নিতুর পিছনে ড্রয়িংরুমে যারা বসে ছিল তাদের মধ্যে প্রায় সবাই এসে দাঁড়িয়ে গেছে। সবার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। সবার মনেই হয়তো একটাই প্রশ্ন- উৎসর সাথে মেয়েটা কে? গায়ে বেনারসি শাড়িই বা কেন? উৎস কি তবে বিয়ে করে বউ নিয়ে এলো? এটাও সম্ভব?
দরজা খুলে দিল আঠারো বিশ বছর বয়সী একটা মেয়ে। পরনে লালশাড়ি। দেহের প্রতিটা অঙ্গে বিয়ের সাজ। দুই হাত ভরতি মেহেদি, পায়ে শব্দ করা নুপুর, মুখের প্রতিটা জায়গায় মেকাপের প্রলেপ এমনকি মাথায় বউ ওড়না। মাথা থেকে পা অবধি মেয়েটাকে দেখল উৎস। ওদিকে মেয়েটা ছলছল চোখে উৎসর পাশে দাঁড়ানো নিতুকে দেখে যাচ্ছে। উৎস বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল,
“হচ্ছেটা কী এই বাড়িতে, সোহা? ফোনে বলা হলো আম্মা অসুস্থ। এখানে সবার পোশাক দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে বিয়ে লাগছে। কী হচ্ছে এখানে?”
ভেতর থেকে এক পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়া নারী এগিয়ে এলেন। নাম ফরিনা বেগম। বয়সের সাথে শারীরিক গড়নের তেমন কোন মিল নেই। গায়ের রঙ ফর্সা, শরীরের উচ্চতা বেশ চোখে লাগার মতোই এবং চেহারা দেখে কিছুতেই মনে হবে না তার বয়স পঞ্চাশের বেশি। তিনি এগিয়ে এসে সোহার পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন। উৎসর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনার বয়স তো কম হচ্ছে না। আর কতদিন এভাবে? বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। এতক্ষণে সময় হলো আসার?”
উৎসর পাশে চোখ যেতেই আঁৎকে উঠলেন ফরিনা বেগম। অচেনা একটা মেয়েকে বিয়ের সাজে ছেলের পাশে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শক্ত গলায় শুধালেন,
“এ মেয়ে কে? সম্পর্ক কী তোমাদের? মেয়েটা বিয়ের সাজে কেন? কী হচ্ছে এখানে?”
চলবে….
প্রথম পর্ব-
https://www.facebook.com/100082490112958/posts/479421864817480/?app=fbl