” আমার ছেলেকে বিয়ে করবে মা?”
উওপ্ত গরমে ফুটপাত ধরে হাঁটছিলো মেয়েটা। পরিধানের ওড়না দিয়ে বারবার ললাটের ঘাম মুছে নিচ্ছিলো। ভর দুপুরের সূর্যটা যেন মাথার এক হাত উপরে নেমে এসেছে। মেয়েটা এবার যেন শরীরের সমস্ত বল হারিয়ে ফেলছে। কাঁধে ঝুলে থাকা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পান করে নিলো। বোতলের পানি পান করা শেষে বোতল পুনরায় ব্যাগে পুড়তে নিতে’ই কোন লোকের কন্ঠস্বর শুনতে পায় মেয়েটি। মেয়েটি ভয়ে,লজ্জায় পিছনে ফিরে তাকালো, সময় নিয়ে।
মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে। লোকটির হাতে বাজারের ব্যাগ। লোকটি মেয়েটির দিকে হেসে তাকিয়ে আছে উওরের আশায়। মেয়েটি যেন ভীত হলো, ফুটপাতের এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে সময় নিয়ে উওর দিলো,
” আমাকে কিছু বলেছেন আঙ্কেল?”
লোকটি হাসলো। ভীষণ সুন্দর হাসি। হাতের বাজারের ব্যাগ থেকে ছোট সাইজের শসা বের করে তাতে কামড় বসিয়ে বলল,
” আমি তো এই শসাকে বলেছি যেন সে আমার ছোট ছেলের বউ হয়। আসলে ছোট ছেলে আমার অনেক হট ইয়ে মানে গরম থাকে অনেক তাই শরীর, মন শান্ত করতে শসা খায় রোজ।”
লোকটির কথা মেয়েটি বিশ্বাস করলো না। মেয়েটি লোকটার দিতে মিথ্যা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে নিজ গন্তব্যে রওনা দিতে উদ্যোগ নিলো।
” আরে মা জননী, যাচ্ছো কোথায়? তোমার জন্য’ই তো আমি এই ভর দুপুরের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছি।”
মেয়েটির পা থেমে গেলো তাৎক্ষণিক। লোকটাকে মেয়েটির কাছে পাগল মনে হচ্ছে। কিন্তু পোশাক পরিচ্ছেদ দেখে মনে হচ্ছে ভদ্রঘরের লোক।
” আমার কাজ আছে। আপনি কিছু বলবেন আঙ্কেল?”
” আমারও কাজ আছে। মেয়ে পটানোর কাজ। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?”
লোকটির কথা শুনে মেয়েটি এবার চিৎকার করে উঠলো। শেষ বয়সে লোকটির মুখে এমন কঠিন কথা শুনলে যে কেউ চিৎকার করে উঠবে।
” কি বলছেন আপনি?”
লোকটি নিজের কথায় নিজেই বোকা বনে গেলো। জিহ্বা কেঁটে আবারও মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল,
” দুঃখিত মা, আমি বলতে চেয়েছিলাম রাস্তা খুঁজি। আসলে আমি আজ চশমা আনতে ভুলে গিয়েছি। এখন আমি বর্তমানে ব্লক সি তে নাকি ব্লক ডি তে দাঁড়িয়ে আছি নিজেও জানি না। তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে?”
মেয়েটি যেন এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। কিয়ৎক্ষণের জন্য মেয়েটি ভেবেছিলো যে সম্মুখ পানের লোকটি মেয়েধরা। কিন্তু মেয়েটির ধারণা ভুল। চশমাহীন লোকটির অসহায় চাহনি, নাকের গোড়ায় গর্তের ন্যায় কালো দাগ হয়ে আছে। বোঝা’ই যাচ্ছে এই কালো দাগ চশমা প্রতিনিয়ত পরার জন্য হয়েছে। মেয়েটি এবার ইতস্ততঃবোধ হলো। মিনমিন কন্ঠস্বরে প্রশ্ন করল,
” আমিও তো রাস্তা চিনি না। এলাকায় নতুন। বাড়ি খুঁজতে পথে নেমে এসেছি।”
” আমি তোমাকে বলে বলে দিবো। এই দুপুরে এই স্থান তোমার জন্য যেমন নিরাপদ না তেমন আমার জন্যও।”
মেয়েটি লোকটি কথা কিয়ৎক্ষণ ভেবে দেখলো। লোকটির কথার যথার্থতা আছে বৈকী। মেয়েটি রাজি হয়ে গেলো। এক পা দু পা আগাতে আগাতে লোকটি বলল,
” আমার নাম আলিমুদ্দিন আজাদ। আমার স্ত্রীর নাম আয়েশা আজাদ। তুমি আমাকে আজাদ আঙ্কেল বলে ডাকতে পারো। তা তোমার নাম কি?”
” আমার নাম রিনিঝিনি রুপ। সকলে রুপ বলে ডাকে।”
” তা শহরে কি নতুন তুমি?”
” হ্যাঁ, এক সপ্তাহ হয়েছে শহরে পা রেখেছি।”
” কোথায় থাকো এখন?”
” আনন্দকন্দ এতিমখানায়।”
এতিমখানার কথা শুনে আজাদ সাহেব থেমে গেলো। সাথে রূপাও।
” কি হয়েছে আঙ্কেল? খারাপ কিছু বলেছি?”
” এতিমখানার উঠেছো যে? তোমার পরিবার পরিজন কেউ নেই?”
পরিবারের কথা শুনে রুপ হাসলো,মলিন হাসিতে।
” পরিবার থাকলে কি আর এতিমখানায় থাকি? কবেই না পরিজনের কাছে চলে যাই!”
আজাদ সাহেব প্রত্যুওর দিলেন না। রুপকে দিক নির্দেশনা প্রদান করে মনে মনে কিছু ছক কশে নিলেন।
ব্লক সিতে চলে আসতে’ই রুপ আশ্চর্যিত হলো। তিন তলা বিশিষ্ট ভবনটির দেয়ালে সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখে। দেয়াল ঘেঁষে ভবনটির নাম লিখা আছে ‘প্রেম নীড়’। নামটি দেখে রুপের মনে কৌতূহল জন্মালো।
” একটা কথা জানার ইচ্ছে জন্মালো মনে।”
” কি কথা বলো।”
” আমি যতটুকু জানি বাড়ির প্রধানদের নামে বাড়ির নেমপ্লেটে নাম লিখা থাকে। আমির যদ্দূর মনে আছে আপনার নাম তো আলিমুদ্দিন আজাদ। তাহলে নেমপ্লেটের বেলায় ‘প্রেম নীড়’ হয়েছে কেন?
প্রেম নীড় নিয়ে রুপের কৌতূহলী দেখে আজাদ সাহেব মনে মনে ভীষণ খুশি হলেন। আজাদ সাহেব মনে ঊনিশ বিশ কিছু ভেবে উওর দিলেন,
” আমার ছোট ছেলে। নাম প্রেম। সুন্দর নাম না! দেখতেও ভীষণ কিউট। প্রতিনিয়ত প্রেম পত্র পায়। প্রেম শেখানোর উস্তাদ। ছোট ছেলের প্রেম প্রেম শেখানো দেখে’ই বাড়ির নামকরণ করেছি ‘প্রেম নীড়’।”
রুপের নিকট আজাদ সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে মাথায় গন্ডগোল আছে। তাইতো আজাদ সাহেবের প্রথম বাক্যের সাথে দ্বিতীয় বাক্যের কোন মিল পাচ্ছে না অপরূপা। রুপ যেন এখান থেকে চলে গেলে’ই বেঁচে যাবে। মুখে মিষ্টি হাসি এনে রুপ বলল,
” আপনার বাড়িতে যেহেতু চলে এসেছি, এবার আমাকে বিদায় নিতে হবে। ভালো থাকবেন আঙ্কেল। এভাবে চশমাবিহীন আর বাহিরে বের হবেন না।”
রুপ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। পিছনে ফিরে হাঁটা শুরু করলো। এদিকে আজাদ সাহেব পকেট থেকে চশমা বের করে দুষ্টু হাসি হাসলো। পরক্ষণে ভাবনায় আসলো যে মেয়েটাকে আটকাতে হবে নয়তো এতক্ষণের কষ্ট বিফলে যাবে। আজাদ সাহেব আবারও রুপকে ডাকতে লাগলো। রুপের পিছনে এক প্রকার দৌঁড়াতে শুরু করলো।
ইয়ামাহা এফ জেড ভার্সন থ্রি মোটরবাইকে চড়ে কেউ একজন রুপের সামনে এসে দাঁড়ায়। মোটরবাইকের চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ করে হাতে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে রুপের চারপাশ ঘুরতে থাকে। যেন রুপের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করছে। রুপ ভয় পাচ্ছে। সামনে একজন মানব আর পিছনে বুড়ো লোক। রুপের অবস্থা এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগ শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে ভয়ে।
” এই মেয়ে তোমার শরীরে কি মধু লাগিয়ে রেখেছো?”
ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুপ। এখনও বোধগম্য হচ্ছে না সম্মুখ পানে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটির কথার যথার্থতা। রুপের বোকা বোকা চাহনিতে যেন মানবটি আরো ক্ষিপ্ত হলো। মাথার হেলমেটের চোখের সামনের কাচের অংশটুকু সামনে থেকে সরিয়ে নিলো মানবটি। ললাটে বিরক্তির আভা ছড়িয়ে রাগী কন্ঠস্বরে বলল,
” অমি কি চায়না ভাষায় কথা বলেছি? বাংলা ভাষা বুঝো না? দেখে তো বাংলাদেশি’ই মনে হচ্ছে। উওর দাও বোকা মেয়ে?”
মানবটির কথার গর্জনে রুপ কেঁপে উঠলো। পিছনে ফিরে সাহয্যকারী আজাদ নামক লোকটিকে দেখে নিলো। যে কি এখন ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অদূরে।
” পিছনে কি দেখছো? আমাকে দেখো। ঐ বুড়ো লোককে দেখে লাভ নেই। তাঁর স্ত্রী সন্তান আছে। আমার কেউ নেই।”
রুপের দৃষ্টি জমিনের দিকে। কিছু কিছু মানুষ আছে রাগ হলে কথা বলতে পারে না। আবার কিছু কিছু মানুষ আছে আকস্মিক কোন বিষয়ের সম্মুখীন হলে কথা বলতে পারে না। রুপের বিষয়টা এমন। সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানবটির ধমকে কথা বলতে পারছে না।
” আরে কি করছিস কি মেয়েটির সাথে নাদিফ! মেয়েটি আমাদের বাসার উপর তলার ভাড়াটিয়া। বাড়ি দেখে পছন্দ হয়েছে। আমি একশত টাকা দাম-দর একটু বেশি চাওয়াতে চলে যাচ্ছে। তাই মেয়েটির পিছু আসছিলাম একশত টাকা কম নিবো এই কথা বলতে। আর তুই কি ভাবছিস? ছিহ্ নিজের বাবার সম্পর্কে এসব ভাবতে তোর মন কাঁপলো না?”
নিবরাজ নাদিফ আজাদ সাহেবের ছোট সন্তান। দুনিয়ার ঘাড় ত্যাড়া, রাগী আর বদ মেজাজি। যা বলে তাই করে নিশ্বাস ত্যাগ করে। আজাদ সাহেবের কথা নাদিফ বিশ্বাস করেছে কি না তা বুঝা মুশকিল। বাবার কথার মাঝে’ই আড়চোখে মেয়েটাকে কয়েকবার পরোক্ষ করে নেয়। হলুদ ফর্সা হওয়ার কাঠফাটা রোদে মুখ লাল টকটকে হয়ে আছে।
নাদিফের মুখে বিরক্তিভাব চলে আসে। মনে মনে বাবাকে ইচ্ছে মতো বকে নেয়।
” বাড়ি আছে ভাড়া হবে। শুধু শুধু মেয়েদের পিছনে দৌঁড়াতে হবে? এক ভাড়াটিয়া চলে গেলে আরেকটা আসবে।”
ছেলের কথায় আজাদ সাহেব বিড়বিড় করে বলেন,
” এমন সোনায় সোহাগা মেয়ে পাবো কোথায়? যেই মেয়েকে তোর জন্য ঠিক করেছি!”
” বিড়বিড় করে কি বলছো। বাসায় যাও মায়ের কাছে। মা তোমার জন্য পাঠ শাক আর শুঁটকি ভর্তা নিয়ে বসে আছে।”
শুঁটকির কথা শুনে যেন বমি চলে আসছে আজাদ সাহেবের। রুপ তখনও আজাদ সাহেবের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আজাদ সাহেব পড়েছেন মহা বিপাকে। ছেলের সামনে কীভাবে বাচ্চা মেয়েটাকে বুঝাবে বুঝতে পারছে না। অগত্যা পকেট থেকে একটি কার্ড বের করে রুপের দিকে এগিয়ে দিলে বলল,
” এটা আমার কার্ড। উপরের নাম্বারটা আমার নাম্বার, তার নিচের নাম্বারটা আমার স্ত্রীর, তার নিচের নাম্বারটা আমার বড়ো ছেলের, তার নিচের নাম্বারটা আমার ছোট ছেলের। সন্ধ্যার পর আমার নাম্বারে ফোন দিও। তোমাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবো। এখন সময় পাচ্ছি না। গিন্নির তলব এসেছে। সময় মত আমাকে না পেলে কুরুক্ষেত্র তৈরি করবে। আসি! চল ব্যাটা নিবরাজ নাদিফ। একসাথে শুঁটকি খাবো।”
রুপের মাথার উপর দিয়ে যেন সব কথা চলে গেলো। হাতের কার্ডটি উলট-পালট করে আজাদ সাহেবের চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে রইলো। এদিকে নাদিফও মোটরবাইকে উঠে বসলো। মোটরবাইকের আওয়াজে রুপ নাদিফের পানে তাকালো। নাদিফের চোখ ব্যতীত পুরো মুখশ্রী হেলমেটের আড়ালে। ভাসমান চোখ দুটো এখনও রুপের দিকে নিবদ্ধ। রুপ ভাসমান চোখ জোড়া দেখে শুকনো ঢুক গিলে। রুপের কাছে মনে হচ্ছে এই আঁখিদ্বয়ের মালিক রুপকে বলছে,
“আরেকবার তোকে হাতের কাছে পাই, ঘার ম’ট’কে দিবো।”
চলবে……
#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|প্রথম পর্ব|