#প্রেমনগরে_প্রশান্তির_ভেলা
#আফসানা_মিমি
|বারো তম পর্ব |
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। কালো রংয়ের গাড়িটাতে যত স্পিড আছে সবটুকুই প্রয়োগ করা হয়েছে যেন এই মুহূর্তে। আরোহী রুপ ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে সিট বেল্ট শক্ত করে ধরে। নাদিফের মুখে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। রুপের এমন জর্জরিত অবস্থা দেখেও পাষান নাদিফের হৃদয় গলছে না।
” আস্তে চালান দয়া করে, ভয় পাচ্ছি।”
নাদিফ নিশ্চুপ। কোন কথা না বলে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিলো শুধু।
” ইগনোর করছিলে কেন আমাকে?”
রুপ কি বলবে লোকটাকে ভেবে পাচ্ছে না। রুপের এখনও অজানা এই রাগী লোকটা কি চায় রুপের কাছে। আর রুপও অজ্ঞাত কেন পালিয়ে বেড়িয়েছে এতদিন লোকটার কাছ থেকে। শুধুই কি লোকটার হু’ম’কি জন্য নাকি অন্য কিছু।
” কথা বলছো না কেন? কসম যদি এখন কথা না বলো তাহলে এই যে পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে না! সেখানে গাড়ি ছেড়ে দিবো। তারপর দুইজনে মরে ভুত হয়ে থাকবো আর তোমার মুখ থেকে কথা শোনার জন্য তোমার ঘাড় মটকে দিবো।”
নাদিফ যেন নিজের মধ্যে আজ নেই। চশমা ওয়ালা ভীতু,বোকা মেয়েটাকে এতদিন দেখতে না পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছে যেন। নাদিফের কান যেন ব্যাকুল হয়ে আছে অপরুপের কথা শ্রবণ করার জন্য, অন্তর তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে একটিবার অপরুপকে বক্ষঃস্থলে আবদ্ধ করার জন্য।
” কথা বলবে না?”
রুপ এবার মুখ খুললো। রুপির ভীত কন্ঠস্বর,
” আপনাকে দেখতে অনেক ভ’য়ং’ক’র দেখাচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি।”
ব্যস রুপের একটা কথায় গাড়ি থেমে গেলো। নাদিফ গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। টায়ারে সজোরে লা’থি মেরে পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নেয়। রুপ স্তব্ধ বনে আছে নাদিফের কান্ডে। রাগী লোকটা এতোটা রেগে যাবে জানলে কখনোই লুকিয়ে থাকতো না রুপ। রুপ এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। রুপের একবার ইচ্ছে করছে লোকটির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে পরক্ষণে লোকটার রাগান্বিত অবস্থা দেখে ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে।
পরপর তিনটে সিগারেট শেষ করে নাদিফ পুনরায় গাড়িতে এসে বসলো। নাদিফ নিজেকে অনেকটা শান্ত করে রোপের সামনে এসেছে। রুপের ভয় পাওয়া চেহারা দেখে নাদিফ ব্যথিত হয়।
” কি খাবে?”
রুপ নাদিফের শান্ত কন্ঠস্বর শুনে বলে,
” বাসায় যাবো। বিকেলে পড়াতে যেতে হবে।”
নাদিফ ব্যথিত হৃদয়ে চুপ করে রইলো। নাদিফ না পারছে মনের কথা রুপকে বুঝাতে না পারছে সহ্য করতে। মনে কথা ব্যক্ত করতে এতো কেন কষ্ট হচ্ছে তা নাদিফের অজানা।
” প্রেমে পড়েছো কখনও?”
গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে নাদিফের প্রশ্ন। রুপ নির্বাক দৃষ্টিতে নাদিফের পানে তাকিয়ে। রুপের বোকা চাহনিতে নাদিফ মুচকি হাসে। ফুলে থাকা গাল টেনে নেয় নিঃশব্দে।
” প্রেম খুবই ভয়াবহ রোগ। যাকে ধরে তাকে একদম নিস্তেজ করে দেয়। প্রিয়জনকে মনের কথা ব্যক্ত করতে না পারায় ধুকে ধুকে মরতে হয় অনিমেষে’ই। এই রোগের ঔষুধি জানা আছে কি তোমার অপরুপ!”
রুপ অনুভব করছে! রুপের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মনে ভয়ানক বিপদের বার্তা জানাচ্ছে। রুপ খুব করে চাইছে যেন ভয়ানক বার্তা রুপের জীবনে না আসে। রূপ যে এই বার্তা বহন করতে পারবে না।
রুপের মৌনতা নাদিফকে খুব পোড়াচ্ছে। কোন কথা না বলে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় নাদিফ।
————
খাবার টেবিলে আজ মনমরা পরিবেশ। সিদ্ধ ভাত, আলু ভর্তা, কাচ কলা ভর্তা দেখে সকলেরই মন বিষন্ন। এই রেসিপি তিনদিন চলবে। প্রায় সময় আজাদ সাহেবের পেটের সমস্যা হয় তখন সকলের খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায় প্রায়।
আয়েশা আজাদ আলাদা বাটিতে পাট শাক আর শুঁটকি ভর্তা রেখে দিয়েছেন স্বামীকে ভয় দেখাবে বলে। আয়েশা আজাদ অবগত যে তাঁর স্বামী নিশ্চয়ই কোন বাহানা করবেন এসব ভর্তা না খাওয়ার জন্য। এজন্য আয়েশা আজাদ আগে থেকেই তৈরি।
ফাহিমা গালে হাত দিয়ে বসে ভাবছে কিছু। আয়েশা আজাদ সেই কখন থেকে বলছে খাবার দিতে তা কানেই যাচ্ছে না ফাহিমার। অগত্যা আয়েশা আজাদ ফাহিমার মাথায় চাঁটি মারলেন।
” উফ মা মারছো কেন? আমি জেগে জেগে ছোট ভাইয়ের আর রুপের রোম্যান্স চিন্তা করছিলাম।”
আয়েশা আজাদ ফাহিমার কথা শুনে এবার মাথায় আরেকটা চাঁটি মারলেন।
” খবরদার ফাহিমা আমার ছোট ছেলে বউমাকে নিয়ে উল্টা পাল্টা ভাববি না। এমনিতেই আমার ছেলেটার এতদিন পর আক্কেল হলো।”
আয়েশা আজাদের মুখের কথা শেষ হলো না তাঁর আগেই ফাহিমা বলে উঠলো,
” যেভাবে রুপকে টেনে নিয়ে গেলো! দেখে বুঝা’ই যাচ্ছিলো রুপকে মনে ধরেছে।”
বউ শাশুড়ির কথার ব্যস্ততায় আজাদ সাহেব এই মুহূর্তে কেঁ’টে পড়তে চাইছেন। এসব কু-খাদ্য আজাদ সাহেবর গলা দিয়ে ঢুকবে না। আজাদ সাহেবের এখন ইচ্ছে করছে কিছু একটা বলে বউ শাশুড়ির মাঝখানে ঝগড়া বাজাতে। তাহলে আর দুজনের একজনেরও আজাদ সাহেবের দিকে ধ্যান থাকবে না। এই ফাঁকে আজাদ সাহেব পালাতে পারবে। চেয়ার থেকে উঠে পা টিপে টিপে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে আজাদ সাহেব ঠিক তখনই আয়েশা আজাদের কণ্ঠস্বর আজাদ সাহেবের কর্ণধারা প্রবেশ করে,
” এই তুমি কোথায় যাচ্ছো? এদিকে আসো খাবার খেয়ে তবে এখান থেকে উঠবে। বাহিরের খাবার খাওয়ার সময় খেয়াল থাকে না! এখন এই খাদ্য তোমার গিলতে হবে সাথে আমরাও গিলবো।
আজাদ সাহেব করুণ চোখে আয়েশা আজাদের দিকে তাকালেন কিন্তু লাভ হল না উল্টো আয়েশা আজাদ টেবিলের মাঝখানে পাট শাক আর শুটকি ভর্তা রেখে দিলেন। তা দেখে আর আজাদ সাহেব কি আর চলে যেতে পারে! অগত্যা চেয়ারে বসে শুকনো মুখে ভাতের সাথে আলু ভর্তা মাখতে শুরু করেন।
খাবার খাওয়ার মাঝেই রুপ নাদিফ প্রবেশ করে প্রেম নীড়ে। নাদিফের হাতে খাবারের প্যাকেট।
” দ্রুত ফ্রেশ হয়ে খেতে আসবে। আর তোমরা খাবার খাওয়া শুরু করিও না। অপেক্ষা করো আমিও ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
সকলের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। রুপ লজ্জায় চলে গিয়েছে উপরে। নিদিফ সকলের সামনে রুপের সাথে কথা বলছে দেখে আজাদ সাহেব মনে মনে বেজায় খুশি। ছেলের এত পরিবর্তন দেখে এখন নিজেকে অনেক গর্ববতী মনে হচ্ছে।
নিজের ঘরে এসে রুপ পায়চারি করতে শুরু করলো। রুপের মস্তিষ্ক যেন ফাঁকা হয়ে আছে। গাড়িতে নাদিফের বলা কথাগুলো রুপকে ভীষণ ভাবাচ্ছে। রুপ বুঝতে পারছে নাদিফ তাঁকে পছন্দ করে। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব! এই অল্প কয়েকদিনে কীভাবে রুপ কে পছন্দ করবে নাদিফ? নাদিফ তো এমন একজন মানুষ যে পদে পদে রুপকে অপমান করতে প্রস্তুত থাকে। নাহ রুপ আর ভাবতে পারছে না। রুপ নিজের জীবনে এভাবে কাউকে প্রবেশ করতে দিবে না। রুপের জীবনটা খুবই কষ্টের। রুপ চাচ্ছে না নাদিফ নিজের অনুভূতির প্রতি আরো গুরুত্ব দিক।
” কি হয়েছে রুপ? তুমি কি কোথাও গিয়েছিলে?
একবার চোখ খুলে দেখলাম তুমি তৈরি হচ্ছো। তারপর আবার ঘুমিয়ে গেলাম। আবার চোখ খুলে দেখলাম কেউ নেই ঘরে, আবারো চোখ বন্ধ করলাম। আবার চোখ খুললাম দেখি সামনে তুমি। দেখলে কতবার আমার ঘুম ভাঙল? এবার বলো কি হয়েছে তোমার?”
” আমার মনে হয় কি রাইসা! রাগী লোকটা আমাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে।”
রাইসা সকাল থেকে বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। আজাদ সাহেবের ডায়রিয়ার কথা, ফাহিমার দৌঁড়োদৌড়ির কথা, এমনকি রুপের ঘুরে আসার কথা কোন কিছুই রাইসার জানা নেই। কেননা সে তো ঘুমে ছিল। বিভোর ঘুমে! রুপের কথা শুনে রাআসার ঘুম উধাও। শোয়া থেকে চটজলদি উঠে বিছানার উপর বসে হা করে তাকিয়ে আছে। রুপ রাইসার কাণ্ডে খুবই বিরক্ত হয়। কাঁধের ব্যাগ খানা রাইসার দিকে ছুড়ে মেরে বলতে শুরু করে,
” আমি কিছু বলছি রাইসা। তোমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে বলছি না। দোয়া করো আমার এই কথা যেন সত্য না হয়।”
” তারমানে তুমি এতক্ষণ নাদিফ ভাইয়ের সাথে ছিলে! ও মাই গড! আমি যে কি খুশি হয়েছি! তুমি জানো না রুপ! অবশেষে, অবশেষে আমার রুপের রূপে মুগ্ধ হয়েছে কেউ একজন।”
রুপ রাইসার কথা শুনে হতাশ। রুপ খুবই চিন্তিত আজকের ঘটনা নিয়ে। এরমধ্যে রাইসার হেঁয়ালি কথায় রুপকে আরো চিন্তিত করে তুলছে।
” আমি এমন সম্পর্কে আগাতে চাইনা। তুমি দেখেছো রাইসা! প্রেম নীড়ের মানুষজন কত ভালো! আজাদ আঙ্কেল, উনার স্ত্রী, ভাবি সবাই কত ভালো। এখন রাগী লোকটা যদি আমাকে ভালবেসে বসে তাহলে পুরো পরিবারের মধ্যে যে হাসিখুশি আছে তা বিলীন হয়ে যাবে। আমি চাইনা এমন কিছু হোক।”
রাইসা এবার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রুপের কাছাকাছি এসে বলে,
” তুমি এতো ভাবছো কেন রুপ? যা হচ্ছে তা হতে দাও না! উপর ওয়ালা যদি নাদিফ ভাইয়ার ভাগ্যে তোমাকে রাখে তাহলে তুমি যতই আপত্তি করো না কেন কিছুই করতে পারবে না।
রাইসার কথা শুনে রুপ চুপ হয়ে যায়। রুপ কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। রুপের ভাবনার মাঝে রুপদের ঘরের দরজায় করাঘাত করে কেউ। রাইসাকে ফ্রেস হতে বলে রুপ অমনোযোগী হয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজার ঐপাশে নাদিফ দাঁড়ানো। নাদিফের চোখগুলো বড়ো বড়ো মার্বেলের মতো হয়ে আছে।
এদিকে রুপ নাদিফকে দেখে মাথা নিচু করে ফেললো। নাদিফের উদ্দেশ্যে মিনমিন করে বলে,
” আমি এখনই চলে যেতাম। রাইসাকে ডেকে তুলতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আপনি নিচে যান।”
নাদিফের হৃদকম্পণ যেন শতগুণে বেড়ে গেলো রুপকে এই অবস্থায় দেখে। নাদিফ কোনরকম নিজেকে সংযত করে বলে,
” গায়ে ওড়না নিয়ে আসবে তো রুপ! তুমি জানো না, লজ্জা নারীর ভূষণ!”
চলবে………