#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১২
এশা খাটের উপর শক্ত হয়ে বসে আছে। অনেকক্ষণ যাবৎ ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। তরকারি ছাড়া ভাত দুই লোকমা মুখে তুলে ও ভেজা চোখে টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে। সেই কান্না এখনো থামেনি।
ওর জীবনটা কখনোই সহজ ছিলো না। ছোটবেলা থেকেই অনেক সংগ্রাম করে বেড়ে উঠেছে। কণ্টকাকীর্ণ এই জীবনে কত জায়গায় কত ভাবে অপমানিত হয়েছে, আঘাত পেয়েছে! কিন্তু আজকের মত এমন আঘাত কখনো পায়নি। ওর বুকের ভিতরটায় ভয়ানক জখম হয়েছে। তীব্র দাবানলে দগ্ধ হওয়ার মত।
ফুয়াদ ব্যালকনিতে রাখা আরামকেদারায় চোখ বুঁজে বসে আছে। তার আঙুলের ফাঁকে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটটা অনাদৃত ভাবে পুড়ে যাচ্ছে। সেটিটে ফুঁ দেওয়ার মত মেজাজ হলো না। এই মুহূর্তে ওর মেজাজ ভীষণ বিক্ষিপ্ত। দারুণ ক্রোধে মস্তিষ্ক ফুটন্ত গরম পানির মত টগবগ করছে যেন।
পলি বেগম এই বাড়ির সর্বেসর্বা, প্রধান হর্তাকর্তা। তার অনুমতি ছাড়া এখানে একটি পাতাও নড়ে না। তাই বলে খাবার নিয়ে এমন নিচু ধরণের ছোটলোকি তিনি করবেন! এর চেয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না! কাউকে খাবার খেতে বসিয়ে তার প্লেটে তরকারি না দেওয়া! কিরকম কুৎসিত ব্যাপার। এই দৃশ্য ফুয়াদ কল্পনাও করতে পারছে না। এশা মেয়েটার প্রতি ওর তেমন ভালোবাসা নেই। কিন্তু আজ সে কতটা দুঃখ পেয়েছে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে।
ফুয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে। পলি বেগমের মুখোমুখি হওয়ার এটি সঠিক সময় নয় ওর জন্য। তবুও আজ ভীষণ ভাবে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাপারটা ওকে এতটা মর্মাহত করেছে!
–তোমার জায়গা, সম্পত্তি, অর্থ-বিত্ত, দম্ভ যত বেশি তোমার জ্ঞান যেন ঠিক ততটাই কম মা। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটলোকি কাজ বোধ হয় তুমি আজ করে ফেলেছো। আমার লজ্জা করছে তোমার কাণ্ডে.. এশার সামনে যেতেও লজ্জা করছে। তোমাদের নিয়ে আমি সারাজীবন সব জায়গায় শুধু লজ্জাই পেয়ে গেছি।
ফুয়াদ থামে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। না.. এটা সঠিক সময় নয়।
পলি বেগম ছেলের দিকে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পলি বেগমের জন্য ফুয়াদকে তার পছন্দের মেয়েটি ছেড়ে চলে গেছে। কই সেদিনও তো সে এত রাগ, ক্ষোভ দেখানোর সাহস পায়নি। আজ হঠাৎ এমন আচরণ করার দুঃসাহস কোথায় পেল!
ছেলের আচরণে পলি বেগম যেন বাক্য হারা হয়ে গেল। আগেও তো তার নিয়মেই এই সংসারে সব চলেছে। তিনি ঘোর অন্যায় করলেও কেউ টু শব্দ করার সাহস করেনি। কিন্তু এশাকে বউ করে আনার পর থেকেই একটার পর একটা অস্থিরতা, ঝামেলা যেন বেড়েই চলেছে। ওই মেয়েটাই সবকিছু মূলে। এই কয়দিনেই ফুয়াদের মাথাটাও খেয়েছে।
এই মুহূর্তে পলি বেগমের ইচ্ছে হলো ফুয়াদের গালে কষিয়ে একটা চড় দিতে। কিন্তু তিনি সেটি না করে ঠাণ্ডা গলায় বলার চেষ্টা করলেন,
–তোমার হঠাৎ মনে হলো আমার জ্ঞান কম! সেটি তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে বলছো। তোমার আচরণে আমি এতটা হতবাক হয়েছি যে এই মূহুর্তে তোমাকে দেওয়ার মত যথাযথ জবাব খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার বউকে বাড়ির নিয়ম-কানুন মেনে চলতে বলো। যাও তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।
ফুয়াদ চলে আসলো। পলি বেগমের সমস্ত ক্রোধ, আক্রোশ আবার এশার উপর জমা হলো। মনে হচ্ছে এই মেয়েটি বাড়ির ভিতর ভালোই ঝামেলা পাকাবে। তার আগেই ওর যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পলি বেগম ক্রূর বিদ্রুপ করে সামান্য হাসলেন একা একা।
__
ফুয়াদ এসে এশার সামনে বসলো। এশার কান্না থেমেছে। তবে তার চোখ-মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে।
–বাইরে খেতে যাবে নাকি খাবার আনিয়ে দিবো?
ফুয়াদ জিজ্ঞাসা করল। এশা মুখ তুলে তাকালো। ওর চেহারার দুঃখ, কষ্ট সব ক্ষোভে পরিণত হলো যেন। ফুয়াদের উপর ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল,
–আপনি দয়া করে কোনো আদিখ্যেতা করতে আসবেন না। মারুফা আর শম্পা ভাবী যেভাবে চলে আমিও এখন থেকে সেভাবে চলবো। খেয়ে পরে কোনোভাবে জীবন কাটলেই হবে আমার।
ফুয়াদ এশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এ কেমন জেদ!
–আমি তো ভেবেছিলাম এই ঘটনার পর তোমার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জেদ হবে। পড়াশোনা করে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাইবে। কিন্তু এ তো দেখছি উল্টো জেদ।
এশা আবার চোখ মুছে বলল,
–এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার মত জায়গা আমার নেই। যার কোথায়ও যাওয়ার জায়গা নেই তার অত আত্মসম্মান নেই, জেদও নেই। আপনি আর কোনো নিয়মের বাইরে আমাকে ঠেলে দিবেন না। আপনার মায়ের সাথে আপনার কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ যদি থেকে থাকে সেটা নিজে মেটান। আমাকে দয়া করে আর ঢাল বানাবেন না।
এশা একটু দম ফেলে ফের বলল,
–আমি শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্যই বিয়ে করেছি। আপনার তো আর আমাকে পছন্দ নয়। বিয়ে করে মায়ের মন রক্ষা করেছেন। যেকোন মূহুর্তে দেশের বাইরে চলে যাবেন। এরপর আমি এ বাড়িতে কাজের মানুষের মত পড়ে থাকবো। আপনার মায়ের চেয়ে আপনিও আমার সঙ্গে কম নিষ্ঠুরতা করছেন না!
ফুয়াদ এসব কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল,
–আমি তোমার জন্য খাবার কিনে আনছি।
–আমি খাবো না।
ফুয়াদ এশার না শুনলো না। সে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলো। রুমের দরজা বন্ধ করে একটা প্লেটে খাবার বেড়ে এশার সামনে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–তুমি খাবে নাকি আমি খাইয়ে দিবো?
এশা কোনো কথা না বলে মুখ শক্ত করে রাখলো।
–এভাবে শক্ত হয়ে আছো কেন? মুখে খুলো। আমাকে অফিসে যেতে হবে। পাঁচটার দিকে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে একটা। আমি ব্যবসায় একটার পর একটা লস করেই যাচ্ছি। এরকম চলতে থাকলে মা আমাকে ব্যবসা থেকে আউট করে দিবে। এই মুহূর্তে সেটা করলে আমি ঝামেলায় পড়ে যাবো।
এশা মুখ খুললো না। ফুয়াদ এত অনুরোধ করলো! প্রথমে ভালো করে বলেছে, পরে রাগও হয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হলো না। এই মেয়ে এত একগুঁয়ে ওর জানা ছিলো না! তাছাড়া ফুয়াদের সঙ্গে এই প্রথম সে রাগ দেখিয়ে কথা বলেছে। এর আগে যতকিছু হয়েছে এরকম আচরণ করার সাহস করেনি। আজ হয়ত একটু বেশি কষ্ট পেয়েছে। সেজন্য রাগ দেখিয়ে ফেলেছে–ফুয়াদ এমন যুক্তিই দাঁড় করালো।
ফুয়াদ ওকে সাহসী হতে বলেছে। সেই সাহস কি এশা ওর সাথেই দেখাচ্ছে? মিটিং এর সময় হয়ে যাচ্ছে। এসব ভাবনা ঝেড়ে ফুয়াদ তৈরি হয়ে নিলো। প্লেটের খাবার অবহেলায় পড়ে আছে। এখন আর ওকে তোষামোদ করার সময় নেই। ফুয়াদ দ্রুত স্যুট বুট পরে গায়ে পারফিউম মেখে বের হওয়ার আগে আরেকবার বলল,
–ইচ্ছে হলে খেয়ে নিও।
__
ফুয়াদ অফিস থেকে ফিরে দেখে খাবার যেরকম রেখে গেছে সেরকমই পড়ে আছে। এশা বিছানার উপর জড়সড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। আশ্চর্য মেয়ে তো! ফুয়াদের এত রাগ হচ্ছে!
ও প্রথমে হাতের ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখলো। অফিসের ফরমাল পোশাক বদলে ট্রাউজার আর টি-শার্ট পড়ে নিলো। এরপর বিরক্ত মেজাজে এশার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিলো। এই মেয়ে ওর কথা শুনছে না কেন? ও বাইরে থেকে খাবার এনে দিয়েছে।
বার বার করে খেতে বলে গিয়েছে। কিন্তু সেই কথা অমান্য করলো। একটু লাই পেয়ে কী মাথায় চেপে বসেছে!
ফুয়াদের ধাক্কায় এশা ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে বলল,
–আমি খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছি। আমার ঘুম ভাঙাবেন না প্লিজ।
ফুয়াদ আর ওকে ডাকলো না। না খেলে না খাক! ওর কী তাতে। ও খাবার এনে দিয়েছে। নিজের কর্তব্য পালন করেছে। খালি পেটে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখুক।
এশার ঘুম ভাঙলো মাঝ রাতে। ফুয়াদ তখনো সজাগ। ঘুম ভাঙার পর ও প্রথমে ফুয়াদকে প্রশ্ন করল,
–আজকে কী জ্যোৎস্না রাত?
–জ্যোৎস্না অমাবস্যার খবর আমি রাখি না।
ফুয়াদ বিরক্ত গলায় উত্তর দিলো। এশা উঠে বসে হাত-মুখ না ধুয়েই প্লেটের খাবার খেয়ে নিলো। এরপর জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো উজ্জ্বল চাঁদের আলো।
–আমি কী স্বপ্ন দেখেছি জানেন?
–না জানি না।
–দেখেছি এরকম একটা জ্যোৎস্না রাতে নদীর পাড়ে বসে আছি। জ্যোৎস্নার আলোয় চারদিক এত সুন্দর দেখাচ্ছিলো!
ফুয়াদ ল্যাপটপ বন্ধ করে এশার দিকে তাকায়,
–চলো তাহলে নদীর পাড়ে বসে জ্যোৎস্না দেখতে।
ফুয়াদ ওর সাথে বিদ্রুপ করছে? কিন্তু না.. পরে বোঝা গেল সে সত্যি সত্যি ওকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এশা ভয় পেয়ে বলল,
–না, না। আপনাদের বাড়ির নিয়মের বাইরে হয়ে যায় যদি!
ফুয়াদ চোখ রাঙিয়ে তাকালো। ঝাঁঝালো গলায় বলল,
–আমার কথা অমান্য করো কোন দুঃসাহসে? দুপুরে কিছু বলিনি। এখন একদম জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিবো তোমাকে।
অগত্যা এশাকে ফুয়াদের সঙ্গে বের হতে হলো নদীর পাড়ে বসে জ্যোৎস্না দেখতে।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
(পরবর্তী পর্ব পরশু পাবেন)