#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৩
এশা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা, শীতল বাতাসে ওর চুল গুলো উড়ছে। চাঁদের ঝকঝকে আলোতে এশার মুখাবয়ব চমৎকার সুন্দর দেখাচ্ছে। ফুয়াদ সেদিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। তার মনে প্রেমে পড়ার ভয়। বিয়ে করতে হয়েছে বলেই করেছে কেবল। স্ত্রীর প্রতি প্রেম, ভালোবাসার ব্যাপার গুলো সচেতন ভাবেই উপেক্ষা করে চলেছে। মেয়েটার প্রতি অন্যায় করছে জানে। কিন্তু কি করার! সব মানুষেরই আলাদা স্বপ্ন, পরিকল্পনা থাকে। ইশা ওর জীবনের পরিকল্পনার অংশ নয়।
–দাঁড়িয়ে থাকবে? বসতে পারো চাইলে।
ফুয়াদ বলল। এশা বোধ হয় শুনতে পেল না। সে উদাস, অন্যমনস্ক হয়ে আছে।
–আপনি জ্যোৎস্না দেখতে পছন্দ করেন? নাকি আমি বলেছি দেখে এসেছেন?
অনেকক্ষণ পর এশা জানতে চাইলো। ফুয়াদ উত্তর দিলো,
–কবি সাহিত্যকরা তাদের গল্প, উপন্যাস, কবিতায় জ্যোৎস্না, বৃষ্টি এসবের অতিরঞ্জিত সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিয়ে মেয়েদের প্রভাবিত করতে পেরেছে। ছেলেদের পারে নাই তেমন। ছেলেরা অত সহজে প্রভাবিত হয় না। জ্যোৎস্না দেখতে আবার পছন্দ করার কি আছে!
–আপনার ধারণা যেসব মেয়েরা গল্প, উপন্যাস পড়ে তারাই শুধু জ্যোৎস্না, বৃষ্টি পছন্দ করে?
–বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। তোমার রুমেও অনেক বই দেখেছি।
এশা আর কিছু না বলে ঘাসের উপর বসলো। ফুয়াদ বিরক্ত গলায় বলল,
–এই রাতের বেলায় ঘাসের ভিতর সাপ, বিচ্ছু কিছু না দেখেই বসে পড়লে। উঠো।
ও সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এই জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর পাড়ে নিজের মনের তীব্র উদাসীনতা ওকে বেখেয়াল করে দিয়েছে যেন। ফুয়াদ মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখে এশাকে আবার বসতে বলল।
–এই বিয়েটা করে তুমি একটা বোকামি করলে এশা। এর চেয়ে যদি কোনো মধ্যবিত্ত পরিবারে ছোটখাটো চাকরিজীবী কাউকে বিয়ে করতে শান্তিতে থাকতে।
এশার পাশে বসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে কথাটা বলল ফুয়াদ। ও এই কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
–সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে আমার শ্বাস আটকে যায়। আপনি শেষ করুন। আমি একটু হাঁটি।
–না, না বসো। দুঃখিত।
ফুয়াদ সিগারেটটা পানিতে ফেলে দিলো।
–ছোটবেলা থেকে কষ্ট করে বড় হয়েছি এজন্য মা সব সময় চাইতেন আমার ধনী পরিবারে বিয়ে হোক। যাতে আমার জীবনে কোনো অভাব না থাকে। ধনী পরিবার থেকে আমার জন্য আরো বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু বেশিরভাগই আমার সম্পর্কে জেনে পিছিয়ে গেছে। যারা আমার চেহারার কারণে একটু আগ্রহ করেছিল তাদের আবার চাহিদা ছিলো ধুমধাম করে বরযাত্রী খাওয়ানো, ঘর সাজিয়ে দেওয়া। কিন্তু এসব মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। মধ্যবিত্ত পরিবারের যে প্রস্তাব মা একটু পছন্দ করতেন তাদের আরো বেশি চাহিদা ছিলো।
এশা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,
–কিন্তু আপনারা বিয়েতে কিচ্ছু চাননি। অর্থবিত্তও অনেক। আপনিও দেখতে ভালো। এত ভালো প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বিয়ের পর লেখাপড়া করতে না পারার ব্যাপারটা তুচ্ছ মনে হলো মায়ের কাছে। এছাড়া সূবর্ণা ভাবীর আচরণও মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। গৃহহীন হওয়ার অবস্থা প্রায়। মা দ্রুত আমার বিয়ে দিয়ে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে চেয়েছিলেন।
ফুয়াদ চুপ থেকে কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল,
–আমি দেখতে ভালো? তোমার ভালো লাগে আমাকে?
–হ্যাঁ।
–তুমিও তো দেখতে সুন্দর। একটা প্রেম ট্রেম করে বিয়ে করতে পারতে। অন্তত কারো ভালোবাসা পেতে। তোমার কোনো প্রেম ছিলো না?
–না। আপনার ছিলো?
–সাতাশ বছরের এই লম্বা জীবনে দুই-একটা প্রেম থাকবে না!
–প্রেম ছিলো তো বিয়ে করেননি কেন?
–মায়ের জন্য পারিনি।
–মায়ের সঙ্গে এটা নিয়েই আপনার ঝামেলা?
–মায়ের সঙ্গে আমার কোনো ঝামেলা নেই। এই প্রসঙ্গ বাদ দাও।
ঝামেলা অবশ্যই আছে। এতটা ভয়াবহ ঝামেলা যে সে পরিবারের কারো কাছে না বলে দেশ ছাড়তে চাচ্ছে। এশা এই ব্যাপারে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ও আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ফুয়াদ দুই হাতের তালুতে মাথা রেখে ঘাসের উপর শুয়ে পড়েছে। হঠাৎ এশাকে বলল,
–আমি বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করি না। বাবা হওয়া মানে কাঁধে বিশাল দায়িত্ব। এই ছোট জীবনে অত দায়িত্ব নেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমার কাছে নেই। আমি যে মেয়েটাকে বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছিলাম সে এই ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নিয়েছিলো।
ফুয়াদ একটু থেমে বলল,
–তোমার সঙ্গে এই সম্পর্কটা কতদূর যাবে জানি না। কিন্তু তুমি কি এই ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিতে পারবে? তুমি কখনো মা হবে না..।
এশা তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর দিতে পারলো না। ওকে হতভম্ব দেখাচ্ছে। এটা সহজ ভাবে নেওয়ার মত ব্যাপার! অনেকক্ষণ ভেবেও এরকম অস্বাভাবিক চিন্তাভাবনা ও সহজ ভাবে নিতে পারলো না।
–কি হলো কথা বলছো না কেন?
এশা নিজেকে সামলে স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করলো,
–আমি বাচ্চাকাচ্চা অনেক পছন্দ করি।
–আমি অপছন্দ করি না। অর্পি, রাঈদ ওদের কোলে নিই, আদর করি। কিন্তু দুই-চারটা ছেলে-মেয়ে জন্ম দিয়ে তাদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার মত বাড়তি ঝামেলা আমি আমার জীবনে নিবো না। আমার কাছে এসবের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
এশা টের পেল ওর মাথার ভিতর ঝিমঝিম করছে। ফুয়াদের সঙ্গে সম্পর্কটা এখন পুরোপুরি ঠিক না থাকলেও ও মনে মনে আশা করেছিল, একদিন সব ঠিক হবে। ওর জীবনটা নিশ্চয়ই সুন্দর হবে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওর মনে সেই আশা ভঙ্গের আশঙ্কা। ফুয়াদ আর ও সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ। এমনকি সে অন্য পাঁচটা মানুষের চেয়েও আলাদা। এশা এখনো তাকে পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। যদিও এত সহজে বুঝে উঠার মত মানুষও সে না। তবে যেটুকু বুঝেছে তাতে স্পষ্ট যে ফুয়াদের জীবনের স্বপ্ন, পরিকল্পনায় কোথায়ও ওর জায়গা নেই। তাহলে ওর জীবনটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এশা অনেকক্ষণ পর বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,
–সবার জীবনেই কষ্টের পর সুখ আসে আপনি কি এ কথায় বিশ্বাস করেন?
–না। জীবন সবার সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করে না।
–আমারও তাই মনে হয়। এই যেমন ধরুন আমার মায়ের জন্ম খুব দরিদ্র পরিবারে। কষ্ট করে বড় হয়েছে। এরপর যখন বিয়ে হলো আমার বাপেরও তেমন আর্থিক অবস্থা ছিলো না। টানাপোড়েনের ভিতরই আমার জন্ম হলো। এরপর আমার বাবা মারা গেল। যখন দ্বিতীয় বিয়ে হলো সেই মানুষটাও মারা গেল। এরপর আরো কষ্ট করে জীবন কাটালো। এখন ভাইয়ের বাসায় উটকো ঝামেলার মত। সেখানেই হয়ত অবহেলায় মারা যাবে। মার জীবনে কখনো কষ্টের পরে সুখ আসেনি।
এশা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–আমি সুখের অপেক্ষায় দিন গুনছি। কিন্তু মায়ের ব্যাপারটা উপলব্ধি করার পর আমার ভীষণ ভয় করছে। হয়ত জীবন তার মত আমার সঙ্গেও ন্যায্য আচরণ করবে না। একটা মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শুধু দুঃখই করবে। কি ভয়াবহ ব্যাপার তাই না?
এশা উঠে দাঁড়ালো। এই জ্যোৎস্না, তার আলোয় উজ্জ্বল নদীর জল–এসব কিছুই এশার এই মুহুর্তে ভালো লাগছে না।
–আচ্ছা বাসায় চলুন।
–জ্যোৎস্না দেখা শেষ?
–হ্যাঁ।
ফুয়াদও উঠে দাঁড়ালো। এশা আগে আগে হাঁটছে। ফুয়াদ দ্রুত কয়েক পা হেঁটে এসে ওর পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। সে বুঝতে পেরেছে বাচ্চা না নেওয়ার সিদ্ধান্তটা এশা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। ও খুব সাধারণ মেয়ে। বড় হওয়ার পর থেকেই হয়ত বাচ্চাকাচ্চা সহ একটি সংসারের স্বপ্ন দেখেছে। তাই এই ব্যাপারটা শুনে ধাক্কা খাওয়া স্বাভাবিক।
এশা ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে জিজ্ঞেস করল,
–আপনি সত্যিই কাউকে না জানিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন?
–হুম।
–আপনি বাবা হতে চান না এটাও সত্যি?
–তোমার সাথে এসব নিয়ে আমি ফাজলামি কেন করবো বলো?
–বিয়ের আগে কেন বলেননি তাহলে?
–তুমি তো আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে চাওনি।
–বাচ্চা নেওয়ার মত স্বাভাবিক ব্যাপার আলাদা করে আবার কে জানতে চায়?
–জানি না।
–আমার যদি কোথায়ও যাওয়ার জায়গা থাকতো আমি আপনাদের বাসায় যেতাম না। যেদিন আপনি আমাকে চড় মেরেছেন সেদিনই চলে যেতাম। আমার সমস্ত আত্মসম্মান জীবনের কাছে অসহায়।
এই বলে এশা হঠাৎ ফুয়াদকে জড়িয়ে ধরলো। ওর চোখে জল ছলছল করছে। ও ব্যাকুল স্বরে বলল,
–ফুয়াদ আমার ভালো থাকতে ইচ্ছে করে। আপনাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
ফুয়াদ কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। যেন এই ব্যাপারে সে বড়ই অপারগ।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা