#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-১৫
এই মেয়েটির নাম হলো সুস্মিতা। নামের মতই তার হাসি সুন্দর। সম্পার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘ভিতরে আসবো?’
এ বাসায় কাউকে ঢোকার অনুমতি দেওয়ার ও কে! তবুও বলল,
-জি আসুন।
সুস্মিতা ভিতরে ঢুকে শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসল। ইদানিং এত গরম পড়ছে! ও গাড়ি নিয়ে এসেছে। তবুও গলা শুকিয়ে গেছে। সম্পাকে বিনয়ের সাথে বলল,
-আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দেওয়া যাবে?
-অবশ্যই যাবে। আপনি বসুন। আমি নিয়ে আসছি।
এ বাড়িতে এমনি ঝামেলার শেষ নেই। এই মেয়ে আবার কেন এসেছে। আশ্চর্য কারবার!
সম্পা ঠাণ্ডা পানি আনতে গিয়ে দেখলো ফ্রিজ লক করা। কয়দিন ধরে ভ্যাপসা গরম পড়ছে। রান্নাঘরে গরমটা আরো বেশি লাগে। এই গরমে সমস্ত রান্না একা করে ওর মেজাজ বাইরের আবহাওয়ার চেয়ে এই মুহুর্তে আরো বেশি উত্তপ্ত। সম্পাও একটু ঠাণ্ডা পানি খেতে চেয়েছিল। ফ্রিজের ভিতর কি এমন আছে যে সেটাকে লক করে রাখতে হবে! পলি বেগমের কাণ্ডকারখানা দেখলে এত রাগ হয়, প্রচণ্ড রাগ। সেই রাগ নিঃশব্দে হজম করা খুব কঠিন ব্যাপার। ইদানিং সে খাবার-দাবার সব আটকে আটকে রাখছে। নিশ্চয়ই এভাবে এশাকে শায়েস্তা করতে চাচ্ছে।
সম্পা এক গ্লাস লেবুর শরবত গুলে নিয়ে গেল সুস্মিতার জন্য। সুস্মিতা ঠাণ্ডা পানি ভেবে এক ঢোক খেয়ে রেখে দিলো। মেয়েটির কাছে ঠাণ্ডা পানি চেয়েছে। সে বোধ হয় একটু আতিথেয়তা করতে শরবত নিয়ে এসেছে।
-আপনি শরবত খেতে পছন্দ করেন না?
-আমি মিষ্টি জাতীয় কিছুই পছন্দ করি না।
সম্পা রাগের মাথায় ফট করে বলে ফেলল,
-আমার শাশুড়ি মা ফ্রিজ লক করে রেখেছে। সেজন্য আপনাকে ঠাণ্ডা পানি দিতে পারছি না। দুঃখিত। আপনি ফুয়াদকে বিয়ে না করে ভীষণ ভালো করেছেন। বড় বাঁচা বেঁচেছেন।
-আপনি আমাকে কীভাবে চিনলেন?
-ছবিতে দেখেছিলাম।
-ও আচ্ছা।
সম্পা এবার একটু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল,
-আপনি হঠাৎ এখানে কেন এসেছেন?
-বিশেষ কোনো দরকারে আসিনি। এমনি।
সুস্মিতা একটু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-ফুয়াদ কোথায়? বাসায় আছে?
-না অফিসে। আপনি ফুয়াদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?
-না, ফুয়াদের সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। বাসায় কি এই মুহুর্তে আপনি একা আছেন?
-না। আমার শাশুড়ি মা, বড় ভাবী, ফুয়াদের বউ আছে। তাদের ডাকবো?
সুস্মিতাকে একটু বিষণ্ণ দেখালো। সে এই বিষণ্ণতা লুকানোর চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল,
-ফুয়াদ সত্যি বিয়ে করেছে?
-হুম। আপনি জানেন না?
-শুনেছি। তবে বিশ্বাস হয়নি।
সম্পা এরপর বলার মত কিছু পেল না। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই ওর সাথে গল্প করতে আসেনি। ফুয়াদের সঙ্গেও নাকি দেখা করতে আসেনি। তাহলে কেন এসেছে? কাউকে ডাকতেও বলছে না। অদ্ভুত ব্যাপার! ও কি এখন বসে বসে এভাবে গল্প করবে?
-কাউকে ডাকবো?
সম্পা আবার জিজ্ঞেস করল। সুস্মিতা বলল,
-আপনার কি তাড়া আছে?
-না তাড়া নেই। কিন্তু আপনি কি এখানে আমার সাথে গল্প করতে এসেছেন?
-না তা অবশ্য আসিনি। আচ্ছা ফুয়াদ এখন কি করছে? চাকরি নাকি ফ্যামিলি বিজনেসেই আছে?
-ফ্যামিলি বিজনেসেই আছেন।
-ফুয়াদের বউ চাকরি করে নাকি পড়াশোনা?
-কোনোটাই না। বিয়ের আগে পড়াশোনা করত। এখন সেটিও বন্ধ।
-ওহ। কোন ক্লাসে পড়তো?
-অনার্স থার্ড ইয়ার।
সুস্মিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সম্পাকে বলল,
-আমি বিশেষ কোনো দরকারে আসিনি। এ বাড়ির কারো সাথে দেখা করতেও আসিনি। তবে আপনাকে পেয়ে বোধ হয় ভালো হলো। আমি আপনার সাথেই একটু কথা বলে চলে যাবো।
এই মেয়েটি নাকি খুব ধনী পরিবারের। দেশের বাইরে থেকে লেখাপড়া করেছে। তার শখ হলো ভ্রমণ করা। ফুয়াদের সঙ্গে যখন বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন শুনেছিল এই বয়সেই নাকি সে ত্রিশটা দেশে ঘুরেছে। এখন নিশ্চয়ই আরো বেশি হবে।
সুস্মিতাকে তখন খুব দাম্ভিক, নাক উঁচু কল্পনা করেছিল সম্পা। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের পরিচয়ে ওর সেই ভুল ভাঙলো। সুস্মিতার আচার ব্যবহার, কথাবার্তায় দারুণ বিনয় আর নম্রতা।
সম্পা একটু ইতস্তত করে বলল,
-আমার শাশুড়ি মাকে একটু ডেকে দেই? আপনি এ বাসায় এসেছেন অথচ আমি তাকে ডাকিনি জানলে ঝামেলা হবে।
-ঠিক আছে যাওয়ার আগে আমি তাহলে তার সঙ্গে দেখা করে যাবো। আচ্ছা এখন আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো।
-কি কথা?
-ফুয়াদকে বিয়া না করা আমার জন্য রাইট
ডিসিশন ছিলো নাকি রং? এই ব্যাপারটা আমাকে খুব বেশি যন্ত্রণা দেয়।
-অবশ্যই রাইট ডিসিশন ছিলো। আপনি তো আর আমাদের মত সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। বিদেশী ডিগ্রি, দেশ-বিদেশ ঘোরা বন্ধ করে আটপৌরে গৃহিণীর মত জীবন কাটাবেন।
সুস্মিতার চোখে মুখে অসহ্য দুঃখ দেখা গেল। সে বেদনা জর্জরিত কণ্ঠে বলল,
-এসব যুক্তি আমার মনকে কেন শান্ত করতে পারছে না বলুন?
সম্পা কি বলবে বুঝতে পারলো না। সুস্মিতার চোখ ভেজা দেখালো। একটু পরই তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়াতে লাগলো। সম্পা বিব্রত বোধ করলো। এই মেয়েকে এখন ও কি বলে সান্তনা দিবে!
সম্পার সান্তনা দেওয়ার দরকার হলো না। সুস্মিতা তার হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়।
সেই কখন চুলায় মাংস বসিয়ে রেখে এসেছে। আছে নাকি পুড়ে ছাই হয়েছে! সর্বনাশ হবে তাহলে। সম্পা দ্রুত রান্না ঘরের দিকে ছুটে যায়। ঝোল সব টেনে গেছে। নিচে সামান্য লেগেছে। তবে পোড়া গন্ধ আসছে না। আল্লাহ বাঁচিয়েছে।
সম্পা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে লিভিং রুমের দিকে গেল না। ও পলি বেগমের রুমের দিকে গেল। সুস্মিতার আসার খবরটা পলি বেগমকে জানানো উচিত। যদিও সে বলেছে যাওয়ার সময় দেখা করে যাবে। কিন্তু সম্পার কেন যেন মনে হচ্ছে সে দেখা না করেই চলে যাবে। পরে আবার এটা জানাজানি হলে ও মুশকিলে পড়বে।
পলি বেগমের রুম ভিতর থেকে আটকানো। সম্পা কয়েকবার কড়া নাড়লো। কোনো সাড়াশব্দ নেই। দুপুরে এই সময় সে প্রায়ই ঘুমায়। তার ঘুম খুব ভার। অনেকক্ষণ যাবৎ ডেকেও লাভ হলো না।
মারুফাকে ডাকবে? একবার ডাকতে চাইলেও পরে আবার ইচ্ছা করলো না। বদমাশ একটা! সব কাজ ওর উপর চাপিয়ে নিজে আরাম করছে।
এশাকে খবরটা দিবে কিনা সেটা নিয়ে খাকিনক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলো সম্পা। স্বামীর প্রাক্তন বাড়িতে এসেছে নিশ্চয়ই খুশির খবর না। মেয়েটার শরীর অসুস্থ। এই অখুশির খবরটা ওকে দিয়ে লাভ নেই।
সম্পা লিভিং রুমে এসে দেখলো সুস্মিতা এখনো শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। যেন তার কোনো তাড়া নেই। সে কি আজ সারাদিন এভাবেই বসে থাকবে? মেয়েটার সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে না। কিন্তু সে হঠাৎ এ বাড়িতে কেন এসেছে কারণটা স্পষ্ট না। এখন তো মনে হচ্ছে শুধু মাত্র সম্পার সঙ্গে গল্প করতে এসেছে। খুব অদ্ভুত ব্যাপার তো!
-তরকারি কি পুড়ে গেছে?
-আর একটু দেরি হলেই পুড়ে যেত।
-আচ্ছা আমি এখন উঠি। ফুয়াদের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আমার ইচ্ছে করছে না।
-আপনি আসলে কেন এসেছেন বলুন তো?
সুস্মিতা এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আরেকটি গলা ভেসে আসলো। এশা লিভিং রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুর্বল গলায় বলল,
-ভাবী আপনার থার্মোমিটারটা একটু দেওয়া যাবে? জ্বরটা মেপে দেখবো।
কথাটা বলার পর সুস্মিতার দিকে চোখ গেল। ও সম্পার দিকে জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সম্পা কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবে বুঝতে পারলো না।
-ফুয়াদের বউ?
সুস্মিতা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো সম্পাকে। ও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। সুস্মিতা সোফা ছেড়ে উঠে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে এশার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
-হাই! আমি ফুয়াদের বন্ধু। এখান দিয়ে যাওয়ার পথে ভাবলাম একটু বসে যাই। কিন্তু ফুয়াদকে বাসায় পেলাম না।
-আপনি বসুন। ফুয়াদ দুপুরের খাবার খেতে এক্ষুণি বাসায় আসবেন বোধ হয়। আপনিও দুপুরে খেয়ে যাবেন।
এখানে আসা মোটেই উচিত হয়নি! কি দরকার ছিলো! নিজের মনকে শান্ত করতে এসে যেন আরো অস্থিরতা বাড়িয়েছি। ফুয়াদের সাথে বিয়ে হলে ও ভালো থাকতো না, ফুয়াদকে ছেড়ে চলে গিয়ে ও ভুল করেনি সেটা নিজের চোখে দেখতে এসেছে। এবং দেখেছে ও তো। তবুও কেন হাঁসফাঁস লাগছে? বুকের ভেতর ছটফট করছে!
ফুয়াদের কানের কাছে ফোন। সে ফোনে কথা বলতে বলতে বাসার ভিতরে ঢুকলো। বাসার দরজা চাপানোই ছিলো। কলিংবেল বাজানোর দরকার হয়নি। দুপুরে খাবার খেয়ে বিকালে একটা কাজে যাবে। আইইএলটিএস এর জন্য বই কিনতে হবে। ফোনে কথা বলতে বলতে অমনোযোগী ভাবে লিভিং রুমে প্রবেশ করে ফুয়াদ। সেখানে পা রেখেই ও থমকে গেল। ওর হৃৎস্পন্দন কয়েক মূহুর্তের জন্য থেমে গেল।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
(অনিয়মিত গল্প দেওয়ার পরও যারা বকাঝকা না করে ধৈর্য ধরে পড়ছেন তাদের জন্য ভালোবাসা। যারা বকাঝকা করছেন তাদের জন্য কম ভালোবাসা।
আপনাদের জন্য ভালো খবর হচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যে আবার নিয়মিত গল্প দিবো। এই ধরুন আর চার-পাঁচ দিন পর থেকেই)