#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-২
এশাকে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে যেতে বলা হয়েছে। ও বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সা ডাকলো। বাইরে আজ এত কড়া রোদ! এশা বার বার ওড়না দিয়ে মুখের ঘাম মুছছে।
রিক্সা থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের সামনে অপেক্ষারত কাউকে এশার চোখে পড়লো না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এদিক-ওদিক তাকালো। ছেলেটার কাছে তো ওর ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। সে এখানে আসলে নিশ্চয়ই কল দিতো। তার মানে আসেইনি!
ঘন্টা খানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর এশার এবার কান্না পেল। এই জলে ভাসা পদ্মর মত জীবনটাকে একটু ঠাঁই পাওয়ানোর জন্য লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করতে চেয়েছিল! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা কেন ওকে এই দুর্দশার জীবন দিলো? এশা চোখ মুছে কান্না চাপানোর চেষ্টা করে। এখানে দাঁড়িয়ে বোকার মত কাঁদলে মানুষজন কি ভাববে!
–আপনি এশা?
এশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অসম্ভব সুদর্শন দেখতে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। ইনি ফুয়াদ? মাথায় চুল কম, ভুঁড়ি মোটা কাউকে ধারণা করেছিল এশা। কিন্তু তার তো মাথা ভর্তি চুল, লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের পুরুষ।
এশা মৃদু কণ্ঠে বলল,
–জি আমি এশা।
–আমি ফুয়াদ। অনেকখানি দেরি করে ফেললাম। দুঃখিত। চলুন রেস্টুরেন্টের ভিতরে গিয়ে বসি।
এই বলে ফুয়াদ এশার অপেক্ষা না করে আগে আগেই রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকে পড়লো। এশার নজর গেল ফুয়াদের পোষাকের দিকে। সে একটি জার্সি, ট্রাউজার এবং সাধারণ জুতা পরে এসেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বাসার সামনের চায়ের দোকানে এক কাপ চা খেতে বেরিয়েছে। এশার সঙ্গে দেখা করা কি এতখানি গুরুত্বহীন ব্যাপার?
–আপনি কি খাবেন অর্ডার করুন। খাবার আসতে আসতে আমরা আলাপ করি।
ফুয়াদ এশার দিকে মেনু কার্ডটা ঠেলে দিলো।
–আমি কিছু খাবো না।
–অন্তত এক কাপ কফি নিন। দেরি করেছি বলে রাগ করলেন? রেগেমেগে কান্না করেছেন?
ফুয়াদ একটু হাসলো। তার সুশ্রী মুখমণ্ডলে বুদ্ধিদীপ্ত হাসি, উজ্জ্বল দৃষ্টি এশার নজর এড়ায় না। নিশ্চয়ই ওর লালচে চেহারা দেখে একথা বলছে।
ফুয়াদ কফি অর্ডার দিয়ে এশাকে প্রশ্ন করল,
–আপনি কি খুব বিপদে আছেন?
এশা এ কথার অর্থ বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকিয়ে রইল।
–পড়াশোনা ছেড়ে বিয়ে করছেন কেন?
এশাকে অপ্রস্তুত মনে হলো,
–বিয়ের পর আপনার পরিবারে তো পড়াশোনা অ্যালাউ করবে না।
–সেটি আমি জানি। কিন্তু এধরনের পরিবারে আপনাকে বিয়ে কেন করতে হবে?
এশা কোনো উত্তর দিলো না। ফুয়াদ কি জানে না ওর ব্যাপারে? শুধু শুধু এসব প্রশ্ন কেন করছে? এইটুকু আলাপের মাঝেই এশা বুঝতে পারলো ফুয়াদ কোনো সহজ মানুষ নয় যাকে চট করে বুঝে ফেলা যাবে।
ওয়েটার কফি হাতে এসেছে। ফুয়াদ কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বলল,
–আপনাকে বোধ হয় কঠিন প্রশ্ন করে ফেললাম। আচ্ছা অন্য কথা বলি। আপনার পছন্দের খাবার কি?
–ভাত, মাংস।
–এই মুহূর্তে আপনাকে এক প্লেট ভাত, মাংস খাওয়ালে আপনার মন ভালো হবে?
এশা মনে মনে বিস্মিত হলো। ফুয়াদকে এক্ষুণি বোঝার চেষ্টা করে বোধ হয় লাভ নেই।
ফুয়াদ এশাকে এক প্রকার জোর করে ভাতের হোটেলে নিয়ে গেল। এরপর এক প্লেট ভাত এবং গরুর মাংস অর্ডার করলো।
খুব অদ্ভুত লাগছে। ও ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে বসে থাকলো। এই অল্প পরিচিত লোকটার সামনে ভাত খেতে ওর অস্বস্তি লাগছে।
–আচ্ছা আপনি খাওয়া শেষ করুন। আমি আসছি।
ইনি কি মন পড়তে জানে? ফুয়াদ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে কোথাও গেল। এশা খেতে শুরু করলো। খাওয়া শেষ হতেই দেখে ফুয়াদ ফিরে এসেছে। এশা সিগারেটের গন্ধ পেল। খুব সম্ভবত ফুয়াদ বাইরে বসে সিগারেট খেয়েছে।
–খাবার কেমন ছিলো?
–ভালো।
–আপনি যেন কিসে পড়ছেন? থার্ড ইয়ার নাকি ফোর্থ ইয়ার?
–থার্ড ইয়ার।
–অনার্স শেষ করতে চান?
–এতদূর এসে কি কেউ লেখাপড়া ছাড়তে চায়?আসলেই বিপদে পরে বিয়েতে রাজি হয়েছি। সৎ বাপের আগের পক্ষের ছেলের সংসারে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। একটু ভালো খেয়ে পরে থাকার জন্য রাজি হয়েছি।
–আপনি আমাদের বাড়িতে ভালো খেয়ে পরে থাকতে পারবেন তার নিশ্চয়তা কি?
এশা কিছু বলল না। ফুয়াদ বলল,
–আবার বোধ হয় কঠিন প্রশ্ন করে ফেলেছি। আচ্ছা এশা আপনার পছন্দের রং কি?
–সাদা।
–ঠিক আছে আপনি তাহলে এখন বাসায় চলে যান।
এশা টেবিল ছেড়ে উঠে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ফুয়াদের দিকে আরেক বার তাকালো। লোকটার মানুষকে আকর্ষণ করার অসম্ভব ক্ষমতা আছে। এশাও আকর্ষণ বোধ করছে।
–এশা শুনুন। শুধু ভালো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য বিয়ে করতে হবে না। আমি আপনাকে পড়াশোনা শেষ করাবো। আনন্দ নিয়ে এবার বিয়েটা করুন।
এশা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বলল,
–আপনার মা বলল যে! আপনাদের বাড়িতে সবকিছু তো তার মতামতে হয়।
ফুয়াদ এই কথার উত্তর না দিয়ে তার বাইকে চেপে বসলো। প্রচণ্ড গতিতে বাইকটা মুহূর্তেই এশার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।
__
পলি বেগমের বড় ছেলের বউ মারুফা হাসি মুখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
–মা সন্ধ্যার নাস্তায় কি তৈরি করবো?
এ বাড়িতে প্রতিদিনের খাবার পলি বেগমের ফরমাশে তৈরি হয়। এমনকি কে মুরগির রান কিংবা বড় মাছের মাথাটা পাবে সেটিও তিনি ঠিক করেন।
–চিকেন নাগেটস, স্যান্ডউইচ আর ফলের জুস তৈরি করো।
–ঠিক আছে।
এর ভিতর ফুয়াদ বাসায় আসলো। পলি বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
–মেয়ে কেমন দেখলে?
–ভালো সুন্দর।
–আমার পছন্দ কখনো খারাপ হয় না। মেয়েটা এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে। তোমার সাথে আলাপ হয়েছে। তুমি তো তা নিশ্চয়ই জানো।
–হ্যাঁ।
–অনার্স শেষ করতে চাইছে বোধ হয়। কিন্তু এত ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারে নাই। চারকুলে তো কেউ নেই।
ফুয়াদ বলল,
–অনার্স শেষ করে কি করবে? এ বাড়ির বউয়েরা তো আর চাকরি করে না। সংসার করতে এত পড়াশোনার দরকার হয় না।
–সেটাই তো।
–আচ্ছা আমি উঠি তাহলে। রুমে যাবো। ক্লান্ত লাগছে। বিশ্রাম নিবো।
–যাও।
ফুয়াদ রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো। এরপর ব্যালকনির আরামকেদারায় বসে সিগারেট ধরালো। রুমের বাইরে সিগারেটের গন্ধ গেলে আবার ঝামেলা!
__
পলি বেগম একটি হিসাবের ডায়েরি নিয়ে বসলেন। বিয়ের কোথায় কত খরচ হবে তা হিসাব করছেন। গহনা দিবেন দশ ভরি। তার বড় দুই ছেলের বউকেও দশ ভরিই দিয়েছেন। তবে সেইসব গহনা তার আয়ত্তেই আছে। দিয়েছে মানে এই নয় যে গহনা একদম বউদের হয়ে গেছে! বাপের বাড়িতেও ভারি কোনো গহনা পরেও যেতে দেন না বউদের।
বিয়েতে তেমন কাউকেই বলবেন না। একদম ছোট ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে হবে। শুধু শুধু টাকা পয়সা খরচা করে আত্মীয়স্বজন খাইয়ে কোনো লাভ নেই। গৃহস্থের খরচ ঠিকই যায় কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সুনাম পাওয়া যায় না। কেউ বলবে মাংস কম পেয়েছে, কেউ আবার রোস্টে লেগ পিস পায়নি বলে গোঁসা করবে! এত ঝামেলার মধ্যে সে নেই। এই ছোট লোক গুলোকে খাইয়ে কোনো নাম নেই।
পলি বেগম মাঝরাত পর্যন্ত বসে বসে ঠাণ্ডা মাথায় সব হিসাব কষলো। খরচা শুধু গহনা কিনতেই যাবে। সেটা গেলেও ভালো। স্বর্ণের দাম দিন দিন বাড়ছে। বউকে সাজপোশাক, অন্যান্য সামগ্রী দিবেন অল্প টাকার মধ্যে।
__
সুবর্ণার হিংসে হচ্ছে। এশার এত ভালো বিয়ে হবে! ওর চেয়ে ভালো শাড়ি, গহনা পরবে এশা! শুনেছে ছেলেটা দেখতেও নাকি নায়কের মত। সুবর্ণা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এশাকে বিয়ের পর লেখাপড়া করাবে না শুনে একটু শান্তি পেয়েছিল। কিন্তু এখন শুনছে ওই ছেলে নাকি লেখাপড়াও করাবে।
সুবর্ণার রাতে ঘুম ভালো হলো না। খাবারও গলা দিয়ে নামছে না। দশ ভরি স্বর্ণ দিবে নাকি এশাকে! বিয়েটা কোনো ভাবে ভেঙে যেত! সুবর্ণার মনে শান্তি ফিরে আসতো। কিভাবে বিয়েটা ভাঙা যায়?
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা