এই_জোছনা_ধারায় #পর্ব-৩

0
5

#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৩

সূবর্ণা বিয়ে ভাঙার কোনো উপায় খুঁজে পেল না। ওর গলায় ধরে কাঁটার মত আটকে থাকা আপদ বিদায় হচ্ছে এতদিনে! শুনেছে মেয়ের বিয়ের পর মিনারা বেগমও এ বাসা ছাড়বেন। দুই জনার একার সংসার হবে। এই খুশিতে তো ওর আত্মহারা হবার কথা। কিন্তু কোথায়ও যেন ভাটা পড়েছে। এশার যদি একটা ছোট ঘরে বিয়ে হতো তাহলে ওর ঈর্ষাকাতর মন শান্তি পেত।

আজ বিয়ে। ঘরোয়া পরিবেশে অতি সামান্য আয়োজন। বরযাত্রীও এসেছে মাত্র বারো জন। বরকে বাদ দিয়ে এগারোজন। বাইরের কেউ না। ফুয়াদের দুই ভাই-ভাবী, একমাত্র বোন, দুলাভাই, এবং তাদের বাচ্চাকাচ্চা।

এশার শ্বশুর বাড়ি থেকে দশ ভরি গহনা এনেছে শুনে আশেপাশে কিরকম সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু বিয়ের অন্যান্য সাজপোশাক সে তুলনায় খুব সাধারণ মনে হচ্ছে। এগুলো স্বর্ণ নাকি ইমিটেশন? যাদের এত গহনা দেওয়ার অর্থ আছে, তারা সাজপোশাকও নিশ্চয়ই জাঁকজমক দিবে। আশপাশ থেকে এধরনের কথা শোনা গেল।

এটা পলি বেগমের বুদ্ধি। দামী সাজপোশাক কিনে টাকা নষ্ট করতে চাননি তিনি! গহনা দিলে লোকসান নেই, এর ভ্যালু সারাজীবন থাকবে। এছাড়াও ছেলের বিয়ে কোনো বড় পরিবারে দিচ্ছে না যে দামী জিনিসপত্র দিতে হবে।

বিকালে বিয়ে হলো। কিরকম অবাস্তব মনে হচ্ছে। এশা ধাতস্থ হতে পারছে না। জীবনটা এবার একটু সহজ হবে তো? অজ্ঞাত আশঙ্কা, ভয় ওকে বিমর্ষ করে দিচ্ছে ক্রমশ। চোখের পানিতে সাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ও শুধু মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে, আল্লাহ জীবনটা এবার যেন একটু সহজ হয়।

বরযাত্রী খাওয়া-দাওয়া সেরে সন্ধ্যার পর বউ নিয়ে রওয়ানা দিবে। এশা লাল বেনারসি পরে বসে আছে। ফুয়াদ সামনের রুমটাতে সবার সঙ্গে। খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালেই স্পষ্ট দেখা যায়। এশা কয়েক বার তাকালো। শেরওয়ানি গায়ে তাকে দেখতে অপূর্ব লাগছে। এই সুদর্শন মানুষটি ওর জীবন সঙ্গী ভাবতেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়! ওর মত ঠাঁই ঠিকানাহীন মেয়ে এত ভালো বর কল্পনাও করেনি।

কনে বিদায়ের সময় কেবল মিনারা বেগমই কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি মূর্ছা গেলেন। তার সমস্ত দুঃখ যেন আজ নতুন করে মনে পড়ছে।

বিশাল আঘাত পেলেও এশা হাউমাউ করে কাঁদতে পারে না। ও নিঃশব্দে কাঁদলো। ছোট বেলা থেকে এ বাড়িটায় বেড়ে উঠেছে। চিরচেনা বাড়ি, অতিপরিচিত রুম, প্রিয় বারান্দাটা… কোনো কিছুতেই ওর অধিকার নেই। ও এই বাড়ির কেউ না, এই পরিবারের সদস্য না! তবুও এটাকে নিজের বাড়ি কেন মনে হয়! ছোট বেলা থেকেই জানা এই পরিচিত সত্যিটাও আজ এত নির্মম হয়ে উঠছে কেন!
___

ফুয়াদ গাড়ির দরজা খুলে দিলো। এশা উঠে সিটে বসে। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো। এশা এবার কান্না থামিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকালো। ফুয়াদের সাথে আজকে এখনো কোনো বাক্য বিনিময় হয়নি ওর। সবার সামনে সদ্য বিবাহিত বউয়ের সাথে আলাপ করতে একটু লজ্জা লাগছে বোধ হয়। এতক্ষণ এশা এটাই ভেবেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তেও তো ওরা পাশাপাশি সিটে বসে আছে। পাশে বসে থাকা নতুন বউয়ের দিকে এক পলক তাকানোর মত আগ্রহ তার ভিতর দেখা গেল না! তাকে অমনোযোগী, উদাসীন মনে হচ্ছে। তার চোখে মুখের তীব্র বিরক্তিও স্পষ্ট।

এশা বিচলিত হয়। সেদিন যখন প্রথম দেখা হলো কি চমৎকার ভাবে কথাবার্তা বলেছিল! কিছুক্ষণের আলাপে ওকে দারুণ ভাবে মুগ্ধ করে ফেলে। এরপর থেকে এশা বিয়ের দিন গুনছিলো। আবার কবে দেখা হবে, কবে ফুয়াদের চমৎকার সঙ্গ উপভোগ করবে! কিন্তু আজ কি হলো?

এশা কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবেও থেমে গেল। সংকোচ বোধ হচ্ছে। ফুয়াদ নিজে থেকে আলাপ শুরু করবে–এই অপেক্ষায় থাকলো। কিন্তু সে গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে আছে অনেকক্ষণ ধরে।

–আপনার কি অসুস্থ লাগছে?

সংকোচ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলো এশা। ফুয়াদ চোখ মেলে ওর দিকে তাকালো। ভারী গলায় বলল,

–না। আমাকে দেখে কি অসুস্থ মনে হচ্ছে?

–কথা বলছেন না তাই জিজ্ঞেস করলাম।

ফুয়াদ একটু হাসলো। তার হাসিতে কোনো জৌলুস নেই।

–বউ সাজে তো তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।

এই প্রশংসা এশাকে খুশি করতে পারলো না। ওর মুখ ম্লান হয়ে গেল ফুয়াদের গা ছাড়া আচরণে। সে এত নির্লিপ্ত আচরণ কেন করছে? মনে হচ্ছে এই বিয়েটিয়ে এসবের কোনো বিশেষ গুরুত্ব নেই তার কাছে। এশার দুশ্চিন্তা হয়। ওর তো চারকুলে কেউ নাই। এই মানুষটা ওকে ভালো না রাখলে ওর তো কোথায়ও যাওয়ার থাকবে না।
__

বিশাল আলিশান বাড়ির চাকচিক্য এবং আভিজাত্যময় এক রুমে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে এশা। অচেনা জায়গা, চারপাশে স্বল্প পরিচিত কিছু মুখ। তাদের নানান গল্পগুজব! এশার সেদিকে কোনো মনোযোগ নেই। ওর মাথায় কেবল ফুয়াদের ব্যাপারটা ঘুরছে।

ফুয়াদের বড় ভাবী মারুফা বলল,

–রাত তো অনেক হয়েছে। এবার ওদের রুমে দিয়ে আসা উচিত।

এশাকে সবাই মিলে ফুয়াদের রুমে নিয়ে আসলো। ফুয়াদ এই মুহূর্তে রুমে নেই। সে একটু পরে আসবে।

পলি বেগম মারুফাকে ডেকে নিয়ে বললেন,

–এশার গায়ের গহনা গুলো সব খুলে আমার রুমে নিয়ে আসো। এত দামের গহনা! কোথায় কি রাখবে!

মারুফা তার শাশুড়ির প্রতিটি আদেশই অক্ষরে অক্ষরে মানে। সে গিয়ে এশার গায়ের গহনা খুলতে লাগলো। এশা মনে মনে আশ্চর্য হলো! এক্ষুণি গহনা খুলে নিয়ে যাবে সেটি ও ভাবতে পারেনি! তাছাড়া ওকে বললে তো ও নিজ হাতেই খুলে দিতে পারতো। মারুফা গয়নাগাটি সব খুলে নিয়ে পলি বেগমকে বুঝিয়ে দিয়ে আসলো।

এশা বোকা হয়ে বসে আছে। এর ভিতরে ফুয়াদের দেখা মিলল। সে রুমে এসেছে। দরজা আটকে খাটে বসতেই কড়া নাড়ার শব্দ হলো। মহাবিপদ হওয়া ছাড়া নতুন বর-বউয়ের রুমে কেউ কড়া নাড়ে না। কিন্তু ফুয়াদ জানে এ বাড়িতে সামান্য কারণেও এই বেকুবের মত কাজ করতে পারে।

ফুয়াদ দরজা খুলে দেখতে পেল ওর মেজো ভাবী তার মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

–অর্পি কাঁদছে। নতুন বউয়ের সাথে ঘুমাবে নাকি।

ফুয়াদ হাসিমুখে বলল,

–ঠিক আছে। দিয়ে যান তাহলে।

ফুয়াদ অর্পিকে কোলে করে রুমে নিয়ে আসলো। অর্পির বয়স ছয় বছর। দেখতে ভীষণ মিষ্টি। মেয়েটা ফুয়াদের ভক্ত।

হাসি মুখে রুমে নিয়ে আসা অর্পিকে সে বিরক্ত মুখে খাটে বসালো ফুয়াদ। এরপর এশাকে বলল,

–বিয়ের রাতে কেউ বাচ্চাকাচ্চা সাথে নিয়ে ঘুমায় না। কাঁদলেই তাকে দিয়ে যেতে হবে না। অর্পিকে তুমি ওর মায়ের কাছে দিয়ে আসো।

এশা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত আগেই তো ফুয়াদ ওকে হাসিমুখে নিয়ে আসলো! আর এখন সদ্য এ বাড়িতে আসা ওকে বলছে দিয়ে আসতে!

–এশা কি বলেছি শুনতে পাওনি?

এশা হতবুদ্ধি হয়ে বলল,

–আমি তো ভাবীর রুমটাও চিনি না। আমি ওকে দিয়ে আসতে গেলে সবাই কি বলবে!

ফুয়াদ হঠাৎ ভয়াবহ রেগে গেল। রাগে তার চোখ বেড়িয়ে আসতে চাইছে,

–দিয়ে আসতে বলেছি দিয়ে আসবে। যাও। এত কথা বলছো কেন? ভাবীর রুম এই মাঝের রুমটার পরেই।

এশা হতভম্ব হয়ে গেল। খানিকটা ভয়ও পেল। ও দ্রুত অর্পিকে কোলে তুলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়। অস্বস্তিতে ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছে। ও অর্পিকে দিয়ে আসবে এটা কেমন দেখায়!

এশা অর্পিকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে সেদিকে আর তাকালো না। লজ্জায় ওর চোখ বুঁজে আসছে। ফুয়াদ এর হাবভাব খুব দুর্ভেদ্য লাগছে। ও ধরতে পারছে না। ওর কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

অর্পিকে দিয়ে রুমে আসতেই ফুয়াদ নরম গলায় বলল,

–শুনো এশা। আমি একটু বাইরে বের হবো। ঘন্টাখানেক পর আসবো। বাসার কেউ যেন না জানে ব্যাপারটা। কাউকে বলবে না।

এশা কি বলবে বুঝতে না পেরে নির্বাক হয়ে রইল। ফুয়াদ ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেল। এরপর সে সারা রাতেও ফিরল না।
(চলবে)

#ইসরাত_জাহান_তানজিলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here