#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৫
কেউ এ বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই বুঝে ফেলবে এখানে পলি বেগমই সর্বেসর্বা। তিনি যেন সাক্ষাৎ বাঘিনী। এত দাপট, আধিপত্য তার!
এশা গহনা আনতে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বেড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর বুকের ভেতরটা এমন ভাবে ধুকপুক করছে যেন হৃদযন্ত্রটা বিকল হয়ে যাবে। ফুয়াদ নিজে গিয়ে আনতে পারে না গহনা? ওকে কেন পাঠাচ্ছে! এ বাড়ির অন্য সবার মতই সে ও তো মায়ের প্রতি অনুগত। তার সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলার ক্ষমতা আছে। তাহলে পলি বেগমের কাছে গহনা থাকা নিয়ে সে এমন প্রতিক্রিয়া কেন করছে! এসব হেঁয়ালির মানে বুঝতে পারছে না এশা।
–দাঁড়িয়ে আছো কেন এভাবে? কতক্ষণ ধরে যেতে বলছি তোমাকে। আবার গিয়ে বলো না যে আমি গহনা চেয়ে পাঠিয়েছি। এসব মেয়েদের ব্যাপারে আমাকে জড়িয়ো না। তোমার গহনা তোমার কাছে থাকা উচিত সেজন্য আনবে।
পিছন থেকে ডেকে বলল ফুয়াদ। এশা এই কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে পলি বেগমের রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো। এই মুহুর্তে ওর মনে হচ্ছে ফুয়াদের অন্য কোনো পছন্দ আছে। সে বোধ হয় ওকে দিয়ে এসব কাণ্ড করিয়ে পলি বেগমের হাতে ওর প্রাণটা নাশ করাতে চাচ্ছে! তাহলে তার রাস্তা পরিষ্কার হবে।
পলি বেগম খাটের উপর বসে আছেন। তার চোখে ভারী চশমা। হাতে প্রতিদিনের হিসাবের
ডায়েরিটা। সেটির দিকে তাকিয়ে থেকেই এশাকে জিজ্ঞেস করল,
–কিছু বলবে?
ওর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার কাছে গহনা চাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া সহজ ব্যাপার। তীব্র সংকোচে ভয় ভয় মুখে এশা বলল,
–মা আমি শাড়ির সঙ্গে একটু গহনা পরতে চাচ্ছিলাম।
পলি বেগম এবার ভালো ভাবে চোখ তুলে তাকালেন এশার দিকে। প্রথমেই ওর পরনের সাদা চকচকে জামদানিটা নজরে পড়লো। এই শাড়ি তো ওকে বিয়তে দেয়নি।
–শাড়ি কোথায় পেয়েছো?
বউকে শাড়ি কিনে দেওয়ার জন্যও কি এ বাড়ির ছেলেরা মায়ের থেকে অনুমতি নেয়? তা না হলে পলি বেগম এভাবে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?
–আপনার ছেলে এনেছে।
–বাহ! বেশ সুন্দর দামী শাড়ি। বাসায়ও কি এভাবে দামী শাড়ির সঙ্গে স্বর্ণ গহনা পরতে?
এশার মুখটা ছোট হয়ে গেল। পলি বেগম ওকে কৌশলে অপমান করছেন! ও সহজ ভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল,
–না, বিয়ের আগে আমি তেমন শাড়ি পরতাম না।
–বিয়ের পর দামী শাড়ি পেয়েছো। আবার এত রাতে আমার কাছে গহনা চাইতে এসেছো।
এশা কিছু বলল না। ওর প্রবল আত্মসম্মান টানাপোড়েনের জীবনে নড়বড়ে হয়ে গেছে। কিন্তু একেবারে ধুয়ে মুছে যায়নি। অপমানে ওর কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
–মানুষ যত পায় তত চায়।
বিড়বিড় করে বললেন পলি বেগম। এরপর বিরক্ত মেজাজে খাট থেকে নেমে নিজের রুমের দক্ষিণ কোণে বেশ যত্নে রাখা লোহার ভারি সিন্দুকটা খুললেন। এই সিন্ধুক খানা তার নানার আমলের। নানার স্মৃতি হিসাবে তিনি এটি রেখে দিয়েছেন।
পলি বেগম সিন্দুক থেকে সব সময় পরার মত সাধারণ কিছু গহনা বের করে এশার হাতে দিলো। ফুয়াদ তো ওকে ওর সমস্ত গহনা নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে। এই মুহুর্তে সেটা বলার কথা ভাবতেও এশার কলিজা কাঁপছে। ও পারবে না বলতে! তাতে যদি ফুয়াদ ওকে খুন করে ফেলে, করুক।
এশা থমথমে মুখে রুমে গেল। ফুয়াদ ওকে আর ঘাঁটালো না। ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলো। এরপর ওকে কাছে টেনে নিলো।
এশা নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিলো। কিন্তু ফুয়াদের স্পর্শে কোনো প্রেম খুঁজে পেল না। এ যেন কেবলই শারীরিক চাহিদা। দুই দিনের পরিচয়ে প্রেম খোঁজা নিজের বোকামি কিনা বুঝতে পারলো না! তবে এইটুকু পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারছে যে ওর সঙ্গে পাশের বালিশের মানুষটার মনের দূরত্ব এক পৃথিবী!
___
পলি বেগম ছিলেন ধনী বাপের একমাত্র মেয়ে। তার আর কোনো ভাই-বোন নেই। মনসুর উদ্দিন ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তার চেয়েও ধনী পরিবারে। কিন্তু পলি বেগমের আচার-ব্যবহারের কারণে সেই সংসার টিকলো না। আশেপাশের সকলের উপর আধিপত্য বিস্তার করা, কর্তৃত্ব ফলানোর অদ্ভুত নেশায় মত্ত তিনি।
পলি বেগমের প্রথম সংসার ভাঙার পর মনসুর উদ্দিন সিদ্ধান্ত নিলেন তার একমাত্র মেয়েকে দ্বিতীয় বার বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠাবেন না। বৃদ্ধ বয়সের একাকিত্বর কথা চিন্তা করে তিনি মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য এমন পাত্র খুঁজলেন যে ঘর জামাই থাকতে রাজি! কোনো ধনী পরিবারের সু-পাত্র এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক ছেলেই অর্থ সম্পদের লোভে পড়ে রাজি হলো। তাদের ভিতর শফিক আহমেদকে মনসুর উদ্দিন পছন্দ করলেন। অর্থবিত্ত কম থাকলেও শিক্ষিত, রুচিশীল, মার্জিত। তিনি এমন পাত্রই খুঁজিলেন।
ফুয়াদের বাবা শফিক আহমেদের তেমন কোনো আধিপত্য নেই এই সংসারে। এমনকি নিজের মা, বোনকে এ বাড়িতে দুই বেলা খাওয়ানোর জন্যও পলি বেগমের অনুমতির দরকার হয়।
মনসুর উদ্দিন গত হয়েছেন। তার সমস্ত সম্পত্তি পলি বেগম পেয়েছেন। এই পাঁচ তলা অভিজাত বাড়ি, বিশাল ফ্যামিলি বিজনেস সবকিছুই তো পলি বেগমের নামে। এ কারণেই তিনি এই সংসারের সর্বেসর্বা। তার কথা সকলে মেনে চলতে বাধ্য।
পলি বেগম সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান মানুষের উপর কর্তৃত্ব ফলিয়ে এবং বছরের পর বছর ধরে তিনি সেটাই করছেন। তার প্রায়ই আফসোস হয়, ইশ্! তিনি যদি মুঘল সম্রাজ্ঞী নুর জাহান হতেন! আরো কত ক্ষমতা থাকতো তার!
__
বাইরে সবে ভোরের আলো ফুটছে। এশা চোখ খুলে দেখলো ফুয়াদ পাশে নেই। এত সকালে সে কোথায় যায় কে জানে!
পলি বেগম ঘুম থেকে উঠতেই শম্পা চা নিয়ে হাজির হয়। চায়ে চিনি বেশি হয়েছে। পলি বেগম বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললেন,
–তোমার বাপের মাথা বানাইছো! এত চিনি দিয়েছো কেন?
শম্পা দ্রুত আরেক কাপ চা করে নিয়ে আসে। ওদিকে অর্পি কাঁদছে। তার কান্না থামানোর চেয়ে পলি বেগমের জন্য নতুন করে চা বানানো গুরুত্বপূর্ণ।
পলি বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
–তুমি আর মারুফা আগামী এক সপ্তাহ বাসার কোনো কাজ করবে না।
–তাহলে কাজ কে করবে?
–এশা করবে। মেয়েটার হাবভাব আমার ভালো লাগছে না। বিয়ের আগে তো ভালোই দেখছিলাম।
শম্পা মনে মনে খুব খুশি হলো। আগামী এক সপ্তাহ শান্তিতে কাটবে।
__
বাসায় মানুষ এগারো জন। একা একা সকালের নাস্তা বানাতেই এশার শ্বাস গরম হয়ে গেল। নাস্তা বানানোর পর পলি বেগম ওকে ডেকে দুপুরের রান্নার তালিকা ধরিয়ে দিলেন।
এত কাজ একা এশা কখনো করেনি। এত মানুষের রান্না! মারুফা আর শম্পা কেন কোনো কাজ করছে না–এই প্রশ্ন করার দুঃসাহস ওর নেই।
এশা রান্না ঘরে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। কোনটা যে আগে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। এখন থেকে কি বাসার সব কাজ ওর একা করতে হবে?
ফুয়াদ বাসায় এসে দেখলো এশা রান্নাঘরে একা সমস্ত কাজ করছে। ও গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–কি ব্যাপার? তুমি একা কেন? বড় ভাবী, মেজো ভাবী?
–জানি না।
–জানো না মানে। তুমি একা কাজ করছো কেন? তুমি কি একা খাবে?
ফুয়াদ আজ আবার ওকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে। এশা জোরালো গলায় বলল,
–সমস্যা নেই। আমি পারবো।
–আমার সমস্যা আছে। মাকে গিয়ে বলো তুমি একা এত কাজ করতে পারবে না।
–পারবো আমি।
–তুমি নাকি পড়াশোনা করবে। অনার্স শেষ করবে। তুমি যদি এভাবে মুখ বুঁজে সব কাজ একা করা শুরু করো তাহলে কিন্তু সব তোমার উপরই চাপিয়ে দিবে। পড়াশোনার জন্য কোনো সময় পাবে না।
এই বলে ফুয়াদ চলে গেল। এশা অনেকক্ষণ যাবৎ ব্যাপারটা ভেবে পলি বেগমের কাছে গিয়ে বলল,
–মা এত কাজ আমি একা করতে পারছি না। ভাবীদের বলুন আমাকে সহযোগিতা করতে।
পলি বেগম চোখ বের করে তাকিয়ে থাকলেন এশার দিকে। তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে আছে।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা