#এই_জোছনা_ধারায়
#পর্ব-৬
এশার সাহস দেখে পলি বেগম চূড়ান্ত অবাক হয়। মারুফা আর শম্পা তো আজ পর্যন্ত এ ধরণের কথা বলার সাহস করেনি। তিনি যা বলেছেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছে। আর এ মেয়ে কাল এসে আজই..। রাগে পলি বেগমের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। তবুও তিনি ঠাণ্ডা মেজাজে বলার চেষ্টা করলেন,
–তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো। এত কথা বলো কেন তুমি?
এশা নিচু গলায় বলল,
–এত রান্না একা করতে করতে তো বিকাল হয়ে যাবে।
এবার পলি বেগমের গলায় ক্রোধ প্রকাশ পেল,
–তুমি একাই দুপুরের মধ্যে সব রান্না শেষ করবে। এবং আজ থেকে প্রতিদিনই তুমি একা রান্না করবে।
এশা কোনো উত্তর দিলো না। পলি বেগমের মুখে মুখে তর্ক করার সাহস ওর নেই।
–এ বাড়িতে যদি আমার কথা মেনে চলতে না পারো তাহলে বাপের বাড়ি চলে যাও। তোমার তো অবশ্য বাপের বাড়িও নেই।
এশার চোখ ছলছল করছে। এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে, এরচেয়ে যদি গরীব পরিবারের অল্প শিক্ষিত কাউকে বিয়ে করতো তাও একটু শান্তিতে থাকতে পারতো। এত প্রাচুর্য, আভিজাত্য দিয়ে কী হবে? এখানে একটু শান্তিতে নিঃশ্বাসও ফেলা যায় না।
এশা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে চলে আসলো। এরপর সব রান্নাবান্না একাই করতে লাগলো। কিন্তু ওর এত দুঃখ হচ্ছে! চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়াতে লাগলো।
ফুয়াদ নিজের রুমে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। নামীদামি একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও ওকে ফ্যামিলির ব্যবসা দেখতে হচ্ছে! সুইডেনের স্কলারশিপটা পেয়েও যেতে পারলো না শুধুমাত্র পলি বেগমের জন্য। ওর সাথের বন্ধু বান্ধব নিজের পছন্দ মত বিয়ে করে দেশ-বিদেশে ঝকঝকে জীবন কাটাচ্ছে। আর ও আটকে রয়েছে কি এক বিচ্ছিরি আটপৌরে জীবনে। যে জীবন ও কখনই চায়নি!
এই ব্যবসা এই পরিবার কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহ খুঁজে পায় না ফুয়াদ। এশা মেয়েটা দেখতে সুন্দর। মাঝে মাঝে ভালো লাগে। কিরকম মিনমিনে স্বভাবের মেয়েটা। চারকুলে কেউ নেই বলে হয়ত কোনো কিছুর প্রতিবাদ করার সাহস করে না। এমন মেয়ে জীবনসঙ্গী হিসেবে ও কখনো কল্পনা করেনি।
পলি বেগম চেয়েছেন ফুয়াদের এই মেধাটা তাদের ব্যবসায় কাজে লাগুক। তার তিন ছেলে মিলে ব্যবসার হাল ধরলে ব্যবসাটা আরো এগিয়ে যাবে। বড় দুই ছেলে ব্যবসা নিয়ে মনোযোগী হলেও ফুয়াদ গত এক সপ্তাহে চার লাখ টাকার লোকসান করেছে।
শফিক আহমেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ফুয়াদকে ডেকে বলল,
–এদিকে আসো তো একটু।
ব্যবসা সংক্রান্ত আলাপ ছাড়া শফিক আহমেদ অন্য কোনো বিষয়ে নাক গলান না। ফুয়াদ যে লোকসান করেছে নিশ্চয়ই তার জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে।
–দেখো তোমার মা যখন চেয়েছে তুমি এই ব্যবসায় থাকো তখন তোমাকে থাকতেই হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে তোমার ভিতর কোনো গুরুত্ব দেখছি না। চার লাখ টাকা লস হলো কীভাবে? তুমি কি ইচ্ছে করে করছো এসব?
ফুয়াদ গা ছাড়া ভাবে বলল,
–ব্যবসায় লাভ লস দুইটাই হবে। ইচ্ছে করে করবো কেন?
–তোমার মা জানলে কি হবে সেটা কি বুঝতে পারছো?
–কী হবে? কী হওয়ার বাকী আছে? যাও গিয়ে জানাও। ঘর জামাইদের সবকিছুর হিসাবই বউয়ের কাছে দিতে হয়।
শফিক আহমেদ চোখ লাল করে ছেলের দিকে তাকালেন। ফুয়াদ সে সবের তোয়াক্কা না করে ওখান থেকে উঠে এলো।
বিরক্ত মেজাজে রুমে এসে দেখলো এশা সদ্য গোসল সেরে বের হয়েছে। ওর রান্নাবান্না শেষ হয়েছে একটু আগে। ও ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল গুলো খুলে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে দ্রুত শুকানোর চেষ্টা করছে। টেবিলে খাবার বেড়ে দিতে হবে। এই কাজও ওর ঘাড়ে পড়েছে। এশাকে দেখতে স্নিগ্ধ লাগছে ভীষণ। সকালের শিশির ভেজা ফুল দেখতে যে রকম স্নিগ্ধ লাগে। ফুয়াদ ওকে পিছন থেকে সাপের মত পেঁচিয়ে ধরলো। ও চুলে শ্যাম্পু করেছে বোধ হয়। খুব সুন্দর ঘ্রাণ আসছে।
–এত দেরি হলো কেন? রান্না কি একা একা করেছো?
এশা ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। ফুয়াদের মেজাজটা চট করে গরম হয়ে গেল। এশাকে নিজের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে বলল,
–কেন তোমাকে কি বলেছিলাম?
–মাকে বলেছিলাম কিন্তু…।
–কিন্তু কী? কীভাবে বলেছো? মিনমিন করে বলেছো?
এই বলে ফুয়াদ হঠাৎ করে এশার গালে চড় মেরে বসলো। ও গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। ফুয়াদ ওর গায়ে হাত তুলবে এটা ওর ধারণার বাইরে ছিলো।
মাত্র ক’দিন হলো বিয়ে হয়েছে। সদ্য বিবাহিত বউয়ের গায়ে এভাবে হাত তুলেও ফুয়াদের ভিতর কোনো অনুশোচনা দেখা গেল না। রাগের মাথায় মেরেছি কিংবা ভুল হয়েছে—এ ধরণের কিছু বলেও দুঃখ প্রকাশ করলো না।
এশা খাটের উপর বিমর্ষ মুখে বসে আছে। ফুয়াদ স্যুট বুট পরে তৈরি হয়ে এশাকে বলল,
–আমি দুইদিন বাড়ি ফিরবো না। আমাকে ফোনে পাওয়া যাবে না।
এশা কোনো প্রত্যুত্তর করলো না। ফুয়াদ বেড়িয়ে গেল। এশার জীবন আগে থেকেই এলোমেলো ছিলো। কিন্তু এখন একটু বেশি এলোমেলো মনে হচ্ছে। এই কয়দিনেই এ বাড়িতে থেকে এত হাঁপিয়ে গেছে যে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে!
__
রাতে এশার মেজো মামা ফোন দিয়ে বললেন,তোর মা সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েছে। তুই এক্ষুণি আয় তো। এশার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ও ফোন রেখে পলি বেগমের কাছে ছুটে গেল। অস্থির স্বরে বলল,
–মাকে দেখতে আমি এক্ষুণি হাসপাতালে যাবো।
এশার তীব্র অস্থিরতার বিপরীতে পলি বেগম ভীষণ গুরুত্বহীন ভাবে বলল,
–সকালে যেয়ো। এখন রাত হয়েছে। তাছাড়া ফুয়াদও বাসায় নেই।
এটা তো ঘরের সমস্ত কাজ করা কিংবা গহনার ব্যাপার নয় যে এশা মুখ বুঁজে মেনে নিবে। ও বলল,
–ড্রাইভার আছে তো। তাকে বলুন আমাকে একটু হাসপাতালে নামিয়ে দিতে।
পলি বেগম চাইলেই এটা করতে পারেন কিন্তু তিনি করবেন না। এই মেয়েটা কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে তার মেজাজ খারাপ করেছে। আজকে এটা ওর শাস্তি।
–বললাম তো সকালে যেয়ো।
এশা ধরে আসা গলায় বলল,
–আমার মা হাসপাতালে ভর্তি। মাথায় খুব আঘাত পেয়েছে। সকাল হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারবো না।
–তো তুমি কি করতে চাও? আমার অনুমতি ছাড়াই যেতে চাও?
পলি বেগম ভেবেছিলেন এশা অন্যান্য দিনের মত দমে যাবে। কিন্তু ও আবার বলল,
–আপনি অনুমতি দেন। আমি একাই যাবো।
–বাড়ির বউ রাতে একা বের হতে চাচ্ছো? তুমি এত সাহস পাও কোথায় বলো তো?
এশার এই মুহুর্তে কোনো কিছুকে পরোয়া করতে ইচ্ছে করছে না। ও ধৈর্য হারিয়ে বলল,
–আপনি অনুমতি না দিলে আমি আপনার অনুমতি ছাড়াই যাবো।
–তুমি আমার অনুমতি ছাড়া এ বাসার বাইরে পা ফেলো তো পারলে।
পলি বেগমকে হতভম্ব করে এশা বাসা থেকে বেড়িয়ে পরলো। এর জন্য কি হতে পারে সেই ভয় ও এই মুহূর্তে পাচ্ছে না।
এশা রিক্সা নিলো। মেজো মামা আবার ফোন করছেন। ওর বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠলো। ফোন ধরার সাহস হলো না। কোনো খারাপ খবর নয় তো? ফোনটা রিং হয়ে কেটে গেল।
ফুয়াদ কোথায় গেছে দুই দিনের জন্য? এই মানুষটা ওকে পছন্দ করে না, ভালোও বাসে না তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। তার মনের নাগাল পাওয়া ও সম্ভব না। এই দুঃখটা ও নাড়া দিলো হঠাৎ। এশা বার বার চোখ মুছতে লাগলো।
রিক্সা জ্যামে আটকা পড়েছে। এশার অস্থিরতা বাড়ে। হঠাৎ ওর অস্থির দৃষ্টি আটকে যায় একটা নীল রঙের বাইকের দিকে। যেটাতে ফুয়াদ বসে আছে। এবং তার পিছনে বসে আছে অত্যন্ত খোলামেলা পোশাকের একটা মেয়ে।
(চলবে)
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
(ঈদের জন্য গ্যাপ গেছে। এখন থেকে প্রায় নিয়মিত পাবেন)