#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১২
#Saiyara_Hossain_Kayanat
প্রিয় রুদ্রাণী,
সকল অপ্রত্যাশিত মুহূর্তই কিন্তু বিরক্তির কারন হয় না। কিছু কিছু অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত জীবনে কিছু সুপ্ত অনুভূতির সৃষ্টি করে। এই যেমন ধরুন আমাদের চিঠির বিষয়টা, এটাও কিন্তু আমাদের দুজনের জন্যই অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা। তবে এই চিঠির জন্যই আমরা আমাদের জীবনে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। নব্বই দশকের মতো চিঠি লেখা, পাশাপাশি বারান্দায় থেকেও একজন আরেকজনকে না দেখে একে অপরের অনুভূতি প্রকাশ করা এসব কিছু কি আপনার কাছে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে!!
[বিঃদ্রঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপত্তিকর জিনিস চোখের সামনে এসে পরে। আর কল্পনার বাহিরে কিছু ঘটলে সেটা আমাদের স্মৃতির পাতায় খুব নিখুঁতভাবে গেঁথে থাকে। যাইহোক দু’দিন চিঠির উত্তর দিতে পারিনি, আপনি অপেক্ষা করেছেন কি না জানতে ইচ্ছে করছে।]
ইতি,
রৌদ্র
আরশি চিরকুটটা পড়ে গভীর ভাবনায় ডুবে গেল। সত্যিই তো সকল অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত বিরক্তির কারন হয় না। রুম থেকে ফোনের শব্দ বেজে উঠতেই আরশি চিরকুটা হাতে নিয়েই রুমে চলে গেল। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তাদের ফ্রেন্ডস গ্রুপ থেকে ভিডিও কল করেছে। কল রিসিভ করতে নীল চেচিয়ে বলে উঠলো-
“ওই তোর এতো সময় লাগে কেন ফোন রিসিভ করতে?? কাসফি তো তোর সাথেই থাকে তবুও তো কাসফি সাথে সাথেই কল জয়েন করে বসে আছে। তাহলে তোর কেন এতো সময় লাগে??”
নীলের এমন চেচিয়ে কথা বলা শুনে আরশি বিরক্ত হয়ে বলল-
“আরে নীল থাম তো এতো চেচাচ্ছিস কেন আজব!! আমি বারান্দায় ছিলাম তাই একটু সময় লেগেছে। এখন বল এই সকাল সকাল কিসের জন্য ভিডিও কল দিয়েছিস তোরা??”
আদ্রাফ গম্ভীর গলায় বললো-
“আজ বিকেলে আমরা তোদের বাসার জন্য রওনা হব। আমাদের পরিবার থেকে পারমিশন পেয়ে গেছি তোদের বাসায় যাওয়ার জন্য।”
আদ্রাফের এমন গম্ভীর গলা শুনে আরশি আর নীল বেশ অবাক হলো। তবে নীলা আর কাসফিয়ার তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ হয়নি হয়তো তারা জানে আদ্রাফের গম্ভীরতার কারন। নীল ভ্রু কুচকে আদ্রাফের উদ্দেশ্যে বলল-
“শালা তোর কথার ধরন শুনে মনে হচ্ছে আমরা ঘুরতে না বরং শোক পালন করতে যাবো।”
আরশিও নীলের কথায় তাল মিলিয়ে বলল-
“তোরা সবাই এমন চুপচাপ কেন আজ?”
নীলা একটা হাসি দিয়ে বলল-
“আরে এসব বাদ দে, ফোন রেখে এখন সবাই গোছগাছ শুরু কর।”
সবাই যে যার মতো করে ফোন দিল। ফোন রাখতেই কাসফিয়া আর নীলা বেশ চিন্তায় পরে গেল। কিভাবে আদ্রাফের মুখোমুখি হবে তারা!! কিভাবে তাদের মনকে বাধা দিবে আদ্রাফের প্রতি কোনো অনুভূতির সৃষ্টি হতে!! আর অন্য দিকে আরশি তাড়াতাড়ি করে চিঠি লিখতে শুরু করল। চিঠি লিখেই বারান্দা গিয়ে ছুড়ে মারলো পাশের বারান্দায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পুরো বারান্দা আর পাখি গুলোর দিকে নজর বুলিয়ে নিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে আসলো। তার মন কু ডাকছে কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা খারাপ হতে যাচ্ছে। অকারণেই কষ্ট হচ্ছে তার এই বারান্দা আর পাখি গুলো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে। তবুও আরশি এসব কিছু পাত্তা দিতে চায় না। মাথা থেকে সকল চিন্তা ভাবনা বের করে নিজের মতো করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো।
————————
অসময়ে ঝুম বৃষ্টি নামার পর এখন পিচঢালা রাস্তা গুলো বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে ঝকঝক করছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন মেঘে ঢাকা আকাশ আর গ্রীষ্মের বৃষ্টি শেষে শীতল হাওয়া। গ্রীষ্মের সময় এই পরিবেশটাই যেন আরশি চেয়েছিল। স্টেশনের একটা বেঞ্চিতে বসে আরশি আর কাসফিয়া অপেক্ষা করছে নীলদের জন্য। মিনিট পাঁচেক যেতেই নীল, আদ্রাফ আর নীলা এক প্রকার দৌড়ে এসে হাজির হলো আরশির সামনে। নীল আরশির পাশে এসে বসতেই আরশি শক্ত গলায় বললো-
“সাড়ে তিনটায় এখানে আসার কথা ছিল তোদের। এখন প্রায় চারটা বাজতে চলছে। আর কয়েক মিনিট দেরি করলেই তো ট্রেন মিস হয়ে যেত।”
নীল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল-
“আর বলিস না বৃষ্টির জন্য দেড়ি হয়ে গেছে। কে জানতো আজ বৃষ্টি হবে!!”
আরশি জ্বলন্ত চোখে নীলের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি আর কাসফি কি তাহলে অন্য অন্য গ্রহ থেকে এসেছি!!”
কাসফিয়া উঠে দাঁড়িয়ে রাগী কন্ঠে বলল-
“তোরা ঝগড়া করতে থাক। আর ওইদিকে ট্রেনে চলে যাক।”
আরশি আর কিছু না বলে ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে ট্রেনের দিকে চলে গেল। বাকি সবাই চুপচাপ তার পিছন পিছন হেঁটে যাচ্ছে। ট্রেনের ভিআইপি কেবিন এসেই আরশি গাল ফুলিয়ে বসে পরলো। নীল আরশির পাশে বসে আরশির দিকে ফিরে অনুনয়ের স্বরে বললো-
“আশু প্লিজ রাগ করে থাকিস না। একটুই তো দেরি হয়েছে। দেখ এখনো ট্রেন ছাড়তে অনেক৷ সময় আছে।”
নীলের কথাটা বলার সাথে সাথেই ট্রেন চলতে শুরু করলো। আরশি রাগান্বিত দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকাতেই নীলের অসহায়ের মতো মাথা নিচু করে ফেললো। নীলের এমন অবস্থা দেখে আদ্রাফ, কাসফিয়া আর নীলা উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। আরশিও নীলের মাথায় একটা চাটি মেরে দিয়ে সবার সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠলো। ঘন্টা খানেক সময় ধরে আড্ডা দিতে দিতে একটা পর্যায় আরশি ক্লান্ত হয়ে নীলের কাধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পরলো। তাই সবাই চুপচাপ বসে আছে। কাসফিয়া সবাইকে বলে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। কাসফিয়া যাওয়ার কিছুক্ষন পরই আদ্রাফ নীলকে বললো-
“তোরা বস আমি দেখে আসি কাসফি কোথায়।”
কথাটা বলে আদ্রাফও কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নীলা স্থির চোখে তাকিয়ে আছে কেবিনে দিকে। কাসফিয়া কেবিনের দিকে যেতেই আদ্রাফ কাসফিয়ার হাত শক্ত করে ধরে কিছুটা দূরে নিয়ে আসলো। কাসফিয়া নিজের হাত ছাড়ানো জন্য বার বার চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই আদ্রাফের শক্তির কাছে হেরে যাচ্ছে। আদ্রাফের থেকে হাত ছাড়াতে না পেরে শেষমেশ কাসফিয়া রেগেমেগে চাপা কন্ঠে বলল-
“আদ্রাফ কি করছিস এসব?? হাত ছাড় আমার।”
এই মুহূর্তে আদ্রাফ কাসফিয়ার কথা শুনে যেন প্রচন্ড রেগে গেল। রাগে চোখ গুলো তার লাল বর্ন ধারণ করেছে। কাসফিয়া দু বাহু চেপে ধরে রাগে গর্জে উঠে বলল-
“কি সমস্যা তোর কাসফি?? আমার সাথে এমন করিস কেন সব সময়?? বার বার আমার ভালোবাসাকে এড়িয়ে যাস কেন?? একটা কারন অন্তত বল। কেন তুই আমার ভালোবাসা বার বার প্রত্যাখ্যান করিস??”
কাসফিয়া আদ্রাফের রাগ দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। আদ্রাফের মতো শান্তশিষ্ট আর দুষ্টু স্বভাবের ছেলে যে এতোটা রেগে যেতে পারে এটা তার চিন্তা ধারনার বাহিরে। কাসফিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে শান্ত গলায় বললো-
“আগে আমাকে ছাড় তারপর আমি বলছি।”
আদ্রাফ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে কাসফিয়া ছেড়ে দিল। একটু দূরত্ব বজায় রেখে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। কাসফিয়া বেশ খানিকটা সময় চুপ থেকে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো-
“তুই নিশ্চয়ই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস আশু এই সব প্রেম ভালোবাসা সব সময় এড়িয়ে যায়। যে কয়েকজন ছেলে ওকে প্রপোজ করেছে সবাই আশুর সাথে একদিন রেস্টুরেন্টে বসে কথা বলার পরেই তাদের আর দেখা পাওয়া যেত না। ওই ছেলে গুলোকে আশুই রিজেক্ট করেছে। আশুর বলা একটা কথার কাছে তাদের সবার ভালোবাসা ফিকে পরে যেত। আর আশুর এমন করার একটা কারন আছে সেটা আমি বলতে চাই না। তবে একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ আশু যতদিন পর্যন্ত কাউকে ভালোবাসবে না, কোনো সম্পর্কে জড়াবে না ততদিন পর্যন্ত আমিও কোনো সম্পর্কে জড়াবো না। যদি আমি আশুর সামনে একটা ছেলের সাথে হেসে খেলে প্রেম করে বেড়াই এটা দেখে আশু হয়তো খুব খুশি হবে। কিন্তু আমি জানি আশু মনে মনে নিজের জীবনটাকে আরও ব্যর্থ মনে করবে, কষ্ট পাবে। আর দশটা মেয়ের মতো নিজের জীবনটাকে স্বাভাবিক না পেয়ে হয়তো এখন যতটা না কষ্ট পাচ্ছে এর থেকেও বেশ তখন আমাকে দেখে আফসোস করবে। তাই আমি এখন কোনো সম্পর্কে যেতে চাই না। আমি আগে আশুকে খুশি দেখতে চাই।”
আদ্রাফ কাসফিয়ার কথা গুলো চুপচাপ মনযোগ দিয়ে শুনলো। কাসফিয়ার কথা শেষ হতেই আদ্রাফ চিন্তিত গলায় বললো-
“আশুর কি কিছু হয়েছে কাসফি??”
কাসফি আগের মতোই শান্ত গলায় বললো-
“বললাম তো আমি এই বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। চিন্তার কিছু নেই। আশু ঠিক আছে তবে একটু ডিপ্রেসড হয়তো দেখে বোঝা যায় না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি আশু ভিতর ভিতর কষ্ট পাচ্ছে।”
আদ্রাফ কাসফিয়ার দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বললো-
” আমি অপেক্ষা করবো তোর জন্য কাসফি। কিন্তু একটা রিকুয়েষ্ট আমাকে ইগ্নোর করিস না। তোর যতদিন সময়ের প্রয়োজন হয় তুই নে আমার কোনো আপত্তি নেই আমি সব সময় তোর জন্য অপেক্ষায় থাকব।”
কাসফিয়া কিছু বললো না। আদ্রাফের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল। আদ্রাফও কাসফিয়ার সাথে সাথেই চলে গেল।
আরশি ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া দিয়ে মাথা সোজা করে বসলো। নীল সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে নম্রমুখে বললো-
“ম্যাম আপনার ঘুম আরামে হয়েছে তো?? যদি না হয় তাহলে আরও কিছুক্ষন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন আমার কাধে।”
আরশি হাই তুলে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো-
“নাহ আর ঘুমাবো না।”
মুহুর্তের মধ্যেই নীল ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো-
“চুপ থাক হারামি। আমার কাধ পুরো ব্যথা হয়ে গেছে। মরার মতো যে ঘুম দিয়েছিস এক ঘুমেই পুরো রাস্তা পাড় করে দিলি। তোর পাশে বসাই চরম বোকামি হয়েছে।”
আরশি নীলের রাগ পাত্তা না দিয়ে বলল-
“এবার তো শিকার করে নে তুই একটা বলদ। কোনো কাজই ঠিক করিস না।”
নীল কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাকি তিনজন এক সাথে চেচিয়ে বলল-
“থামম তোরা।”
————————
রাত প্রায় নয়টা বাজে আরশি আর ওর বন্ধুরা সবাই এসে আরশিরদের এলাকায় পৌঁছালো। বৃষ্টির কারনে চারপাশে নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। মানুষজন তেমন নেই বললেই চলে। তারা সবাই নিজেদের মতো কথা বলতে বলতে হেটে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই আরশির পায়ে কাঁদা লাগায় দাঁড়িয়ে গেল। আরশি সবার পেছনে থাকায় বাকি সবাই খেয়াল করেনি। আরশি জুতা খুলে পা ঝাড়ছে এমন সময় পেছন থেকে এক শক্তিশালী হাত এসে আরশির মুখ চেপে ধরলো। আরশিকে জোড় জবর্দস্তি করে টেনে নির্জন জায়গায় নিয়ে গেল। আরশি নিজেকে ছড়ানো চেষ্টা করেও পারছে না। অনেক বার চেষ্টা করার পর যখন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পালাতে নিবে এমন সময় লোকটা আবারও সামনে এসে পথ আটকে ফেললো। ভয়ে আরশির পুরো শরীরে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। হাত-পা অনবরত কেঁপে যাচ্ছে। মনে মনে শুধু একটাই কথা ভেবে যাচ্ছে “তবে কি সে ধর্ষণের শিকার হতে যাচ্ছে!!” আরশি ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-
“আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ। আমাকে যেতে দিন।”
বখাটে ছেলেটা একটা বিদ্রুপ হাসি দিয়ে আরশির কাছে এসে আরশির ওড়না টান দিয়ে ফেলে দিল। সাথে সাথে আরশি অঝোরে কান্না শুরু করে দিল। আরশির কান্না আর অনুরোধ কিছুই সেই নেশায় বুদ হয়ে থাকা বখাটে ছেলেটার কানে গিয়ে পৌঁছালো না। সে তো নিজের মতো করেই আরশির শরীরের দিকে ক্ষুদার্থ প্রাণীর মতো তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে তার আরশিকে কাছে পাওয়ার লালাসা। আরশি জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে কান্না করতেই লোকটা ঝাপিয়ে পরলো আরশির উপর।
চলবে….
(হ্যাপি রিডিং। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️🖤)