চিত্তসন্ধি পর্ব ২২ লেখা: #Azyah

0
4

#চিত্তসন্ধি
পর্ব ২২
লেখা: #Azyah

“অল্প সময়ের জন্য ভুলে যা তুই ডাক্তার।নে একটা টান দে।”

অর্ধেক খাওয়া সিগারেটটা মেহতাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো রায়হান।দুজনই ক্লিনিকের ছাদে।রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।পাগলের দশা।পড়ে যাওয়ার নূন্যতম ভয় নেই।তাছারাও কাপড়ের অবস্থ শোচনীয়।রায়হানের ইন করা শার্ট একদিকে ঝুলে আছে।সূক্ষ কুচকানো। মেহতাব সকালে ঘরের কাপড়ে বেরিয়েছে।এখনও ঠিক তাই।এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে দুলছে।

রায়হান আবার ডাকলো, “নিবি?”

“লজ্জা করা উচিত তোর রায়হান?”

“হাহ্ যেদিকে সিগারেট বানানো কোম্পানি লজ্জা করে না ওদিকে আমরা কি জিনিস?আর সবসময়তো খাই না। মাসে একবার বুরিছোঁয়া করি।মাথা হ্যাং থাকে যখন।”

“খাবো না আমি”

“তাহলে এই সমস্যার সমাধান কোথায় পাবি?”

“আমার সমস্যার সমাধান অলরেডি আছে”

“সেটা কি?”

“একান্ত ব্যক্তিগত সমাধান!বলতে ইচ্ছুক নই”

“সেই সমাধানটা কি আদর?”

রায়হানের মুখে আদরের নাম শুনে চমকে উঠলো মেহতাব।যেনো কোনো চুরি ধরা পড়েছে।বিরাট তথ্য কেউ ফাঁস করে দিয়েছে। মেহতাবের চেহারা দেখে না হেসে পারলো না রায়হান। হোহো করে হেসে উঠলো।হাসির শব্দ কানে বিষাক্ত পদার্থের মতন বারি খাচ্ছে।

এড়িয়ে যেতে মেহতাব বললো, “আমি উঠি”

মেহতাবের বাহু টেনে রায়হান বললো, “আরেহ থাক ব্যাটা!মহিলা মানুষের মতন শুরু করছিস।”

নিঃশব্দে মাথা ঝুঁকিয়ে পা দুলাচ্ছে মেহতাব।রায়হান আবার বললো,

“আমার চোখ কঠিন চোখ! যদিও আমি চোখের ডাক্তার না।আমি সেদিনই বুঝেছি যেদিন তুই আদরকে ইনজেকশন দিসনি।হাত কেপেছে তোর।তোর হাত কেপেছে!আমাকে আদরের আশেপাশে দেখলেই তাড়িয়ে দিতি।”

“তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুই না।”

“আমি কিছুই ভাবছি নারে ভাই”

“তুই এসব বাদ দিবি?আমি উঠে চলে গেলাম নাহয়”

“আচ্ছা আচ্ছা বাদ দিলাম। ইউ গাইস ক্যারি অন!”

“বাড়ি যাসনি কেনো?”

“তোর সাথে আমিও ফেঁসে গেছি।তুই যেখানে আমি সেখানে।তোর ওফ ডিউটি থাকা সত্বেও তুই ডিউটিতে আছিস।আর আমার নাইট ডিউটি না থাকা সত্ত্বেও আমি নাইট ডিউটিতে আছি”

“চলে গেলেই পারতিস।কেউ আটকেছে তোকে?”

“একজন স্পেশাল পেশেন্টকে সামলানোর জন্য তুই আছিস।তোকে সামলানোর জন্য কারো থাকা দরকার”

“হাসালি।আমাকে সামলে নিবি তুই?”তাচ্ছিল্যের সুরে বললো মেহতাব।

“যত যাই বলিস আর করিস।আমাকে পাবি সবখানে।আর হ্যা ভয় পাস না!যদি জীবনে কোনোদিন বিয়ে করিস বউয়ের ভাগ চাইতে আসবো না।”

কপাল কুঁচকে মেহতাব বলে উঠলো, “এসব ফালতু কথা বলে তোর ক্লান্ত লাগে না?”

সাবলীলভাবে আবোলতাবোল বলছে রায়হান।নেশা না করেও যেনো মাতাল সে।

“ভাল্লাগে নারে। মন চায় এসব ডাক্তারি বাদ দিয়ে সন্ন্যাস নেই”

“বিয়ে করে নে”

মেহতাবের মুখ দেখে বিয়ে শব্দটি শুনেছে?এটা আদৌ কি সত্যি?নাকি কোনো স্বপ্ন।স্বাভাবিকভাবে বিয়ে শব্দটা মেহতাব বলতেই পারে না। অসম্ভব!

“হা করে চেয়ে আছিস কেন?”

“তুই আমারে রাস্তা থেকে সরানোর এই ফন্দি আটছিস?ভাই আমি তোর রাস্তায় কোনোদিন ছিলাম না ভাই।জানিস আমার ঢোল বাজাতে অনেক ভালো লাগে!”

“এখানে ঢোল আসলো কোথা থেকে?”

“আরেহ ঢোল! মানে তুই।তোকে বাজিয়ে দেখছিলাম একটু”

মেহতাব নাক ফুসতে ফুঁসতে বললো, “ফাউল একটা মানুষ তুই!”

বলেই উঠে চলে গেলো। রায়হানও উঠে এসেছে।খুব সাবধানে দাড়িয়ে। মেহতাব এর পেছনে সিটি বাজালো কিছুক্ষন তারপর পেছন পেছন আসতে আসতে বললো,

“একটা গান গাই তোর জন্য?তুইতো অনেক গান শুনিস এটাও শুনেছিস নিশ্চয়ই।”

সাত তলা বিল্ডিং এর সিডি বেয়ে নেমে চলেছে তারা উভয়ই। মেহতাব রায়হানের কোনো কথার পাত্তা দিচ্ছে না।কিন্তু সে বলেই যাচ্ছে।শেষমেশ গানটাও গেয়ে ছাড়লো,

“তেরি ঝুঁকি নাজার,তেরি হার আদাহ
মুঝে কেহ রাহিহে ইয়ে দাস্তান।
কই শাকস হে,জো কি ইন দিনো
তেরে জেহেন-ও- দিলপে হে ছা গায়া ”

__

আদর ছুটিতে আছে।তাকে ছুটি দিয়েছে মেহতাব নিজেই।বাবাকে সময় দেওয়া উচিত।দুইদিন আশরাফ মাহমুদকে হসপিটালে রেখে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।একবারের জন্য আদর তার সামনে আসেনি। চেকআপে আসলেই মাথা নতজানু করে রাখতো? মেহতাবকে ভাবাচ্ছে বিষয়টা।আদর কি লজ্জা পাচ্ছে নাকি ভয়?বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেললো নাতো!এখানে তারই দোষ কি?আদরকে কাদতে দেখে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি।নিজের অজান্তেই অনেককিছু প্রকাশ করে ফেলেছে। বিনাশব্দে।চোখের ইঙ্গিতে। সজ্ঞানে।নিজের উপর রাগ হবে নাকি আদরের উপর?এত এত টেনশনের মধ্যে এই টেনশনটাও জুড়ে গেলো।ইচ্ছে করেই তাকে দুইদিনের ছুটি দিয়েছে।ভুলে যাক সেদিনের কথা।নিজেকে স্বাভাবিক করুক। মেহতাবকেও শান্ত হওয়ার সুযোগ দেক।তারপরও চোখ তাকে দুইদিন দেখবে না এটা নিয়ে ঘোর আপত্তি জানাচ্ছে।

আদর ছুটি পাওয়ার জন্য সর্বদা আনচান করে।তবে আজ মন টিকছে না।বাবার জন্য দুধ গরম করতে করতে ভাবছে।মাথাটা এক সেকেন্ডের জন্য থামতে চায় না।একটার পর একটা কথা ভাবতেই থাকে। ওভারথিংকার বলে কথা। ইদানিং মেহতাবকে নিয়ে বেশি ভাবা পড়ছে।দিনের বেশিরভাগ সময়টা জুড়েইতো এখন সে। তাছাড়াও তার আচার আচরণ।প্রথমে একবারও ভাবিয়েছে আদরকে। হয়ত সেদিন জ্বরের ঘোরে ছিল। অসুস্থ ছিলো।কিন্তু সেদিন? ধ্যান, জ্ঞান সবই ছিলো।ভাবতেই বারবার শরীর কেপে উঠে।এতটা কাছাকাছি!তাও এই নিরামিষ লোকের?কিভাবে চোখ মিলাবে? আবারতো কাজে গিয়ে তার মুখোমুখি হাওয়া লাগবে।লজ্জায় মরেই যাবে আদর।

“কি করছিস আদর।দুধ উত্রে পড়ে যাচ্ছে সব”

মায়ের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো আদরের।নাহয় এতক্ষন চামচ হাতে শূন্যে চেয়ে ছিলো।

“খেয়াল করিনি আম্মু”

জোহরা খাতুন গ্লাসে দুধ ঢালতে ঢালতে বললেন,

“কি ভাবছিলি?”

“তেমন কিছুই নাহ মা।”

জোহরা খাতুন স্বামীর মলিন মুখ দেখে ভীষণ রকমের বিষাদগ্রস্ত।তাকে সাহস দিতে শুধু স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন।আশরাফ মাহমুদ দুধে চুমুক দিয়ে নাক কুচকে নিলেন।ঠিক আদরের মতন তার স্বভাব।দুধ জিনিসটা বেশীই অপছন্দের।কিন্তু কিছু করার নেই ডাক্তারের নির্দেশ আর পরিবারের চাপে খেতেই হবে।নাক চেপে পুরো গ্লাস ঢকঢক করে গিলে শ্বাস ছাড়লেন।বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে বললেন,

“জোহরা আমার মেয়েটাকে নিয়ে আমার ভারী চিন্তা। একটামাত্র মেয়ে আমার”

“সন্তানের চিন্তা সব বাবা মারই হয়”

“কিন্তু আমার চিন্তাটা এবার একটু বেশিই হচ্ছে”

জোহরা খাতুন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

“কেনো বলোতো।আমাদের মেয়ে এখন ঠিক আছে।ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া,পড়ালেখা,কাজ সবই করছে”

“বলতে কষ্ট হচ্ছে তবে এটা নিয়ম।মেয়ের একটা ভবিষ্যৎ দরকার না?তার জীবনে একটা সঙ্গী দরকার না?কতদিন বাঁচি তার কোনো হিসাব নেই।”

জোহরা খাতুন রেগে গিয়ে বললেন, “একদম ফালতু বকবে না বলে দিচ্ছি।তোমার এখন বেচে থাকার বয়স”

“বেচে থাকা আর করে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো বয়স থাকে না। যার যখন সময় হয় সে তখন চলে যায়।আমি চলে যাওয়ার আগে মেয়ের একটা সচ্ছল ভবিষ্যৎ আর সুখী সংসার দেখতে চাই জোহরা”

“তুমি কি আদরের বিয়ের কথা ভাবছো?”

“এতদিন ভাবি নি।কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মনে ভয় ঢুকে গেছে।আমরা না হয় ওর আকদ করে রাখবো। ও নিজেকে গুছাবে, ভবিষ্যৎ গড়বে।তারপর নাহয় স্বামীর সংসারে যাবে।আমি চাই আমি যাওয়ার আগে আগে তাকে একটা শক্ত হাতে তুলে দিয়ে যাই ”

“আমিওতো চাই।কিন্তু আদর কি রাজি হবে?”

“আজ হোক কাল হোক রাজি হতে হবে।জীবন একা কাটে না। সঙ্গীর প্রয়োজন।আমাদের কেউ ছিলো না।ভালোবেসে বিয়ে করার অপরাধে আমাদের পরিবার পর্যন্ত আমাদের ফেলে দিলো।সারাজীবন একে অপরের সঙ্গী হয়ে থাকলাম।আদর যদি কাউকে পছন্দ করে ওকে জিজ্ঞেস করো। ওর পছন্দের মানুষকেই আমার পছন্দ”

“আমি আদরকে জিজ্ঞেস করবো।তুমি চিন্তা করো না”

“দেখাশুনা শুরু করো।তোমার আর আদরের সম্মতিতে সব হবে।”

“আমার ওই ডাক্টারটাকে অনেক পছন্দ আদরের জন্য”

“কোন ডাক্তার?”

“ঐযে ডক্টর নওশের মেহতাব।ভালো ছেলে।একবার কল করায় সকাল সকাল ছুটে এসেছে।তোমায় হসপিটালে এনেছে।সারারাত তোমার জন্য ডিউটি করেছে।আমার চোখে লেগেছে আদরের জন্যও হয়তো টান অনুভব করে কিছুটা”

“আমরা ভেবে বসে থাকলেইতো হবে না।আদর আর ডক্টর মেহতাবের দিকটা ভালোভাবে দেখতে হবে।”

“তা ঠিক”

___

“ভুলে গেলে মনে করিয়ে দেই দুই দিনের ছুটি শেষ মিস আদর।”

“আমি আসবো না” কাটকাট জবাব আদরের।

“নিজে থেকে ছুটি দিয়েছি বলে আস্কারা পেয়ে গেছেন?”

“আমি এমনেই আসবো না।কিছুদিন পর আসি?”

কথাগুলো খুব কষ্ট করে বলছে আদর।কোনোভাবেই মেহতাবের মুখোমুখি সে হতে চায় না।

“কিছুদিন পর না কাল আসবেন”

“উহু!”

“ঠিক আছে।একটা যথেষ্ট কারন দেখান না আসার।”

“বললাম না এমনেই!” চেচিয়ে বললো আদর।

“স্বর নিচু করে কথা বলুন।”

আসছে স্বর নামিয়ে কথা বলা লোক!নিজে তাকে লজ্জা দিয়ে আবার কারন জানতে চাইছে। এমনিতেতো সব মনের কথা তোতা পাখির মতন অনর্গল বলতে থাকে।বুঝে ফেলে।এবার বুঝতে পারছে না কেন?তার সিস্টেমে কোনো গন্ডগোল দেখা দিয়েছে নাকি?

“আম ওয়েটিং।এত সময় নেই হাতে আমার”

“অসস্তি লাগে আমার।শুনেছেন!এই জন্য আসবো না।”

খট করে ফোন কেটে দিলো আদর।ফোন রাখার সাথেসাথে বুকে হাত দিয়ে জোরেজোরে শ্বাস নিচ্ছে।কি একটা অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল!

পরক্ষনেই মেহতাবের মেসেজ আসলো,

“কাল সার্প ১০টায় আপনাকে চোখের সামনে চাই আমার।চাই যেহেতু বলেছি, আই মিন ইট”

চলবে…

[ভার্সিটির কিছু কাজে বিজি শিডিউল যাচ্ছে।তাই গল্পের পর্বগুলো ছোট হচ্ছে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here