চিত্তসন্ধি পর্ব ৩৭ লেখা: #Azyah

0
199

#চিত্তসন্ধি
পর্ব ৩৭
লেখা: #Azyah

অলস বিকেল। কাজেদের ছুটি দিয়ে আবারো ঠিক আগেকার মতন দু পা ঝুলিয়ে শহর দেখছে দুইভাই।উপর থেকে নিচে চলাচল করা গাড়িগুলো অনেক ছোট দেখাচ্ছে। দ্রুত গতিতে চলে যাওয়া গাড়িগুলো চোখের পলকেই হাওয়া!সাথে বাজে স্বাধের রং চা।এত বিশ্রী চা কেউ খায়?তবুও চুমুক দিচ্ছে।বাজে জিনিস ইচ্ছে করে পান করে আবার নাক ছিটকাচ্ছে।শেষ চুমুক দিয়ে রায়হান চেহারার অঙ্গিভঙ্গী তিক্ত করে বোঝালো একদম বাজে স্বাদ ছিলো।শেষ হয়ে গেছে বাচা গেলো যেনো।

“আদরকে বিয়ে করে নে”

স্তম্ভিত একজোড়া চোখ রায়হানের দিকে চেয়ে আছে।যত দ্রুত চেয়েছে তত নামিয়েও নিয়েছে।আজ ইচ্ছে নেই তর্ক করার রায়হানের সাথে। নির্বিকার চিত্তে চেয়ে আছে সামনে।যুদ্ধ করছে মন, মস্তিষ্কের সাথে।অনেককিছু সাজানো।কিন্তু সব গুলিয়ে যায় আদরের সামনে এসে।ভুলে যায়,হারিয়ে যায়।মুখ ফসকে উল্টোপাল্টা বেরোয়।আদরের চেয়ে বেশি নির্বোধ সে নিজে।

“কি বলেছি শুনেছিস?”

“আমি ওর সাথে ঠিকমতো কথাই বলতে পারি না”

“এসব ছার মেহতাব!মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে”

“আমি জানি!”

“তাহলে?”

“ও আমার চোখের ভাষা বোঝেনা কেনো?অধিকার খাটায় না কেনো? নিজেওতো পরিষ্কার করে কিছু বলে না।আমার ভয় করে।আদরের অস্তিত্ব আমার মধ্যে এমনভাবে ভর করছে আমার ভয় করে।মার মতন যদি ছেড়ে চলে যায়?”

“ছেড়ে যাবে কেনো আশ্চর্য্য!”

“মানুষের প্রায়োরিটি বদলায় রায়হান।আমি আগাতে পারছি না।কিন্তু অনেকটা এগিয়ে গেছি।এখন মনে হচ্ছে নিজের প্রতি কঠোরতা অবলম্বন করা উচিত ছিলো।আদর আমাকে বলেছে সে কিছু একটা অনুভব করে।এরপর থেকে আমার ভয় আরো বেড়ে চলেছে।”

“আমার জানা মতে তুই প্রেম করিসনি কখনো।হারানোর ভয়টা আসছে কোথা থেকে?”

মেহতাব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,

“হারানোর ভয় কি শুধু প্রেম করলেই থাকে!এটা আমার একটা মানসিক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমি পাওয়ার আগেই হারিয়ে যাওয়ার হিসাব করি।আমার পাগল মনে হয় নিজেকে।”

হাস্যোজ্জ্বল রায়হানের মুখে থমথমে নিরবতা বিরাজ করছে আপাদত। নিষ্পলক আকাশের দিকে চেয়ে বলল,

“মানুষের প্রায়োরিটি বদলায়।কিন্তু সবার ক্ষেত্রে না।আমাকে দেখ!”

অবাক সুরে মেহতাব প্রশ্ন করলো, “মানে?”

“আমি আজ এখানে তোকে দুটো কথা বলতে ডেকেছি ”

“কোন দুটো কথা?”

“মন দিয়ে শুনবি।কোনো রিয়েক্ট করবি না।সবাই নিজের ভালো আগে বোঝে তাই নিজেরটা দিয়েই শুরু করি।আমি তোর বোনকে ভালোবাসি মেহতাব।যেদিন থেকে ভালোবাসা কি জিনিস বুঝেছি আমার প্রেমের পাতায় “রূপসী” নামটা শুনেছিস অনেকবার।দুয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিস।আমি বলি নি।না তোকে না তোর বোনকে।কিন্তু মেয়ে মানুষগুলো কিভাবে যেনো নেশার মতন রক্তে মিশে যায়।ছাড়া যায় না।তলব বাড়তেই থাকে।আমারও বেড়েছে। বিগত এক বছর যাবত মিশার সাথে আমার সম্পর্ক।আমি চাইনি সম্পর্কে জড়াতে।আমি সরাসরি বিয়ে করতে চেয়েছি।কিন্তু বাবা চলে গেলো তারই মাঝে।তারপর মিশার স্বপ্ন।বিদেশ যাওয়ার।তুই জানিস আমি মিশাকে কেনো এয়ারপোর্ট দিতে আসিনি।সেদিন যদি আমি আসতাম! স্বার্থপর হয়ে যেতাম।কোনো কিছুর বিনিময়ে ওই উড়োজাহাজে মিশাকে উঠতে দিতাম না।একটা ভাই অথবা বাবা কি চায়?বোন সুখে থাকুক,একটা অয়েল স্ট্যাবলিশড ছেলের সাথে বিয়ে দেক,দেখে শুনে রাখার মতন ছেলে হোক।আমি হয়তো তোর মতন কামাই না।কিন্তু এত কমও আমার আর্নিং না যে তোর বোনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবো না। আমার চরিত্রে দোষ নেই।কারণ আমি প্রেমের বুঝ আসা যখন থেকে শুরু করেছে আমি মিশাকেই চেয়েছি।তোর হারানোর ভয় আছে।আমারও আছে।আমি বিয়ে করতে চাই ওকে।তারপর নাহয় আবার চাচ্চুর সাথে ইংল্যান্ড পাড়ি জমাক।আমার কোনো আপত্তি নেই।আমি ওকে সুখী রাখবো। স্ট্রেইটকাট কথা বললাম।আমি মিশাকে চাই নিজের স্ত্রী হিসেবে”

রায়হানের প্রত্যেকটা বাক্য মেহতাবের কানে বাড়ি খাচ্ছে। কল্পনার বাহিরে সমস্ত কথাগুলো।মিশা আর রায়হান?তারা এক বছর যাবৎ সম্পর্কে জড়িত এটা মেহতাব ভ্রুনাক্ষরেও টের পেলো না?নিজের বোনকেও বুঝলো না?আর রায়হান?প্রায় সময়ই সে তার সাথে থাকে।এতটাই কেয়ারলেস মেহতাব?মানুষকে বুঝতে চিনতে ভুল করে ফেলছে।

রায়হান আরো বললো,

“আদরকে সময় দে মেহতাব।তুই হারানোর ভয়ে ওকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিস।তোর এই দোষেই দেখবি সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে।দুটো কথা বলার কারণ আছে।আমি বড্ড স্বার্থপর।নিজের স্বার্থ উদ্ধারের সাথেসাথে তোকে খুশি দেখতে চাই।মিশা বলেছে তুই বিয়ে না করলে সেও করবে না।”

রায়হান মেহতাবকে মাঝ সমুদ্রে একা ফেলে রেখে চলে গেলো।একদিকে আদর আরেকদিকে মিশা।একজনকে নিয়ে ভাবতে গেলে আরেকজনের সাথে অন্যায় হয়ে যাবে।কি করবে বুঝতে পারছে না।নিজের চুল দুহাতে মুঠ করে ধরলো। এতোএতো চিন্তায় পাগল না হয়ে যায়।

___

শার্ট ঝেড়ে ছাদ থেকে নেমে এসেছে।এতখন আদরকে একা রাখা ঠিক না। এখন কাজের সময়।এসব নিয়ে বাড়ি গিয়ে ভাবা যাবে। সর্বপ্রথম মিশার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।নেমে এলো। ক্যাবিনে প্রবেশ করতেই আদর টেবিলে মাথা রেখে আছে।মেয়েটি কি ঘুমিয়ে পড়লো?কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখতেই আদর চোখ খুলেছে।হুট করে চোখ খুলে মেহতাবের চেহারা ভেসে আসলে ভরকে উঠে।দ্রুত মাথা তুলতে গিয়ে বাড়ি খায় মেহতাবের মুখে।এত জোড়ে বাড়ি লেগেছে মেহতাবের মুখে তৎক্ষনাৎ দাতে ঠোঁট লেগে কেটে গেলো।হাত দিয়ে ঠোট চেপে আছে মেহতাব। ব্যথিত মুখের ভঙ্গি।হাতে আর ঠোঁটে রক্ত দেখে আদর এগিয়ে এসেছে। আতংকিত হয়ে মেহতাবের হাত টেনে বললো,

“সরি আমি একদম খেয়াল করিনি। আই এম রিয়েলী সরি।”

মাথা দুদিকে ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগলো।কিভাবে রক্ত পড়া থামাবে।কিছু না পেয়ে টিসু বক্স থেকে টিসু নিয়ে মেহতাবের ঠোঁটে চেপে ধরেছে।

“এভাবে ঝুঁকে ছিলেন কেনো? হ্যা?এবার হলোতো বিপদ।রক্ত থামছে না কেনো?কি করবো?”

এক নিঃশ্বাসে কথা বলে যাচ্ছে আদর। মেহতাবের কোনো ভাবক্রিয়া নেই।ঠোঁটে টিসু চেপে দাড়িয়ে।আদরের চোখ মুখ জুড়ে অস্থিরতা।সামান্য আঘাত তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে। আরেকটু হলে কেঁদেই দিবে। হাসফাস করতে থাকা আদরকে থামালো মেহতাব।

ব্যথা কাতর গলায় বললো, “রিল্যাক্স!আমি ড্রেসিং করে নিচ্ছি”

“কিভাবে রিল্যাক্স!কোনোকিছু গুরুত্ব দেন না আপনি।আমার কারণেই ব্যাথাটা পেয়েছেন!”

মেহতাব মৃদু ধমকে বলল,

“আদর!চুপ। কিছুই হয়নি আমার।সামান্য ঠোঁট কেটেছে।”

“এক্ষনি ড্রেসিং করেন”

“করছিতো ”

সিংকের আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের ঠোঁট নিজেই ড্রেসিং করছে মেহতাব।তার ঠিক পেছনে আদর।বারবার উকিঝুকি দিচ্ছে।মুখে চিন্তার ছাপ।সবই উপলদ্ধি করছে মেহতাব।আয়নায় তার অবয়ব দেখা যাচ্ছে।তার চিন্তা দেখে মনে অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করে।এই অস্থিরতা শুধু তার জন্যেই।

“চিন্তা হয় আমার জন্য?”

আদরের দিকে ঘুরে মেহতাব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।তার থেকে এমন প্রশ্ন আশা করেনি একদম।শুকনো ঢোক গিলে আদর।ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে কিনা সেখানেও একবার দেখে নিয়েছে।

মুখ ঘুরিয়ে বললো,

“আপনার জন্য চিন্তা হবে কেনো আমার?আপনি কে?”

দু আঙুলের সাহায্যে আদরের নাক টেনে বলল, “আমার কথা আমাকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না?”

“রায়হান স্যার ঠিকই বলেছে আপনি একটা জলদস্যু!”

মেহতাবের চেহারার হাসি বিরল।অনেক কম দেখা যায় তাকে শশব্দে হাসতে।প্রাণ খুলে হাসে না বললেই চলে।হ্যালির ধূমকেতুর ন্যায়। আদর নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করে। মেহতাবকে হাসতে দেখে।নাহলে তার চেহারা দেখে যে কেউ বলতে পারবে হাসি কি জিনিস ডাক্তার সাহেব জানেন না।

মেহতাব অদূরে কণ্ঠে ডাকলো, “আদর!”

বেহায়ার মতোন চেয়ে আছিলো মেহতাবের দিকে। দ্রুত চোখ নামিয়ে লজ্জিত ভঙ্গীতে বললো, “হুম?”

“আমার মাথাটা ধরেছে।”

“চা দিবো?”

“নাহ”

“তাহলে?”

“একটা ম্যাজিকাল হেড ম্যাসাজ দরকার।”

মেহতাবের আবদার তার চাহনীতে স্পষ্ট। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবদার করছে তার মাথাটা ম্যাসাজ করে দিতে।আদরও সিদ্ধান্ত নিলো দিবে।এতদিন যে তার উপর জোর খাটিয়েছে,অন্যায় করেছে তার প্রতি সবকিছুর শোধ তুলবে আজ।চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলবে।কেমন লাগে সেও বুঝুক। অসভ্য ডাক্তার!

শয়তানি হাসি হেসে বললো,

“অবশ্যই স্যার।আপনার সকল বিষয়ে খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব।আপনি আরাম করে চেয়ারে বসে পড়ুন”

মেহতাব চশমা খুলে চেয়ারে ঝুঁকে আছে।চোখজোড়া বন্ধ।হেড ম্যাসাজ করবে,সেই ছলে চুলগুলো টেনে ছিরে ফেলবে সেই পরিকল্পনা থাকলেও এখন বেশ লজ্জাবোধ হচ্ছে।না জানি কিভাবে সেখিন জড়িয়ে ধরে ফেললাম। সমুদ্রের ঢেউ বুঝি ভয়, সংশয়কেও তলিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।জ্ঞানে ছিলো না। এখনতো সম্পূর্ণ সজ্ঞানে।কিভাবে কপালে হাত রেখে মালিশ করে দিবে?হাত এখনই কম্পন ধরেছে।

মেহতাব আড়মোড়া হয়ে বলে উঠে, “কি হলো?”

“দি..দিচ্ছি”

“চুল ছিঁড়ে ফেলার ইচ্ছেটাকে যেনো কোনোভাবে পূর্ণতা না দেওয়া হয়”

আদর জ্বিভ কাটলো।এতকিছুর মধ্যে এটা কিভাবে ভুলে যায় যে।সেতো ডাক্তার না অন্তর্যামী।কিছু ভাবা তার সামনে পাপ বলে গণ্য করা হয়।নিজের মন মস্তিষ্কের সুইচ বন্ধ করে কাজে লেগে পড়া বুদ্ধিমতীর কাজ।

নরম হাতের স্পর্শে স্নিগ্ধশীতল হয়ে উঠলো মস্তিষ্ক। প্রশান্তিপূর্ণ অন্তর।উত্তেজিত হৃদপিণ্ড শমিত হয়ে আসছে।কপালে হাত রাখতেই যেনো সকল চিন্তা দূরে হটে গেলো। সারাদেহ অপ্রমত্ত।বয়স অনুযায়ী আদর একজন সম্পূর্ণ নারী হলেও মেহতাবের কাছে তাকে বাচ্চাই মনে হয়।নিজের কাছেই অবাক হয় সে এই বাচ্চা মনে হওয়া মেয়েটি তার সমস্তটা জুড়ে বসে আছে। শিথিল করছে শক্ত ব্যক্তিত্বটাকে।

আদর বেশ নৈপুণ্যের সাথে মেহতাবের কপালে ম্যাসাজ করে যাচ্ছে।সামান্য তেলতেলে তার মুখটা। ললাটের তাপমাত্রা এসির বাতাসে সামান্য ঠান্ডা।আদর এই কাজে অভিজ্ঞ।ছোটোবেলা থেকেই বাবার মাথা টিপে দেওয়ার দায়িত্বে সে নিয়োজিত।এত দক্ষতার সাথে কাজ করে যেনো এই কাজে তার চেয়ে পারদর্শী আর কেউ নয়।
বরাবর দশ মিনিট দাড়িয়ে থেকে হেড ম্যাসাজ দিয়েছে। মেহতাব বোধহয় ঘুমিয়ে পড়লো।প্রশস্ত বুকে শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠানামার গতি।আর ওষ্ঠজোড়া কিঞ্চিত ফাঁকা।দেখেই বোঝা যাচ্ছে আরামে ঘুমোচ্ছেন তিনি। মেহতাবের পরিশ্রান্ত চেহারা দেখে তার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত ত্যাগ করলো আদর। সাহস যুগিয়ে ফাঁকা হয়ে থাকা মুখটা বন্ধ করে দিয়ে সরে গেলো।

তার আগেই ঘূমু চোখে মেহতাব আধো কণ্ঠে বলল,

“যেয়ো না।চুলগুলো টেনে দাও প্লিজ!”

মায়াময় কণ্ঠে আদরের পা জোড়া থেমে গেছে।মাঝেমধ্যে এই বদরাগী ডাক্টার বিমুগ্ধ করে।তার কন্ঠ এমনেতেই অনেক সুন্দর।যেভাবেই বলুক না কেন।এখন মনে হচ্ছে ঘুমন্ত কন্ঠধ্বনি আরো বেশি সুন্দর।এই বিমোহিত গলায় আবেদন কিছুতেই নামঞ্জুর করার সাধ্য নেই আদরের।মেহতাব আরো পেছনে হেলান দিয়ে একপাশে মাথা এলিয়ে আছে।সমস্ত মাথার ভর নিজের কাঁধেই নিয়েছে।হাত দুটো বেঁধে আছে পেটে।দ্রুত পা ফেলে মেহতাবের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দশ মিনিট দাড়িয়েই সে ক্লান্ত।এখন মনে হচ্ছে তার এই ক্লান্তি মেহতাবের আবদারের সামনে কিছুই না।হাত গলিয়ে দিলো কালো চুলে।বেশ মোলায়েম চুল।বেশি ছোটোও না বেশি বড় না।সভ্য দেখাতে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু চুল রেখেছে। মুখে হাসি নিয়ে আলতো করে চুল টেনে দিচ্ছে মেহতাবের।মেহতাব কাচা ঘুমে উপভোগ করছে।আদরের ইচ্ছে হয় তাকে একবার ছুঁয়ে দিতে।নিজের ভেবে অনেক সময় গল্প করতে।যেখানে কোনো সিরিয়াস টপিক থাকবে না।অহেতুক সংলাপ চলবে দুজনের মধ্যে।যেসব আলাপের কোনো অর্থ নেই।তাকে পেয়ে জীবনে তৃপ্ত মনে হয়।পরপর আবার মনে হয় সে তার হয়েও নেই।এই এলোমেলো,অগোছালো অনুভূতিগুলোর একটা আলাদা নাম,একটা আলাদা পরিচয় দরকার না?জীবনে একে ওপরের একটা বিশেষ স্থান দরকার না?যেখানে তারা দুজন আলাদাভাবে বাঁচবে।একবার মুখ ফুটে বলুক!তাকে একটা স্থান দেক!আদর কোনোদিন তাকে ফিরিয়ে দিবে না।সাদরে গ্রহণ করে নিবে জীবনে।

____

বত্রিশ পাটি দাত বের করে রায়হান দাড়িয়ে।সামনেই লোকের সমাগম।আপনজনকে খুঁজে চলেছে প্রত্যেকটি চোখ।অনেকে প্রিয়জনকে জরিয়ে ধরে অঝোরে অস্রু ঝরাচ্ছে।সবার চোখে অপেক্ষা, অস্রু তবে খুশির।না জানি কতদিন পর একে অপরকে দেখছে এই মানুষগুলো।যত অপেক্ষার ফল এই চেনা পরিচিত মুখগুলো।প্রত্যেকটা মানুষের একেকটা গল্প।ফিরে পাওয়ার স্বাদ গ্রহণ করছে।খুশির ঠিকানা নেই। মেহতাব দাড়িয়ে গম্ভীর মুখে।থমথমে চেহারা।পাশে থাকা রায়হানকে মনের অবস্থা বুঝতে দেওয়া যাবে না।এতটা মাস পর বাবা আর বোনকে দেখবে।মনে হচ্ছে কতো না কতো বছর কেটে গেছে।নিজেকে সামলে রাখার কত ফন্দি আটছে মনের ভেতরে।শেষমেশ সামলে নিতে পারলেই হলো। রায়হান এর হাত কচলানো দেখে মেহতাব বিরক্ত ভঙ্গীতে তাকালো।মেনেছে যে সে মিশাকে ভালোবাসে।তাই বিনা শব্দে বেহায়াপনা করবে?তাও আবার বড় ভাইয়ের সামনে?

আধ ঘন্টার মধ্যে মিশা আর নাসির সাহেব বেরিয়ে এলেন।এসেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন।বয়স বেড়েছে।অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়েছেন।এখন বাচ্চাদের মতন কেদে দেন।অথচ তার থেকেই শক্ত ব্যক্তিত্বটা পেয়েছে মেহতাব।পরপর বোনকে সযত্নে আগলে নিলো।মিশা রায়হানকে দেখে মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে নিয়েছে।পরিবারের মিলনমেলা শেষে বেরিয়ে পড়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

“রূপসী আমি এবার তোমায় বিয়ে করেই ছাড়বো।আর কত?আমি মানলাম তোমার ভাই থেকে এক বছরের ছোটো। তারপরও বয়সতো হয়েছে অনেক”

মিশার হাতের আঙ্গুলে আকঝোঁক করতে করতে বলল রায়হান।আজ এ বাড়িতেই আছে সে।নানান বানাহায় মেহতাবদের বাড়িতে রয়ে গেছে।খাওয়া দাওয়া,আড্ডা শেষে কিছু নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছে ছাদে।

“ভাইয়াকে বলেছো?”

“বলেছি সেই কবে!”

“কি উত্তর ছিলো ভাইয়ার?”

“তোমার ভাইয়ের কোনো উত্তর আছে?সে জানে শুধু প্রশ্ন করতে।উত্তর নামক জিনিসটা তোমার ভাইয়ের ডিকশনারীতে নেই”

“তারপরও!এ্যানি রিয়েকশন?”

“আহাম্মকের মতন চেয়ে ছিলো আমার দিকে।আমি বলেই কেটে পড়ি”

সব কথার মাঝে মিশার মনে পড়লো আদরের কথা।রায়হান ছবি দেখিয়েছে মিশাকে।বেশ মিষ্টি মেয়ে বলে বলে উঠেছিল মিশা।ভাইয়ের জন্য একদম পারফেক্ট।মিশা বললো,

“আদর আপুর কথা বুঝিয়েছো?”

“বলেছি।তাতেও তোমার ভাইয়ের রিয়েকশন সেম ছিলো।…. দেখো মিশা তোমার ভাই বিয়ে করুক আর না করুক।আমি কিন্তু বিয়েটা এবার করবোই করবো।মাকে বলে রেখেছি।তুমি এলেই যেনো বাসায় এসে চাচ্চুর সাথে কথা বলে।”

“বাবাকে আমিও একটি আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়েছি।এখন দেখি বাবা আর ভাইয়া মিলে যে সিদ্ধান্ত নেয়”

মেহতাব জানে মিশা রায়হানের সাথে আছে। নাসির সাহেব খাওয়া দাওয়া করে নিজের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছেন।এতদিন পর নিজের নীড়ে ফিরে সস্তি পাচ্ছেন।হোক বিদেশ আধুনিক। প্রশান্তি মেলে নিজের দেশের মাটিতেই। ড্রয়িং রুমে বসে মেহতাব। মিশাকে ডাকা ঠিক হবে?খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় মেহতাব।অবশ্যই ঠিক হবে।ভাই হয় সে। রায়হানের সাথে এখনও তার কিছুই হয়নি। অধিকারটা ভাইয়ের বেশি। দ্রুত ফোন নিয়ে মেসেজ করে দিল মিশাকে।

“আমার রুমে আয়।কথা আছে”

গুটিসুটি হয়ে ভাইয়ের সামনে বসে আছে।সেই একমাত্র যে মেহতাবকে কোনরকম ভয় পায় না।আজ ভীষণ অসস্তি হচ্ছে।কেননা সে জানে তার ভাই রায়হান আর মিশার ব্যাপারে সব জেনে গেছে।

“অনেক বড় হয়ে গেছিস?”

মেহতানের এরূপ প্রশ্নে ভীত হয়ে উঠলো মিশা।উত্তরে বললো,
“ভাইয়া তুমি রাজি না হলে আমি এখানেই থেমে যাবো”

“কি থেমে যাবি?কিছু কি হয়েছে?কোন ব্যাপারে বলছিস?”

আশ্চর্য্য হলো মিশা।ভাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, “তুমি না সব জানো?”

“কি জানি?”

“রায়হান আর আমার কথা?”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেহতাব বললো, “জানি!সবই জানি।কিন্তু আমার আফসোস এতটুকুই সবার মতন তুইও আমার থেকে দূরে।আমাকে কিছুটা জানাস নি।তুই আমার বোন। রায়হানও আমার ভাই।কিন্তু এই কথাটা তুই আমাকে বলতে পারতি?আমি তোর সুখ কেড়ে নিতাম? যবে থেকে সাবলম্বী হয়েছি তোর কোনো সখ আমি অপূর্ণ রেখেছি?”

তার ভাই কম কথা বলে।এটা মিশা জানে।অল্প শব্দে সম্পূর্ণ কথাকে কাটিয়ে দেয় অথবা সমাপ্তি ঘটায়।আজ এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে দিলো। কথায় চাপা অভিমানের ঘ্রাণ পাচ্ছে।

ভাইয়ের দুইহাত আগলে নিয়ে বললো, “সরি ভাইয়া।তুমিতো রায়হানকে পছন্দ করো না।আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম”

মিশার কথার বিপরীতে মেহতাব প্রশ্ন করলো, “রায়হান কখনো বলেছে আমি ওকে পছন্দ করি না?”

“নাহ”

মেহতাব কথা বাড়ালো না।মাঝ পথে আলাপ ছেড়ে যাওয়ার স্বভাব তার আগের।বললো,

“গিয়ে ঘুমো।বাকি কথা আমি রায়হানের সাথে বলবো”

___

রাত তিনটে। নিদ্রাহীন চোখে মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে।ফোন জ্বলজ্বল করছে আদরের ছবি। কক্স বাজারে তুলেছে।পেছনেই মেহতাবকে আবছা দেখা যাচ্ছে।বারবার জুম করে দেখেও দেখার স্বাদ মিটছেই না।একদম না!দারুন রকমের ইচ্ছে জাগছে মনে একটা কল করবে।কিন্ত এখন গভীর রাত।এই রাতের কথা ভেবে ইচ্ছেটা আরো মাথায় চরে বসলো।অবশ্যই কল করবে।এই মুহূর্তে তার ঘুমন্ত কণ্ঠ শুনা দরকার।মনের প্রশান্তির জন্য।একটি ঘুমে ব্যাঘাত ঘটুক!কি আসে যায়?তাছারাও নিজের কপালে আর চুলে তার স্পর্শ এখনও লেগে আছে।

কোনো ধরনের ভাবনা চিন্তা না করে কল করে বসলো আদরের নাম্বারে। মধ্যরাতে মেহতাবের কল দেখে ঘাবরে উঠেছে।দ্রুত কল রিসিভ করে বললো,

“এত রাতে কল দিলেন?কি হয়েছে?সব ঠিক আছে তো?”

আদরের কন্ঠে ভয়।ঘাবড়ে গেছে মেয়েটা।ইস!অযথা তাকে ভয় দেখালো।কই ভেবেছিলো তার ঘুমু ঘুমূ কন্ঠ শুনে হৃদয়কে শীতলতা দিবে। তা আর হলো কোথায়?

অগ্যতা উত্তর দিলো, “হাইপার হয়ো না।কিছুই হয়নি।এমনেতেই কল করেছি”

শ্বাস ছাড়লো আদর।মাথা অর্ধেক উঠিয়ে রেখেছিল। শরীর ছেড়ে দিয়ে বালিশে পূনরায় মাথা রাখলো।বললো,

“এভাবে এত রাতে কল করে বলছেন এমনেতেই কল করেছেন?কত ভয় পেয়েছি জানেন?”

“কেনো ভয় পেয়েছো?”

কিভাবে বলবে তাকে নিয়ে ভয় হচ্ছিলো।সে ঠিক আছে কিনা সেই বিষয়ে চিন্তা হচ্ছিলো। বলেও দিত।কিন্তু সেই সুযোগটা এখনও মেহতাব তাকে দেয়নি।নিজের মধ্যে চেপে রাখার স্বভাব তার নেই।

“ঘুমটা ভেঙে দিলেন।”

“আর তুমি যে আমার স্বাদের চুলগুলোর উপর অত্যাচার চালিয়েছো?চুলে হাত দিয়ে দেখলাম আলগা হয়ে ঝরে যাচ্ছে সব”

আদর দ্রুত বলে ফেললো, “এইযে শোনেন!আপনার চুল পড়া এটা আপনার বয়সের দোষ।এই বয়সে একটু আকটু চুল পরেই।একটু আকটু না।অনেকের টাকও পড়ে যায়।আমাকে দোষারোপ বন্ধ করেন।আমি খুব যত্ন সহকারে হেড ম্যাসাজ করেছি। চুল টেনে দিয়েছি”

মেহতাব ঠোঁট কামড়ে হাসলো।হাসির সাথে তার নিঃশ্বাসের আওয়াজ ফোনের অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। কিছু সময় পাড় হয়েছে। মেহতাব নিশ্চুপ।তার নীরবতা মানতে না পেরে আদর বললো,

“চুপ হয়ে গেলেন যে?”

“শুনছিলাম”

“কি?”

আবারো মনব্রত নিলো।তবে অল্প সময়ের।নিজেই নীরবতা ভেঙে বললো,
“ইদানিং নিজেকে শূন্যে ভাসমান মনে হয় কেনো?”

“অন্য জগতে হারিয়ে গেলেন বুঝি?”

“বোধহয়”

“তাহলে ঐ জগতে ঘুরতে থাকেন একা।এদিক থেকে ওদিক।”

“এই জগতে আরো একটি অস্তিত্ব আছে।আমি খুব। খুব!গভীরভাবে সেই অস্তিত্বকে অনুভব করছি”

“আপনি অনুভব করতে জানেন ডাক্তার সাহেব?”

“তোমার মুখে এই ডাকটা অনেক মানায়”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here