#চিত্তসন্ধি
পর্ব ১০
লেখা: #Azyah
“চা আনা আপনার কাজ?”
বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মেহতাবের প্রশ্নের সম্মুখীন হলো আদর।বুকে হাত বেধে ডেস্কের সামনে দাড়িয়ে আছে
ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে আদর উত্তর দিল,
“হতে পারে”
“হতে পারে না।এটা আপনার কাজ না।আপনার কাজ এখানে বসে কাজ করা।আমার অনুমতিবিহীন রুম থেকে বের না হওয়া।শুধু আমার আদেশ মান্য করা”
“মুখের উপর মানুষকে না করে দেওয়া যায়না স্যার!সে আপনার মেহমান ছিলো।”
আদরের মুখে স্যার ডাক শুনে অনেকটা অবাক হয়েছে মেহতাব।এতদিন কাজ করছে কোনো দিন স্যার বলে সম্মধন করেনি।আজ হটাৎ?
“নেক্সট টাইম আমি না বললে কারো কথায় কোনো কাজ করবেন না”
“জ্বি আচ্ছা”
“কাল ফিল্ডে কাজ আছে।সকাল ১০ টায় চলে আসবেন”
“ঠিক আছে।”
“ওকে”
“এবার আমি আসি?”
“শিওর ”
সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মাথা নামিয়ে দিয়েছে আদর।মুখ জুড়ে সামান্য রাগের ছাপ।হয়তো মুখে বলতে না পেরে শান্তভাবে মেনে নিয়েছে।কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
___
বাহিরে রৌদ্রের তাপ প্রখর।আদর উকি ঝুঁকি দিচ্ছে বারবার জানালার বাইরে।সকাল ৮টায় উঠে বসে আছে।কোনো কাজের আগে তার ঘুমটা ঠিক এভাবেই আগে আগে ভেঙে যায়।এখনও একঘন্টা হাতে সময় আছে। দেলাওয়ার হোসেন ফোন করে জানিয়েছেন ক্লিনিকের বাসে করেই সব ডাক্টাররা যাবেন।কিন্তু সূর্য মামাতো আজ বেশ ভাবে আছে।এভাবে রৌদ্রের মধ্যে দাড়িয়ে যদি কাজ করতে হয় নির্ঘাৎ জ্ঞান হারাবে আদর!
আরো আধঘন্টা সূর্য বিলাস করতে করতে ফোনটা বেজে উঠলো।দেলাওয়ার হোসেন জানিয়ে দিয়েছেন বেরিয়ে পড়তে। চুলে উঠি করে ঝুঁটি বেধে নিলো আদর। হাটতে হবে বিধায় পায়ে স্নিকারটাও পড়ে নিলো।কালো টপ আর জিন্সের সাথে সাদা রঙের স্কার্ফ গলায় পেঁচিয়ে দৌড়ে বেরিয়েছে।আজ বাবা বাইক দিয়ে নামিয়ে দিবে ক্লিনিকে।বাইকে উঠে আধ রাস্তায় গিয়ে মনে পড়লো কাল কাপড়ে গরম বেশি লাগে।আর আজই তার কালো পড়তে হলো।নিজের বোকামির ফল সবসময় তার ভোগ করতে হয়।আজও ঠিক তাই।বাইক থেকে নেমে বাবাকে বিদায় দিয়ে বাসের সামনে দাঁড়াতেই চোখদুটো রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো।ডক্টর মেহতাবও আজ কালো শার্ট পড়েছে।সাথে ধূসর রঙের ফরমাল প্যান্ট। হাতাগুলো সবসময়ের মতন গোটানো।একহাতে এপ্রোন আরেক হাতে মোবাইল।মাথা নিচু করে মোবাইলের মধ্যে দেখছে।পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেহতাবকে পর্যবেক্ষণ করে চেহারায় চোখ গেলো।ভাজ হয়ে থাকা কপাল আর মুখের গাম্ভীর্য দেখে আদরের তাকে দেখার ইচ্ছেই চলে গেছে।আনমনে নিজেকেই বলে উঠলো,
“গলা পর্যন্ত সব ঠিক ছিলো।চেহারাটা দেখেইতো আর ভাল্লাগছে না।হুতুম পেঁচা কোথাকার!”
মেহতাবকে টপকে রায়হান এগিয়ে এলো আদরের দিকে, “মিস আদর” এত জোরে বলেছে যেটা মেহতাব এর কান অব্দি গিয়ে ঠেকলো।সে এতক্ষন আদরকে নোটিশ করেনি।
রায়হান এগিয়ে গিয়ে আদরকে প্রশ্ন করলো,
“কেমন আছেন?”
বিনয়ের সঙ্গে আদর উত্তর দিলো, “জ্বি ভালো”
“এইযে আপনার কথায় কথায় জ্বি ব্যবহার করা।জিনিসটা অনেক সুন্দর লাগে”
এর উত্তরে কি বলবে ভেবে না পেয়ে আদর বললো, “ওহ আচ্ছা”
“আপনিও যাচ্ছেন তাহলে আমাদের সাথে?”
“হ্যা”
“আমারতো কোনো অ্যাসিস্টেন্ট নেই।আমার কাজগুলো কে করবে?আপনি আমাকে হেল্প করবেন?”
“কিন্তু আমি তো স্যারের আন্ডারে”
“আরেহ স্যার আমার ভাই হয়।কিছু মনে করবে না।”
কাজের কথা শুনেই মেজাজ ফুটন্ত পানির মতন টগবগ করতে শুরু করে দিলো।কেনো হেল্প করবে তাকে? সেকি ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস নাকি?এক ভাই প্যারা দিতে দিতে জান অর্ধেক শেষ করে ফেলছে।এখন আরেকজন উদয় হলো পুরো জান শেষ করতে!অন্যদিকে মেহতাব এর দৃষ্টি তাদের দুইজনের উপর।একটু একটু কথা শোনা যাচ্ছে।সম্পূর্ণ কথা শুনতে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে আটকে নিলো।
বাসের হর্ন বাজতেই একে একে সকলে বাসে উঠে বসলো।গুনে গুনে ১৮ জন যাচ্ছে। ডাক্তাররা সবাই বসেছেন একপাশে।বাকিরা অন্যপাশে।সবার শেষে মেহতাব উঠলো।আদরের পাশের সিটটাই শুধু খালি।বসবে কি বসবে না ভাবতে ভাবতে রায়হান এসে বসে পড়লো আদরের পাশে।হুট করে পাশে বসায় হচ্কচিয়ে উঠেছে আদর।তারপরও স্মিথ হেসে অন্যদিকে ঘুরে বসে পড়লো।পুরো বাসে কানা ঘুসা চলছে ডাক্টার আর অ্যাসিস্টেন্ট একসাথে বসা নিয়ে।সেখানে রায়হানের কোনো হেলদোল নেই।সে বরাবরের মতনই ভিন্ন প্রকৃতির।রায়হানের নজর মেহতাবের দিকে গেলে সে বলে,
“ডক্টর মেহতাব আমার সিটে বসে পড়েন”
আদরের পাশে রায়হান।ঠিক তার পাশের সারিতে মেহতাব।মুখ শক্ত করে সামনের দিকে চেয়ে।বারবার ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ছে।মেজাজ তুঙ্গে।ঘন্টাখানেক পর বাস এসে থামলো ঢাকার থেকে একটু দুরত্বে এক লোকালয়ে।আশপাশ দেখতে অনেকটা গ্রামের মতন।বাড়িঘর দোকাপাট এর অবস্থা তেমন ভালো না।মানুষের কথায় যতটুক বুঝলো আদর এখানে দূর দূরান্ত পর্যন্ত হাসপাতাল ক্লিনিক বলতে কিছু নেই। মূলত এই উদ্দেশ্যে এখানে আসা।আদরের কাছে সব নতুন।বাকিরা অনেকেই এইসব ব্যাপারে জানে আর দক্ষ।আদর বাকি স্টাফদের পেছন নিতে যায়।ঠিক তখনই মেহতাব বাজখাঁই গলার বলে উঠে,
“ওখানে কোথায় যাচ্ছেন!”
“বাকিরা সবাই ওই পথটায় যাচ্ছে তাই আরকি।”
“আমি বলেছি যেতে?”
“না” ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলো আদর।
“কাল কি বলেছি আজকেই ভুলে গেলেন?আমার পারমিশন ছাড়া এক পাও নড়বেন না।”
আদর মাথা দুলিয়ে বলল, “ঠিক আছে”
“ফলো মি”
আদরকে ওই পথে যেতে আটকে নিজেই ধেইধেই করে চলে যাচ্ছে সেখানে।যেহেতু সে নিজেও যেত এই রাস্তায় তাকে আটকালো কেনো?এখন বসের পেছনে অ্যাসিস্টেন্ট এই নীতি অনুসরণ করছে সে? মেহতাবকে বিড়বিড়িয়ে গালি দিতে দিতে পেছন পেছন যাচ্ছে আদরও।
আদর বারবার আকাশের দিকে চেয়ে সূর্যের কাছে আকুতি মিনতি করছে তেজ কমানোর জন্য।সে দুইদুইটা তেজ একসাথে সামলাতে পারছে না।এক সূর্য দ্বিতীয়টা মেহতাব।বড় স্কুলের মাঠে টেন্ট টানানো।সেখানে বিভিন্ন বিষয়ক ডাক্টাররা রুগী দেখছেন। সিনিয়র ডক্টররা রাউন্ডে আছেন।আদর মেহতাব থেকে একটু দুরত্বে বসে তাকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।আর হাততো চলছেই খাতা কলমে।আজ কসাই সাহেবের মেজাজ খারাপের থেকেও বেশি খারাপ।ঝাড়ি ছাড়া কথাই বলছে না। প্রত্যেকটা শব্দে যেনো আগুন বর্সাচ্ছে আকাশে থাকা সেই সূর্যের মতন।
“মেডিসিনের সিসিগুলো পাস করেন।”
পাশে একটি বক্স এর মধ্যে কাচের বোতলে মেডিসিন রাখা।দেখেই মনে হচ্ছে অনেক ভারী।আদর বাক্সের দিকে তাকিয়ে ভাবলো এটা তুলতে গেলেতো জান বেরিয়ে যাবে। ভাবনায় ছেদ পড়ল মেহতাবের আরেকদফা ধমকে,
“এত সময় লাগে!”
ধরফরিয়ে বড় বক্স হাতে তুলতেই মাটিতে পড়ে গেল।আদর মৃদু চিৎকার করে উঠেছে। কাচের বোতল ভেঙে তরল ওষুধ অনেকটাই জমিনে গড়িয়ে পরছে।আদরের চোখ রসগোল্লার ন্যায় হয়ে গেলো মুহুর্তেই।মেহতাব উঠে এসেছে। ওষুধের সিসি গুলো নেড়েচেড়ে দেখলো সব ভেঙ্গে চুরমার। মেহতাব হাঁটু গেড়ে বসে।তার ঠিক পেছনে থরথর কাপতে থাকা আদর।ঠোঁট কামড়ে দাড়িয়ে। এখন কি হবে?
মেহতাব উঠে গিয়ে গগন কাপিয়ে ধমক দিল আদরকে,
“আর ইউ ব্লাইন্ড!কি করলেন এটা?সবগুলো ঔষধ নষ্ট হয়ে গেছে। কোথা থেকে আনবো এগুলো?”
মেহতাবের ধমকে খানিকটা পেছনে সরে গেছে আদর।তাকে দেখতে রাগী মনে হলেও এমন ভয়ংকর রূপ দেখেনি কখনো।সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে।রায়হান আর দেলোয়ার হোসেনসহ আরো কয়েকজন সিনিয়র ডক্টর এগিয়ে এসেছেন।
আদরকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারো চিৎকার করে উঠলো মেহতাব,
“এতগুলো রোগীর জন্য এসব ঔষধ আনা হয়েছে।ঢাকা এখান থেকে দেড় ঘণ্টা দূরে।আপনি দায়িত্ব নিবেন এতগুলো মানুষের?”
রায়হান মেহতাবকে রেগে যেতে দেখে এগিয়ে এসে তাকে শান্ত করতে চাইলে সে বললো,
“প্লিজ ডক্টর রায়হান।আমার ম্যাটার থেকে দূরে থাকুন!”
সিনিয়র ডক্টর শরিফুল ইসলাম এগিয়ে এসে বললেন,
“রিল্যাক্স ডক্টর মেহতাব।এখানে রাগারাগির চেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট এর সমাধান খুঁজে বের করা।”
মেহতাব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো।আদর পরনের কাপড় চেপে মাথা নত করে দাড়িয়ে।বাঁধ ভেঙে অস্রু বইতে চাচ্ছে।কিন্তু বাধা দিয়ে রেখেছে সে।কেদে যুদ্ধ জয় করা যাবে না।ভুলটা অনেকাংশে তার।
গলা নামিয়ে মেহতাব বললো,
“দেলাওয়ার চাচা ক্লিনিকে কল করে বলেন মেডিসিন এর বক্স রেডি রাখতে।আপনি আর রোজিনা আপা গিয়ে নিয়ে আসবেন।”
“আর হ্যা ওনাকে নিয়ে যান সাথে!” আদরকে দেখিয়ে বললো মেহতাব।
একে একে সবাই চলে গেছে যারযার কাজে। দেলাওয়ার হোসেন ক্লিনিকে কল করে মেডিসিন রেডি করতে বললেন।এবার যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।আদরকে ডেকে বললেন,
“আসেন আমার সাথে”
আদর কথা না বাড়িয়ে চলে গিয়েও ফিরে এলো। মেহতাবকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আমার হাত ফসকে পড়ে গেছে।আমি ইচ্ছে করে করিনি”
মেহতাব হাত উঁচু করে বললো,
“নো মোর এক্সকিউজ!গো।”
চলবে…