#চিত্তসন্ধি
পর্ব ১৩
লেখা: #Azyah
মেহতাব উঠে যেতে নিলে তাল মেলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেয়।মাথা ঘুরাচ্ছে।টেবিলে হাত রেখে নিজেকে সামলে দাড়ালো।চোখের সামনে মৃদু ঝাপসা লাগছে।ডক্টর খলিল এসে প্রশ্ন করলো,
“আর ইউ ওকে?”
“হ্যা স্যার।আসি”
“মেহতাব! বসো আমি দেখছি।”
“স্যার চিন্তা করবেন না।”
“নো মোর এক্সকিউজ।বসতে বলেছি।অবস্থা দেখেছো তোমার?গায়ে জ্বরও দেখছি।”
একসাথে অতিরিক্ত কাজের চাপে নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলা আর ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া না করায় কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেহতাব।প্রেশার লো। ডক্টর খলিল তাকে মেডিসিন দিয়ে কেবিনে রেস্ট নিতে বলেছেন।হুট করে এতটাই দুর্বল লাগতে শুরু হলো যে ঠিকঠাক হাটতে পারছে না। দেলাওয়ার হোসেন এসে ধরে নিয়ে গেলেন।সাথে কেবিনের বেডে শুইয়ে দিয়েছেন।
“স্যার আপনি দুপুরেও খান নাই।আপনার জন্য খাবার আমি স্যার?”
চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন দেলাওয়ার চাচা।
মেহতাব কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিলো।
দেলাওয়ার চাচা আবার বলে উঠলেন,
“ওষুধগুলি হাই পাওয়ারের।খলিল স্যার বলসেন খালি পেটে খাওয়া যাইবো না”
“ওষুধ খাবো না।আর খাবার খেতেও ইচ্ছে করছে না।রুচি নেই মুখে।আপনি যান আমি ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে।”
“এদিকে ঘুমাবেন স্যার?”
“হ্যাঁ”
“বাড়ি গেলে হয়না স্যার”
“আপনি যান।”
দেলাওয়ার চাচা মাথা ঝুঁকিয়ে ভাবলেন। তারপর বললেন,
“স্যার বাইরে আছি।দরকার পড়লে ডাকবেন”
নিজের কেবিনের বেডে পড়ে আছে মেহতাব।হাত পা অবশ লাগছে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।সামান্য উঠে একটু পানি খেয়ে নিল।খাবার ত্যাগ করেছে।পানিটা না খেলে হয়তো বেচে থাকাই দায় হয়ে যাবে।পানি খেতে উঠে মনে পড়লো চোখে মুখে একটু পানি দেওয়া দরকার। চোখসহ পুরো চেহারা জ্বলছে।দুর্বল পায়ে উঠে সিঙ্ক এর সামনে দাঁড়িয়ে সারা মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে।আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখে ভাবছে,
“কিসের নেশায় ছুটছি?কেনো নিজের উপর এত জুলুম?আমি মেহতাব যাকে কেউ নড়াতে পারতো না।সেখানে আমিই নড়বড়ে হয়ে গেলাম!নিজেকে শাস্তি দিয়ে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছি?রায়হানের ইমম্যাচুরিটি দেখে তার উপর রাগ দেখাই!ম্যাচুর হয়ে কি নিজে এখন যা করছি?”
___
“তোকে বকেছে?আরেহ ছেড়ে দে জব।জীবনে কত জব আসবে যাবে।সেলফ রিসপেক্ট ইজ মোর ইম্পর্ট্যান্ট।…
যদি ভেবে থাকিস তোকে আমরা এই কথাগুলো বলবো?তাহলে ভুল।”
রোহিতের কথার প্রেক্ষিতে আদর প্রশ্ন করলো, “তাহলে কি বলবি?”
শান্তা বলল, “আমাদের ফিলোসফি তুই জানিস।ভেবে চিন্তে সব প্রবলেম এর সমাধান।একলাফে উঠে একটা সিদ্ধান্ত নিলেই পড়ে রিগ্রেট করা লাগে।”
“ঠিক বলেছিস শান্তা।অন্যসব সো কল্ড ফ্রেন্ডদের মত বলবো না যে জব ছেড়ে দে।দেখ তুই মানিস দোষ তোর ছিলো অনেকাংশে ”
“আমি মানি রোহিত।কিন্তু সে আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগই দেয় না।আমাকে কথা শুনিয়ে আড়ালে চলে যায় সবসময়।”
“সে কোনো এক্সপ্লিনেশন নেয়নি এটা তার ভুল। বাট সে কিন্তু তোকে কাজ থেকে বের করে দেয়নি।বরং তোকে কল করে জয়েন করতে বলেছে।যদি রাগ না দেখিয়ে বের করে দিত তাহলে সেটা আরো বেশি অপমানজনক হতো।”
রুবি বলল, “তুই বলেছিস সে মুখ ভার করে রাখে।কথাও কম বলে।শুধু তোর খাবার,মেডিসিন,কাজ নিয়ে একটু তদারকি করে।কারণ এটা তার দায়িত্ব।আর চুপচাপ মানুষের রাগ একটু বেশিই থাকে।”
রোহিত বললো, “এবার তুই ভাব কি করবি।তুই এমনেতেই বাড়ি থেকে টাকা নিতে চাস না।নিজের খরচ নিজেই বহন করিস। চাকরীতে এসব একটু আধটু ধমক খাওয়াই লাগে।”
প্রকৃত বন্ধুরা যেমন সৎ কাজে সাথে থাকে তেমন অসৎ কাজেও।আদর ভেবেই নিয়েছিলো তার বন্ধুরা তার সিদ্ধান্তকে সাপোর্ট করবে।কিন্তু এখানে তারা যেসব কথা বললো সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে আদর।ভুল ঠিক বিবেচনা করার বোধ জ্ঞান হয়েছে তার।শুধু একটু সময় দরকার।
___
সেদিন রাতের পর মেহতাবের অবস্থা আরো অবনতি হয়েছে।খালি পেটে বমি করে নাজেহাল অবস্থা।তিনদিন যাবৎ হসপিটালেই আছে।কোনোভাবে জোর করে বাড়ি পাঠানো যায়নি।রায়হান না পেরে তার মাকে ডাকিয়েছে।তিনিও এসে মেহতাবকে বোঝাতে ব্যর্থ।চোখ গেঁথে গেছে।পুরো চেহারা মলিন।এক কাপড়ে তিনদিন পার করে দিলো। মেহতাব এর এমন অবস্থা দেখে দেলোয়ার হোসেন মেহতাবের বিরুদ্ধে গিয়ে ডাক্টার খলিলকে ডেকে এনেছেন।
ডক্টর খলিল এসে মেহতাবকে অর্ধজ্ঞান পড়ে থাকতে দেখে বললেন,
“একি অবস্থা তোমার মেহতাব!”
দেলাওয়ার হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“ওকি ওষুধ খায়নি?”
দেলাওয়ার হোসেন উত্তর দিলেন,
“বড় স্যার কত বললাম খাবার খান ওষুধ খান। কথাই শুনতেছে না।বাড়ি পর্যন্ত যায়নি।সকালে দুই চামচ স্যুপ খাইয়ে দিয়ে গেছে ওনার চাচী”
ডক্টর খলিল ভ্রু কুচকে মেহতাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“এসবের মানে কি মেহতাব?তুমি একজন ডাক্তার হয়ে এরকম করছো?”
“দেলাওয়ার সেলাইন আনো।”
মেহতাব এর হাতে সেলাইন দিয়ে ডক্টর খলিল বললেন,
“আমি একঘন্টা পর এসে চেকাপ করে যাবো।”
“জ্বি স্যার”
মেহতাব চোখ বন্ধ করে মৃদু স্বরে গোঙ্গালো।রায়হান এসে একটুপর পর দেখে যাচ্ছে তাকে। দেলাওয়ার হোসেন কোনোভাবে চোখের আড়াল করছে না।ছায়ার মতন লেগে আছে।সেও বাড়ি ফেরেনি মেহতাব এর জন্য।গেলেও অল্প সময়ে ফিরে এসেছেন।আধ ঘন্টা মেহতাব এর পায়ের কাছে বসে থেকে লক্ষ করলো সে একটু ঘুমিয়েছে।তবে ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে।শার্টের বোতাম কয়েকটা খুলে দিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিলো।
ভাঙ্গা কণ্ঠে মেহরাব ঘুমের বলে উঠলো,
“ভীষণ অভিমানী তুমি”
দেলাওয়ার হোসেন ঠিকঠাক শুনতে পেলেন না।তার সেই ফোন বেজে উঠলো।আদর কল করেছে দেলাওয়ার হোসেইনকে।তিনদিন পর সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে সে।কাজে ফিরবে।তবে সাহসে কুলাচ্ছে না।তাই দেলাওয়ার হোসেনকে কল করে সেখানকার পরিস্থিতি জানতে কল করার।
“হ্যালো দেলাওয়ার চাচা”
“হ্যালো আপনি কই? আসেননা কেন?”
এটার উত্তর কি দিবে আদর ভেবে পেলো না।কথা এড়িয়ে বললো,
“আপনার স্যার ডিউটিতে আছে আজ?”
“স্যার বিগত তিনদিন ধরে হসপিটালে।”
“কেনো আজতো ডিউটি ছিলো না আমার জানা মতে”
“স্যারের অবস্থা অনেক খারাপ।কিছু খায় না।তিনদিন বাড়ীতেও যায় নাই।এদিকেই পইড়া আছে।অনেক অসুস্থ।মাত্র বড় স্যার সেলাইন দিয়ে গেছে”
“অনেক খারাপ মানে?”
“মানে কি জানি হইছে।খাইতে চায় না কিছু, ঘুমায়ও না। কতদিন আগেতো ঠিকই আছিলো।আপনি যেদিন থেইকা
আসেন না তারপর কয়দিন ঠিকই ছিল এর তিন চারদিন পর থেকেই এই অবস্থা”
আদরের মন হটাৎ খারাপ লাগায় ছেয়ে গেল। এতটা অসুস্থ শুনে খারাপ লাগছে।তিন চারদিন যাবৎ এই অবস্থা আর সে জানেও না।আচ্ছা জানার কি দরকার ছিলো? মেহতাবের প্রতি রাগের চেয়ে বেশি এখন খারাপ লাগছে। ঠোঁট কামড়ে প্রশ্ন করলো,
“আমি কি আসবো চাচা?”
“আসলে ভালো হয়।আমি একলা স্যাররে সামলাইতে পারতাছি না”
“আমি আসছি!”
নিজের অজান্তেই তাড়াহুড়ো করছে আদর। মাথার শুধু একটা জিনিষ ঘুরপাক খাচ্ছে দ্রুত পৌঁছাতে হবে।কি হয়ে গেলো গম্ভির শক্তপোক্ত মানুষটার।ধমক দেওয়ার সময়তো ঠিকই ভালো থাকে।তাহলে এখন এমন নুয়ে পড়লো কেন?আবার আমার খাওয়া নিয়েও তার অনেক মাথা ব্যথা।তাহলে নিজের বেলায় এসব কোথায় গেলো?আদরের বরাবরই মায়া বেশি। অল্পতে গলে যায়।সম্পুর্ণটা মা হলেও ঠিক তার মায়ের মতন।নিজেই এসব ভেবে মুখ ভেংচিয়ে মাকে বলে বেরিয়ে পড়লো।মেহতাবের কাছে ঝাড়ি খেয়েছিল এই কথা ভুলে দৌড় লাগিয়েছে ক্লিনিকে।
চলবে…