#চিত্তসন্ধি
পর্ব ১৯
লেখা: #Azyah
“কারণ আমি জানি না।কিন্তু এতটুকু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি নিজেকে নিজের দুর্বলতা না শক্তি বানানো উচিত।যেনো হুট করে কোনো ঝড় হাওয়া এসে ভেঙে দিতে না পারে”
মেহতাব এর আওয়াজে মাথা তুললো আদর।হাঁটুতে হাত বেধে ঠিক তার পাশে বসে আছে।কখন এলো সে? টেরও পেলাম না!নিজের মধ্যে এত মগ্ন ছিলাম।না জানি কতক্ষন যাবৎ বসে আছে।
নাক টেনে বললো,
“আপনি কখন এলেন?”
“দশ মিনিট আঠেরো সেকেন্ড” ঘড়ি দেখে জবাব দিল মেহতাব।
“পেশেন্টদের রেখে এখানে যে?”
“বাকি পেশেন্টদের দেখে সর্বশেষ পেসেন্টকে দেখতে এলাম”
“আমাকে বলছেন?”
“এখানে আপনি আমি ব্যতীত আর কারো অস্তিত্ব নেই”
কিছু সময়ের ঘোর নিরবতা বিরাজ করছে সিড়ি ঘড় জুড়ে।কারো মুখে কোন কথা নেই।আদর ভাবছে কেনো আমি পেছনে ফেলে আসা কোনোকিছু ভুলতে পারি না। পুরোনো কিছু বর্তমানে এসে দেখা দিলে আগের কথাগুলো মস্তিষ্কে জীবিত হয়ে উঠে।ঈশানের প্রতি আর ভালো লাগা নেই আদরের।অনেক আগেই সব ধুয়ে মুছে অতীতেই ফেলে রেখে এসেছে। তারপরও কেনো?এটা একটা বদ অভ্যাস।ভালো,খারাপ সকল কথা আদর মনে রাখে।পেছনে ফেলে রাখা ভালো মুহূর্তগুলো ভেবে হাসি,খারাপ সময়গুলো ভেবে কাদে।এটা শুধু ঈশানের ক্ষেত্রে নয় সকল ক্ষেত্রে।জীবনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা কথা আদরের স্মরণে আছে।
“আমার মনে হয় মানসিক ডাক্তারের প্রয়োজন স্যার।”
“নিজেই নিজের ডাক্তার হন লাইফ টাইম সার্ভিস পাবেন।এখানে যুদ্ধ করে বেচে থাকতে হয়”
“আপনিও কি যোদ্ধা?”
মেহতাব মৃদু হেসে বললো, “হ্যা আমিও যোদ্ধা,আপনিও।আমি জানি না আমি জয়ী নাকি পরাজিত যোদ্ধা।কিন্তু যুদ্ধ করছি।এই ক্লিনিকটা দেখছেন? জানেন এটা আগে কেমন ছিল?”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আদর বললো,
“কেমন?”
“তিন রুমের একটা একতলা বিল্ডিং ছিলো।উপরে টিনের ছাদ।এক রুমে তিন থেকে চারজন ডাক্টার একসাথে বসতো।আরেক রুমে নারী রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হতো,আরেক রুমে পুরুষদের।আমার নানা এবং দাদার উদ্যোগে বানানো এই ক্লিনিক। খুব ভালো বন্ধু ছিলেন তারা।ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছিলো পারেননি।তাই ক্লিনিকের মাধ্যমে নিজেদের আপোস মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন।টাকা ছিলো না কারোই তেমন।ক্লিনিক চালানোর ক্ষমতাটাও হারাতে থাকেন। ব্যবসা করে কোনো রকমে এই ক্লিনিকের পেছনে ব্যয় করতেন।পড়ে এক সময় আমার বাবা আর মার বিয়ে দিলেন। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে আরো মজবুত করার জন্যে।আমার মা একমাত্র সন্তান ছিল আমার নানার। ওয়ারিশ সূত্রে এই ক্লিনিকের মালিক হয় আমার মা, বাবা আর চাচা।একদিন সিদ্ধান্ত হলো ক্লিনিককে আরো পরিপাটি করবেন।এমন নাজেহাল অবস্থায় কোনো রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব না।কোনো ডাক্টার আমাদের ক্লিনিকে আসতে চাইতেন না।”
মেহতাব থামলো।হয়রান এতটুকু বলেই।কিন্তু আদর উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।কথা শুনছে।জানার ইচ্ছে বাড়ছে।এরপর কি হলো?
“তারপর?”
“তারপর কি আমার নানা,দাদা শেষ বয়সে অনেক গর্বিত ছিলেন।তাদের ছেলে মেয়েরা এতটা হার্ড ওয়ার্কিং।আমার বাবা চাচা যখন সামলে উঠতে পারেননি।তখন মাও কাজে লেগে যায়।তাদের তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই ক্লিনিক।আজ তাদের বদৌলতে এত জাকজমোকপূর্ন সবকিছু।এরপর আসলাম আমি,আমার বোন আর রায়হান।আমার বোন মানে সেদিন যাকে রেস্টুরেন্টে দেখেছেন।আর রায়হানকেতো চেনেনই।ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো না।মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে অনেকটা এই পেশার মোহে আটকা পরে গেছি।অথচ আমার মা কিছুই দেখতে পারেননি” শেষ কথাটি বলে মেহতাবের কন্ঠস্বর ভার হয়ে আসলো।
“কেনো দেখতে পারেননি?উনি কোথায়?”
ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে কাচের গ্লাস ভেদ করে চোখ গেলো অম্বরের অর্ধ চাঁদের দিকে।পাশেই একটি তারা জ্বলজ্বল করছে।আঙ্গুল তুলে সেই তারাটিকে দেখিয়ে বললো,
“ঐযে চাদের পাশে তারাটি দেখছেন?সেখানে আমার মা”
আদর বুঝতে পারলো।কি বোঝাতে যাচ্ছে আসলে।তার মা তাদের ছেড়ে চলে গেছে?ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে আদর।চোখে অথৈ জ্বল ছলছল করছে।বড্ড আবেগপ্রবন মেয়ে।এসব কথা তার বুক চিরে গিয়ে লাগে।আজ প্রথম মায়া হচ্ছে এই কসাই সাহেবের প্রতি।তাছারাও অপরাধবোধও হচ্ছে।না জেনেই বোনকে তার বউ ভেবে বসে ছিলো?ছি ছি!
“কি হলো?আপনি এমন ইমোশনাল হয়ে গেলেন কেন?”
“সরি। আসলে এসব কথা শুনলে আমার অনেক খারাপ লাগে ”
“ব্যাপার না।আপনাকে এসব বলার কারণ হচ্ছে কি পেয়েছেন,কি হারিয়েছেন তার হিসাব করে জীবন পার করে দিলে ফলাফল শূন্য।ভোগের আশা ছেড়ে যেভাবে চলছে দিন চলতে দিন।যা চলে গেছে যেতে দিন,যা আসছে সেটাকে আকড়ে নিন।সামর্থ না থাকলে ছেড়ে দিন”
“আপনি কি করে বুঝলেন আমার পুরনো কোনো জিনিসে আটকে?”
“অনুমান করলাম। এমনে এমনেইতো ডাক্টার হইনি!মানুষের হার্টবিট, পালস রেট মেপে,মুখ আর শরীরের অবস্থা দেখে অনুমান করে ফেলি তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোনো রোগ আছে কিনা।”
“রায়হান স্যার আপনার ভাই হয়।আপনি ওনাকে এভাবে তাড়িয়ে দেন কেনো?উনি যদি রেগে যান? উনিওতো আংশিক মালিক এখানকার।”
“রায়হান আর আমার মধ্যকার সম্পর্ক বুঝে ওঠার মতন এত বড় আপনি হননি”
গুরুগম্ভীরপূর্ন একটা সময়ের মধ্যে আদর রেগে গেলো। তৎক্ষনাৎ বললো,
“আমি যথেষ্ট বড়।আমার বয়স কত জানেন? দুই এ দুই এ বাইশ”
“দুই এ দুই এ চার হয়।আমার কত জানেন?”
“না”
“গুনে গুনে আপনার থেকে নয় বছরের বড় আমি।”
হিসাবে ভীষন কাচা আদর।আঙ্গুল দিয়ে গুনছে বাইশ থেকে নয় বছরের বড় হলে কত বয়স হয়।গুনে পেলো একত্রিশ বছর।এত বয়স্ক এই লোক! দেখেতো বোঝাই যায় না।
“আপনাকে দেখে বোঝা যায়না আপনার এত বয়স!”
আবার বয়স নিয়ে খোটা দিচ্ছে।আড়চোখে আদরের দিকে তাকালো।আদর দৃষ্টি নুয়ে নিয়েছে।মেহতাব বললো,
“আপনাকে দেখে যে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের মতন লাগে তার বেলায়?”
“আচ্ছা আচ্ছা।এবার চলেন।এভাবে বসে থাকলে আপনার কাজ আটকাবে।আর সেটার জন্য দায়ী হবো আমি”
উঠে দাড়ালো আদর।পা বাড়িয়েছে যাওয়ার জন্য। ওড়নায় টান পড়তে ভরকে উঠলো।এখানে সে আর মেহতাব ব্যতীত কারো অস্তিত্ব নেই।তাহলে ওড়না টেনে আছে কে?ভুত নাকি জ্বীন!চোখ কটমট করে পেছনে তাকাতেই দেখলো সিড়ির স্টিলের রেলিংয়ের সাথে আটকে আছে। মেহতাবও আটকে থাকা ওড়নার দিকে চেয়ে।
আলতো হাতে ছাড়িয়ে দিয়ে উঠে বললো,
“আপনি যা ভেবেছেন তেমন কিছুই হয়নি”
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।আচ্ছা লজ্জায় পড়েছে।অবশ্যই ওনার মন পরে ফেলার ঐশ্বরিক শক্তি আছে।নাহলে কিভাবে বুঝলো!আদর ভেবেছিল মেহতাব তার ওড়না টেনে ধরেছে।
“কিভাবে গম্ভীরমুখে লজ্জা দিয়ে গেলো!”
____
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ রুবিকে আমার মনের কথা বলেই ছাড়বো।” ক্যাম্পাসের মাঠে হাত শক্ত করে রেখে রোহিত শান্তা আর আদরকে বললো।
শান্তা মুখ ভেংচিয়ে বললো, “এটা তুমি ফার্স্ট ইয়ার থেকে বলে আসছো সোনা।তোমাকে দিয়ে হবে না”
“আমি ভেবেছিলাম হয়তো বুঝবে সে না বলা কথাগুলো” উদাস হয়ে গেলো রোহিতের চেহারা।
“সবাইতো আদর আর শান্তা হয়না”
বলে শান্তা আদরের দিকে তাকালো।মহারানী গালে হাত রেখে মাঠের ঘাসগুলোকে একটা একটা করে তুলছে।আজকাল বেশ অন্যমনস্ক দেখায়।বন্ধুদের আড্ডায় তেমন মনোযোগ নেই এখন।সবাই কথা বলে সে থাকে নির্বিকার।
মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে শান্তা বলল,
“কিগো ভাবনার রানী।আপনি কি ভূমির প্রেমে পড়েছেন নাকি ঘাসের?যখন আড্ডায় বসেন গালে হাত দিয়ে মাথা নামিয়ে রাখেন।”
“প্রেম? নাতো প্রেমে ট্রেমে পড়িনি।”
“ভূমি আর ঘাসের প্রেমে পরাও যায় না বেক্কল মহিলা” রোহিত ফোড়ন কেটে বললো।
“আচ্ছা এসব বাদ দে।কি বলছিলি রোহিত?”
“দেখো কান্ড ওর দুই কানের পাশে বসে আমি আমার জীবনের এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম সে কিনা শোনেই নি।রুবিকে সবটা জানাবো ”
“সেই সিদ্ধান্ত তুই এই তিন বছরে কতবার নিয়েছিস রোহিত?”
“এবার ফাইনাল দোস্ত।ওরে অনুভব করাতে পারলাম না।এবার স্বীকারোক্তি দিবো।”
“অনুভব করানো যায় নাকি? মুখে না বললে মানুষ কিভাবে বুঝবে কেউ কাউকে পছন্দ করে?” হতবুদ্ধির মতন চাইলো আদর রোহিত আর শান্তার দিকে।
শান্তা বলল, “যারা প্রেমে পড়েছে, যার প্রেমে পড়েছে তাকে অনুভব করাতে চায় সবার প্রথমে।তার কাজের মাধ্যমে,কথার মাধ্যমে।প্রথমেই মুখে বলে ফেললে ঐ ভালোবাসা বেশিদিন টিকে না আমার মতে।কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো যার অনুভব করা দরকার সে বাদে পৃথিবীর সকল মানুষ জানবে এরা একে অপরকে পছন্দ করে।ওর মধ্যে আমাদের এক গাঁধী রুবি”
রোহিত ভ্রু নাচিয়ে বলল, “তুই এত প্রেমবিদ্যা কোথা থেকে শিখলি শান্তা?নিশ্চই সেই হ্যাংলা পাতলা শীতল নামের ছোকরা থেকে!”
“এভাবে বলিস কেনো? ও কিন্তু তোদের হবু দুলাভাই।”
রোহিত বিস্মিত চোখে বললো, “এই কাহিনী কবে ঘটলো?”
“শীতল আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের ছেলে।আমার শিক্ষক।তিনি আগে থেকেই বাবা মাকে বলে রেখেছে যেনো আমাকেই তার ছেলের বউ করতে দেয়।তারপর কি?তার সাথে দেখা করতে করতে ভালো লাগাও জন্মে গিয়েছে” শেষের কথা বলে লাজুক হাসলো শান্তা।
“যাক মামা ভালো”
“আমরা সবাই সেট। শীতলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক।তুই আর রুবিও মোটামুটি সেট।মধ্যে আছে আমাদের আদর আপা।তুইও একটা ছেলে কুড়িয়ে বিয়েটা সেরে ফেল।”
“এহ!আমি কুড়াবো কেনো। কুড়ানো জিনিস আদরের পছন্দ না।আমি বিয়ে করবো একজন সুদর্শন পুরুষকে।যেকিনা আমাকে পেতে মরিয়া হয়ে থাকবে সারাক্ষণ।দেখে নিস!”
শান্তা রোহিত একজোটে বলে উঠলো, “ওকে বস!”
চলবে…