#চিত্তসন্ধি
পর্ব ১
লেখা: #Azyah
নিউ লাইফ ক্লিনিক।জীবনের ত্রিশটা বছর পার হয়ে গেছে।এর মধ্যে পেছনের অনেকগুলো বছর কেটে গেছে মানব দেহের প্রত্যেকটা অঙ্গ,ঔষধের গন্ধ আর কাটাছেঁড়ার মধ্যেই।আজ একত্রিশতম বছরের প্রথম দিন।জন্মদিন নাকি মানুষের জীবনে বিশেষ একটি দিন হয়।তবে এই দিকটি সবার জন্য এক নয়।একজন বিশিষ্ট ডাক্তারের দিনটি পার হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ জন রোগীর চেকাপ করতে গিয়ে।কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘন্টা।নিজের জন্য সময় নেই। নিঃশ্বাসটাও মেপে মেপে নিজে হয়।সেখানে জন্মদিন পালন করা বিলাসিতা।
ধূসর রাঙা শার্টের উপর সাদা এপ্রোন। এসির পাওয়ার ১৬তে।তারপরও গরমে ঘাড় নাক ঘেমে এসেছে।সাদা সচ্ছ কাচের চশমা খুলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।ক্লান্ত লাগছে।এত এত মানুষের এত এত রোগ,এত সমস্যা।মাথা হ্যাং হয়ে যায়। শরীর চলে না।জোর করেই চালাতে হয়।
দরজায় খটখট শব্দ হতেই তপ্ত নিঃশ্বাস এর সাথে জবাব আসলো,
“কাম ইন”
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেলোয়ার বললেন,
“স্যার আরেকটা পেশেন্ট আছে।আপনি কি একটু কষ্ট করে দেখবেন?তার মা বললো তিনি নাকি রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে বসেছিলেন।”
“রুগী দেখা আমার কাজ।অনুমতি নেওয়ার কি আছে?শুধু জানিয়ে দিবেন।”
“জ্বি আচ্ছা।আমি কি ডাকবো ওনাদের স্যার?”
“আসতে বলেন”
ডাক্তারের কেবিনের বাইরে শাড়ি পরিহিত এক রমণী পা দুলিয়ে যাচ্ছে।যখন থেকে এসেছে তার পা দুটো নরেই যাচ্ছে। দেলওয়ারের কোনোভাবেই লাগছে না এই মেয়ে নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল রাস্তায়।তার চেয়ে অদ্ভুত পরনের কাপড়।হসপিটালে কে শাড়ি পরে আসে? চিকিৎসা করতে এসেছে নাকি বিয়ে খেতে?তবে মেয়েটির পাশে বসা মহিলার মুখে বিষণ্ণ চিন্তার ছাপ।দেখেই মনে হচ্ছে তিনি যা বলেছেন তা সত্য।মেয়ে আসলেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।মেয়েকে দেখে বোঝার উপায় না থাকলেও মায়ের চেহারা দেখে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন দেলোয়ার।
ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে এসে তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
“স্যার আপনাদের ভেতরে যেতে বলেছে।একটু জলদি করেন স্যারের ডিউটি আওয়ার শেষ।”
কেবিনের দরজা ঠেলে জোহরা খাতুন বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করলেন,
“আসতে পারি?”
চোখ নামিয়েই উত্তর আসলো,
“জ্বি”
মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছেন জোহরা খাতুন তার মেয়েকে নিয়ে।সেই তার মেয়ে যে কিনা হুটহাট অজ্ঞান হয়ে যায়।
কলম চালাতে চালাতে প্রশ্ন করলেন,
“সমস্যা কার?”
“স্যার আমার মেয়ে আদরের।ভার্সিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে গিয়ে হুট করে অজ্ঞান হয়ে যায়।খাওয়া দাওয়া একদমই করতে চায়না।শরীর ভীষণ দুর্বল।”
“ওনার পাস্ট হিস্ট্রি?”
“হরমোনাল ইমব্যালেন্স আছে।সাথে আন্ডার ওয়েট”
ডেস্কের উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা “ডক্টর নওশের মেহতাব”।
সামনের মানুষটিকে দেখে বিষম খেয়ে আছে আদর।এটা ডাক্তার?কই সে ভাবলো আধাপাকা চুল,দাড়ি ওয়ালা মধ্যবয়স্ক একজন লোক বসে থাকবে! এ দেখি এক চ্যাংরা ছেলে।চ্যাংরা বললে ভুল হবে প্রাপ্ত বয়স্ক একজন বলিষ্ঠ পুরুষ।বসে থাকা অবস্থায় তার যতটুকু দৃশ্যমান ততটুকু মেপে নিচ্ছে আদর।চুলগুলো ছোটোও নয় বড়ও নয় মাঝারি।মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি।চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা।মুখে থমথমে নিরবতা।দেখে মনে হচ্ছে মেজাজ চড়া। তারা আসার পর থেকে একবারও চোখ তুলে তাকায়নি।মানুষকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার এক আলাদা শক্তি নিয়ে জন্মেছে সে। যার সাথেই দেখা হয় তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে নেয়।হোক সে পরিচিত অথবা অপরিচিত,নারী অথবা পুরুষ। ডাক্টার হোক অথবা দারোয়ান।এইযে একটু আগে? দেলোয়ার হোসেনকে দেখে মনেমনে ভাবছিল এই লোকটা বোধহয় কাজের চাপে শুকিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা!বলা হয় খালি মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।আদরের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।
কয়েক মিনিট অতিবাহিত করে ডক্টর নওশের মেহতাব চোখ তুলে তাকালো।একবার তাকিয়ে সাথেসাথে চোখ নামিয়ে ফেলে।মাথায় খেললো মেয়েটিকি শাড়ি পরে আছে? অদ্ভুত বিষয়।আরেকবার তাকিয়ে দেখা দরকার।যেমন চিন্তা তেমন কাজ।এক সেকেন্ড সময় নিয়ে সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পুনরায় দৃষ্টি স্থাপন করেছে সাদা কাগজের উপর।সাদা রঙের শাড়ি পরে আছে আদর।সাথে মুখে সার্জিকাল মাস্ক। চোখদুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
ফার্স্ট ইয়ারের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে সিনিয়র হিসেবে দায়িত্বরত ছিলো সে আর তার বন্ধুগন। মাকে নিয়েছিলো সাথে।প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করবে।সেখানেই অতিরিক্ত গরমে আর দুর্বলতায় অজ্ঞান হয়ে বসে।আদরের মা জোহরা বেগম ডাক্তারের কাছে মেয়ের নালিশ করতে করতে মুখের ভাষা শেষ করে ফেলছেন।তারপরও থামছেন না।এত বড় একটা মেয়ে বড্ড জ্বালায় তাকে।ছোট বাচ্চাদের মতন খাবার নিয়ে দৌঁড়াতে হয়।
মেহতাব শুনছে তবে কোনো উত্তর দিচ্ছে না।এসব সমস্যা শোনা তার নিত্যদিনের কাজ।সব শুনে বুঝে আঙ্গুলের ইশারায় আদরকে তার পাশের সিট দেখিয়ে বললো,
“এখানে বসেন”
আদর তার কথা মত উঠে দাড়ায়।এগিয়ে যেতে নিলেই ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে জোহরা খাতুন তাকে আটকে ফেলে।আবার রেগে বলে উঠে,
“দেখেছেন স্যার।হাঁটার শক্তিটুকু নেই।এদিক সেদিক ধুপধাপ পড়ে যায়।”
আদর চোখ পাকিয়ে মায়ের দিকে চেয়ে ঠিক মেহতাব এর পাশের চেয়ারে মাথা নত করে বসেছে।আবারো আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললো,
“বাম হাতটা এগিয়ে দিন।পালস চেক করবো”
বামহাত এর কব্জিতে দু আঙ্গুল রেখে পালস চেক করতে লাগলো। নজর তার ঘড়ির দিকে।পরপর স্টেটেস্কোপ হাতে নিয়ে হার্টবিট চেক করতে গিয়ে থেমে গেলো।হাত কচলে বললো,
“এটা বুকের বামপাশে রাখেন।আমি নিঃশ্বাস নিতে বললে নিবেন।ছেড়ে দিতে বললে ছাড়বেন”
আদর তার নত চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে গেছে বেচারা লজ্জা পাচ্ছে।মেয়েদের গায়ে ভুলবশতও স্পর্শ করতে কাতরাচ্ছে। স্টেটেস্কোপটি বুকের বামপাশে ধরে মনে মনে বিড়বিড় করলো,
“এই ব্যাটার বউ বুঝি একে মেয়েদের থেকে দূরে থাকতে বলেছে।”
সকল পর্যবেক্ষণ শেষে মেহতাব বললো,
“আমি কিছু টেস্ট দিচ্ছি।করিয়ে কালকের মধ্যে আমাকে দেখাবেন।”
পরপর আবার প্রশ্ন করলো,
“আপনার নাম?”
জোহরা বেগম আগেভাগে উত্তর দিতে চাইলে থামিয়ে দিল তাকে।
“রোগীর সমস্যাগুলো সে নিজে বলুক।”
আদর উত্তর দিল,
” আমার নাম আদর শিকদার”
“বয়স”
“২২”
আঙ্গুল থেমে গেছে মেহতাব এর।দৃষ্টি তুলে আদরের দিকে দিলো।চাহনি তীক্ষ্ম।কলম সাইডে শব্দ করে রেখেছে।বুকে হাত বেধে পেছনে হেলান দিয়ে বললো,
“আপনার বাইশ বছর?”
“জ্বি”
“আপনার ওজন কত জানেন?”
“মাপি নি অনেকদিন ”
“মাত্র ওজন মাপলাম খেয়াল করেননি?”
“জ্বি?আসলে না”
“ওজন ৩৯ কেজি।…মাত্র!”
“ওহ”
“আপনার বয়স অনুযায়ী কি আপনার ওজনটা ঠিক আছে?”
“কি জানি?”
“লেট ইট বি ” তপ্ত শ্বাস ছাড়লো।উঠে আবার কলম চালানো শুরু করেছে। প্রেসকিপশন হাতে ধরিয়ে দিলো।
____
“তোমার মনে হয় না এখন বিয়েটা করে ফেলা উচিত?”
“আমারতো মনে হচ্ছে না বাবা।মনে হলে সেটা তোমার হচ্ছে” খাবারে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললো মেহতাব।
নাসির সাহেব ছেলের এমন খাপছাড়া কথায় অভ্যস্ত।তারপরও তিনি হাল ছাড়বেন না।ছেলের একটা ব্যবস্থা করতে পারলে একটা বোঝা নামবে।
“একা কিভাবে থাকবে?”
“সেটা আমি ভালো পারবো।তুমি এত চিন্তা করে নিজের প্রেশার বাড়িও না।”
“মেহতাব তুমি বুঝতে পারছো না।আগামী মাসে মিশার ফ্লাইট।তোমার ক্যারিয়ার সেটেল করে দিয়েছি।এবার মেয়েটার করতে হবে।তাকে নিয়ে যাচ্ছি।আমাদের যাওয়ার পর কে দেখবে তোমাকে?ইউকে কোনো পাশের গ্রাম না যে বললেই চলে আসা যায়!”
“বাবা ক্যারিয়ারের সাথে আরো একটা জিনিস শিখিয়েছো সেটা ভুলে গেলে মনে হয়”
“বলো?বলে ফেলো! কোন জিনিসটা আমি ভুলে গেছি।যদি তোমার কথায় মনে পড়ে।”
সামান্য চোখ তুলে বাঁকা হাসলো মেহতাব।হোক সে বাবা আর সে তার ছেলে। কথায় মেহতাব এর সাথে একবিন্দু পারেননা তিনি।আজও পারবেন না।এটা ভেবেই মেহতাব হাসছে।
“আমি খুলনা মেডিকেল থেকে একা একা পড়ালেখা করে ঢাকা এসেছি।আমাকে একাকীত্বের ভয় দেখানো হচ্ছে?”
মেহতাব এর বোন মিশা তাদের কথা খুব মনযোগ সহকারে শুনছিল।এখন মনে হলো বাবার পক্ষ হয়ে তারও কিছু বলা দরকার।তাই নড়েচড়ে বসে সেও বললো,
“ভাইয়া তখনকার ব্যাপার আলাদা ছিলো।তখন অবশ্যই তোমার মনে এই আশা ছিল একদিন ঢাকা ফিরে আসবে। পরিবারের কাছে।একাকীত্ব কেটে যাবে।কিন্তু এখন?সামনে কোনো আশা দেখছ?”
“তোর মনে কি আশা নেই যে তুইও ইউকে থেকে পড়ালেখা করে একদিন দেশে ফিরবি।আমার কাছে।আমার একাকীত্বটা কেটে যাবে?”
নাসির সাহেব কাটকাট গলায় বলে উঠলেন,
“তোর ভাইয়ের সাথে কথা বলা বেকার। দেখবো নে কিভাবে থাকে?”
মিশাও বাবার দলের।সেও তাল মিলিয়ে বললো,
“হ্যা!যেদিন ফাসবে আচ্ছামত ফাসবে।সেদিন ফিরে তাকিয়ে দেখবে বিয়ের বয়স পাড় করে এসেছে আরো এক যুগ আগে।”
___
এলোমেলো চুল আর রুক্ষ চেহারায় আদর বসে আছে ক্যাবিনের সামনে।ভীষণ বিরক্ত সে।সকাল সকাল সাধের ঘুম বাদ দিয়ে টেস্ট করতে আসা লাগলো।খাবারের সুরত দেখেনি এখনও।খালি পেটে টেস্টগুলো করতে হয়েছে।তার মধ্যে সেই বজ্জাত মহিলা ডায়নির মতন এতগুলো রক্ত শুষে নিল।সামান্য একটা ব্লাড টেস্টে এত রক্ত লাগে!ইচ্ছে হচ্ছে চুলগুলো টেনে দিয়ে আসি।এমনেই শরীরে হাড়গোড় ছাড়া কিচ্ছু নেই।এক ঘণ্টায় রিপোর্ট পেয়ে যাবে।আবার ঘূমেরা ঝাঁক বেঁধে ঝুঁকে আছে চোখের দরজায়।বসেই না ঘুমিয়ে পড়ে।দাড়িয়ে ঘুমোলে হয় ঘোড়া।বসে বসে ঘুমোলে কি হয়?কোন প্রাণী বসে ঘুমায়?হয়তো আদর নামের কোনো প্রাণী!
জুতোর ঠকঠক আওয়াজে আসন্ন ঘুমটা ভেঙে গেলো। ডানে ঘুরে তাকাতেই দেখা মিললো লম্বা চওড়া সেই ডাক্তারের। একহাতে এ্যাপ্রণ ঝুলিয়ে অন্যহাতে ফোন দেখছে। আকাশী রঙের শার্টের সাথে কালো প্যান্ট। খুবই ফরমাল ব্যাপার স্যাপার।সাথে পায়ের দ্রুত গতি।এত সকাল সকাল একটা মানুষ এত ফিট অ্যান্ড ফ্রেশ থাকে কিভাবে?পেছন পেছন আসছে সেই গতকালকের লোকটা।হাতে তার ব্যাগ।তার নাম দেলোয়ার।যিনি কাজের চাপে শুকিয়ে যাচ্ছে।
এবারও গতদিনের মত দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আদর এর জোহরা খাতুন।কারো এক্সরে রিপোর্ট চেক করতে করতে বিনয়ের সাথে বলে উঠলো,
“গুড মর্নিং”
“কাহেকা গুড মর্নিং।এত সকাল সকাল কারো মর্নিং গুড হয়?”
অত্যন্ত নিচু স্বরে আওরালো আদর।
“বসুন”
চেয়ারে হেলান দিয়ে গভির মনোযোগে প্রত্যেকটি রিপোর্ট উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছে।মুখে নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। গাম্ভীর্য দিয়ে ভরা সমস্ত চেহারা।আদরের চোখ ঘুরছে পুরো ক্যাবিনটার দিকে।সাদা রঙে সাজানো অনেক সুন্দর।অনেক বড়ও বটে। মেহতাবের নজর তখনও রিপোর্টে।নজর সেখানে রেখেই বলে উঠলো,
“মাস্ক খুলে বসেন”
“জ্বি?”
“আমি বলেছি মাস্ক খুলে বসেন।”
সাথেসাথে জোহরা বেগম কনুই দিয়ে গুতো দিলেন। চোঁখ বড়বড় করে বোঝাচ্ছেন যা বলা হচ্ছে করতে।একহাতের সাহায্যে মাস্কটা খুলে নিল আদর।ভেসে উঠলো তার গোলগাল চেহারাটা।নাকের বামদিকে জ্বলজ্বল করছে একটি স্টোনের নোসপিন।হলদেটে তার রং।শুকনা পাতলা ছিমছাম দেহ।
“এবার আমি টোটালি এক্সপ্লেইন করবো।খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবেন আপনারা দুজনই।”
“জ্বি স্যার আপনি বলুন” জোহরা খাতুন বললেন।
“ওনার মুখের দিকে ঠিকঠাক খেয়াল করলে দেখবেন হাতের চেয়ে চেহারা বেশি হলদে। চোখও। জন্ডিস আছে।সাথে হরমোনাল ইমব্যালেন্স এর জন্য আগে যে মেডিসিন দেওয়া হয়েছিল সেগুলো তার আর কোনো কাজে আসছে না। মেডিসিন এর পাওয়ার বাড়াতে হবে।”
“কোনো বড় সমস্যা নেই তো?”
“তেমন কিছুই না।কিন্তু এখন যদি এই সমস্যাগুলোকে হেয়ালি করা হয় ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হবে।ওনার খাওয়া দাওয়ার যে রুটিন আছে সব চেঞ্জ করতে হবে।”
“জ্বি”
“মিস ওর মিসেস আদর?”
“মিস!”
“ওকে মিস আদর।বাকি কথা আপনার সাথে।পাঁচমাস সময় আপনার হাতে।”
চোখ তুলে প্রশ্ন করলো,
“কিসের পাঁচ মাস?”
“পাঁচ মাসের একটা ডায়েট থাকবে আপনার।সাথে মেডিসিন।আপনার মা থেকে যে বর্ণনা শুনেছি আপনার তা শুনে বুঝলাম আপনি অনেক বিরক্ত করেন!”
তুলে রাখা চোখ নুয়ে গেলো।লজ্জায়।এভাবে মা তার সমস্ত কীর্তি ফাঁস না করলেও পারতো।
“ডায়েট চার্ট দিবো আপনাকে।কোনো ধরনের ফাস্ট ফুড খাওয়া চলবে না।আজ থেকে সব বন্ধ।খাবার তিন বেলার জায়গায় চারবেলা খাবেন।খুদা লাগলেই ভাত খাবেন।এক মাসে অন্তত ৩ কেজি ওজন বাড়তি চাই আমি!প্রত্যেক মাসে এসে চেকাপ করিয়ে যাবেন।গট ইট!”
এমন কথার ভঙ্গি মোটেও পছন্দ হলো না আদরের।চোখ ছোটছোট করে আনমনে ভাবছে,
“উনি কি আমাকে থ্রেট করছে!আমি যদি না খাই উনি কি জানবে? ফাষ্টফুড বাদ দিতে বলছে!হাহ্ পানি খাওয়া ছাড়তে পারবো কিন্তু আমার প্রাণের বার্গার পিজ্জা। ইম্পসিবল!করবো না কিচ্ছু করবো না।দেখি কি করে!”
আদরের দিকে পূর্ন দৃষ্টি স্থাপন করে মেহতাব বললো,
“মাথায় উল্টোপাল্টা যেসব চিন্তা আছে ঝেড়ে ফেলে দিন।যদি ভাবেন আপনাকে এসব বিষয়ে জোর করা হচ্ছে।ইয়েস! ইউ আর রাইট।আপনার মতন অনেক পেশেন্ট অনেক পেশেন্ট হ্যান্ডেল করেছি আমি।আপনি কোনো বড় ব্যাপার না।ইউ হেভ ওনলি ফাইভ মান্থস। রিমেম্বার দ্যাট।”
জোহরা বেগম খুশি হয়ে গেলেন।ডাক্তারের কথার ঝাঁঝে মনে হচ্ছে তার মেয়েকে টক্কর দেওয়ার মতন।মনে আশা জাগছে এই ঠিক করতে পারবে তার মেয়েকে। তিনিও বলে উঠলেন,
“আমার মেয়েকে ঠিক করে দেন।ওর এমন রোগা পাতলা গড়ন দেখে অনেকেই বাজে কথা বলে”
“মানুষের জন্য যদি আপনার মেয়েকে ঠিক করতে চান সেটা অন্যায় হবে তার সত্তার উপর।নিজে হেলথি থাকা প্রয়োজন।নিজের জন্য।আর হ্যা আমি আমার কাজের প্রতি অনেক বেশি লয়াল।আমি যে পেশেন্টের কেস হাতে নিয়েছি ফলাফল ১০০ ভাগ পেয়েছি।এটা আমার অহংকার ভাবলে ভাবতে পারেন।যদি আপনার মেয়ের কেসটা আমার হাতে দেন।সাথে কো অপারেটিভ থাকেন।আশা করি ভালো ফল পাবেন।তবে এখানে আপনার মেয়ে যদি গাফিলতি করে তাহলে তার সাথেসাথে আমার কাজেও ব্যাড ইম্প্যাক্ট পড়বে।ভুল হয়তো সে করবে কিন্তু দোষ সম্পূর্ণ আমার ঘাড়ে এসে পড়তে পারে।যে ডাক্তার ভালো চিকিৎসা করেনি।আর এটা আমি কোনোভাবেই বরদাস্ত করবো না”
“আর আপনি মিস আদর!আমার কথা কানে গেছে?আপনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাথার মধ্যে এসব থেকে ছাড়া পাওয়ার ফন্দি আটছেন।যদি আমার ডায়েট চার্ট এর এক ইঞ্চি এদিক ওদিক হয় আমি আপনাকে পাঁচ মাস হসপিটালে ভর্তি রাখবো।সাথে আমার পক্ষ থেকে ফ্রি ইনজেকশন।তাতে সাহায্য করবে আমাকে স্বয়ং আপনার মা।”
এমন ব্যবহার করার কি আছে!মুখে রসকষ নেই নাকি? কালতো মুখে তালা দিয়ে বসে ছিলো।আজকে রুডনেসের বন্যা বইছে মুখ দিয়ে।যেনো আমি কোনো আসামি।সে পুলিশ।তার কথা মতন সব কাজ করতে হবে আমাকে!
“মিস আদর আপনি বাহিরে বসেন।আপনার মার সাথে আমার কথা আছে।”
আদর উঠে চলে গেলো বাইরে। মেহতাব জোহরা খাতুনের উদ্দেশে বললো,
“সরি ম্যাম। পেশেন্টের ভালোর জন্য মাঝেমধ্যে একটু বেশি স্ট্রিক্ট হওয়া লাগে।আপনার হয়তো খারাপ লাগতে পারে আপনার মেয়ের সাথে এমন ব্যবহারে”
“না না স্যার কি বলছেন? আপনিতো ওর ভালোর জন্যই ওর সাথে এভাবে কথা বললেন।আমার কোনো সমস্যা নেই।আমি জানি আমার মেয়ে ভালো কথা শুনার মেয়ে না।ওকে এভাবেই হ্যান্ডেল করা লাগবে।”
রুমের দরজায় টোকা দিয়ে দেলোয়ার ঢুকলো রুমে।এসে অনুমতি চাইছে কিছু বলার।অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বললো,
“স্যার নোটিশ দেওয়া হয়েছে।কিন্তু কোনো অ্যাসিস্টেন্টই পাওয়া যাচ্ছে না।আপনি কোনো রিকোয়ারমেন্ট দেননি বলে”
“আমার তেমন কোনো রিকোয়ারমেন্ট নেই।শুধু শিক্ষিত একজন ছেলে অথবা মেয়ে হলেই চলে।কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।আপনি ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি দেখেন।কাজের চাপ দিনদিন বাড়ছে।আমি সামলে উঠতে পারছি না।”
চলবে…