চিত্তসন্ধি পর্ব ২০ লেখা: #Azyah

0
1

#চিত্তসন্ধি
পর্ব ২০
লেখা: #Azyah

জীবন তার গতীতে প্রবাহমান।সময় যেনো পাখনা মেলে উড়ে গেলো। আদর কাজে জয়েন করেছে আজ একমাস। কাজের প্রতি একটু একটু ভালো লাগা তৈরি হয়েছে।কিন্তু মেহতাব এর ধমক খেয়ে সেই ভালো লাগা ক্ষণিকের জন্য চলে যায়। মেহতাবের রাগ, দায়িত্বশীলতা, বিরক্ত মুখশ্রী দিয়েই কাজ করছে।সব ভালোর মধ্যেও বেচারি ওজন বাড়াতে পারেনি।এটা নিয়ে দ্বিগুণ ঝামেলা করছে মেহতাব।খাবারের পরিমাণ বাড়িয়েছে।এক্সারসাইজসহ অন্যান্য বিষয়ে বিশেষ নজরদারি করছে।

আদরের ফোনে টুং করে আওয়াজ বাজতেই লাফিয়ে উঠলো।ফোনের মেসেজ অপশনে গিয়ে দেখলো কাজের প্রথম বেতন এসে গেছে।এটা যেকোনো কর্মচারীর জীবনে একটা আনন্দের দিন।সে আগেও কাজ করেছে।অন্য কাজের তুলনায় এবারের স্যালারিটা বেশি। পরিশ্রমের ফল সাথে কসাই সাহেবকে সহ্য করার ফল।আদরও চওড়া হাসি নিজেকে বড়লোক ভাবতে শুরু করলো।আজ বন্ধুদের নিয়ে খানাদানা হবে। ট্রিট হবে আদরের পক্ষ থেকে।

মুখের হাসি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল মেহতাব এর কলে,

“কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”

“স্যার আজকে ছুটি নেই?”

“একদম না”

“আচ্ছা অর্ধেক বেলার ছুটি?”

“আপনি কাজই করেন অর্ধেক বেলা!”

“এমন করবেন না প্লিজ।আমার পায়ে ব্যাথা।”

“পায়ে ব্যাথা?..ঠিক আছে আমি ইকবাল চাচাকে পাঠাচ্ছি।”

“আরেহ নাহ!কি বলেন?আসছি আমি”

হেলেঢুলে কেবিনে প্রবেশ করলো আদর।বিরস চেহারা।আজকে কাজে আসার একদম ইচ্ছে ছিলো না।বেতনের টাকা আস্কারা দিয়েছে তার ইচ্ছেকে।বাহিরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে ফুর্তি করবে।সেটা আর হলো কই?কিছু না হলেও বেডের সাথের টেবিলে রাখা সামগ্রীর দেখে ভীষণ অবাক হলো।চা বানানোর যাবতীয় জিনিস এখানে রাখা।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আদর প্রশ্ন করলো,

“এগুলো কে এনেছে?”

“কোম্পানি দিয়ে গেছে”

“ওহ। সাইড করে রাখবো?”

“নাহ তার প্রয়োজন নেই।আর কষ্ট করে একশোবার ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাওয়া লাগবে না।”

“কে খায় একশোবার চা?”

আদর ইচ্ছে করে প্রশ্নটা করেছে।সে নিজেও জানে ক্যান্টিনে বারবার চা খেতে কে যায়!সে নিজে।চা ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ লাগে।মাঝেমধ্যে মনে হয় তার জন্মই চা খাওয়ার জন্য। মেহতাবকে চা খাওয়ার অজুহাত দিয়ে অনেকবার কেবিন থেকে বেরিয়েছে। মেহতাব কিছু বললো না শুধু তাকিয়ে রইলো তার প্রশ্নের বিপরীতে।

“এক কাপ চা বানান”

“আমি কেনো বানাবো?আপনি না বলেছিলেন এসব আমার কাজ না”

“আমি খাবো বলে আপনি চা বানাবেন।কারণ আপনি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট আর আমি বস।আমি ব্যতীত অন্য সকলের জন্য চা আনা অথবা বানানো আপনার কাজ না”

“বুঝলাম”

“রং চা বানাবেন। কড়া করে ইউথ আউট সুগার ”

“আপনি কি এটা চায়ের বর্ণনা দিলেন?”

“হ্যাঁ কেনো?”

“এসব মানুষে খায়?চিনি ছাড়া চা?আপনার চা খাওয়ার কি দরকার স্যার।গরম পানি দেই” বিনয়ের সুরে অপমান করলো আদর।

“আপনি একটা বেয়াদব জানেন?”

কথাটি মেহতাব বেশ তীক্ষ্মভাবে বলেছে।মুখে মুখে উত্তর দেওয়া থেকে বিরত থাকা দরকার আপাদত।কারণ সে যদি শুরু করে আদরের ময়দানে জায়গা হবে না।মাঝেমধ্যে চুপ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ।

মেহতাব আরেকদফা বললো, “একদম মুখে মুখে তর্ক করবেন না।সবসময় বাড়াবাড়ি ভালো না।ছাড় দেই বলে মাথায় চরে বসছেন।যা বলা হয়েছে করেন”

মুখটা ছোট হয়ে গেছে আদরের।একটু বোধহয় বেশিবেশি করে ফেলে সে।যতই হোক সে তার বস আর বয়সে বড়।এভাবে কথা বলা মোটেও উচিত নয়।রেগে যেতেই পারে।নিজের দোষ ধরতে গিয়েও মনটা খারাপ লাগছে।একটু নাহয় বলে ফেলে বেশি কথা!তাই বলে এভাবে বলবে?মানুষ কষ্ট পায়না?সারাক্ষণ খালি ধমক আর তেতো কথা।আবার খুব ভাবনার দ্রুত পরিবর্তন ঘটলো।কাকে দিয়ে কি আশা করছি আমি?যে নিজের ডাক্টার ভাইকে হুটহাট অপমান করে বের করে দেয় সে নাকি তার মতন একজন সামান্য অ্যাসিস্ট্যান্টকে ছেড়ে দিবে।

ভাবনা চেতনার পর্ব চুকিয়ে নিঃশব্দে চা বানাতে লাগলো।ঠিক যেমন মেহতাব বলেছে তেমন করেই। কড়া লিকারের চা,চিনি ছাড়া।বানিয়ে মুখটা ঝুলিয়ে টেবিলের সামনে অল্প শব্দে রেখে আসলো।মেহতাব আদরের রং উড়ে যাওয়া চেহারা আর সকল কর্মকাণ্ড ঠিকঠিক লক্ষ্য করছে।তবে নিঃশব্দে।

চায়ের চুমুক দিচ্ছে চেয়ারে হেলান নিয়ে।শেষ চুমুকে আদরের ভোতা মুখের দিকে চেয়ে বলল,

“আপনি খেলেন না যে? আপনারতো আবার পরান বেরিয়ে যায় চা না খেলে”

আদর কিছু একটা ভাবলো।সময় নিয়ে উত্তর দিল,

“এখন খেতে ইচ্ছে করছে না”

“কাপটা নিয়ে যান”

কোনো জবাব না দিয়ে কাপ সরিয়েছে।ভালোমত পরিস্কার করে যেখানে ছিলো সেখানে রাখলো। পুনরায় ফিরে এলো নিজের ডেস্কে।মাথা নিচু করে থাকায় চুলগুলো বারবার সামনে চলে আসছে আদরের।একহাত টেবিলে ঠেকিয়ে আরেক হাতে চুল ঠিক করতে ব্যস্ত।অবাধ্য চুলগুলো নিজের মনমর্জি মত কাজ করছে।আদর বারবার সরিয়ে নিলেও কথা শুনলো না।মোবাইলের দিকে নজর দিয়ে কখনো ঠোঁট কামড়াচ্ছে কখনো হাসছে। নিশ্চয়ই মোবাইলে হাসির কিছু চলছে?হুট করে দেখা গেলো চোখ শূন্যে তুলে কিছু ভাবা শুরু করলো।কয়েক সেকেন্ড পর আবার নামিয়ে নিল।স্থির হয়ে বসে থেকেও স্থির নেই।মুখের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া! মেহতাবের সচ্ছ চশমার আড়ালে থাকা চোঁখকে আটকে। সবসময়তো আশেপাশেই থাকে।কখনো এতটা শান্তিতে বসে তাকে পর্যবেক্ষণ করা হয়নি।দেখেছে তাও অল্প সময়ের জন্য। আঙ্গুলের ফাকে পেন্সিল ঘুরাতে ঘুরাতে মোহনীয় দৃষ্টি আদরের চেহারার প্রত্যেকটা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াতে নিবদ্ধ।আজ নোসপিনে ভিন্নতা এসেছে।কালো পাথর জ্বলজ্বল করছে বরাবরের মতন।ঠোঁটে খুব অল্প পরিমাণে লিপস্টিক দেওয়া। লিপস্টিক দেখে সেদিন গাড়ীর কথা মনে পড়লো। মেহতাব মাথা মাথা ঘুরিয়ে হেসে নিল সামান্য।কি অসভ্য মেয়ে!এতবড় একটা কথা বলে ফেলতে একফোঁটা মুখে আটকায়নি?

“স্যার!”

“স্যাররর!”

দেলাওয়ার হোসেন দ্বিতীয় ডাক দিয়ে তৃতীয়বার ডাক দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।কিন্তু ডাক্টার মশাইয়ের কোনো হুশ জ্ঞান নেই।আদর একবার দেলাওয়ার হোসেনের দিকে চেয়ে আবার মেহতাবের দিকে তাকালো।সাথে সাথে বললো,

“আপনাকে ডাকছে দেলাওয়ার চাচা”

জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে একটু উঠে বসলো মেহতাব।তার এই হুট করে ঘোরে হারিয়ে যাওয়া!পাশে মানুষ এসে দাড়িয়ে আছে!অবশ্যই দেখেছে তাকে আদরের দিকে তাকিয়ে থাকতে।

গলা পরিস্কার করে নিজের বাহু ঘষে বললো,

“জ্বি দেলাওয়ার চাচা?”

“বড় স্যারেরা মিটিংয়ে বসছে।আপনারে ডাকে”

“আসছি আপনি যান”

দেলাওয়ার হোসেন চলে যাওয়ার পর মেহতাব আদরকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“কেবিন লক করেন আর আমি…”

মেহতাবকে থামিয়ে আদর নিচু স্বরে অল্প শব্দে বলে উঠলো,

“আমি জানি”

যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।শার্টের গোটানো হাতা ঠিক করতে করতে আড়চোখে প্রশ্ন করলো,

“কি জানেন?শুনি?”

আদরের পক্ষ থেকে পূনরায় নিচু স্বরের উত্তর,

“ভেতর থেকে কেবিন লক করবো,আপনি ছাড়া কেউ যেনো প্রবেশ না করে কেবিনে”

“গুড” বলে বেরিয়ে গেলো মেহতাব।”

___

আবারো স্বাধীন পাখির মতন ডানা মেলে বেডের সাইডে চলে গেলো।একটি বিশ্রাম নিবে।কিন্তু এই ডানা ঝাপটানো পাখির মন ভীষণ খারাপ।অপমানে জর্জরিত।উৎফুল্লতা নেই। অভিমান জমেছে।তারপরও নিজের ভালো বুঝে সটাং হয়ে শুয়ে পড়ল।মনে মনে গালি দিতে নিলেও থেমে গেলো। উনিতো আবার মনের কথাও শুনে ফেলে।তাকে গালি দিচ্ছি বলে আবার অপমানের বন্যায় ভাসিয়ে দিবে।
ঘুমটা খুব শীগ্রই এসে পড়ে।আদরকে ছাড়া থাকতেই পারে না। বিছনায় গা এলিয়ে দিলেই একলাফে চোখের মধ্যে এসে মিশে যায়। অতিরিক্ত ঘুমকাতুরে।যদিও তার ঘরের বিছানার জন্য আরাদায়ক না। তারপরও এই একমাসে অভ্যাস হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই ধুপধাপ পড়ে যায়। দশ মিনিটের মাথায় আদর বিভোর ঘুম।ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে অতিরিক্ত ঘুমের কারণে কসাই সাহেব তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছেন।

আরো বিশ মিনিট পর। মেহতাব ফিরছে।বাহিরের চেয়ারে এক পলক দৃষ্টি দিলে দেখতে পেলো দেলাওয়ার চাচা নেই।অবশ্যই নাস্তা করতে নিচে গেছেন।দরজা খোলার চেষ্টা করে পারলো না।বুঝে গেছে ভেতরের কাহিনী।না ধাক্কিয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে প্রবেশ করলো।ভেতরে ঢুকে যেমনটা ভেবেছিলো ঠিক তাই।আদর ঘুমিয়ে।সামনে দাড়িয়ে বুকে হাত গুঁজে কিছুক্ষন চেয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো।তবে বেশিক্ষণ টিকে নি। নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগছে মনে!আদরের সামনে ইদানিং কোনোকিছুই চলে না।মন তার মনমতো কাজ করে। মস্তিষ্কের বারণ মানে না।ঘুমন্ত আদরের পাশ ঘেঁষে বসেছে।সামান্য ঝুঁকে বিড়বিড় করে বললো,

“এত ঘুম কোথা থেকে আসে হূ? আবার রেগে নাকটাও লাল করে রেখেছো!আমার সাথে অভিমান করে লাভ নেই বুঝলে।আমি মানুষটা লোহার চেয়েও বেশি শক্ত।”

ঘুমের ঘোরে কান্ড ঘটিয়ে বসেছে আদর। মেহতাবের বিছনায় আটকে রাখা হাত টেনে ধরে বলছে,

“আম্মু আর পাঁচ মিনিট!আর….পাঁচ মিনিট ঘুমোতে দাও”

আদরের অদূরে কণ্ঠে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করলো।কারো ঘুমুঘুমু কন্ঠ এতটা নেশার মতন লাগতে পারে?তবে এখন লাগছে।তার পুরো মুখশ্রী জুড়েই মাদকতা।এই মাদকতায় ধীরেধীরে বধ হয়ে যাচ্ছে মেহতাব। একতো হাত টেনে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে তারমধ্যে ভুলভাল বকছে।মেহতাবের অবস্থা নাজেহাল। বিমোহিত হয়ে আদরের কপালে গাঢ় চুমু বসলো। তড়িৎ গতিতে সরে গিয়েছে মেহতাব। সাথে আলতো হাতে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিলো খুব সাবধানে।আদর যেনো উঠে না যায়।অন্তত সে নিজেকে সামলে নেওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাক।

জোরে জোরে শ্বাস দিয়ে নিজেকে শান্ত করছে।কাজটা মোটেও ঠিক করেনি সে।এই কথাটা যেনো কেউ কানের সামনে ঢোল পিটিয়ে বলছে।আদর যদি উঠে যেতো?কেমন একটা পরিস্থিতির শিকার হতো সে?

“আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।সরি”

“ঠিক আছে সমস্যা নেই”

“বাড়ি যাই? ডিউটি শেষ হতে আর দশ মিনিট বাকি যদিও?”

আদরের কথায় এখনও একরাশ অভিমান। মুখটা এইটুকুখানি করে রেখেছে।মাত্র যে চুমু খেয়ে অভিমান ভাঙ্গাতে চাইলো সেটাতো আর জানে না।তারপরও রাগ হচ্ছে তার এত নিচু স্বরে কথা শুনে।

“পার্কিংয়ে গিয়ে দাড়ান”

“আমি একা যেতে পারবো”

“আবার মুখে মুখে তর্ক!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here