#চিত্তসন্ধি
পর্ব ৬
লেখা: #Azyah
সাদা এপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ আদরের হাতে দিয়ে সার্জারির জন্য রেডি হচ্ছে মেহতাব।অটির সামনে মুখে মাস্ক আর সার্জারী ক্যাপ।হাতে গ্লাভস পড়তে পড়তে আদরকে কি কি কাজ করতে হবে সেটা বুঝিয়ে দিলো।
“এগুলো নিয়ে আমার কেবিনে যান।কাজগুলো কমপ্লিট করে রাখবেন।আমার এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে।”
আদর মাথা দুলালো।তার এই বিনাশব্দের উত্তর মেহতাব এর পছন্দ হয়নি।সে আবার বললো,
“বুঝেছেন?”
“জ্বি জ্বি”
“আচ্ছা”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম” আমতা আমতা স্বরে আদর বলেই ফেললো।এতখন যাবৎ এটাই ভাবছিলো কিভাবে বলবে।
মেহতাব আরচোখে তাকিয়ে বললো,
“বলেন”
“আপনারা যে এত কাটাছেঁড়া করেন।ভয় করে না?”
আদরের এমন প্রশ্নে ঘুরে তাকালো মেহতাব।খুবই বেকুব মার্কা একটা প্রশ্ন। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তাদের কাটাছেঁড়া করতে ভয় করে কিনা?ডাক্তারি পড়ালেখা সম্পর্কে নাই জানতে পারে।কিন্তু ডাক্তারি কাজ সম্পর্কে ধারণা অবশ্যই সবার আছে। যার মধ্যে আদরের প্রশ্নকে অহেতুক মনে হচ্ছে।
মেহতাবকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ হাসি পাচ্ছে আদরের।সম্পূর্ণ নীল আবরণে ঢাকা সে। নীল রঙের বড় ড্রামের মতন দেখাচ্ছে।
মুখ চেপে নিজের হাসি সংবরণ করে বললো,
“আমি যাই”
____
পুরো কেবিন খালি।নিজেকে মুক্ত মুক্ত মনে হচ্ছে।আগামী এক থেকে দেড় ঘণ্টা এই রুমটি পুরো আদরের দখলে। অনুমতিবিহীন কেউ প্রবেশ করবে না এখানে।পুরো কেবিনে চোখ বুলিয়ে বিশাল হাসি দিল আদর।নিজেকে স্বাধীন স্বাধীন লাগছে যে!হাতে সাদা এপ্রোন আর স্টেটেস্কোপ। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। এপ্রোনটা পড়ে দেখা যাক?গলায় স্টেটেস্কোপ আর পরনে সাদা এপ্রোন পড়ে নিজেকে কিছুক্ষনের জন্য ডাক্তার ভেবে নিলে ক্ষতি কিসে?তার আগে সবদিকে নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে। কোথাও সিসিটিভি ক্যামেরা নেইতো।মাথা উচিয়ে উচিয়ে দেখে দিলো চারদেয়ালের সবখানে। নাহ! কোনো ক্যামেরা নেই। এবারে কে ঠেকায় তাকে ডাক্টার হওয়া থেকে।দ্রুত এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে দিলো।কাধে ঝুলিয়েছে স্টেথোস্কোপ।তার শরীরের তুলনায় এপ্রোনটা অনেক বড়!কিন্তু ব্যাপার না।
হাতা গুটিয়ে পড়ে নিজেকে দেখছে।পরপর বললো,
“ইস! যদি একটা আয়না থাকতো!”
আয়না না থাকার আক্ষেপ ঘুচিয়ে নিলো মোবাইলের ক্যামেরা। চট করে কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছে নিজের।এরপর চোখদুটো সোজা গিয়েছে চেয়ারের দিকে।আজ যেহেতু ডাক্তার সেজেছেই পুরো দমে অসুল করবে।গিয়ে বসে পড়লো মেহতাব এর চেয়ারে। মুখে কিছুটা গম্ভিরভাব এনেছে।ঠিক মেহতাব এর মতন।সে আজ এক ঘণ্টার ডাক্টার।নিজের ইচ্ছেগুলোকে পূর্ণতা দিয়ে নিজেই নিজেকে বলে উঠলো,
“অনেক হয়েছে আদর।এবার সব জিনিস জায়গামতো রেখে কাজে লেগে পর।তোকে এভাবে এসে দেখলে নির্ঘাত এই স্টেটেস্কোপ দিয়ে গলা চেপে মেরে ফেলবে।”
এপ্রোন চেয়ারে রেখে নিজের ডেস্কে চলে গেছে।এটা তার ডেস্ক। ছোটোখাটোর মধ্যে সুন্দর।কাজগুলো দ্রুত হাতে শেষ করে নিলো।অল্প কাজ করতে তেমন সময় লাগেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো মাত্র আধ ঘণ্টা পেরিয়েছে।এখনও অনেক সময়?একা কি করবে?তার বন্ধুগনও অনলাইনে নেই।ভাবতে ভাবতে চোখ গেলো পেশেন্টের বেডের দিকে। কোমড়টাও ব্যথা করছে এতক্ষন বসে থেকে।গিয়ে একটু শুয়ে পড়বে নাকি?কসাই সাহেবতো নেই।আসতেও অনেক দেরি।রুমটা ভেতর থেকে লক করা।আধ ঘন্টার ন্যাপ নেওয়াই যায়।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ।সটাং হয়ে শুয়ে পড়লো বেডে। দশ মিনিট শুয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়লো।
একঘন্টা পর সার্জারি শেষে হাত ধুয়ে নিয়েছে। সার্জারী এর সব বস্ত্র খুলে আগের রূপে ফিরে এসেছে।মেরুন শার্টের হাতা গুটিয়ে রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হসপিটালের টাইলসে স্লিপ খেয়ে সামনে এসে বাঁধা হয়ে দাড়ালো রায়হান।মেহতাব কিছুতেই ভেবে পায়না একজন ডাক্তার হয়ে কিভাবে এত বাচ্চামো করে?
“কি চাই?”
“চল ক্যান্টিনে।তোর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে”
“এখানেই সব বোঝাপড়া মিটিয়ে নিন ডক্টর রায়হান।”
“না চা খেতে খেতে মেটাবো।চলেন স্যার প্লিজ”
সার্জারি শেষে চায়ের ভীষণ প্রয়োজন ছিলো মেহতাব এর।তাই অযথা তর্কে না জড়িয়ে রায়হানের পিছু নিল।রায়হান নিজের জন্য দুধ চা আর মেহতাবের জন্য রং চা এনে টেবিলে বসলো।
“ডক্টর নওশের মেহতাব আপনি কি কাজটা ভালো করলেন?”
” কি করেছি?”
“যেদিন থেকে বললাম মিস আদর কিউট বাচ্চাদের মতন।এর মানে আপনি অবশ্যই বুঝেছেন।এভাবে কেড়ে নিয়ে নিজের অ্যাসিস্টেন্ট বানিয়ে নিলেন”
রায়হান অহেতুক কথা বলে।যা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।রেগে গিয়ে মেহতাব বললো,
“তোর আদরকে কিউট,বাচ্চাদের মতন বলার আগেই তাকে আমি আসিসটেন্ট হিসেবে নেওয়ার জন্য প্রক্রিয়াধীন ছিলাম”
“আমাকে দিয়ে দে!”
“একদম ফালতু কথা বলবি না রায়হান!দিয়ে দে মানে কি?কি ধরনের কথা এসব!”
“আরেহ আরেহ।রেগে যাচ্ছিস কেনো?আমিতো মজা করছিলাম।তোর অ্যাসিস্টেন্ট তুইই রাখ।আমি একটু ঢু মেরে যাবো মাঝেমধ্যে।তাছারাও তোর যা তেজ।মেয়ে একমাসের মাথায় ভাগবে”
মেহতাব উঠে দাড়ালো। আর বললো,
“সে ভেগে যাবে নাকি থেকে যাবে সেটা নাহয় পড়ে দেখে নিবো?আপনি একজন এডাল্ট।তার উপর একজন ডাক্তার।আপনাকে এসব উল্টোপাল্টা কথা আর বাচ্চামোতে মানায় না”
_____
আদর ঘুমিয়েছে দুই ঘণ্টা।শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই তার।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো।আড়মোড়া হয়ে উঠে বরাবর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিষম খেলো।সন্ধ্যা ছয়টা বাজে!এর মানে সে সেই চারটা থেকে ঘুমিয়ে?শুকনো ঢোক গিলে উঠতে গিয়ে আরেকদফা চমকে উঠলো।সেদিনের মতন ভূত দেখেছে আবার।ডেস্কের চেয়ার বেড থেকে কিছুটা দুরত্বে রাখা।তার মধ্যে যিনি বসে আছেন সে আরো ভয়ঙ্কর।মেহতাব পা ছড়িয়ে ঠিক আদরের বরাবর বসা।মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।আদরের মনে হচ্ছে তার সময় শেষ।সাথে চাকরিটাও।চাকরি গেলে এতটা খারাপ লাগবে না।কিন্তু এখন যে সে মুখ দিয়ে অপমানের টর্নেডো ছাড়বে সেটার কি হবে? ভয়ার্ত চোখে মেহতাবকে একবার দেখে মাথা নামিয়ে নিলো।
“ঘুম কেমন হলো মিস আদর?”
“সরি”
“আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি?”
“না..আসলে আমি ঘুমোতে চাইনি।”
“চাননি তাহলে ঘুমিয়ে পড়লেন কি করে?”
“বসে থেকে ব্যাক পেইন শুরু হয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন পর এভাবে টানা বসে কাজ করলাম তো।তাই একটু….”
বাকি কথা শুনলো না মেহতাব।হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে তাকে।উঠে দাড়িয়ে চেয়ার টেনে পূনরায় নিজের টেবিলের সামনে এনে রেখেছে। আদরও দ্রুত পায়ে উঠে মেহতাব এর সামনে গিয়ে বলতে লাগলো,
“আমার আসলেই ব্যাক পেইন হচ্ছিলো।আমি মিথ্যা বলছি না”
“হুম”
“সরি নেক্সটে এমন হবে না”
“মনে থাকে যেনো।এখন বাড়ি যান”
____
বাড়ি ফিরে লম্বা শাওয়ারে ঢুকেছে মেহতাব।ঝর্নার নিচে মাথা রেখে হাত ঠেকিয়ে আছে দেয়ালে।পানি গড়িয়ে পড়ছে বলিষ্ঠ দেহ বেয়ে।চোখ জ্বালাপোড়া করছে।তারপরও সরে যায়নি।মাথার গরম রক্ত ঠান্ডা করতে হবে।চোখ ভেস্তে যাক!ঘন্টাখানেক পর বেরিয়ে এলো।চোখজোড়া লাল হয়ে আছে।অনেকক্ষন পানির নিচে থাকার প্রভাব।খালি গায়ে থ্রী কোয়াটার প্যান্ট পরে বেরোলো।সাদা টাওয়ালে চোখ মুছতে মুছতে নিজের রক্তিম চোখ জোড়ার উপর নজর বুলিয়েছে।আয়নায়।এতটা প্রভাব ফেলেনি চোখজোড়া তার মধ্যে।
ফোন বেজে উঠতেই রিসিভ করলো।ফোন কানে গুজে নিলো কাধের সাহায্যে।হাত দিয়ে খাটে ছড়িয়ে থাকা সব জিনিস একে একে সরিয়ে নিতে শুরু করলো।সর্বশেষ হাত গেলো এপ্রোনে।হাত দিয়ে সরাতে নিলেই ঘ্রানেন্দ্রিয়তে ভেসে আসে অদ্ভুত রকমের সুভাষ।যা নাক ভেদ করে মস্তিষ্কে গিয়ে বারি খাচ্ছে।ঘ্রাণটা তীব্র।তার এপ্রোনের মধ্য থেকেই ভেসে আসছে।আজ সকাল থেকেই এই ঘ্রাণটা পাচ্ছে মেহতাব। এপ্রোন নাকের সামনে এনে শুঁকে নিলো।শরীরটা শিরশির করে উঠলো।শীতলতা পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে।সেতো পারফিউম দেয় না।তাহলে?
“ভাইয়া খেতে এসো”
মিশার আওয়াজে এপ্রোন বিছানার উপর রেখে চলে গেলো নিচে।
“চোখ লাল কেনো?আমাদের যাওয়ার শোকে কেঁদেছো নাকি?”
“গোসল করলাম মাত্র তাই”
“এতক্ষন পানির নিচে থাকার কি দরকার?” নাসির সাহেব বললেন।
“বাহিরে অনেক গরম”
“তারপরও এতো ভিজবে না।ঠান্ডা লাগলে কে দেখবে তোমাকে আমরা যাওয়ার পর?”
“নিজের জন্য নিজেই যথেষ্ট”
“তুমি আমার সাথে যেভাবে কথা বলো মাঝেমধ্যে মনে হয় তোমার সাথে আমার চির শত্রুতা ” নাসির সাহেব খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললেন।
“বাবা কেনো রাগ করছো বলোতো?এমনতো না আমি এখন এভাবে কথা বলি!ছোটবেলার অভ্যাস।আর এটা তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না”
“রায়হানকে এ বাড়িতে নিয়ে এসো।দুইভাই একসাথে থাকবে।”
“আমি ওকে মোটেও আনবো না বাবা!” মেহতাব এর খাবার শেষ পর্যায়ে।প্লেট তুলে কিচেনের দিকে চলে গেলো।
____
রাত তখন বারোটা বেজে তেইশ মিনিট,
বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় মেহতাব।হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে ঠেকেছে মাথার ডানদিকে।অন্যহাত ল্যাপটপে। ল্যাপটপে ভিডিও চলছে।স্ক্রিনে ভেসে আসছে আদরের এপ্রোন পরিহিত দৃশ্য।গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো।ভিডিওর মাঝামাঝি অংশে দেখা গেলো আদর মেহতাবের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়েছে।কখনো হাসছে,আবার কখনো মুখ গম্ভীর করে ডাক্তার সাজার ভান ধরে আছে।শেষ অংশে দেখা মিলল সবকিছু জায়গা মত রেখে আয়েশ করে বেডে শুয়ে পড়েছে। এখানটায় জুম করলো মেহতাব।কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত করে আদর ঘুমিয়ে পড়েছে।বাকি সময় তার ঘুমন্ত চেহারার সরজমিনে সাক্ষী তার চশমার পেছনে থাকা পড়ে থাকা চক্ষুদ্বয়।আদর হয়তো কোনদিন জানবেই না কেবিনে হিডেন ক্যামেরা লাগানো।
চলবে…