#চিত্তসন্ধি
পর্ব ৭
লেখা: #Azyah
“আপনি কি রেগে আছেন?দেখেন আমি সত্যি ইচ্ছে করে ঘুমাইনি কাল।আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো”
“হুম”
“আমি সরি বলেছি”
“শুনেছি আমি”
“আপনি তাহলে এখন আমার উপর রাগ নেই?”
বারবার একই কথা বলে যাচ্ছে আদর।নিজের পক্ষ নিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার তাগিদে।তার বিন্দু পরিমাণ ধারণা নেই মেহতাব সব জানে।
“আমি রেগে আছি নাকি এটা জেনে আপনি কি করবেন?”
“আপনি রেগে আমাকে যদি ঝাড়ি দেন,কাজ বাড়িয়ে দেন?”
মেহতাব এর শীতল চাহনীতে দমে গেল আদর। চশমাটা খুলে রেখেছে। অদ্ভুত লাগছে তাকে চশমা ছাড়া দেখতে।মনে হচ্ছে চেহারায় কিছু একটা মিসিং।চোখগুলো ছোটছোট।
আবার ইচ্ছে হলো নিজের হয়ে শেষ বাক্য বলেই যাক।নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে উঠে পরে লেগেছে কেনো সে নিজেও জানে না।
“আসলে কি বলেনতো।আমি তো আপনার পেশেন্টও।অনেক দুর্বল আমি।একটু বেশি পরিশ্রম করলে ক্লান্ত হয়ে পড়ি।আর কখনো হবে না”
“আপনার শেষ হলে আমি শুরু করি?”
“কি শুরু করবেন?” আদর অবাক সুরে প্রশ্ন করলো।
“আমি বুঝতে পেরেছি।আপনি শুধু আমার অ্যাসিস্টেন্টই না পেশেন্টও। সেদিকটাও খেয়াল রাখা লাগবে আমার।বেশি খারাপ লাগলে ১৫ মিনিটের জন্য রেস্ট নিতে পারেন।সেটা অবশ্যই আমার অনুপস্থিতিতে আর যখন কোনো কাজ না থাকবে তখন”
আদর হাসলো।হেসে দুদিকে মাথা দুলিয়ে তার কথায় সম্মতি জানিয়েছে।দরজায় টোকা পড়তেই মেহতাব বললো,
“কাম ইন”
রায়হান এসেই আদরের দিকে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মিস আদর?”
“জ্বি?”
“কেমন আছেন?মনে আছে আমাকে?”
“জ্বি আছে”
“দেখেন সেদিন আপনাকে কৌতুক শুনিয়ে যদি ইনজেকশন না দিতাম আপনি এখানে ফিটফাট দাড়িয়ে থাকতে পারতেন না”
আদরের রায়হানের এমন কথায় স্মিথ হাসলো।সেদিন কতশত আজগুবি কথা শুনিয়ে তাকে ইনজেকশন দিয়েছে রায়হান।কৌতুক হাসির চেয়ে বেশি হাস্যকর ছিলো তার কথার ভঙ্গি।বেশ মজার মানুষ সে।এমন মানুষ আদরের ভীষণ ভালো লাগে।নিজে না পারলেও মজার মানুষের সাথে মিশতে পছন্দ করে।
“আপনি দাড়িয়ে আছেন কেনো বসেন?”
“বসছি”
“আচ্ছা এবার বলেন আপনার কি অবস্থা?শরীর কেমন আছে?”
“জ্বি আগে থেকে ভালো”
“হুম ভালোতো হতেই হবে।ডক্টর মেহতাব এর অ্যাসিস্টেন্ট কম পেশেন্ট আপনি”
আদর প্রত্যেকটা কথার উত্তর হাসির মাধ্যমে দিচ্ছে। কিই বা বলবে উত্তরে।বারবার জ্বি জ্বি করতেও ভালো লাগছে না।
“আপনার হাসিটা বেশ সুন্দর”
মুখের উপর প্রশংসা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলো আদর। স্বাভাবিক চেহারায় উত্তর দিলো,
“ধন্যবাদ”
রায়হান এর আসার কারণ খুব ভালো করে জানে মেহতাব।চোয়াল শক্ত করে দুজনের আলাপণ শুনছে।হজম করছে। নিঃশব্দে।একবার চোখ রায়হানের দিকে আরেকবার আদরের দিকে।নিরবতা ভঙ্গ করে বললো,
“ডক্টর রায়হান আপনি কোনো কাজে এসেছিলেন?”
“যে কাজে এসেছিলাম সেটাতো…”
“লেট ইট বি।আমি এবং আমরা!কাজে বিজি আছি।আসতে পারেন”
রায়হান গায়ে না মাখলেও আদরের কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগলো না।এভাবে মুখের উপর কাউকে বেরিয়ে যেতে বলা কি ঠিক?সেও একজন ডাক্তার তারও সম্মান আছে।রায়হান চলে যাওয়ার পর মেহতাব এর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।সে এক একজন পেশেন্টের নাম বলছে আদর সেটা লিখছে।সব নাম লিখা শেষে কলম কামড়ে দাড়িয়ে রইলো মেহতাব এর সামনে।প্রশ্ন করতে মন উসখুস করছে।করবে কি করবে না!মেহতাব আদরকে একবার দেখে নিল। পূনরায় চোখ ল্যাপটপ স্ক্রিনে রেখে বললো,
“কি বলবেন বলে ফেলেন”
“আসলে.. ঐযে আরেকজন ডাক্তার আসলেন না?আপনি এভাবে ওনাকে তাড়িয়ে দিলেন।উনি অবশ্যই কষ্ট পেয়েছেন!”
“আপনার খারাপ লাগছে?”
“আমার খারাপ লাগবে কেনো? খারাপতো ওনার লাগার কথা”
“এগুলো আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার।আপনার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই”
____
আজ ডিউটি নেই।আদরের মনে হচ্ছে সে স্বাধীন।মাত্র তিনদিন কাজ করেই তিন বছরের ন্যায় ক্লান্তি দেখাচ্ছে বন্ধুদের সামনে। শান্তা মারমা ওড়না দিয়ে চশমা পরিষ্কার করতে করতে বললো,
“ঢং দেখলে বাঁচি না।মাত্র তিনদিন কাজ করেই এই অবস্থা”
“তিনদিন কাজ করেছি।হয়তো এক টানা দাড়িয়ে থাকতে হয়েছে নাহয় বসে।এগুলা পেইন লাগে আমার কাছে।”
রোহিত ফোড়ন কেটে বললো,
“আমি যাচ্ছি সেই ডাক্তারের কেবিনে।গিয়ে বলবো স্যার আদরের জন্য একটা কিং সাইজ বেডের ব্যবস্থা করেন।সাথে চা কফির।হালকা নাস্তা থাকলে ভালো হয়।একটা হোম থিয়েটার থাকলে বেশ জমবে।আরামে শুয়ে বসে কাজ করবে আদর”
আদর বললো, “সব কথার মধ্যে কিছু কথা ভালো বলেছিস।কসাই সাহেবের কেবিনটা অনেক বড়।ইচ্ছে করে একটা ইন্ডাকশন বসাই।সাথে কফি মেশিন।মাঝেমধ্যে একটু চা কফি খেতে ইচ্ছে করেতো।আমি পারলে পুরো সংসার পেতে বসবো কেবিনে”
“ডাক্তার সাহেবের সাথেই সংসার পেতে নাও। সব পাবে” রুবি বলে উঠলো।
“তোরে কতবার বলবো ব্যাটা বিবাহিত!”
“না জেনেই বলে ফেললি বিবাহিত?আর যদি বিবাহিত নাও হয় তাহলে কি চান্স নিবি নাকি?”
“নাহ বাবা ভুলেও না।সেদিন আরেকজন ডক্টরকে যে অপমান করলো।আমাকে তুলে ফেলে দিবে।আমার একটা ভোলাভালা নাদান জামাই চাই।কসাই সাহেব আস্ত খাটাশ”
“আচ্ছা এসব বাদ দে। ধানমন্ডিতে নতুন রেস্টুরেন্ট হয়েছে।চল যাই আজকে। আদরেরতো কাজ নেই আজ” শান্তা অবশেষে তার চশমা চোখে দিয়ে বললো।
“চল তাহলে”
____
বোনের সাথে একটু সময় কাটানো দরকার।অনেকদিনের জন্য দূরে চলে যাচ্ছে। কবে না কবে দেখা হয়।মুখে প্রকাশ না করতে পারলেও ভীষণ রকমের ভালোবাসে বোনকে।আজ সারাদিন তাকে নিয়ে কাটানোর প্ল্যান।দুই ভাই বোন মিলে লং ড্রাইভে বেরিয়েছে। বাবা নাসির উদ্দিনকে আসতে বললে তিনি আসেননি।ঢাকা শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে ফিরে রেস্তোরায় এসেছে লাঞ্চ করতে।
“কি খাবি অর্ডার কর”
“তুমি করো ভাইয়া”
“তুই জানিস এসব খাবার আমার পছন্দ না।তুই অর্ডার কর আমি কফি খেয়ে নিব”
মিশা কপট রাগ দেখিয়ে বললো, “এসব ডাক্তারগীরি আমার সাথে দেখাবে না বলে দিলাম”
“আচ্ছা তুই অর্ডার কর।আমিও সেটাই খাবো।”
ওয়েটারকে ডেকে দুজনের জন্য সেট মেনু অর্ডার করলো মিশা।দুজন পাশাপাশি বসে আলাপ করছে।হাসছে একটু একটু।আর শান্তার কাধে হাত ঠেকিয়ে আদর হা করে চেয়ে আছে তাদের দিকে।তার সাথে রুবি,রোহিত আর শান্তাও।তাদের আগে থেকেই জানান দিয়েছে আদর।সামনের টেবিলে বসা লোকটাই সে ডাক্তার।
সুরে সুরে আদর বললো, “দেখেছিস বলেছিলাম না ব্যাটা বিবাহিত।আমার মুখের কথাতো বিশ্বাস করিস না।”
রুবিও প্রখর দৃষ্টি স্থাপন করে বলছে, “আসলেই দোস্ত”
আদর আবার বললো, “কিভাবে লাজুক হেসে কথা বলছে দেখ।আর আমার সামনে!এক একটা শব্দ বিষাক্ত সুচের মতন।ঘাউরামি করে।ভালো কথার মধ্যেও প্যাচ।”
রোহিত করুন সুরে বলে উঠলো, “তোর সাজানো সংসার ভেঙে গেলোরে দোস্ত।এখন দেখছি এই সংসারের মালকিন অন্য কেউ”
সবাই একসাথে “হুম” বলে উঠে।মেহতাব মিশা কথা বলতে বলতে খাচ্ছে। সর্বক্ষণই মেহতাব এর মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেখা।বোনের সামনে কোনোভাবেই মন খারাপ করা যাবে না।নাই চেহারা গম্ভীর করা যাবে।খাওয়া শেষে মিশা ভাইয়ের বুকের সাথে লেগে সেলফি তুলে নিলো।সাথে হাত ধরেও।আদর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চিবুচ্ছিলো।হুট করে এই অবস্থা দেখে হেচকী উঠে গেলো তার। কাশতে কাশতে জান যাচ্ছে তার।পুরো রেস্তোরা জুড়ে তার কাশির শব্দ বাজছে।দেয়ালে দেয়ালে। রেস্টুরেন্ট এর অনেকের মনোযোগ আপাদত আদরের দিকে।মেহতাব এরও। দূর থেকে দেখে একবিন্দু ভুল করলো না চিনতে।আদর ম্যানু কার্ড দিয়ে মুখ ঢেকেও রেহাই পায়নি মেহতাব এর ধুরন্দর চোখ থেকে।
“একটা গান আছে দোস্ত বুঝলি।আমি ফাইসা গেছি মাইনকা চিপায়!তোর সাথে যাচ্ছে কিন্তু” রোহিত হোহো করে হেসে বলে।
___
রাত একটায় অপিরিচিত নাম্বার থেকে কল রোহিত, শান্তা,রুবি আর আদরের লুডু খেলায় ব্যাঘাত ঘটায় ।এত রাতে কার মনে পড়লো আদরকে?
“হ্যালো!”
“আপনার মাকে ফোন দিন”
“এহ! আপনি কে ভাই?”
“আপনার এতকিছু জানার প্রয়োজন নেই।আপনার মাকে ফোনটা দিন!”
“কেনো আমার মাকে ফোন দিবো?বিয়ের প্রস্তাব দিবেন নাকি?দেখেন এসব প্রস্তাব দিলে দিনের বেলায় দিবেন।চোরের মতন রাতে কি?”
উত্তর আসলো না।ফোনের অপরপ্রান্তে ঘোর নীরবতা।
“রাত বিরাতে ফাজলামো করেন মেয়েদের ফোন দিয়ে?কাজ কাম নাই কোনো!আগে বলেন আপনি কেডা?”
ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ভারী কন্ঠে বললো,”আমি মেহতাব”
ফিউস উড়ে গেছে সঙ্গেসঙ্গে।এই ব্যাটা এত রাতে ফোন দিয়ে মাকে চাচ্ছে কেনো?আর সে নাম্বার পেলো কোথায়? ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
“আপনি..আপনি আম্মুকে চাচ্ছেন কেনো?”
“রাত কয়টা বাজে?”
“একটা”
“চার্ট অনুযায়ী আজ দুপুরের খাবারে কি ছিলো?”
আমতা আমতা করে আদর বলে, “ইয়েহ মানে.. মাংস,ভাত আর ডাল”
“আপনি খেয়েছেন কি?”
“ওয়েট ওয়েট।আমি কিন্তু মাংস খেয়েছি সেটা বাড়ির না।রাইস খেয়েছি সেটাও বাড়ির না।ফ্রাইড রাইস। ডালটা দুর্ভাগ্যবশত রেস্টুরেন্টে ছিলো না”
মেহতাব ধমকের সুরে বলে উঠলো, “ইয়ার্কি করছেন আমার সাথে?আপনার মাকে ফোনটা দিন”
“আম্মুতো ঘুমায়”
“আর আপনি?”
“আমি এইতো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম।ফোনের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো”
“তাই? কন্ঠ শুনেতো মনে হচ্ছে না”
চুপ বনে গেলো আদর।এত সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যে বলেও কাজ হচ্ছে না। রেস্টুরেন্টে তার চাহনি দেখেই বুঝা উচিৎ ছিলো সামনে ঝড় অপেক্ষা করছে।
“আর হবে না এমন।”
“স্বীকার করছেন তাহলে?”
“জ্বি সরি”
“প্রথম ভুল করেছেন তাই ছাড় দিলাম।আর হ্যা আগামীদিনের ডিউটিতে খাবার আনার প্রয়োজন নেই।”
__
দিনের পর রাত,রাতের পর দিন।ধারাবাহিকতা অব্যাহত।সময় নিজ গতিতে ছুটে আজ আদরের কাজের দশতম দিন।এই কয়দিনে অনেকভাবেই কাজটা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্ঠা করেছে।অনেকটা সফলও সে। মেহতাবের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্ঠা করে।কিন্তু মেহতাব এর বিন্দু পরিমাণ পরিবর্তন নেই।বোন আর বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আরো বিষণ্ণ তার মন।তবে নিজের কাজের প্রতি ঠিকই দায়িত্বশীল।
“আমার ছুটি লাগতো” অনেকক্ষন নিজের সাথে যুদ্ধ করে শেষমেশ বলেই দিলো আদর।
“কেনো?”
“ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে।”
“অ্যাটেন্ড করা জরুরি?”
“উম!”
“ছুটি পাচ্ছেন না।মাত্র জয়েন করেছেন কাজে।এখনই কিসের ছুটি লাগবে আপনার?”
“শুক্রবার এমনিতেও ছুটির দিন।”
“আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমি ওফ ডিউটি ছিলাম চারদিন।তাই শুক্রবার কাজ করা লাগবে।”
“আমি বন্ধুদের কথা দিয়েছি,সব প্ল্যান সেট,আমি উপস্থাপনা করবো প্রোগ্রামে।যদি না যাই তাহলে সমস্যা হবে”
“পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব আপনার উপর?”
“নাহ সেটা হবে কেনো?শুধু প্রোগ্রামের” কপাল কুঁচকে উত্তর দিলো আদর।
“ঠিক আছে।প্রোগ্রাম শেষ করে চলে আসবেন।”
“শাড়ি পরে হসপিটালে কাজ করতে আসা সম্ভব না”
মেহতাবের শীতল দৃষ্টি দেখতে ভয় করে। অদ্ভুত লাগে। কীভাবে যেনো তাকায় এই লোক। বোঝাই যায় না সম্মতি দিচ্ছে না রেগে যাচ্ছে।চোখের ভাষা পড়ার মতন জ্ঞানী আদর নয়।ঠিক এখন তার দৃষ্টিতে মাথা নুয়ে গেলো আদরের।ভাবছে আরেকটা বার জিজ্ঞেস করে দেখবে নাকি?তার আগেই মেহতাব বলে,
“ঠিক আছে যান”
চলবে…