চিত্তসন্ধি পর্ব ৫৬ লেখা: #Azyah

0
187

#চিত্তসন্ধি
পর্ব ৫৬
লেখা: #Azyah

ডিসেম্বরের শুরুতে শীতের ঘনঘটা।রাস্তার দ্বারে জ্বলজ্বল করছে ল্যাম্প পোস্ট।বাতাসে বইছে ঘ্রান। প্রেমের ঘ্রাণ,ভালোবাসার সুগন্ধি। প্রতিবার একই মানুষের প্রেমে পড়া এক অন্তর।এই চিত্তে একই মানুষ বারবার রাজত্ব স্থাপন করে। অগোছালো জীবনে শান্তির রেশ।তার গায়ের সুগন্ধী মিশে আছে রক্তকণিকায়।নিঃশ্বাসের সাথে প্রশান্তি তাকে বলে।ভাবনা চিন্তার এক আলাদা জগৎ।কেমন যেনো এক অসুখ!মানুষ বলে ডাক্তারদের অসুখ হতে নেই। আসলেই কি তাই?এই অসুখটা যে ভীষণ প্রিয়। প্রিয় মানুষের অসুখ।বাস্তবতায়,রেডিও আজকাল কেউ শোনে না।তবে আজ মন বললো পুরনো কিছু স্মৃতি পুনরুদ্ধার করা যাক।বাম হাতে রেডিও অন করে নেয়।কানে ভেসে আসলো একটি গান।

শীতের রাতের বিশাল অংশ জুড়ে বয়ে গেলো এক গানের সুর,

“ভূবনো মোহনো গোরা
কোন মণিজনার মনোহরা,
ভূবনো মোহনো গোরা
কোন মণিজনার মনোহরা,
ওরে রাধার প্রেমে মাতোয়ারা
চাঁদ গৌর আমার রাধার প্রেমে মাতোয়ারা,
ধূলায় যাই ভাই গড়াগড়ি।
যেতে চাইলে যেতে দেবো না না না না
যেতে চাইলে দেবো না না না যেতে দেবো না।
তোমায় হৃদয় মাঝে,
তোমায় হৃদয় মাঝে রাখিবো ছেড়ে দেবো না
তোমায় হৃদ মাঝারে রাখিবো ছেড়ে দেবো না।””

মাঝ রাস্তায় গাড়ি তার মন মোতাবেক থেমে গেলো।তিনচার বার স্টার্ট করেও লাভ হচ্ছে না। ইঞ্জিনে সমস্যা।কুচকুচে কালো রঙের গাড়ি থেকে সাদা শার্ট পরিহিত মেহতাব বেরিয়ে আশপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখছে।এই রাস্তায় একটু সামনেই মেকানিক আছে।তবে রাতের বেলায় কি পাওয়া যাবে?গাড়ি লক করে পায়ে হেঁটে চলে গেলো।বাড়ি পৌঁছানো আসল কাজ।সে পিপাসু। প্রেয়সীকে নেত্রে ধারণ করার পিপাসু।কত ঘন্টা দেখেনি তাকে?পাঁচ মিনিট হাঁটলো।হাতে সোনালী রঙের ঘড়িটায় রাত দশটা চল্লিশ মিনিট। অদূরে ছোট গ্যারেজে হলুদ রঙের বাতি দেখে আশ্বস্ত হলো।নাহ! ভোগান্তি পোহাতে হলো না তাহলে।

পায়ের গতি বাড়িয়ে গ্যারেজের লোককে বললো,

“ভাই একটু আসবেন? আমার গাড়ীর ইঞ্জিনে বোধহয় সমস্যা হয়েছে।গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না”

মধ্যবয়স্ক লোক তার কথায় উঠে দাড়ালো। মুখভঙ্গি বলছে সে সাথে যেতে প্রস্তুত।দুহাতে প্রয়োজনীয় যন্ত্র নিয়েছে।নিয়ে “আসেন” বলে সাথে হাটতে শুরু করেছে।

একদিকে গাড়ি মেরামত হচ্ছে।অন্যদিকে ফোনে আদরকে পাওয়া যাচ্ছে না।বেজেই চলেছে কোনো হুশজ্ঞান নেই। গুনগুনে সাতবার কল না ধরায় মেহতাবের ভ্রূদ্বয়ের মধ্যে অত্যন্ত গাঢ় ভাঁজ।সাথে মনে ভয়ের রেশ।মেয়েটি উল্টো রেগে গেলো নাতো?নাকি সত্যি সত্যি চলে গেলো বাপের বাড়ি।আদরকে দ্বারা যেকোনো কিছু সম্ভব।কোনোকিছু করার আগে একবিন্দু ভাবে না। উল্টোপাল্টা কাজে ওস্তাদ।এসবের জন্য ভুগতে তাকে সাথে মেহতাবকে।ধ্যান ধারণার রাজ্য থেকে ফেরত আসতে হলো মেকানিকের আওয়াজে।গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে।বড্ড সময় নিয়ে ফেললো। পারিশ্রমিক চুকিয়ে ভারী মস্তিষ্ক নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটেছে।

__

বাড়ি ফিরতে সময় লেগেছে বিশ মিনিট।সামান্য দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে গেছে দোতলায়।হাতে ব্যাগটা শক্ত হাতে চেপে।কলিং বেল চাপতে গিয়েও থেমে গেলো হাত।দরজা খোলা।হালকা ভেড়ানো। অহেতুক আরো চিন্তা জুড়ে বসলো মস্তিষ্কে।দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো এক পিনপিনে অন্ধকার ঘরে।কোনো ঘরে কোনো বাতি নেই।চিন্তা তরতর করে ভয়ে পরিণত হচ্ছে।আদরের সাড়াশব্দটুকু নেই।তাহলে কি সত্যিই?

“ভয়ের কিছু নেই।আমি আপনাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যাইনি।”

পেছন থেকে আদরের কন্ঠস্বর পেয়ে মাথা উপরে তুলে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মেহতাব।বাম হাতে থাকা ব্যাগ একপাশে রেখে পেছন ফিরে তাকালো।চমকে উঠে তৎক্ষনাৎ।হৃদপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়।আদর মোমবাতি হাতে দাড়িয়ে।মোমের হলদে আলো তার পরনে থাকা আসমানী রঙের জর্জেটের শাড়ীকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলছে। প্রসাধনীহীন সাদামাটা চেহারা।আলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকা নেত্র নক্ষত্রের ন্যায় দেখাচ্ছে।দেহের ভাজে লেপ্টে থাকা আকাশী রং অসস্তি বাড়িয়ে তুলছে মেহতাবের।অস্থির করছে চিত্ত।শাড়িতে অনেকবার দেখা হয়েছে আদরকে।তবে আজ আবেদনময়ী লাগছে!

মেহতাবের অসস্তিকে তোয়াক্কা করলো না আদর। মোমবাতি খাবার টেবিলে রেখে বলে উঠলো,

“আপনিতো রাগ করেছিলেন আমার সাথে।তাই আপনার জন্য আপনার পছন্দের সব খাবার বানিয়েছি।নিজ হাতে!সব রান্না শেষ ইলেকট্রিসিটিটাও চলে গেছে।আমাদের বাড়ির মেইন সুইচবোর্ডে নাকি সমস্যা।এইযে দেখেন মোমবাতির আলোয় পুরো টেবিলে এত্ত সুন্দর করে সাজিয়েছি খাবার।”

একটু থেমে আদর আবার বললো, “ভালোই হলো সিনেমার মতন ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করা যাবে।”

কথা বলতে বলতে উপলব্ধি করলো মেহতাব নিশ্চুপ।তার দিকে ফিরে করুন মুখ বানিয়ে বললো,

“আমি কিন্তু অনেক কষ্ট করেছি আপনাকে মানানোর জন্য।এবার রেগে থাকলে চলবে না”

মেহতাব নিশ্চুপ ভঙ্গি বজায় রেখে আদরের কাছে এসে দাঁড়ায়।আদরের তেলতেলে মুখটা চুম্বকের মতন টানছে। মস্তিষ্ক শীতল করে তুলছে।শাড়ির ভাজে উন্মুক্ত কোমড় চেপে নিজের কাছে টেনে প্রশ্ন করলো,

“শুধু ডিনার প্ল্যান করে আমাকে মানাতে চেয়েছো?নাকি এই লুকে আমাকে পাগল করার পরিকল্পনা লুকায়িতো এর পেছনে?”

নেত্র পল্লব ঝুঁকিয়ে নেয় সাথেসাথে।আদরের গুণধর বান্ধুবির পরামর্শে আজ নিজেকে সাজিয়েছে। মেহতাবকে মানাতে।দুটো উপায় বলেছিলো রুবি তাকে।রাগ ভাঙ্গাতে পছন্দের খাবার রান্না করতে অথবা তার জন্য সাঁজতে।আদর দুটো পথই অবলম্বন করেছে।আকাশী রংটা মেহতাবের পছন্দের।

মেহতাব ছোট্ট করে আবার প্রশ্ন করলো, “হুম?”

“তে..তেমন কিছু না।” আমতা আমতা করে উত্তর দেয় আদর।

“তাহলে এই শাড়ি কাকে দেখানোর জন্য পড়েছ?”

“এমনেই পড়েছি”

আদরকে ঝড়ের গতিতে ছেড়ে দিয়ে মেহতাব বলে, “যাও তাহলে আমারও রাগ ভাঙেনি।”

মুহূর্তের মধ্যে বেকে বসায় হতভম্ব আদরের চোখ মুখ।সরে যেতে চাইলে মেহতাবের শার্ট টেনে ধরে।নিশ্চুপ থেকে যেতে বারণ করছে। মেহতাবের রাগ নেই।তবে জ্বালাতে ইচ্ছে করছে আদরকে।কতটা ব্যাকুল করতে পারে তার রেগে থাকা সেটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। মুখে আসন্ন হাসিটুকু টুপ করে গিলে ফেললো।আদরের করুন মুখ দেখে আবার না হেসে থাকাও যাচ্ছে না।

গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করে, “কি?”

“আমার কষ্টের দাম নেই আপনার কাছে?”

“অবশ্যই আছে।আমি শুধু প্রশ্ন করেছি নিজেকে শাড়িতে সাজিয়েছো কার জন্য? উত্তরতো দিতে পারলে না”

সবসময়ের মতন ঠোঁট কামড়ে ধরে আদর।ভীষণ রাগ হচ্ছে।হাত কচলাচ্ছে বারবার।সরাসরি উত্তরটা মুখে এসেও যেনো বাধাপ্রাপ্ত।সময় নিলো।নিজের সাথে লড়াই করলো। অতপর নাক ফুঁসতে ফুঁসতে উত্তর দিলো,

“আপনার জন্য!খুশি?”

“নাহ!”

সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান!বিষম খেয়ে গেলো আদর।গোলগোল চোঁখে মেহতাবের দিকে তাকিয়ে।যেকিনা পিঠ দেখিয়ে দাড়িয়ে আছে।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায়।কিন্তু আজ যেনো পৃথিবীর সমস্ত হাসিরা তার মুখে এসে গাদাগাদি করছে।বারবার নিঃশ্বাস নিয়ে এই হাসিকে দমানোর আপ্রাণ চেষ্টায়।

পেছন থেকে আরেকদফা শার্টে টেনে ধরে। একপ্রকার খামচে। ঝাঁঝ মিশ্রিত কণ্ঠে আদর বললো,

“আমি এত কষ্ট করেছি।রান্না করেছি।এসবের মূল্য দেন।”

আদরের দিকে ফিরে মেহতাব।বুকে হাত বেধে প্রশ্ন করলো, “কিভাবে মূল্য আদায় করবো?”

“প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি বাড়ি ফিরবেন?আপনার পছন্দের খাবার দেখে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।আপনার পছন্দের রঙের শাড়ীও পড়লাম।এই দুটো জিনিসের কারণে আপনার রাগ উড়ে যাবে।এখন দেখছি কোনো কাজই হলো না।আমার কত কষ্ট হয়েছে জানেন?জয়তুন খালাকে মিথ্যে কথা বলে ঘরেই ঢুকতে দেইনি।এখন দেখা যাচ্ছে আমার কষ্টের কোনো দামই নেই আপনার কাছে” রাগান্বিত মুখে আদর থেকে জবাব আসলো।

আদর আবার বললো, “আমার কষ্টের বিনিময়ে আমাকে নগদ এক লাখ টাকা দেন।”

“এখনই দিতে হবে?”

“হ্যাঁ এখন! এখানে দাড়িয়ে।”

“আচ্ছা হাত দাও”

আশা নিয়ে হাত আগ বাড়িয়ে দেয় আদর।মেহতাব তার পেতে রাখা হাতে শূন্য হাত ছুঁইয়ে বলে, “দিলাম”

“কি দিলেন?”

“টাকা?”

“কই দিয়েছেন?হাত ছোঁয়ালেন শুধু”

আদরকে এড়িয়ে হাত ঘড়ি খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল মেহতাব।আর বলতে লাগলো, “দিয়েছি দেখো।এগুলো খালি চোখে দেখা যায় না। মাইক্রোস্কোপ দরকার!”

“আপনি মজা করছেন আমার সাথে?”

“আমাকে মজার মানুষ মনে হয় তোমার?”

আর কোনো উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয় সে। রেগেমেগে হাটা দিয়েছে ঘরের দিকে। যথেষ্ট হয়েছে।সবসময় বাড়াবাড়ি। বউয়ের মন রক্ষা করতে অন্তত বসে পরতো খেতে? মিথ্যে প্রশংসা করলেও পারতো?নিমিষেই সবকিছুতে ছাই দিলো।তার ঠিক পিছু পিছু মেহতাব।দরজা বন্ধ করতে চাইলে একহাতে আটকে ফেলে মেহতাব। মুচকি হেসে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খায়।

আদুরে কণ্ঠে বলে উঠলো, “রাগ করে না।”

“আমি রাগলে আপনার কি?আর রাগ করার অধিকার আমার আছে?সব রাগ আপনারই!”

“আমার রেগে থাকার কারণে যদি আমার একমাত্র বউ আমার জন্য সাজে আর আমাকে পাগলপ্রায় বানিয়ে দেয়?আমি প্রতিদিন রাগ করবো”

রাগ অভিমানের পালা শেষ করে মেহতাব খাবার টেবিলে বসেছে।আদরের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।অবশেষে মেহতাবের রাগ ভাঙ্গানোর টোটকা জানতে পেরেছে।আগামীবার রাগ করলেই এই পদ্ধতি অবলম্বন করবে বলে মন বানায়।নিজে নিজে সব খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। স্বামিসেবায় কোনো ধরনের কমতি রাখছে না এই মুহূর্তে।সবকিছুতেই মুগ্ধ মেহতাব।এতদিন এক প্রাপ্তবয়স্ক কিশোরী রূপে দেখছে আদরকে।আজ যেনো পরিপূর্ণ নারী। কোমরে আঁচল গুজে গিন্নীর মতন করে খাবার সার্ভ করছে তাকে। নিশ্চুপ চোখে উপভোগ করছে আদরের ভিন্ন পরিবর্তিত রূপ।

“এভাবে প্রতিদিন আমার সেবা করলে আর আমার কথা শুনলেইতো আমি রাগ করি না”

চামচটা হাত থেকে রেখে দিলো।একহাত কোমরে রেখে তর্জনী আঙ্গুল মেহতাবের দিকে তাক করেছে।বলে উঠে,

“আপনি কোন বিষয়ে রাগ করেন না বলেনতো?আর যদি রাগ নাও করেন আপনার মুখ দেখে মনে হয় কেউ আপনার ভাতে ছাই দিয়েছে!”

“তাই না?কি করবো তাহলে?”

“হাসেন”

“আমার হাসি অসুন্দর”

মেহতাবের দিকে এগিয়ে গেলো আদর।পাশের চেয়ারে বসেছে।কিছু বলতে চায় তা স্পষ্ট।তবে চোখে চোখ রাখার সাহস পেলো না। দৃষ্টিনত করেই বললো,

“আপনার হাসি সুন্দর।ভীষণ সুন্দর।আমার চোখে পুরো আপনিটাই সুন্দর।সবসময় হাসবেন।তবে সেটা শুধু আমার সামনে।অন্য মেয়েদের সামনে মুখ গোমড়া করে রাখবেন।”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here