#চিত্তসন্ধি
পর্ব ৩৯
লেখা: #Azyah
ভোরের আলো ফুটেছে।সামান্য আলো সাদা পর্দা চিরে আসছে।ক্যাবিনটা মৃদু আলোকিত।বিদঘুটে অন্ধকার হয়। এককাত হয়ে তন্দ্রায় আদর।চুলগুলো এলোমেলো।ফুলে আছে চেহারাটাও।এখন একটি স্বাস্থ্য বেড়ে যাওয়ায় আগের তুলনায় বেশিই গোলগাল লাগছে চেহারা।এপাশ,ওপাশ হয়ে ঘুমোনোর গালে সল্প সরু ভাজ দেখা যাচ্ছে।পাশে একপা উঠিয়ে বসে মেহতাব দেখছে তাকে।মাত্রই ফিরলো ক্যাবিনে।হাত তার আদরের চুলের গভীরে।বারবার বিলি কেটে দিচ্ছে।সামান্য ঝুঁকেও আছে।চোখের ঘন পাঁপড়িতে হাত বুলিয়ে দিল।পরপর সাদা নোসপিনটায়।তারপর ঠোটে।রাতে মেহতাবের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারি।নিজে উঠে গিয়ে আদরকে শুইয়ে দিয়েছিল।তারপর চলে যায় নিজ কাজে।
অদূরে গলায় ডাকলো, “আদর”
কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।এই মেয়ে ঘুমকাতুরে,ভালোবাসা কাতুরে।মেহতাবের সর্বত্র নিঃস্ব করে দিতে এসেছে তার জীবনে।
“সকাল হয়ে গেছে।ওঠো।বাড়ি যাবে না?”
ঘুমের মধ্যেই মাথা নাড়িয়ে গোঙ্গালো, “উহুম!”
“যাবে না?”
ঘুমন্ত আদরকে দু হাত টেনে উঠিয়েছে।জোর করে।আদর ভিষণ বিরক্ত।কেনো জোর করা হচ্ছে তাকে?একটু ঘুমোতে দিলে কি হয়? স্বাদের ঘুম ত্যাগ করতে চায়না। উঠিয়েও লাভ হলো না। মেয়েটিই এখনও চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছে। অগ্যতা তাকে পেছন থেকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়েছে।আদর বেশ আয়েশে মেহতাবের কাধে মাথা এলিয়ে দিলো।
“ম্যাথিও এসেছে।ওকে তোমার উপর ছেড়ে দেই?”
ম্যাথিও নাম শুনতেই পিত্তি জ্বলে উঠলো।ঘুমে বিভোর চোখ চট জলদি খুলে ফেলেছে।ছিটকে সরে বললো,
“কই!কই ওই অসভ্য বিড়ালটা!একদম কাছে আনবেন না ওকে”
ভ্রু দ্বয়ে ভাজ ফেলে মেহতাব বললো, “আমার ম্যাথিওকে অসভ্য বলছো তুমি?”
“হ্যাঁ।আপনার বিড়াল আপনার মতই”
“এর মানে আমাকেও অসভ্য বলছো?”
চোরের মতন!খুব সাবধানে এক লাফ দিয়ে বেড থেকে নেমে পড়লো।নেমেই দৌড় লাগিয়েছে ওয়াশরুমে। জান বাঁচাতে হবে তো!অসভ্য বলার দায়ে জেলে ভরে দিবেন নাহয় এই ডাক্টার সাহেব।
____
রায়হান ও তার মা ফরিদা বেগম বসে আছেন ড্রয়িং রুমে।সাথে মেহতাব আর তার বাবা নাসির সাহেব।মিশা বারবার উকিঝুকি দিচ্ছে।কেননা তার আর রায়হানের ব্যাপারেই কথা হচ্ছে।
ফরিদা বেগম বললেন, “বড় ভাইজান আমরাতো আর অপরিচিত না।আমার রায়হানকে ছোট বেলা থেকেই চেনেন।আপনার আরেকটা ছেলে।আর তাছাড়া ওর দুইজন দুইজনকে পছন্দ করে।আপনার কি মেয়ের জামাই হিসেবে আমার রায়হানকে পছন্দ?”
“কিযে বলো ফরিদা!পছন্দ হবে না কেনো?রায়হান আর মেহতাব দুটো ছেলে আমার।দুটো যোগ্য ছেলে।” নাসির সাহেব খুব উৎফুল্লতার সাথে বললেন কথাটি।
মেহতাব বললো, “চাচী মিশা বাহিরে পড়াশোনা করছে।এখনই বিয়ে করাটা সম্ভব নয়।আমি চাচ্ছিলাম বাগদান করে রাখি।পড়ে পড়াশোনা শেষ হলে নাহয়?”
ফরিদা বেগম উত্তরে বললেন, “তোমরা পরিবারের পুরুষ।যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই হবে।আর মিশা আমার মেয়ে। ও ওর স্বপ্ন পূরণ করুক। আমার পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই। রায়হান তোর কোনো সমস্যা আছে”
ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেনা।আপাদত রায়হান এর অবস্থা এমনটাই।নাদান শিশু সেজে বসে আছে।অথচ বাস্তবে বদের হাড্ডি। লাজুক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল,
“নাহ আমার কোনো সমস্যা নেই”
আগামী শুক্রবার মিশার বাগদানের দের ফিক্স হয়েছে।অল্প দিনের ছুটিতে এসেছে তাই এত তাড়াহুড়ো।রায়হানের মুখে খুশির ঝলক দেখার মতোন ছিলো।ভাবতেও পারেনি মেহতাব এত দ্রুত রাজি হয়ে যাবে।মিশা খুশি হলেও ভাইয়ের উপর ভীষণ অভিমান জমেছে।ভাইয়ের কাছে হেরে গেলো।শেষমেশ ভাইয়ের আগেই বিবাহ বন্ধনের প্রথম ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে।
রাতের খাবারের টেবিলে তিনজন একসাথে।মেহতাব, নাসির সাহেব আর মিশা।মিশা আর নাসির সাহেব এসেছেন চারদিন হলো।একসাথে হলেও সাথে বসে খাওয়ার সুযোগ হয়নি।তিন রাত কাটিয়েছে মেহতাব ক্লিনিকে।তাদের সাথে আরো একজন যোগ হয়েছে।তাদের পরিবারের নতুন সদস্য। ম্যাথিও তার নাম।টেবিলের উপর বসে সেও খাচ্ছে তার খাবার।এরমধ্যেই ফোন বেজে উঠলো।আদর কল করেছে।মিশার চতুর চোখ সেটা দেখে ফেলেছে সাথেসাথেই। চুপিচুপি হেসেও নিলো।
খাওয়ার মধ্যেই মেহতাব কল ধরে বললো,
“হুম?”
“আপনি কোথায়?”
“রাস্তায়!”
“ওমা!এই সময় রাস্তায় কি করেন?”
এই নির্বোধ মেয়েকে নিয়ে কই যাবে?কথার ধাঁচ বোঝে না। এতদিনেও মেহতাবের স্বভাব সম্পর্কে তার নূন্যতম ধারণা হয়নি।মুখের কথা বিশ্বাস করে বসে থাকে।সেটা সত্যি না মিথ্যা,মজা নাকি সিরিয়াস সেটাও তার ছোটো মাথায় ঢোকে না।অন্যদিকে মিশা গোয়েন্দার মতন তাকিয়ে আছে।মেহতাব আরচোখে খেয়াল করলো।
চোখ নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,
“কল ইউ লেটার”
সঙ্গেসঙ্গে কল কেটে দিয়েছে।আদরের মুখের বাতি নিভে গেছে।চোখের পলকে মুখ লটকিয়ে নিলো।এই কল ইউ লেটার শুনার জন্য নিজের সাথে দ্বন্দ বাজালো?দিবে কি দিবে না ভেবে আধ ঘণ্টা নিজের মস্তিষ্ককে কষ্ট দিলো। চিন্তার ক্ষয় করলো?
অন্যদিকে মিশা খাওয়ার মধ্যে বললো, “তুমি আমার কথা রাখলে না।আমি কি বলেছিলাম তোমার আগে আমি বিয়ে করবো না।একটা ভাবি এনে তারপর বিদায় হবো এ বাড়ি থেকে।তুমি এদিকেই নিজের কথা মানিয়ে নিলে?”
“তুই এখনও বিদায় হোস নি এই বাড়ি থেকে”
“তুমি বিয়ে করবে না?”
“সময় হলে করবো”
সময় হলে করবো।এই পুরো বাক্যের চেয়ে “করবো” শব্দটা মিশা আর নাসির সাহেবের কানে গিয়ে তীরের মতন বাড়ি খেয়েছে।এতদিন বিয়ে করবে না বলতো।এবার অন্তত এতটুকু বলেছে সময় হলে করবে।এতেই তারা অনেক খুশী।মানুষ যত পায় তত চায়। নাসির সাহেবের মনে আরো একটি ইচ্ছে জাগলো।যেহেতু করবে বলেছে।তাহলে আরো কিছু প্রশ্ন করে নেওয়া যাক।
তিনি বলে উঠলেন, “কবে করবে বাবা?”
“বললামই তো সময় হলে”
“মেয়ে পছন্দ করেছো?নাকি আমরা দেখবো?”
মেহরাব আরচোখে তাকালো বাবার দিকে।বাবা ছেলের চাহনি দেখে বুঝে গেছে বেশি লোভ ভালো না।করবে যেহেতু বলেছে করবেই।বেশি কথা বললে তার মত বদলে যেতে পড়ে।তাই নিজের মুখে তালা এটে দিলো।
মিশা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিলো।মনে মনে বললো, “মেয়ে পছন্দ করেছে মানে? তারতো এখন প্রেম প্রেম ভাব।এটাতো বাবা জানে না।আমিও যে জানাবো তার উপায় কই?বেচারা আমার হবু জামাই ফেঁসে যাবে।নাহলে এখনই সব ফাঁস করে দিতাম!”
___
“হঠাৎ কল দিলেন যে মিস আদর?”
সময় যাচ্ছে।অথচ উত্তর আসেনি।আবার কি হলো? মেহতাব প্রশ্ন করলো,
“কল দিয়ে কথা বলছো না কেনো?”
“আপনি কল করেছেন”
“তুমি তখন কল করেছিলে আমি খাচ্ছিলাম। এইজন্য এখন ব্যাক করলাম”
“খাচ্ছিলেন সেটা বললেই হতো”
আদরের কণ্ঠে স্পষ্ট অভিমান।এই ছোট বিষয়ে কেউ রাগ করে?মেয়েরা আসলেই কোমল।তাদের একটু এড়িয়ে যাওয়া যায় না,কষ্ট দেওয়া যায় না। মোমের মতন গলে যায়। আজকালতো অধিকারও খাটায়।সাহস দেখায়।
“তোমাকে কেনো বলবো?তুমি কে?”
আরো রাগিয়ে দিলো।অভিমান হুড়মুড়িয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে।পাহাড় সমান উচু।মনের কোণে কালো মেঘ জমছে। বৃষ্টির মতন করে এবার অস্রু ঝরার পালা!
আদর নাক টানতে টানতে বললো, “সরি।আপনাকে বিরক্ত করা মোটেও ঠিক হয়নি।রাখলাম!”
“আরেহ!শুনো…”
কোনো কথাই শুনলো না আদর।দ্রুত কল কেটে ফোন ছুঁড়ে ফেলেছে বিছানার এক কোণে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।নিজের উপর অত্যধিক রাগ হচ্ছে।কিভাবে এতটা বেহায়া হয়ে গেলো সে?একটু কথা বলার জন্য নির্লজ্জ্ব হয়ে উঠলো!তার আগেই বোঝা উচিত ছিল মেহতাবের জীবনে আদর কেউ না।সব অভিনয়!নাটক!কোনো অনুভূতি নেই তার মনে।যা আছে সবই মোহ।সেটাও একদিন কেটে যাবে।বারবার নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে চলে যায় তার কাছে।আর অপমানিত হয়।
মেহরাব নাছোড়বান্দা!আঠারোতম ফোন আসায় আদরের মন গলতে শুরু করলো।ধরবে না ধরবে না বলে ধরেই ফেলেছে।
“কি!”
হাসি পাচ্ছে মেহতাবের।তবে হাসিকে পাশে রেখে দিলো।কেননা আদর কিছুই বোঝে না।বুঝতে চায় না।হাতে পায়ে বড় হওয়া ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের এমন উদ্ভট আচরণ!
“কল কাটলে কেনো?”
“আমি এমনেতেই কল করেছিলাম।আর এই এমনেতেই কল করাটা ঠিক হয়নি”
“আসলেই ঠিক হয়নি।এবার শাস্তি ভোগ করো!”
“কি শাস্তি?”
“ভিডিও কলে এসো।আর হ্যা!এরপর কেনো,কি কারণে,আসবো না এই শব্দগুলো ব্যবহার করলে শাস্তি বাড়াবো। কাল সামনে থেকে শাস্তি দিবো।আর সেই শাস্তি তুমি একদম সহ্য করতে পারবে না।”
ফোনের স্ক্রিনে আদরের ভোতা মুখ ভাসছে।কপালের মধ্যিখানে ভাঁজ ফেলে নিচে তাকিয়ে আছে।ড্রিম লাইটের আলোয় চেহারার অবয়ব পরিষ্কার না হলেও অস্পষ্ট নয়। মেহতাবের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।ফোন পায়ের কাছে রেখে গিটার নিয়ে বসলো।ঠিক তখনই ম্যাথিও ঘুম থেকে উঠেছে। গীটারের শব্দে কাধে চড়ে বসলো।সেও গান শুনতে ইচ্ছুক।এমনটাই বোঝাচ্ছে। ম্যাথিওকে মেহতাবের কাধে দেখে আদর বললো,
“ও আপনার ঘাড়ে কি করে?”
“দেখো না মাথায় গাল ঘষে দিচ্ছে। আহ্লাদ দেখাচ্ছে আমার সাথে।”
“ভালো!”
মেহতাব এর ঠোঁট জুড়ে হাসি।অভিমানী হোক,রাগী হোক,লজ্জা পাওয়া চেহারা হোক।সবই আজকাল মেহতাবের প্রিয়।মাথা পেতে নিতে ইচ্ছে করে সব!
“ওয়ারফেজের একটা গান ইদানিং আমার খুব ভালো লাগছে”
চট জলদি বলে বসলো আদর,
“কি গান?”
“শুনবে?”
পরক্ষনেই নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখে আদর বললো, “আপনার ইচ্ছে!”
“ম্যাথিও শুনতে চাচ্ছে।আমি ওর আবদার ফেলতে পারি না।গাই?তুমিও শুনো।”
গান ধরলো মেহতাব।প্রত্যেকটা লাইন আদরের জন্য।সে বোঝে কিনা সেটাই ভাবনার বিষয়!
“সেদিন ভোরে, বুকের গভীরে
শুনেছি জমে থাকা নীল বেদনারা ডাকে
এই শহরে ইটের পাহাড়ে, ছিলনা কেউ যে দেওয়ার প্রেরণা
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়
আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে
আর নয় আঁধার, তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে
ভরে মন অন্তহীন রঙ্গিন এক উৎসবে
আজকে শুনি আনন্দধ্বনি,
পৃথিবী ভবেছে সুখে বেঁচে থাকার মায়ায়
শূন্য আশার জীবন্ত ভাষায়, অদূরে দেখেছি প্রাণের মোহনা
যন্ত্রে বাঁধা মন, ছিল ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ, ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়
আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে
আর নয় আঁধার, তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে
ভরে মন অন্তহীন রঙ্গিন এক উৎসবে”
বিশাল রকমের মুগ্ধতা নিয়ে শুনেছে আদর।মনে হলো লাইনগুলো তাকেই ডেডিকেট করা হচ্ছে।”তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে।ভরে মন অন্তহীন রঙ্গিন এক উৎসবে” এই লাইনটা আদরের হৃদয় ছুঁয়েছে। মেহতাবের ভারী,গম্ভীর , জাদুকরী কণ্ঠে ঘোরে চলে গেছে।নিজে ঘোরে থেকেও মেহতাবের দৃষ্টি ঠিকই উপলদ্ধি করছে।অন্যরকম চাহনী তার।আদরের অনেকটা কাছে থাকলে যেমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে? হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মনে হয়!ঠিক তেমন।প্রতিবার তার দৃষ্টি হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে। শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বাড়িয়ে তোলে।
___
শুক্রবার,আজ মিশার বাগদান। মিশার তরফ থেকে শুধু মেহতাব আর নাসির সাহেব।সাথে জয়তুন বেগম,তার মেয়ে আর নাতি।মায়ের দিক থেকে অনেককেই দাওয়ার করা হয়েছিল।তারা ঢাকার বাহিরে থাকার কারণে আসতে পারেনি।রায়হান তার মা ফরিদা বেগম।তাদের সাথে রায়হানের বড় মামার পরিবার।
বিকেল বেলায় সবাই এসে হাজির।এখানে সবাই পরিচিত।বিশেষভাবে অতিথি অ্যাপায়নের কিছুই নেই। বড়রা বসে কথা বলছে।সাথেই মাথা নিচু করে বসে রায়হান।একটিবারের জন্য মিশার কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। মিশাকে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে রায়হানের মামাতো বোন নীলিমা।
এরমধ্যেই জয়তুন বেগমের ডাক পড়লো। মেহতাবকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, “আব্বা বিরিয়ানি দমে দিবেন না?”
বোনের বাগদানের কালো রঙের বডি ওয়ের পড়ে ঘুরছে মেহতাব সারাঘরে।মাত্রই বিরিয়ানি বিষয়ে জরুরি ফোন রিসিভ করতে ঘরে গিয়েছিল।তার মধ্যেই জয়তুন বেগবের ডাক।দ্রুত পায়ে এসে বিরিয়ানি দমে বসিয়ে দিলো।
জয়তুন খালা বললেন, “আপনি এবার গোসল কইরা ভালা দেইখা একটা পাঞ্জাবি পড়েন”
“হুম” বলে চলে গেলো মেহতাব।
গোসল সেরে লাল রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে।সাদা পায়জামার সাথে।চুল মুছে আয়নার সামনে রাখা মায়ের ছবিটা ঠিক করে রাখলো।বাঁকা হয়ে ছিলো।আজকের দিনটায় মাকে কতটা মিস করছে একমাত্র সে নিজেই জানে।তবে মুখে কোনো প্রকার খারাপ লাগার ছাপ থাকা চলবে না।আজ তার বোনের জীবন নতুন মোড় নিতে চলেছে। অত্যন্ত খুশি সে।তার খুশিতে সামান্য টুকু।আয়নার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নায় মিশাকে দেখতে পেলো।মেরুন রঙের শাড়িতে অপরূপ লাগছে তার বোনকে।তবে মুখটা রঙহীন। মেহতাব ঘুরে তাকালো মিশার দিকে।কাছে গিয়ে নিজের মুখে বিশাল হাসি টেনে বললো,
“কিরে?মন খারাপ দেখাচ্ছে কেনো?”
মিশা কোনো উত্তর না দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মেহতাবকে। আহ্লাদী মেয়েটি ছোটোবেলা থেকেই।বললো,
“মার কথা মনে পড়ছে!”
যেমনটা ভেবেছিল মেহতাব।নাহয় নিজের পছন্দের মানুষের সাথে বিয়ে হবে?তারতো খুশি হওয়ার কথা।কিন্তু মার জায়গা কেউ কি পূরণ করতে পারে?জীবনে অনেক মানুষ চলে আসলেও সেই জায়গাটা অপূর্ণই রয়ে যায়। মেহতাবও ধুঁকে ধুঁকে মনে করে তার মাকে।কিন্তু সেতো প্রকাশ করতে জানে না।নিজের মধ্যে চেপে কয়লা করে হৃদয়কে।
“মাকে মনে পড়বেই।এর মানে এটা না যে এসব ভেবে নিজের খুশির দিনগুলোতে কষ্ট পেয়ে বসে থাকবি।আমরা কষ্ট পেলে মাও কষ্ট পাবে।”
মিশা কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না।কিছুক্ষন ভাইকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। দুয়েক ফোটা জ্বলও ফেলেছে চোখের।বেশ কিছুসময় পর মাথা তুলে তাকালো।ভাইয়ের চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলতে লাগলো,
“তোমাকে সুন্দর লাগছে ভাইয়া!”
বিনিময়ে মেহতাব মুচকি হেসেছে।কেউ প্রশংসা করলে কি প্রতিক্রিয়া দিতে হয় সে জানে না।জানে কিন্তু কিছু বলতে পাড়ে না।হোক সে আপন বোন।ছোট একটা ধন্যবাদ দিতেই অসস্তিবোধ করছে।
মিশা আবার বললো, “আজকে আমায় একটা সত্যি বলবে?”
“তোকে কখনো কোনো মিথ্যা বলেছি?”
“না।প্রমিজ করো সত্যি বলবে?আজ আমার এনগেজমেন্ট।তুমি আমার কথা রাখবে না?”
“আচ্ছা বল।করলাম প্রমিজ।”
“তুমি আদর আপুকে ভালোবাসো?”
কোনো উত্তর দিচ্ছে না মেহতাব। থম মেরে দাড়িয়ে আছে। চোখদুটো নত। নিতান্তই অপরাধীর মতন।মিশা আদরের কথা জানে।কে বলেছে সেটা বুঝতেও অতটা বেগ পেতে হলো না।
মিশা আবার বলে উঠলো,
“বিয়ে করবে আদর আপুকে?করে নাও।আপু দেখতেও অনেক সুন্দর।”
“সুন্দর দিয়ে সব হয়না”
“তারপরও তুমি তাকে একপলক চোখের আড়াল করো না!”
“করবোও না!”
মিশার ঠোঁটে ঢেউ খেলানো হাসির দেখা মিলছে। মুখে ভালোবাসে না বললেও ছোট্ট একটা কথায় বুঝিয়ে দিল তার অনুভূতির গভীরতা।এতটুকু শব্দই মিশার জন্য যথেষ্ট।
চলবে…