চিত্তসন্ধি পর্ব ৫৮ (শেষ পর্ব) লেখা: #Azyah

0
2

#চিত্তসন্ধি
পর্ব ৫৮ (শেষ পর্ব)
লেখা: #Azyah

প্রচণ্ড রকমের অসুস্থতা নিয়ে শুয়ে আছে আদর। জোহরা খাতুন মেয়ের পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্য দূরে সরছেন না। ভীষন দুর্বল।নিজ থেকে উঠে বসতেই পারে না।মিশা আর নাসির উদ্দিন চলে যাওয়ার পরই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আশরাফ মাহমুদ অনেক অনুনয় বিনয় করে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে এসেছেন।মেহতাব তাকে অসুস্থ অবস্থায় দূরে ফেলে রাখতে নারাজ।তারপরও আদরের বাবার কথায় রাজি হয়েছে।প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথে আদরকে একবার করে দেখে যায়।রাতের খাবার ঘরেই নিয়ে এসেছেন।জোর করে মেয়েকে টেনে তুললেন।আজকাল খাওয়া দাওয়াতেও অনেকটা অনীহা তার।

ভাত মুখে পুড়ে দিয়ে বললেন,

“মেহতাব তোকে কাল টেস্ট দিয়ে গেছে।তুই এখনও করালি না।”

“ভালো লাগে না আম্মু”

“ভালো লাগেনা বললেই হবে?দেখ কি হাল তোর!টেস্ট করে ওষুধ নিতে হবেতো। যার স্বামী ডাক্তার তারই নাকি এই অবস্থা।দেখিস এসে যদি জানতে পারে টেস্ট করাসনি আচ্ছামত বকা দিবে।”

“খেলাম নাহয় একটু বকা। ইনজেকশন থেকে ওনার বকা অনেক ভালো!”

“মেহতাব নেই তাই সাহস পাচ্ছিস।আসুক আজ!সব বলবো।খাবার, ওষুধ কিছুই খেতে চাস না।টেস্ট করতেও জাসনি।তোকে মেহতাব ছাড়া কেউ মানুষ করতে পারবে না।”

মায়ের কথায় একগাল হেসে আদর বলে উঠলো, “আমাকে কি তোমার বিড়াল মনে হয়?আমিতো মানুষই মা।”

“বিড়ালও তোর চেয়ে ভালো।”

মা মেয়ের কথোপকথনের মধ্যেই বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠেছে। আসন্ন পরিস্থিতি আন্দাজ করতে পেরে লাফিয়ে উঠলো আদর।শরীরে যেনো ঐশ্বরিক শক্তি এসে গেছে।নিজেকে ঠিকঠাক করে মার কাছে এসে বললো,

“আম্মু খাইয়ে দাও। ক্ষিদে পেয়েছেতো! কি তুমি না খাইয়ে বসে বসে আমায় বকছো ”

মেয়ের বদলে যাওয়া রূপে মোটেও অবাক না জোহরা খাতুন।মুখ শক্ত করে বললেন,

“হয়েছে! ঢং করা লাগবে না।আমি জানিতো কলিং বেলের আওয়াজে রূপ বদলেছো তুমি!”

আশরাফ মাহমুদ এর সাথে দেখা করে সোজা আদরের রুমে এসে মেহতাব। জোহরা খাতুনকে সালাম দিয়ে আদরকে সরাসরি প্রশ্ন করে,

“টেস্ট করতে যাও নি তাই না?”

যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত পোহায়।আদর আগে থেকেই জানতো মেহতাব এসেছে।এসেই তাকে এই প্রশ্ন জুড়ে দিবে সেই ব্যাপারেও কোনো দ্বিধা ছিলো না। অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে বললো,

“আপনি জানেন?”

“তুমি টেস্ট করতে গেলে অবশ্যই আমিই সবার আগে জানতাম।”

জোহরা খাতুন উঠে দাড়ালেন।বললেন, “ওকে নিয়ে আমি পারি না।সারাদিন খায়নি কিছু।এখন তোমার ভয়ে খাবার মুখে তুলেছে।তুমিই সামলাও ওকে।”

জোহরা খাতুন চলে গেলে মেহতাব দরজা বন্ধ করে দেয়।আদরের মুখোমুখি এসে বসে। মুখে বিরক্তির ছাপ। নির্বিকার বসে আছে।

আদর বললো, “কি?”

“এভাবে হলে আমি তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবো।সেখানে কে বাঁচাবে তোমাকে?খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়াবো।”

“আমার খেতে ভালো লাগে না বমি আসে।খাবারের গন্ধই সহ্য করতে পারি না আমি।”

“আর কি কি সমস্যা হয়?”

“দুর্বল লাগে”

“আমার ব্যস্ততার সুযোগ নিও না।কাল যদি টেস্ট করতে না যাও আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম!”

__

নতুন দিন। সময়টা গরম আর ঠান্ডার মাঝামাঝি।সূর্যের উত্তপ্ত কিরণ গ্রীষ্মের আগমনীবার্তা দিয়ে যাচ্ছে।ঠিক একইভাবে বসে আছে আদর।তবে স্থানের ভিন্নতা।হাতে নীল রঙের রিপোর্ট। রিসিপশন থেকে কালেক্ট করে মেহতাবের জন্য কেবিনে অপেক্ষায়।অটি শেষ করে সরাসরি কেবিনে আসবে।তারপর শুরু হবে আদরের কাছে প্রশ্ন উত্তরের পালা।জোহরা খাতুন আদরের পাশে বসে আছেন।বারবার মেয়ের দিকে পানি এগিয়ে দিচ্ছে।সে পানি পান করতে নারাজ।এয়ার কন্ডিশন রুমে বসেও ঘেমেই চলেছে।

কেবিনের দরজা সামান্য শব্দ করে খুললো।জোহরা খাতুনকে সালাম দিয়ে মেহতাব বললো, “একটু অপেক্ষা করুন।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি”

হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে এসে বসেছে।ঠিক আদরের মুখ বরাবর।একবার চাইলো তার দিকে।তবে প্রতিক্রিয়াহীন।হাত বাড়িয়ে রিপোর্ট চেয়ে নিলো।কাপা হাতে আদর এগিয়ে দিয়েছে।কালো চেয়ারে হেলান দিয়ে নীল রঙের রিপোর্ট এর প্রত্যেকটা পেজ উল্টেপাল্টে দেখছে মেহতাব।চোখের পাপড়ি ঝাপটাচ্ছে মাঝেমাঝে।মুখটা অত্যন্ত গুরুগম্ভীর।মিনিট পাঁচেক ফাইল চেক করে বন্ধ করে পাশে রেখে দিলো।

“ক..কি সমস্যা?” শুকনো ঢোক গিলে আদর প্রশ্ন করলো। ভীত তার স্বর।

মেহতাব তৎক্ষনাৎ উত্তর দেয়, “রক্তশূন্যতা,রক্তে হিমোগ্লোবিন কম”

“আর?”

“আর কোনো সমস্যা নেই”

বচন ভঙ্গি আর মুখ ভঙ্গি বলছে অনেক সমস্যা আছে। মেহতাবকে ভালো চিনেছে আদর।তার মুখ পড়তে শিখেছে।কখন রেগে থাকে,কখন খুশি বেশ বোঝে সে।এই মুহূর্তে তার ভাবভঙ্গি ঝড়ের আগের নিস্তব্ধতা।চোখে চোখ রাখছে না সে।বারবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে যাচ্ছে।জোহরা খাতুন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।

মুখে হাসি নিয়ে বললেন, “তাহলে আমরা বাড়ি যাই।বাবা তুমি কাজ করো।আজ রাতে আমাদের বাড়িতে রাতের খাবার খাবে কিন্তু”

মেহতাব জোহরা খাতুনের কথার জবাবে বলে, “আজকে সম্ভব হবে না।অন্য আরেকদিন।কিছু মনে করবেন না আম্মু।”

জোহরা খাতুন জোর করতে চেয়েও করলেন না।বললেন, “কাজের চাপ থাকলে সমস্যা নেই।কিন্তু কাল আসবে। কালতো অফডে তোমার।সারাদিন আমাদের সাথে কাটাবে।”

“জ্বি”

জোহরা খাতুন আদরের উদ্দেশ্যে বললেন, “চল”

কিছুটা অন্যমনস্ক আদর।মার কথা যেনো কানেই যায়নি। দৃষ্টি নত করে গভীর ভাবনায় মত্ত।দুয়েকবার ডাকার পরও সাড়া পাওয়া যায়নি।জোহরা খাতুন কাধ ধাক্কে ডাকলেন। খানিকটা লাফিয়ে উঠলো আদর।

“কি হলো চল?”

“আম্মু আমি বাড়ি যাবো”

“বাড়িতেইতো যাচ্ছি।”

আদর আমতা আমতা করে উত্তর দিলো, “আমি ওনার সাথে বাড়ি যাবো”

অবাক হলেন জোহরা খাতুন।আদর যেকিনা বাবার বাড়ি আসার জন্য পাগলপ্রায় ছিলো সে নিজে থেকে ফিরে যেতে চাচ্ছে।আদর আর মেহতাবের মুখশ্রীর দিকে চেয়ে আর কথা বাড়ালেন না।মেয়ের কথায় সম্মতি দিয়ে একাই ফিরে গেলেন বাড়ি।

জোহরা খাতুন চলে যাওয়ার পর মেহতাব উঠে দাঁড়িয়েছে।দরজা সামান্য খুলে দেলোয়ার হোসেনকে ডেকে দুপুরের খাবার দিয়ে যেতে বললো।কেবিনে ফিরে ফাইল নিয়ে সরে গেলো আদরের সামনে থেকে।এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়াস চলছে। পিনপিনে নিস্তব্ধতা পুরো কেবিন জুড়ে। মেহতাবের জুতোর খটখট শব্দ ছাড়া কোনো আওয়াজই নেই।আদরের দৃষ্টি এদিক থেকে ওদিক হেঁটে চলা মেহতাবের প্রতিক্রিয়াহীন মুখের দিকে।বুঝেশুনে কিছু বলতে গেলেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় দেলোয়ার চাচা।কাজে নৈপুন্য এবং বিশ্বস্ত একজন মানুষ। মেহতাবের বলার সাথেসাথেই খাবার নিয়ে হাজির। মধ্যবয়সে এসেও কাজের গতি মেলাতে পারেনা অনেকেই। মেহতাবের ডিউটি চলাকালীন ছায়ার মতন পাশে থেকেছেন!

কেবিনে প্রবেশ করে বললেন, “স্যার খাবার গরম আছে দ্রুত খেয়ে নেন।আজকে সারাদিন আপনি ঠিকমত খাওয়ার সুযোগ পাননি”

মেহতাব হেসে উত্তর দিলো, “হুম!আপনি খেয়েছেন?”

“না স্যার।আপনার খাওয়া শেষ হলে যাবো”

“আমার জন্য অপেক্ষা করা লাগবে না।আপনি গিয়ে খেয়ে আসেন।”

“জ্বি আচ্ছা” বলে বেরিয়ে গেলেন দেলোয়ার চাচা।

নির্বিকার প্লেটে খাবার সার্ভ করে আদরের দিকে এগিয়ে দিলো। নিজের প্লেটেও নিজেই খাবার সার্ভ করেছে।অন্যদিন হলে আদরকে আদেশ করে বসতো।আজ এই মুহূর্তে পরিস্থিতি ভিন্ন। নিঃশব্দে নিজের বিগড়ে থাকা মেজাজের বহিঃপ্রকাশ করছে ডক্টর নওশের মেহতাব।আদরের ধৈর্য্য বরাবরই কম।খাবার প্লেট দূরে সরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মেহতাবের দিকে,

“কি সমস্যা বলবেন?”

খাওয়ার মধ্যেই দৃষ্টি দেয় আদরের দিকে। পূনরায় চোখ নামিয়ে ছোট করে উত্তর দেয়,

“খাও”

“খাবো না।আপনি বলেন কি সমস্যা রিপোর্টে?”

খাওয়া থামিয়ে মেহতাব আদরের দিকে চেয়ে বলল, “রিপোর্ট দেখেছো অবশ্যই?তুমিতো অশিক্ষিত না।অবশ্যই জানো কি লেখা রিপোর্টে!”

“আমি রিপোর্ট না নিজে দেখেছি না আম্মুকে দিয়েছি দেখতে।”

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মেহতাব বললো, “রিপোর্ট দেখার প্রয়োজনও তোমার নেই। রিপোর্টে কি আসতে পারে সেটা তুমি আগে থেকেই জানো!”

“তারমানে?”

কঠিন স্বরে মেহতাব উত্তর দেয়, “জ্বি! তুমি আমার কথা শোনোনি!আমি বারবার তোমাকে বারণ করেছি।সাবধানে থাকতে বলেছি।তারপরও আমার চোখের আড়ালে সেটাই করলে যেটা তুমি চেয়েছো।একটা মেডিসিনও নাওনি তুমি। পূর্ব পরিকল্পিত ছিল এটা!এখন এমন একটা মুখ বানাচ্ছ কিছু জানোই না”

“আপনিও সমান অপরাধী!”

“আমি এদিকে কথা বাড়াবো না।যা ইচ্ছে করো”

__

রাগে নাক ফুলাচ্ছে আদর।সামনে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেহতাব। ঘুমোয়নি।জেদের বশে ইচ্ছেকৃত ঘুমের ভান করে আছে।ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত আড়াইটা।আদরও মুখ শক্ত করে মেহতাবের মুখপানে চেয়ে।তাকে বোঝানোর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ! না পারতে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

চোখ বন্ধ অবস্থায় মেহতাব গাঢ় কণ্ঠে বললো, “কাদঁছো কেনো?”

“কাদবো নাতো কি করবো?এখন আমার হাসার কথা।আপনি সেটাও হতে দিলেন না”

“আচ্ছা কাদো তাহলে!”

মেহতাব এর বাহু ধাক্কে তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো আদর,

“শুনেন!”

“হুম?”

“সবতো ঠিক আছে। তারপরও এমন করছেন কেনো?”

বন্ধ করে থাকা চোখ খুলে তাকালো।আদরের কান্নারত চেহারা দেখে মন শক্ত রাখতে পারে না মেহতাব। চোয়াল শক্ত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।হাত বাড়িয়ে চোখের জল মুছে গালে হাত রেখে বললো,

“অনেক সমস্যা আছে আদর। শুরুর দিকেই তোমার অবস্থা এতটা খারাপ।তুমি সামনে কিভাবে সামলাবে?”

“পারবোতো”

“মনের জোরে সব হয় না সবসময়।”

“আমি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবো।আপনার সব কথা শুনবো।কোনো অনিয়ম করবো না একদম।প্রমিজ!”

হেরে যাওয়ায় সুখ অনুভূত হয়।এই সুখ একান্তই নিজের প্রিয় মানুষের কাছে।জেদ আর কান্না মিশ্রিত মুখমণ্ডল মেহতাবের হারের জানান দিচ্ছে।নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে আদরের কপালে চুমু খায়। ভাসা মায়াবী চোখের সমুদ্রে ডুবে যেতে শুরু করে।হুট করে আদর একটি বাক্য বলে উঠে। মেহতাবের সর্বাঙ্গে কম্পন ধরিয়ে দেয়।ছোটছোট নেত্রগুলো সামান্য প্রসারিত হয়ে উঠে।

“অনেক অনেক ভালোবাসি আপনাকে”

জয় পরাজয় খেলায় নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা মনে।নিজেকে উজাড় করার!শিকলে আটকে থাকা শব্দগুলোকে মুক্ত করার।

আদরের কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে ফেলে মেহতাব।হাত গিয়ে ঠেকে আদরের পেটে।নিঃশ্বাসের বেগ প্রবল।বলে উঠলো,

“আমিও ভালোবাসি!তবে এখন শুধু তোমাকে একা নয়। তোমাদেরকে!”
___

সময়টা বর্ষার,

সাদা এপ্রণে হরেক রকম রঙের দাগ।কোনটা লিপস্টিকের, কোনোটা কাজলের আবার কোনোটা কলমের।স্টেটেস্কোপটা অর্ধ ভেঙে মাটিতে পড়ে আছে।জমিনে ছড়িয়ে আছে পানি। ওয়াশরুম থেকে গড়িয়ে এসে পুরো ঘর ছোটোখাটো বন্যা কবলিত।হেলেদুলে ঘরে পা রাখতেই আতকে উঠলো আদর।হাতে তার খাবারের বাটি।শুধু আধ ঘণ্টার জন্য ঘরের বাইরে পা রেখেছিল এরই মধ্যে ঝড় বয়ে গেছে সুসজ্জিত ঘরটায়। দ্রুত গিয়ে ওয়াশরুমের নল বন্ধ করেছে।পুরো ঘরটায় পানি। পরিষ্কার করার কথা মাথায় আসতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।

আদর ধমকের সুরে ডাকলো,

“মাহাব!”

ধমক শুনে ছোট ছোট পা তুলে দাড়িয়ে পড়লো।নিজের দেহের চেয়ে অনেকখানি বড় মাপের এপ্রন গায়ে জড়িয়ে আছে।হাত,পা মুখ সম্পূর্ণটাই লাল,কালো রঙে আবৃত।

সামান্য তোতলানো কণ্ঠে উত্তর আসে,

“আমি কিছু করিনি!”

আদর কোমরে একহাত রেখে ঝাঁঝালো স্বরে প্রশ্ন করে,

“তো কে করেছে শুনি?”

“ভুত এসেছিল ঘরে মাম্মাম”

“বিকেলে আরো একটা ভুত আসবে।ঘরের এই অবস্থা দেখলে তোমাকে আমাকে কাচ্চা চিবিয়ে খাবে!”

অল্প বয়সেই কথার ধাঁচ আন্দাজ করে নেয় সে। মুখে হাত দিয়ে হেসে বললো,

“তুমি কি বাবাকে ভুত বলছো?”

“হ্যাঁ!”

“বাবা শুধু চিকেন আর ফিশ চিবিয়ে খায় কারন ওরা অনেক স্মল হয়।বেবিদের মতন।আমি তুমিতো বিগ।আমাদের বাবা চিবিয়ে খেতে পারবে না”

মাত্র চার বছরের এতটুকু বাচ্চার মুখে অতিরিক্ত যুক্তিসম্পূর্ণ কথা শুনে বোকা বনে গেলো আদর।হা করে চেয়ে আছে মাহাবের দিকে। এপ্রণের নাজেহাল অবস্থা।তারপর চোখ গেলো ভেঙে পড়ে থাকা স্টেটেস্কোপটার দিকে।চোখ কপালে উঠে গেলো।

হাতে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে আনমনে বলে উঠে,

“আজকে খবর আছে।”

আদরের কন্ঠ শুনে মিশা এসেছে।ঘরের অবস্থা দেখে তার চোখও ছানাবড়া। মাহাবের দিকে চোখ পড়তেই হেসে ফেললো মিশা।হাসতে হাসতে বললো,

“আমার বাবাকে মাছরাঙার মতন দেখাচ্ছে।”

মাছরাঙার অর্থ বুঝতে ব্যর্থ মাহাব।তবে শুনতে বেশ ভালো লাগছে।তাই খুশিতে গদগদ হয়ে এক লাফ দিয়ে বললো,

“তাই ফুপ্পি?”

“হ্যাঁ? কিন্তু এগুলো কি করেছো?বাবা দেখলে বকবে।”

“বাবাতো বকে না।বাবা শুধু চোখ রাঙায়।”

এরই মধ্যে আদর বলে উঠে, “মিশা বোন আমার।তোমার আদরের ভাতিজাকে নিয়ে যাও।হাত মুখের যে অবস্থা করেছে এগুলো একটু পরিষ্কার করে দাও।তোমার ভাই আসার আগে আমার রুম চকচকে করতে হবে”

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।ঘড়ির কাঁটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে আদর।মেহতাব বাড়ি ফেরেনি এখন পর্যন্ত।মেসেজ করে জানিয়েছে ফিরতে দেরি হবে।অন্যদিকে বাবাকে ছাড়া খেতে নারাজ মাহাব।খাবারের প্লেট নিয়ে এদিক ওদিক দৌড়ে যাচ্ছে।বড্ড পাজি ছেলেটা।আদর চেয়েছিলো তার সন্তান যেনো তার স্বভাবের হয়।বাবার মতন চুপচাপ গম্ভীরমুখো না হয়।এখন নিজে পস্তাচ্ছে।সে যে আদরকে একশগুন ছাড়িয়ে গেছে।ছোট পা দুটো এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম পায় না। আদর ছাড়াও নাসির সাহেবকে এই বয়সেও নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়ে।তার লাগাম টানার মানুষের অপেক্ষায় আদর। আধঘণ্টা তার পেছনে দৌড়ে কলিং বেল বেজে উঠলো। সোফায় লাফাতে থাকা মাহাবের পা থেমে গেছে।চোখের পলকে পা গুটিয়ে বসে গেছে নতজানু হয়ে।
দরজা খুলতেই চোখের সামনে সাদা রঙের চেক শার্ট পরিহিত পুরুষের মুখ ভেসে আসলো। হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাড়িয়ে আছে।একে অপরকে দেখে যেনো সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।কালো ব্যাগটি আদরের হাতে এগিয়ে দিয়ে জুতো খুলছে।

ঘরে ঢুকে স্বশব্দে ডেকে উঠলো মেহতাব,

“বাবা?”

চুপচাপ বসে থাকা মাহাব উঠে দাড়ায়।এক দৌড়ে বাবার কোলে চড়ে বসে। আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে বাবার বুকের সাথে।

আদর বলে উঠলো, “আপনার অতি ভদ্র ছেলে!”

আদরের কথা শুনে মেহতাব মাহাবকে প্রশ্ন করলো, “আজ কি দুষ্টুমি বেশি করেছো বাবা?”

“না বাবা। আমি একদম গুড বয়।”

“আচ্ছা। খেয়েছো তুমি?”

“হ্যাঁ”

বাজখাঁই গলায় আদর বলে উঠে, “মিথ্যে কথা!আমি বিগত আধঘণ্টা যাবৎ ওর পেছনে দৌড়াচ্ছি।”

ব্যাগ থেকে জ্যুস বের করে মাহাবের হাতে ধরিয়ে বললো,”এটা খাবারের পর খাবে।এখন বাবা ফ্রেশ হবো ঠিক আছে?”

“ওকে বাবা”

মাহাবকে কোল থেকে নামিয়ে আদরের দিকে এগিয়ে গেলে আদর বলে, “ওকে একটু ধমক দেন।অনেক জ্বালায় কিন্তু!”

আদরের গাল টেনে মেহতাব বললো, “তোমার অতি ভদ্র ছেলে।”

রাত একটা,

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে মেহতাব।মাঝেমধ্যে ঘুমোতে ঘুমোতে অনেক দেরি করে ফেলে।রাতের সময়টা বাবা ছেলের।পাশেই ম্যাথিও ঘুমিয়ে আয়েশ করে।অনেকটা বড় হয়ে গেছে সেও। মাহাবের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে এখনও এই বাড়িতে টিকে আছে।নিজের বিশেষ স্থান দখল করে।আদর বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে। মেহতাবের স্বভাব এখন তার মধ্যে।আকাশ দেখার দায়িত্বের ভাগ নিয়েছে। মাহাবকে শুইয়ে লাইট নিভিয়ে দেয় মেহতাব।ধীর পায়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ায়।কোনো হুশ জ্ঞান নেই আদরের।এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত বাধন! ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বললো,

“আমার দিকে একটু খেয়াল দেওয়া দরকার তোমার”

“সারাদিন কাজে থাকেন।আমার আমার খেয়ালও চান।”

“সারাদিন কাজে থাকি।সারারাত তোমার কাছেই থাকি।তুমিতো দিব্যি ঘুমাও।”

“আপনি ঘুমোন না বুঝি?”

“আমি প্রায় অনেক রাত তোমার ঘুমন্ত মুখ দেখে কাটিয়েছি”

“ডেকে তোলেন না কেনো তাহলে?”

“সারাদিন আমার ঘরটাকে সামলাও,নিজের কাজ করো,আমার বাবা আর তোমার বাবা মার দায়িত্ব পালন করো।তারপর রাতে শান্তিতে ঘুমাও।আর তোমার শান্তির ঘুম আমাকে শান্তি দেয়।”

“আমরা একে অপরকে সময় দিচ্ছি না।”

“কাছাকাছি থেকে সময় দিলেই হয়?আমিতো হাজারো ব্যস্ততায় তোমার কথা ভাবি।তুমিও ভাবো।এটাও আমার অজানা নয়।”

“আজকাল গানটানও গান না।আপনার গিটারটাও আপনার উপর রেগে।আপনার ছেলের হাত থেকে এটাকে অনেক কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছি।লাভ কি? কাল সকালে এটাও আপনার ভদ্র ছেলের হাতে তুলে দিন ভেঙে ফেলুক!”

“সোজাসুজি বললেই পারো আমার গান শুনতে তোমার ভালো লাগে।আর এখন!এই মুহূর্তে আপনি আমার গান শুনতে ইচ্ছুক!”

মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে দেয় আদর।মনের কথা বোঝার এক আধ্যাতিক শক্তি মেহতাবের মধ্যে আছে।এটা আদরের প্রথম থেকেই জানা।না বলা কথা কি সহজেই তুলে ধরে।লজ্জা দেয়।আবার আবদারগুলো অপূর্ণও রাখে না।ঘরে গিয়ে গিটারটা নিয়ে আসলো।বারান্দার দরজা ভিড়িয়ে নেয়। সোফায় বসে আদরকে টেনে নেয় কোলে।প্রিয়তমাকে জাপ্টে ধরে অরিতিক্ত সতর্কতার সাথে সুর তোলে।খুবই সামান্য আওয়াজে। নাহয় মাহাব উঠে যাবে।অনেকদিন পর মেহতাবের গভীর কণ্ঠে গানের সুর উঠেছে,

“তুমি আর আমি আর কেউ নাই
এমন একটা যদি পৃথিবী হয়
মিলনের সুখে ভরে যায় বুক
যেখানে আছে শুধু সুখ আর সুখ
সেই সুখ আমাকে দিও
জেনে নিও
তুমি আমার
তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়
তুমি আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয়”

সমাপ্ত~

(আপনাদের আশাস্বরূপ সমাপ্তি দিতে পারিনি।ভুল ত্রুটি মাফ করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here