‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[০৮]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
“বাপের বাড়িতে কি ঘি মধু আছে যে দু’দিন পর পর বাপের বাড়ি যাওন লাগব? আমিও তো শ্বশুরবাড়িতে থাকি, সংসার করি। কই আমি তো দু’দিন পর পর বাপের বাড়ি যাওয়ার লাইগ্যা ঘ্যান ঘ্যান করি না।”
“আসলে আম্মুর খুব জ্বর এসেছে, তাই যেতে চাচ্ছিলাম।”
“জ্বরে কেউ মরে না। যাও, গিয়ে দুপুরের রান্না শুরু করো।”
পলকের শাশুড়ি কথা গুলো বলে চলে গেলেন। পলক চোখের পানি মুছে তরকারি কাটতে বসল। শাশুড়ির কঠিন কথাগুলো শুনে ওর খুব কষ্ট হয়। তবুও মুখ ফুটে কিছু বলতে না সে। কালকে রাত থেকে ওর মায়ের খুব জ্বর এসেছে। এজন্য একটাবার মাকে দেখার জন্য সে বাপের বাড়ি যেতে চেয়েছিল। পলক একবুক কষ্ট হজম করে মনে মনে বলল, “মা গো! আমি যেতে না পারলেও আল্লাহর কাছে তোমার সুস্থতা কামনা করছি।”
বিয়ের আগে পলক সিনেমা দেখে ভাবত শ্বশুরবাড়ি মানে সুখের আরেক রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজকুমারের সঙ্গে খুব সুখে তার দিন কাটবে। ওর কোনো কষ্ট থাকবে না; শুধু সুখ আর সুখ। গল্পের হিরোইনের মতো সেও সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে। সবার মন জয় করে সে ভালবাসা কুড়াতে পারবে। শ্বশুরবাড়িতে থেকেও নিজের ইচ্ছামতো চলাফেরা করতে পারবে। পড়াশোনা করে শিক্ষিত একজন মা হবে। সে সবার ভালবাসা নিয়ে বাঁচবে। কিন্তু বিয়ের পর সে অল্পতেই বুঝে গেল বাস্তবতাটা কি!
“নারী তোমার জন্ম হয়েছে পিষ্ট হতে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে নয়।”
আমাদের বাস্তব জীবন সিনেমা বা গল্পের মতো এতো টা সাজানো গুছানো হয় না। প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু না কিছু কমতি থাকেই। বিয়ের আগে পলক কল্পনা রাজ্যতে যা ভেবেছিল, সেগুলো সব মিথ্যা, বানোয়াট; মনের কল্পনা দিয়ে চোরাবালির উপর যত্ন করে গড়ে তোলা এক টুকরো স্বপ্ন। যে স্বপ্নটা তলিয়ে যেতে একটুও সময় লাগে না। এজন্য প্রতিটা মানুষের উচিত কল্পনাতে সুখের রাজ্য না গড়ে, বাস্তবতার সাথে লড়াই করার মনোবল তৈরী করা। যাতে বাস্তবতার চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়ার আগে সে আঁকড়ে ধরে বাঁচার মতো নিজের সম্বলটুকু পায়।
প্রত্যয় পেশেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কয়েক বার ইচ্ছের দিকে তাকায়। ইচ্ছে খেলতে খেলতে বেডের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর হাতে পায়ে কলমের কালির আঁকিবুঁকি করা। প্রত্যয় মুচকি হেসে পেশেন্ট দেখা শেষ করল। জামিল এসে জানাল এখন আর কোনো পেশেন্ট নেই৷ প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে তুয়ার কেবিনে গেল। তুয়া বেডে শুয়ে ছিল, কিন্তু চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। প্রত্যয় ইচ্ছেকে পাশের বেডে শুইয়ে দিল। তুয়ার আব্বু বাসায় গেছেন আর তুয়ার আম্মু কেবিণের এক কোণে যোহরের নামাজ পড়ছিলেন। প্রত্যয় তুয়ার পাশে বসে বলল, “বোকারা সব সময় যুদ্ধের ময়দান থেকে পালায়। আর বুদ্ধিমানরা প্রাণের পরোয়া না করে প্রাণহীন হওয়া অবধি লড়াই করতে থাকে। কারণ তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে, মারবে না হয় মরবে। প্রকৃত যোদ্ধারা জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুটাকে শ্রেয় বলে মনে করে। কিন্তু আমি চাই তুমি প্রকৃত লড়াকু যোদ্ধা হও।”
তুয়া প্রত্যয়ের কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনল। প্রত্যয় তুয়ার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলল। তুয়া ওর আম্মুর দিকে একবার তাকাল। উনি নামাজ পড়ে কেবিনের বাইরে চলে গেলেন। কারণ উনি জানতেন প্রত্যয় তুয়াকে ভালো কিছুই বলবে। তুয়া প্রত্যয়ের সোজাসুজি বসল। প্রত্যয় বুঝতে পারছে তুয়া ওকে কিছু বলতে চায়। এজন্য প্রত্যয় তুয়াকে সাহস দেওয়ার জন্য বলল,”তুমি আমাকে যা বলতে চাও, বলতে পারো।”
তুয়া চোখ দু’টো মুছে একটা বড় ঢোক গিলে বলল, “আপনি দেখতে খুব সুদর্শন। আপনাকে সুদর্শন শঙ্খচিলের উপাধি দিলেও ভুল হবে না।”
তুয়ার কথা শুনে প্রত্যয় অবাক হলো না। সে একদম স্বাভাবিক ভাবে তুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যয়ের মুখে অবাক, বিষ্ময়, হাসি, কষ্ট, কোনো ছাপই দৃশ্যমান নয়; সে একদম স্বাভাবিক। প্রত্যয় এখন বোকাদের মতো মাঝখানে কথা বলে তুয়ার কথা আটকাতে চায় না। সে তুয়ার পুরো কথাটা শুনতে চায়। তুয়া প্রত্যয়কে চুপ থাকতে দেখে বলল, “আপনি এতবড় একজন কার্ডিওলজিষ্ট। আপনি সব দিকে থেকে পারফেক্ট একজন মানুষ।”
প্রত্যয় এখনও চুপ করে আছে। সে এখন তুয়ার কথার মানে আঁচ করতে পেরেছে৷ তবুও প্রত্যয় টু শব্দ করল না। তুয়ার চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরছে। সে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কান্না আটকে বলল, “একজন ডক্টর, সুদর্শন ছেলে, সমাজের উচ্চ শ্রেণীর একজন মানুষ আপনি। এবার বলুন, আপনি এত বড় মাপের মানুষ হয়ে কি একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে পারবেন?”
প্রত্যয় কোনো কথা বলল না। তুয়া প্রত্যয়কে চুপ থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, “ডক্টর প্রত্যয়! সান্ত্বনার বাণী বিনামূল্যে দেওয়া যায়। এজন্য সান্ত্বনার বুলি ছড়াতে কেউই কম করেন না। তখন কথাগুলো কত্ত সহজে বলে দিলেন। কিন্তু করাটা কি আদৌও সম্ভব? একজন ধর্ষিতাকে সান্ত্বনার বাণী দিয়ে নিজেকে বড় করতে চাচ্ছেন? নাকি সবাইকে বোঝাতে চাচ্ছেন, আপনি বৃহৎ মনের মহৎ একজন মানুষ?”
তুয়া কথাগুলো শান্তভাবে বললেও, কথার গভীরতা গুলো প্রত্যয় ঠিকই বুঝে নিচ্ছে। তুয়ার চোখ দু’টো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ফোলা ফোলা চোখ দু’টোতে রাগের ফুলকি দেখা যাচ্ছে। প্রত্যয় বলল, “সান্ত্বনার বাণী দেই নি। আমি শুধু তো… ।”
তুয়া প্রত্যয়কে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে চিৎকার করে বলল, “একজন ধর্ষিতাকে একবেলা খেতে দেওয়া যায়, তাকে সান্ত্বনার বাণী দেওয়া যায়, হাসাহাসি করা যায়, কটু কথা বলা যায়, গালমন্দ করা যায়। মানবতার খাতিরে তার কাছে এক দন্ড বসা যায়। কিন্তু তাকে বিয়ে করে বউ বলে স্বীকার করা যায় না। এই শিক্ষিত সমাজে তাকে নিয়ে ঘোরাফেরা করা যায় না। কারণ কি জানেন? তার কারণ সে ধর্ষিতা! হ্যা ধর্ষিতা! একজন ধর্ষিতার ভাগ্যে এতকিছু জোটে না। আপনি কি বুঝেছেন আমি কি বলছি? বুঝেছেন আপনি? আপনাকে মহৎ সেজে আমাকে এত সান্ত্বনা দিতে কে বলেছে? কে চেয়েছে আপনার ভাষণ? আমি? আমি চেয়েছি আপনার সান্ত্বনা? আমাকে করুণা করতে এসেছেন? একজন ধর্ষিতাকে করুণা করতে এসেছেন?”
তুয়ার আম্মু দৌড়ে এসে মেয়েকে ধরলেন। তুয়ার শরীর থরথর করে কাঁপছে। উনি তুয়াকে ধরে বললেন, “মা! আমার সোনা মা, শান্ত হ। তোর ভালোর জন্যই তো প্রত্যয় কথাগুলো তোকে বলেছে, মা। সে ভালো মানুষ বলেই তো তোর ভালো চায়।”
তুয়া ওর আম্মুর দিকে তাকিয়ে তাকাল। তুয়ার কাছে সবাইকে অসহ্য লাগছে। কারো কথা ওর সহ্য হচ্ছে না। ভালো কথাও ওর কাছে তিক্ততায় পরিণত হচ্ছে। তুয়া ওর আম্মুর কথা শুনে নিজেকে উনার থেকে ছাড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “আমার ভালো কেন চাইবে? কেন চাইবে? কে উনি? কোনো পুরুষই ভালো না। বলো! তুমিই বলো, পুরুষ মানুষ এত ভালো হলে আমি কেন ধর্ষিতার কালিমা পেলাম? কেন আমার শরীরে নোংরা, অপবিত্রের অপবাদ এসে লাগল? বলো! বলো আম্মু! কেন এই কালিমা আমার শরীরে লাগল? পুরুষ ভালো হলে কেন তাদের কাছে মেয়েদের ধর্ষণ হতে হয়? উত্তর দাও! কি হলো উত্তর দাও আমাকে, আম্মু?”
তুয়া আবারও উত্তেজিত হয়ে গেছে। ওর চিৎকারে নার্সরা ছুটে এসেছে। প্রত্যয় এর মাঝে একজন নার্সকে ঘুমের ইনজেকশন রেডি করতে বলেছে। তুয়া আবারও পাগলামি শুরু করার আগেই প্রত্যয় তুয়ার হাতে ইনজেকশন পুশ করে দেয়। তুয়া ছোটাছুটি করে উঠতে গেলে প্রত্যয় ওকে বাঁধা দেয়। ইচ্ছে তুয়ার চিৎকারে ভয় পেয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। তুয়া চিৎকার করে বলছে, “বলুন! বলুন! কেন আমাকে করুণা করছেন? কেন? আমি করুণা নিয়ে বাঁচতে চাই না। আমি মরে যাব। মুক্তি চাই! আমি মুক্তি চাই।”
তুয়া কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে ঘুমিয়ে গেল। তুয়ার শরীরে স্যালাইন দেওয়া হলো। প্রত্যয় অন্য সিরিঞ্জ দিয়ে ব্যথা কমানোর লিকুয়িড মেডিসিন স্যালাইনে যুক্ত করে দিল। যাতে স্যালাইনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ব্যথার মেডিসিন ওর শরীরে গিয়ে হাতের ব্যথাটা কম হয়। তুয়াকে একটু কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। সে এখন বেশ কয়েক ঘন্টা নিশ্চিন্তে ঘুমাবে। প্রত্যয় ইচ্ছেকে নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। জামিলকে সন্ধ্যা আটটায় ওটি রেডি করতে বলে সে বাসায় চলে গেল। তুয়ার আম্মু বসে বসে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
তুরাগকে প্রত্যয়ের আম্মু বাসায় ডেকে খাইয়েছেন। তুরাগ এখন ঘুমাচ্ছে। তুরাগের শরীরে জ্বর চলে এসেছে। প্রত্যয়কে বাসায় ফিরতে দেখে প্রত্যয়ের আব্বু-আম্মু তুয়াকে দেখতে গেলেন। ইচ্ছে প্রত্যয়দের ফ্ল্যাটে আসেনি। সে দেখেছে প্রত্যয় তুয়াকে ইনজেকশন দিয়েছে। এজন্য ইচ্ছে কিছুতেই আর প্রত্যয়ের কাছে আসবে না। প্রত্যয়ের গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে পালিয়েছে।
প্রত্যয় ফ্রেশ না হয়েই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। পুরো বাসায় এখন সে একা আছে। প্রত্যয়ের কষ্টমিশ্রিত চোখের পানিতে ওর বালিশ ভিজে যাচ্ছে। ওর কান্নার কোনো শব্দ নেই। শুধু অঝরে নোনা পানি ঝরে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। সে কাঁদছে কেন? তুয়ার কষ্ট দেখে নাকি তুয়ার প্রশ্নে ক্ষত বিক্ষত হয়ে? প্রত্যয় বালিশটা আঁকড়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে থাকল। এভাবে কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে প্রত্যয় ঘুমিয়ে গেল।
সন্ধ্যার একটু আগে প্রত্যয় উঠে ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে গেল। ওর আব্বু-আম্মু তখনও হসপিটালেই ছিলেন। এখানে থাকলে তুয়া বেশি হাইপার হয়ে যাচ্ছে, এজন্য প্রত্যয় তুয়াকে রিলিজ করার পারমিশন দিল। তুয়া ভুল করেও একবার প্রত্যয়ের দিকে তাকায় নি। তুয়ার আব্বু-আম্মু মেয়েকে নিয়ে বের হলেন। প্রত্যয় উনাদের গাড়িতে তুলে দিয়ে ওটির ড্রেস পড়ে ওটিতে ঢুকে গেল। সে রাত তিনটার আগে বাসায় ফিরতে পারবে কিনা সন্দেহ। কারণ রাতেই ওর দু’টো অপারেশন করতে হবে।
পরেরদিন সকালে প্রত্যয় ওর আব্বু-আম্মুর সঙ্গে নাস্তা করতে বসেছে। প্রত্যয়ের আব্বু টুকটাক যা জিজ্ঞাসা করছেন, প্রত্যয় তার উত্তর দিচ্ছে। তখন কলিংবেল বেজে উঠল। প্রত্যয়ের আম্মু দরজা খুলে দেখে প্রিয়ম এসেছে। উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রিয়ম দ্রুত পায়ে হেঁটে ওর রুমে গিয়ে, শব্দ করে রুমের দরজা আঁটকে দিল। কাউকে কিছু বলার সুযোগটুকুও সে দিল না। প্রত্যয়ের সামনে প্রিয়ম কখনও অভদ্র আচরণ করে না। কারণ সে সাহস প্রিয়মের বুকে নেই। এজন্য ওর এমন অাচরণে সবাই খুব অবাক হলো।
প্রত্যয়ের আম্মু দেখলেন একটা মেয়ে দরজার সামনে মুখ কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যয়ের আম্মু মেয়েটি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে? তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
মেয়েটা মাথা নিচু করে নিল। প্রত্যয় আর ওর আব্বু দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটি উনাদের দেখে মাথাটা আরো নিচু করে বলল,
“আমার নাম চাঁদ! আমি প্রিয়মের বিয়ে করা বউ।”
To be continue…!!