সুদর্শন শঙ্খচিল’ [১৫] লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

0
78

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৫]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

তুয়া মনে মনে বলল, “ধর্ষিতা বলেই কি প্রত্যয় আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে? নাকি বিয়ে করে এখন ওর আফসোস হচ্ছে?”

তুয়া নিজের করা প্রশ্নে নিজেই আঁতকে উঠল। প্রত্যয়কে তুয়া ওর বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে পেয়েছে। বিশ্রী অতীতকে পিছে ফেলে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু প্রত্যয় এখন মুখ ফিরিয়ে নিলে তুয়া চিরতরে নিঃশেষ হয়ে যাবে।

তুয়া ওর মনের অবান্তর চিন্তা বাদ দিয়ে ধীর পায়ে প্রত্যয়ের কাছে গিয়ে বলল, “আপনার কি কিছু হয়েছে? আমাকে বলা যায় না?”

প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “আমি ঠিক আছি। আচ্ছা, তুমি গিয়ে আম্মুকে বল, আমি নাস্তা করব না। এখন আমি দুই ঘন্টা ঘুমাব।”

প্রত্যয় রুমে গিয়ে চোখের উপরে হাত রেখে শুয়ে পড়ল। তুয়া মন খারাপ করে প্রত্যয়ের আম্মুকে জানাল প্রত্যয় এখন নাস্তা করবে না। প্রত্যয়ের আম্মু তুয়ার মন খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হল, মন ভার কেন?”

তুয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল, “আম্মু, ওই বাসাতে যাব?”

প্রত্যয়ের আম্মু হেসে বললেন, “যাও, তবে প্রত্যয় বাসায় আছে, তাড়াতাড়ি চলে এসো।” তুয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।

প্রত্যয়ের আম্মু প্রিয়মকে নাস্তা করতে ডাকলেন। প্রিয়মও বলল, সে খাবে না। চাঁদ আর প্রত্যয়ের আম্মু-আব্বু নাস্তা করে নিলেন। তুয়া ওর রুমে গিয়ে দরজা আঁটকে কাঁদতে লাগল। তুয়ার আম্মু মেয়ের এমন করার কারণ বুঝলেন না। তুরাগ ইশারায় উনাকে চুপ থাকতে বলল। তুয়ার আম্মু চিন্তিত হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন।

চাঁদ অনেকক্ষণ ধরে প্রিয়মের রুমের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। কিন্তু কিছুতেই প্রিয়ম দরজা খুলছে না। প্রত্যয়ের আম্মু হাসতে হাসতে বললেন, “চাঁদ, প্রিয়মের থাপ্পড় খেতে না চাইলে চলে আয়।”

চাঁদ মুখ ভেংচি দিয়ে প্রত্যয়ের আম্মুর পাশে বসে বলল, “থাপ্পড় তো তোমার ছেলের হাতের মোয়া। আমি না চাইলেও সে জোর করে দিয়ে দেয়।”

প্রত্যয়ের আম্মু শব্দ করে হাসতে লাগলেন। চাঁদ আসার পর উনি কথা বলার মানুষ পেয়েছেন। এই কয়েকদিনে চাঁদের প্রতি উনার মায়া বসে গেছে। উনাদের সম্পর্কটাও আগের তুলনায় ভাল হয়েছে।

-“আর কি মানুষের পিরিয়ড হয় না, নাকি তুমিই পৃথিবীতে প্রথম মেয়ে যার পিরিয়ড হলো?”

রনিতের আম্মু রাগে গজগজ করতে করতে কথাটা বললেন। পলক লজ্জায় মাথা নিচু করে নিল। রনিতের দাদী মুখে পান দিয়ে বললেন, “ছিঃ! ছিঃ! ব্যাডা মাইষ্যের কানেও এসব কওন লাগে? লাজ লজ্জা কিচ্ছু নাই।”

পলক সবার কথা চুপ করে শুধু শুনল। দাদী শাশুড়ির কথার প্রতি উত্তরে পলকের বলতে ইচ্ছে করল, “স্বামীকেই তো বলেছি, পুরো পাড়ায় তো আর ঢোল পিটিয়ে জানাই নি। তাহলে এত খ্যাচ খ্যাচ করছেন কেন?”

পলক চাইলেও বলতে পারল না তাই ওর ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখল। রনিতের আম্মু বললেন, “যাও গিয়ে রান্নাঘরটা পরিষ্কার করো।” পলক রান্নাঘরে যেতে যেতে শুনল, দিশা সোফায় বসে আপেল খেতে খেতে বিরক্তের কন্ঠে বলল, “যত্তসব আহ্লাদ।”

পলক রান্নাঘরে গিয়ে সকালের এটো থালাবাসন ধুয়ে নিল। রনিত অফিসে যাওয়ার পর পরই সে উঠে পড়েছে৷ তবুও এত কথা শুনতে হল। বাবার বাসায় থাকলে পিরিয়ডের প্রথম দিন সারাদিন শুয়ে থাকত। ওর আম্মু গরম পানি করে দিত, খাইয়ে দিত। বাহানা দেখিয়ে বাড়ির কোনো কাজ করত না। কিন্তু এখন ওকেই সব কাজ করতে হচ্ছে। প্রায় সব মেয়েরাই বাবার বাড়িতে আহ্লাদে চললেও, শশুড়বাড়ি এসে নিজেকে শক্ত করে তোলে। কারণ প্রথমদিন এসেই সে বুঝে যায়, এটা শশুড়বাড়ি।

রনিত আজকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে আসল। পলক তখন শুয়ে ছিল। পেটের ব্যাথায় সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কোনো রকমে কাজ সেরে এসে শুয়ে পড়েছে।

রনিত পলককে বলল, “গোসল করে নাও।” পলক কিছু বলল না। এই সময় মেজাজটা খুব খিটখিটে থাকে। তাই রনিত কথা বাড়াল না। সে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল।

প্রত্যয় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিল। টানা দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে ওর মাথাটা এখন যথেষ্ট ঠান্ডা আছে। প্রত্যয় আশেপাশে তাকিয়ে তুয়াকে দেখতে পেল না। কলি বেলকনিতে চেচাঁমেচি শুরু করেছে। প্রত্যয় কলিকে খাবার দিয়ে এসে রেডি হচ্ছে। একটুপরে তুয়া কেঁদে চোখ ফুলিয়ে প্রত্যয়ের রুমে ঢুকল। প্রত্যয় শার্টের কলার ঠিক করে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কাঁদছ কেন?”
তুয়া মুখ ঘুরিয়ে কান্নারত গলায় বলল, “কোনো কাজ পাচ্ছি না তাই বসে কাঁদছি।”

তুয়ার অভিমানী কথা শুনে প্রত্যয় হেসে তুয়ার পাশে বসে বলল, “দেখি, আমার দিকে তাকাও।”

তুয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “সরি!”
তুয়া হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-“না, সরিতে কাজ হবে না।”
-“তাহলে কিসে কাজ হবে?” (মুচকি হেসে)
-“প্যারিসে যাবেন না, যাবেন না মানে যাবেনই না।”

প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখের পানি মুছে দিল। তুয়া প্রত্যয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, “আমি কি কোনো ভুল করেছি? আমাকে বলুন, আমি আমার ভুলটা শুধরে নিব। তবুও আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েন না।”

প্রত্যয় শান্ত কন্ঠে তুয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল,
– “কালকে সারারাত জেগে ছিলাম, একটুও ঘুমাতে পারিনি। প্রচন্ড মাথা ব্যথা আর মনটাও ভাল ছিল না। তাই তোমাকে হার্ট করে ফেলেছি। এজন্য আমি আবারও সরি। আর আমি প্যারিসে যাচ্ছি ইমারজেন্সি পেশেন্টের অপারেশন করতে। ওখানে থেকে ডাক্তারী পড়া শেষ করে ফিরেছি। ওখানে আমাকে সবাই জানে এবং চিনে। আমারই একজন টিচার আমাকে ডেকেছে, কি করে না যায় বল?
তুমি তো জানো আমার পেশাটাই হচ্ছে সেবাপ্রদান করা। এখন অবধি কোনো পেশেন্টকে ইগনোর করে সরিয়ে দেই নি, আজও পারব না। আচ্ছা, পাঁচদিনের জন্য আমাকে যেতে দাও। আমি কথা দিচ্ছি কাজ সেরে দ্রুত ফিরে আসব।”

তুয়া এবার কান্না থামাল। এখন প্রত্যয়ের যাওয়া আটকানো মানে অমানবিক একটা কাজ করা। কারণ সে একজন দায়িত্ববান ডাক্তার, একথা ভুললে চলবে না। তুয়ার মনটা প্রত্যয়ের জাদু মিশ্রিত কথা শুনে ভাল হয়ে গেল।
আজকে সকালের প্রত্যয়কে ওর বড্ড অচেনা লাগছিল। কিন্তু এই প্রত্যয় তার চেনা প্রত্যয়, শুধু তার প্রত্যয়। আর এই চেনা প্রত্যয়কেই সে পাগলের মতো ভালবাসে। কারণ এই ছেলেটাই এখন ওর বেঁচে থাকার অবলম্বন।

প্রত্যয় তুয়ার দুই গালে হাত রেখে আদুরে সুরে বলল, “এত সহজে আমার থেকে মুক্তি পাবে না, মনে রেখ এটা।”

তুয়া প্রত্যয়ের চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি কখনও এই মুক্তি চাইবও না।”

প্রত্যয় মুচকি হেসে তুয়াকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিল। তুয়া প্রত্যয়ের কানে কানে স্লো ভয়েজে বলল,
-“সাংঘাতিক ভালবাসি।”

প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “ধন্যবাদ।”

**!!

বিল্ডিংয়ের অনেকে জানে প্রত্যয় আর তুয়ার বিয়ের কথা। এই নিয়ে বেশ কানাঘুষাও চলছে। সকালে দুই জন মহিলা বাসায় এসে প্রত্যয়ের আম্মুকে বলেছেন, “ভাবি, সব বাদ দিয়ে ধর্ষিতার সঙ্গে সোনার টুকরো ছেলের বিয়ে দিলেন?”

আরেকজন মহিলা বললেন, “ছেলেটা লোক সমাজে মুখ দেখাবে কি করে? একবারও ভাবলেন না?” প্রত্যয়ের আম্মু উনাদের চা দিয়ে হেসে বললেন, “আমি ছেলের শরীরে মানুষের রক্ত আছে। তাই সে ধর্ষিতা মেয়েকে সজ্ঞানে বিয়ে করেছে।”

মহিলারা আর কিছু বলার মুখ পেল না। তুয়াকে রুম থেকে বের হতে দেখে প্রত্যয়ের আম্মু বলল, “তুয়া, কলিকে খাবার দিয়ে এসো, না হলে চেচাঁমেচি করে কান শেষ করে দিবে।”

তুয়া ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল। প্রত্যয়ের আম্মু কৌশলে তুয়াকে ওখান থেকে সরিয়ে বলল, “আমরা ভাল আছি। আপনারা বিষ না ঢালতে আসলেই খুশি হব।” মহিলা দুইজন অপমানিত হয়ে চা না খেয়ে চলে গেলেন।

মহিলাদের বিদায় দিয়ে প্রিয়মকে ওর আম্মু ডেকেও উঠাতে পারলেন না। প্রত্যয় নাস্তা করে হসপিটালে চলে গেল। তারপর প্রিয়ম রুম থেকে বের হলো। ভাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস ওর নেই। চাঁদ আর তুয়া বেলকনিতে বসে গল্প করছে আর পেয়ারা খাচ্ছে। চাঁদ গল্প করতে করতে ওদের বিয়ের কথা তুয়াকে জানাল। সব শুনে তুয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

-“কেউই চায় না তার নুড পিক ভাইরাল হোক। প্রিয়ম ভাইয়ার সঙ্গে যা হয়েছে সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে।”

চাঁদ মাথা নিচু করে নিল। এসবের পেছনে তারও হাত ছিল না। চাঁদকে কাঁদতে দেখে তুয়া বলল, ” ধৈর্য্য ধরো, নিশ্চয়ই তোমার ভালবাসার জয় হবে।”

To be continue…!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here