সুদর্শন শঙ্খচিল’ [২১] লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

0
58

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[২১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

পাখি ডাকা সিগ্ধ সকালে তুয়া ছাদের গিয়ে দাঁড়াল। বিশুদ্ধ বাতাসে চারপাশে চোখ বুলিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করছে। এত সকালে মানুষজন, গাড়িঘোড়া, চেচাঁমেচি হট্টগোল নেই শুধু আছে, একরাশ নিস্তব্ধতা। প্রত্যয়ের আম্মু নামাজ পড়ে ছাদে এসেছেন গাছে পানি দিতে। তুয়াকে দেখে উনি মুচকি হেসে বললেন, ” একা ছাদে কি করছিস?”

তুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে উনাকে দেখে মুচকি হেসে বলল, “পাখিদের কাছে তোমার ছেলের নামে অভিযোগ জানাচ্ছি। আর আকাশকে বলছি, তাকে ফিরে আসার কথা মনে করিয়ে দিতে।” তুয়ার কথা শুনে উনি গাছে পানি দিতে দিতে বললেন, “তা পাখি আর আকাশ কি খবর পৌঁছে দিয়েছে?” তুয়া মুখ ভার করে ঠোঁটে উল্টে বলল, “হুম তা তো দিয়েছেই।”

প্রত্যয়ের আম্মু হেসে তুয়ার মাথা হাত রেখে বললেন,”আমার ছেলের উপর অভিমান করিস না, দেখবি সে দ্রুত ফিরে আসবে।” তুয়া প্রত্যুত্তরে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “অভিমান করতে আমার বয়েই গেছে।” তুয়ার কথা উনি উচ্চশব্দে হেসে বললেন, “তাহলে প্রত্যয়কে আসতে নিষেধ করি।” তুয়া দোলনাতে বসে অভিমানী গলায় বলল, হ্যাঁ এখন তা তো করবেই। আর আমি কে, আমার কথা হয়তো ওর মনেও নেই?””

তুয়ার কথা শুনে প্রত্যয়ের আম্মু হেসে বললেন, “আমার ছেলেটাও হয়তো ওখানে তোর জন্য ছটফট করছে। চিন্তা করিস কাজ সেরে দ্রুত চলে আসবে।” এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে নিয়ে নিচে চলে গেলেন।

কালকে প্রত্যয়ের সঙ্গে কথা বলে প্রিয়ম সারারাত মেঝেতে বসে কাটিয়েছে। রাতের আঁধারে ওর জীবনের কিছু অপ্রাপ্তির হিসাব মিলিয়েছে। প্রিয়ম বেড়াতে যাওয়ার আগে তুয়াকে ওর মনের কথা জানিয়েছিল। নীল রংয়ের চিরকুটে ভালবাসার কথা লিখে ইচ্ছের হাতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু ইচ্ছে সেটা তুয়াকে দেয় নি বরং নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল। তুয়া চিরকুট দেখে ইচ্ছেকে জিজ্ঞাসাও করেছিল,” ওর হাতে এটা কিসের চিরকুট?” কিন্তু প্রিয়ম দিয়েছে বলে ইচ্ছে
চিরকুট টা তুয়াকে ধরতেও দেয়নি। পরে খেলার ছলে ইচ্ছে চিরকুট টাই হারিয়ে ফেলেছে। প্রিয়ম চাঁদকে নিয়ে আসার পর ইচ্ছেকে আড়ালে জিজ্ঞাসা করেছিল চিরকুটের কথা। কিন্তু ইচ্ছে বলেছিল, “ওতা আমাকে দিসো আমি তুয়া আপুকে দিব কেনু?”

প্রিয়ম তখনই বুঝেছে ইচ্ছে তুয়াকে চিরকুটটা দেয়নি আর তুয়াও জানতে পারেনি ওর মনের কথা। প্রিয়ম এজন্যই বাসের সিটে হেলান দিয়ে তুয়ার উত্তর জানার কথা বলেছিল। আর পরের জার্নিটা একলা নয় তুয়াকে নিয়ে দুকলা করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রিয়মের সব ভাবনা, ইচ্ছে, স্বপ্ন, ভালবাসা, এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে চাঁদের আগমন হল ওর জীবনে আর সবটা ধীরে ধীরে বদলেও গেল। তুয়া হয়তো আর জানবেও না প্রিয়ম আড়ালে আবড়ালে ওকে প্রচন্ড ভালবেসেছিল আর এখনও বাসে।

**!!

রনিত আর পলক সকালে একসঙ্গে খেতে বসেছে। আজকে পলকের খুশি যেন আর ধরছেনা। সে বেশ কিছুদিন ধরে ওর বাবাকে দেখার বায়না ধরেছে। এজন্য রনিত দুই দিনের ছুটি নিয়ে পলকদের ওর বাবাকে দেখাতে নিয়ে যাবে। দুই দিন থাকতে পারবে শুনে পলক তো খুশিতে লাফিয়ে উঠল। পলকের অবস্থা দেখে রনিত হেসে বলল, “লাফিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলো না তখন কিন্তু আর যাওয়া হবে না।”

গল্প করতে করতে দু’জনে খেয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। যথাসময়ে দু’জনে পৌঁছে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। রনিত পলকের রুমে চলে গেল আর পলক সবার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠল। অনেকদিন পর সে বাড়িতে এসেছে তাই গল্পের ঝুলি নিয়ে বসেছে। জামাইয়ের আপ্যায়নের কথা ভেবে
পলকের বাবা বাজারে গেলেন আর ওর মা রান্নাঘরে চলে গেল। তখন কথার ছলে পলককে ভাবি হাসতে হাসতে খোঁচা মেরে বলল, “তা কয়দিনের জন্য আসলে গো ননদিনী, এক সপ্তাহ নাকি একমাস?”

পলকের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। ভাবি পলককে চুপ থাকতে দেখে আবারও হেসে বললেন, “বেশিদিন থাকার জন্যই বরকে নিয়ে এসেছ নাকি? আমি ভেবেছিলাম বাপের বাড়ি যাব তোমার জন্য আর যাওয়া হল না।”

বিয়ের পর বাবার বাড়িতে দিন গুনে আসতে হয় পলকের জানা ছিল না। পলক ঢোক গিলে ছলছল চোখে ওর ভাবির বলল, “না ভাবি আজকেই বিকেলেই চলে যাব। কালকে তুমি তোমার বাবার বাড়ি যেও।” পলককের ভাবি কথাটা শুনে যেন খুব খুশিই হলেন। পলক মুচকি হেসে আড়ালে চোখ মুছে রুমে গিয়ে রনিতকে বলল, “অনেকদিন পর বাড়িতে এলাম কিন্তু এখানে এসে আর মন টিকছেনা। আজকে বিকালেই চলে যাব আমার নিজের সংসারই ভাল।”

রনিত পলকের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “যেমনটা বলবেন মহারাণী।” পলক কথাটা শুনে জোরপূর্বক হেসে রুম ত্যাগ করল। রনিত কিছুক্ষন আগে রুম থেকে হতে গিয়ে পলকের ভাবির কথাটা শুনেছে। সে ভেবেছিল কোনো বাহানা দেখিয়ে পলককে নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু ওর কিছু বলার আগেই পলক খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে একটা বাহানা হাজির করল।

**!!

তুরাগ বাইকের চাবি হাতের আঙ্গুলে ঘুরাতে ঘুরাতে নিচে নামছে। ইচ্ছে ওদের রুমের বাইরে ছোট্ট একটা টুলে বসে পুতুলের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল। তুরাগ ইচ্ছের গাল টেনে বলল, “জানপাখি তোমার মন খারাপ কেন?”

ইচ্ছে তুরাগকে কিছু না বলে ওদের রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিল। তুরাগ হতবাক হয়ে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে ওর কাজে চলে গেল। ইচ্ছের আম্মু ইচ্ছেকে কোলে বসিয়ে নুডুলস খাইয়ে দিলেন। ইচ্ছে কালকের মার খেয়ে ভয়ে টু শব্দ করল না। জেদ না করে একদম ভদ্র মেয়ের মতো খেয়ে টিভিতে কার্টুন দেখতে বসল। ইচ্ছের আম্মু অবাক হলেও কিছু বললেন না বরং খুশি হলেন। তবে মেয়ের মনে যে ভয়ের সৃষ্টি করছেন, উনি একথা আন্দাজ করতেও পারলেন না। কিছু বললে আম্মু মারবে ভেবে ইচ্ছে নুডলসের ঝালে ঠোঁটে জ্বলার কথাও বলল না। শুধু মারের ভয়ে পানি দিয়ে নুডুলস গিলে খেল।

ইচ্ছে ওর বাবাকে কাছে পায়না। প্রত্যয় আর প্রিয়মের কাছে যা আবদার করে তারাও হাসি মুখে সেগুলো পূরণ করে। বাচ্চারা যাদের কাছে ভালবাসা পায় তাদের কাছেই যেতে চাই। ইচ্ছেরও ছোট্ট মনে প্রত্যয় আর প্রিয়মের জন্য একটা মায়া জন্মেছে। এজন্য তাদের কাছে যাওয়া জন্য সে এতটা জেদ ধরেছিল। কিন্তু ওর কথাটা কেউ বুঝলই না, বরং মার খেয়ে ছোট্ট মনে ভয়ের সৃষ্টি হল।

**!!

প্রত্যয়ের স্যার এখন কিছুটা সুস্থ আছে। এজন্য প্রত্যয় অন্য ডক্টরদের সঙ্গে কিছু কথা বলে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেছে। প্যারিসের লা- দিফেন্স গিয়ে সে নিজের কাজ সেরে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হয়েছে। লা-দিফেন্স প্যারিসের প্রানকেন্দ্র আর এখানে রয়েছে বিলাশ বহুল পন্যের দোকান। এখানে বছরে প্রায় এক কোটি সত্তর লাখ পর্যটক বেড়াতে আসেন এবং কেনাকেনা করেন। আর এজন্য প্যারিসকে কেনাকাটার স্বর্গও বলাও হয়।

জার্নির সময়টুকু প্রত্যয় কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। এত লং জার্নিতে সে বই পড়ে, কখনও তুয়ার ছবি দেখে, কখনও গেম খেলে, আবার কখনও ঘুমিয়ে কাটাল। তারপর দীর্ঘ জার্নি সমাপ্ত করে যথাসময়ের সে বাংলাদেশে পৌঁছাল। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে ডুকে ফ্রেশ হয়ে হালকা কিছু খেয়ে রাজশাহীর বাসে উঠে বসল। রাজশাহীতে যাওয়ার ফ্লাইট আছে, তবে চার ঘন্টা পর ততক্ষণ অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রত্যয় বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল। একটুপরে, বাস তার নিজস্ব গতিতে চলতে শুরু করল।
ওর দুই সিট পরে একটা বাচ্চা একটাই গান অনবরত বাজিয়েই যাচ্ছে। কেউ বন্ধ করতে বললেই বাচ্চাটা চিৎকার করে উঠছে। এজন্য বাসের অনেকেই বিরক্ত হয়ে বাচ্চার দিকে তাকাচ্ছে। প্রত্যয় না বাচ্চাটার দিকে একবার তাকিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে রইল।

বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রত্যয়ের ইচ্ছের কথা মনে পড়ল। ফোন বের করে ইচ্ছের আম্মুকে বেশ কয়েকবার ফোন করল, কিন্তু উনি ধরলেন না। তাই ফোনটা পকেটে রেখে প্রত্যয় চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “ইচ্ছেমণি বোধহয় মেলা দুঃখু পেয়েছে।” কথাটা বলে প্রত্যয় মৃদু হাসল।

দুপুরে সবাই একসঙ্গে খেয়ে তুয়া রুমে গিয়ে ঘুমিয়েছে। আসরের আজানের সময় প্রত্যয়ের আম্মু তুয়াকে একবার দেখে গেলেন। কাজ কাম নেই ডেকেই বা কি হবে ভেবে উনি চাচীদের বাসায় গেলেন। চাঁদ এক বাটি নুডলস নিয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে আর খাচ্ছে। প্রিয়ম ওর রুম থেকে চেচিঁয়ে ওর আম্মুকে বলল, “আম্মু একমগ কফি দাও, প্লিজ। আমার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।”

প্রিয়মের চিৎকার শুনে চাঁদ ওর মুখে নুডলস পুরে বিরক্ত হয়ে বলল,” এই বলদা খালি ষাড়ের মত চেচাঁতেই জানে। আমার কাছে এসে একটু জানু মনু বলবে না তা না, সারাটাদিন ম্যা ম্যা করবে নয়তো আমাকে খ্যাচ খ্যাচ করতেই থাকবে।”

চাঁদ কফি বানানোর জন্য উঠতে গেলে তখন কলিংবেল বেজে উঠল। সে দরজা খুলে প্রত্যয়কে দেখে অবাক হয়ে বলল, “ভাইয়া আপনি?”

প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “হুম, কেমন আছো চাদঁ?” চাদঁ ‘ভাল আছে’ বলে কে কোথায় আছে গড়গড় করে বলে হাফ ছাড়ল। তুয়ার কান্নার কথা সহ আরও খবরও প্রত্যয়কে জানিয়ে দিল। প্রত্যয় চাঁদের কথা শুনে হেসে ওর রুমের দিকে পা বাড়াল। আর চাদঁ প্রিয়মকে বকতে বকতে কফি বানাতে রান্নাঘরে চলে গেল।

প্রত্যয় রুমে ঢুকে তুয়াকে ঘুমাতে দেখে মুচকি হাসল কিন্তু ডাকল না। ওর শরীরে এখন ধুলাবালি লেগে আছে এজন্য আগে ফ্রেশ হয়ে আসল। তুয়া একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে টাওয়াল বেলকনিতে মেলে দিয়ে তুয়ার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর কিছু একটা ভেবে প্রত্যয় ওর মাথা ঝাকিয়ে ভেজা চুলের পানি তুয়ার ঘুমন্ত মুখের উপরে ফেলল।

তুয়া বিরক্তকর শব্দ করে নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল। প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে একই কাজ আবারও করল, তুয়া রেগে চোখ খুলে প্রত্যয়কে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকল। তুয়া ভাবছে এটা সত্যি নাকি স্বপ্ন দেখছে? তবে সে মনে প্রাণে চাচ্ছে এটা যেন সত্যি হয়। তুয়ার মনে হচ্ছে সে বেশ কয়েক বছর পর প্রত্যয়কে দেখছে। তাই সে প্রত্যয়ের মুখ পাণেই তাকিয়ে আছে। তুয়াকে এভাবে তাকাতে দেখে প্রত্যয় তুয়ার নাক টেনে বলল,”স্বপ্ন নয় পাগলি সত্যিই এসেছি।”

কথাটা শুনে তুয়া প্রত্যয়ের গলায় মুখ ডুবিয়ে কাঁদতে লাগল। সে ভেবেছিল, প্রত্যয়ের সঙ্গে কিছুতেই কথা বলবেনা। কিন্তু প্রিয় মানুষটাকে দেখে সে নিজেকে সামলাতে পারলনা। বরং অভিমান ভুলে তার বুকেই নিজের জায়গাটা বুঝে নিল। আর প্রত্যয় মিটিমিটি হেসে তুয়াকে ওর বুকে আবদ্ধ করে নিল।

To be continue…..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here