সুদর্শন শঙ্খচিল’ [১১] লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

0
67

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১১]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

প্রত্যয় আলতো করে তুয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “শরীরের আত্মাকে ছুঁড়ে ফেলে কেউ কখনও বাঁচতে পারে, তুমিই বলো?”

তুয়া মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “চলো, তাহলে আমার সামনে সুইসাইড করবে।”

তুয়া প্রত্যয়কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “না! আমি সুইসাইড করব না। আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?”

প্রত্যয় মাথা নাড়িয়ে বলল, “উহুম! আমি শুনতে পাচ্ছি না। তুমি তো ভীতু, তাই ওয়াদা করেও বলছ না। তাহলে আমি কেন তোমার কথা বিশ্বাস করব?”

প্রত্যয়ের কথা শুনে তুয়া কান্নারত সুরে বলল, “আমি সত্যিই সুইসাইড করব না। আমাকে আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না তো? আচ্ছা! আমি ওয়াদা করেই বলছি, আমি সুইসাইড করব না।”
-“হুম! এবার বিশ্বাস হলো।”

প্রত্যয় তুয়ার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জোর দিয়ে আবারও বলল, “তুমি সুইসাইডের কথা ভুলেও মাথাতে আনবে না। তুমি বাঁচবে, আমার জন্য তোমাকে বাঁচতে হবে।”

তুয়া কাঁদতে থাকল। কিছুতেই ও চোখের অশ্রু ঝরা থামাতে পারছে না। তুয়ার এই কান্না হচ্ছে অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়ার কান্না, দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়েও নতুন উদ্যমে এক টুকরো ভরসা নিয়ে বাঁচার প্রবল ইচ্ছে পোষণের কান্না।

মানুষ শুধু কষ্টেই কাঁদে না, কাঁদে তো চরম খুশিতেও। মানুষের হৃদয়টাকে যখন অপ্রত্যাশিত কিছু আকাঙ্ক্ষা এসে ছুঁয়ে দেয়, তখনই একজন মানুষ সুখে দুঃখে আপ্লুত হয়ে দু’নয়নের অশ্রু ঝরায়।

তুয়াকে কাঁদতে দেখে প্রত্যয় মুচকি হেসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার কি আরও কাঁদতে ইচ্ছে করছে?”

তুয়া বোকার মতো মাথা নাড়াল। অর্থাৎ সে আরও কাঁদবে। তুয়ার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ানো দেখে প্রত্যয় মুচকি হেসে বলল, “আমার বুকটা তোমার জন্য উন্মুক্ত। তুমি চাইলে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে পারো।”

প্রত্যয় কথাটা বলতেই তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে নিল। তুয়া চাচ্ছিল এখন কোথাও মুখ লুকিয়ে মন ভরে কাঁদতে, চোখের পানির সঙ্গে ওর কষ্টের যাত্রাপথ এখানেই সমাপ্ত করতে। তুয়া প্রত্যয়ের বুকে মুখ লুকিয়ে আগের তুলনায় দ্বিগুন শব্দে কাঁদতে লাগল। প্রত্যয় তুয়াকে ওর বাহু ডোরে আবদ্ধ করল না। বরং তুয়া নিজেই প্রত্যয়ের শার্ট খামছে ধরে প্রত্যয়কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। প্রত্যয়ের মুখ তখন তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।

ড্রয়িংরুমে সবাই চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। তুয়া দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে। সে ঠিক মতো খায় না, কথা বলে না, রাত হলে শব্দ করে কেঁদে ওঠে, পাগলামি করে। মেয়ের এত কষ্ট উনারাও সহ্য করতে পারেন না। তুয়ার আম্মু প্রত্যয়ের আম্মুকে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা জানায়। প্রত্যয় নিজেও এসব শুনে তুয়ার বাসায় আসে আর তুয়াকে সুইসাইডের পথ দেখায়। আমাদের মস্তিষ্কে একবার সুইসাইডের কথা ঢুকে গেলে, সেই চিন্তায় মাথাতে বার বার ঘুরপাক খায়। তখন মনে হয় সুইসাইড-ই সব সমস্যার একমাত্র সমাধান। নিজে থেকে এই চিন্তা মস্তিষ্ক থেকে না সরালে মানুষ এই পদক্ষেপই গ্রহন করে। প্রত্যয়ও টেকনিক ব্যবহার করে তুয়াকে এমন ভাবে কাবু করল। নিজে একা থাকাকালীন সুইসাইড করলেও, কারো সামনে করা যায় না। বাবা-মা, ভাইয়ের ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে তো নয়ই। তুয়া যখন বলল সে সুইসাইড করবে না, তখন প্রত্যয় তুয়াকে ওয়াদাবন্ধ করে নিল।

একটু পরে প্রত্যয়ের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। তুয়াকে না সরিয়ে প্রত্যয় জামিলের কল দেখে রিসিভ করল। জামিল বলল, “স্যার, আপনাকে দ্রুত হসপিটালে আসতে হবে। ইমারজেন্সি হার্টের পেশেন্ট এসেছে, খুব গুরুতর অবস্থা ।”

প্রত্যয় তুয়ার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “তুমি ডক্টর সোহেলকে বলো প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করতে। আমি এক্ষুণি আসছি।”
-“জ্বি স্যার।”

তুয়া প্রত্যয়ের কথা শুনে কান্না বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্রত্যয় বলল, “এখন আমার যেতে হবে।”

তুয়া মাথা নাড়িয়ে যাওয়ার সম্মতি জানাল। প্রত্যয় তুয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “উহুম! একদম কাঁদবে না। এখন লক্ষী মেয়ে হয়ে খেয়ে সময় মতো ঘুমিয়ে পড়বে, মনে থাকবে?”

তুয়া মাথা নাড়াল। প্রত্যয় হেসে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। প্রত্যয় ড্রয়িংরুমে বসে থাকা সবাইকে বলল, “আপনারা চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ! সব ঠিক হয়ে যাবে। আম্মু, আমি এখন হসপিটালে যাচ্ছি। আমার ফিরতে অনেক রাত হবে।”
-“আব্বু কিছু তো খেয়ে যা।”
-“সময় নেই, আম্মু।”

কথাটা বলে প্রত্যয় আর দাঁড়াল না। সে লিফ্টের অপেক্ষা না করে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল। ইচ্ছে ওদের দরজার সামনে বসে খরগোশ নিয়ে খেলছিল। ইচ্ছের বাবা ইচ্ছকে সাদা ধবধবে একটা খরগোশের বাচ্চা এনে দিয়েছে। ইচ্ছে প্রত্যয়কে দেখে দাঁত বের করে হেসে বলল, “প্রত্তুয়, দেকো আমাল খগরোশ কত্ত সুইটুফুল।” প্রত্যয় একবার তাকিয়ে দ্রুত পায়ে যেতে যেতে বলল, “হুম! খুব সুন্দর, ইচ্ছেমণি।”

ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে কোমরে হাত রেখে বলল, “তুমি একতা পঁচা মানুছ।”

প্রত্যয় ইচ্ছের কথাটা শুনল না। সে গাড়িতে উঠে দ্রুত ড্রাইভ করে চলে গেল।

প্রত্যয় একজন দায়িত্ববান ডক্টর। আল্লাহর রহমতে সে মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়েছে। প্রত্যয় কখনই চায় না, তার পারসোনাল লাইফের জন্য কারো প্রাণনাশ হোক। প্রত্যয়েরও ইচ্ছে করছিল তুয়াকে ওর বুকে আবদ্ধ করে রাখতে। কিন্তু সে যে পেশাতে আছে, সে চাইলেও দায়িত্ব এড়াতে পারবে না। তার বিবেক তাকে দায়িত্ব এড়াতেও দিবে না।

রনিতের উপর রাগ করে পলক অন্য দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। রনিত পলককে একটানে ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা! আমরা বাচ্চা নিব। তবে একটা শর্ত আছে।”

পলক ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি শর্ত?”

রনিত এক হাতে ভর দিয়ে শুয়ে বলল, “তুমি নিজে মেয়ে খুঁজে আমাকে আরেকটা বিয়ে দিলে আমরা বাচ্চা নিব।”
-“কেন? আমি তোমাকে বিয়ে দিব কেন?”
-“কারণ বাচ্চা নিলে তুমি মারাও যেতে পারো। বউ ছাড়া তো আর একা থাকা যায় না, তাই না? তখন তো আমাকে আরেকটা বিয়ে করতেই হবে। তুমি যখন থাকবে ‌না তখন ওই বউকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাব, আদর করব, তাকে ভালবাসব। তাই বলছি মরার আগে তুমি এসব দেখে যাও, আর বাচ্চা নিয়েও যাও।”

পলক ছলছল চোখে রনিতের দিকে তাকিয়ে আছে। রনিত স্বাভাবিক ভাবে পলকের দিকে তাকাল। পলক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে রেগে বলল, “তোর কয়টা লাগে?”

রনিত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল,”ইয়া আল্লাহ! ছিঃ! ছিঃ! স্বামীকে কেউ তুই বলে?”
-“অন্য মেয়েকে নিয়ে ঘুমানোর এত শখ তোর?”
-“বিয়ে করালে ঘুমাব, আদর ক..।”

রনিত পুরো কথা বলতে পারেনি। তার আগেই পলক রনিতের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। এতটাই জোরে কামড়ে ধরেছে যে রক্ত বেরিয়ে গেছে। রনিত পলককে জোর করে ছড়িয়ে হাত দিয়ে ওর ঠোঁট চেপে ধরল। গলগল করে ঠোঁট থেকে রক্ত বের হচ্ছে, পলকের ঠোঁটেও রক্ত লেগে গেছে। তবুও পলকের চোখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। সে যেন এতটুকুই সন্তুষ্টু নয়। পলক রক্তমাখা ঠোঁটে হেসে বলল, “আর বিয়ে করবা?”

রনিত করুণ দৃষ্টি তাকিয়ে বলল, “না! আমার বিয়ের শখ মিটে গেছে।”

পলকের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটল। মেয়ে জাতি বড়ই অদ্ভুত। এরা বাবা আর স্বামীর ভাগ কোনো পরিস্থিতিতেই কাউকে দিতে চায় না। এই দু’টোই মেয়েদের নিজস্ব সম্পদ। বিয়ের পর স্বামী নামক মানুষটার মুখে অন্য মেয়েকে কথা শুনতেও মেয়েরা বড্ড নারাজ।

রনিত পলককে সোজা ভাবে বুঝালে বুঝত না। তাই সে একটু বাঁকা ভাবে বুঝাতে চাইছিল। যাতে পলক একটু হার্ট হলেও রনিতের কথাটা সহজে ধরতে পারে। কিন্তু পলক তো বুঝলই না, বরং উল্টে রনিতের উপরই হামলা করল। সে ভাবল না রনিত তাকে ভালবাসে বলেই তার লাইফ রিস্কে ফেলতে চাচ্ছে না। রনিত পলকের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, “নারী জাতি তোমরা বড়ই অদ্ভুত। নিজের লাইফ রিস্কের কথা একবারও ভাবছ না। কিন্তু স্বামীর ভাগ ছাড়ার কথা ভুলেও কল্পনাতে আনো না।”

[বুকের বা পাশে গল্পের সঙ্গে এই গল্পের কোন মিল নেই। আর যারা রেগুলার গল্পে না দিলে খোঁচা মেরে কথা বলছেন, তাদের বলছি গল্প ঠান্ডা মাথা ভেবে তারপর লিখতে হয়, লিখলাম বললেই লিখা হয়ে যায় না। সুন্দর করে সাজিয়ে লিখতে গেলেও একটু সময়ের প্রয়োজন, ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছি বলে সেই সময়টুকু হচ্ছে না। আর যে গ্রুপ গুলো গল্প পোষ্ট করি সেখানে নেক্সট ছাড়া কোন রেসপন্স করেন না। গল্প পড়েন কিন্তু দু’টো ভাল মন্দ লিখেন না। তাহলে কি আমারও উচিত নয়, আপনাদের খোঁচা মেরে অথবা আরো দেরী গল্প দেওয়া? সত্যি কথা হলে দিনে এক পার্ট না দুই পার্ট দিলেও আপনারা সেইম কাহিনিই করেন। গল্পের মাঝে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। নিচে দিলে সবাই পড়ে না।]

প্রিয়ম বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে কেবল বসল। চাঁদ প্রিয়মের দরজার আড়াল থেকে বলল, “আসব?”

প্রিয়ম গম্ভীর গলায় বলল, “আর এক পা বাড়ালে এক কানে মেরে আরেক কান গরম করে দিব। এবার থাপ্পড় খেতে চাইলে আয়।”

চাঁদ ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। সে প্রিয়মের সামনে গেলেই প্রিয়ম ওকে থাপ্পড় মারে। সবার সামনে তুমি করে বললেও সবার আড়ালে তুই করে কথা বলে। এক কথায় সে চাঁদকে সহ্যই করতে পারে না। প্রিয়মের কথা শুনে চাঁদ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, “আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করছ কেন ?”

প্রিয়ম বলল, “খুশির ঠেলায়! কোনো কাজ পাচ্ছি না তাই।”

প্রিয়মের কড়া কথা শুনে চাঁদ কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে চলে গেল। প্রিয়ম চাঁদের মুখ দেখতেও নারাজ, চাঁদ এত চেষ্টা করেও প্রিয়মকে স্বাভাবিক করতে পারছে না। প্রত্যয়ের জন্য প্রিয়ম চাঁদকে বাসা থেকে বের করে দিতেও পারছে না। চাঁদও কম চালাক নয়! সেও কেঁদে কেঁদে প্রত্যয়কে সাপোর্টার হিসেবে পাশে পেয়েছে। এটাই হয়েছে প্রিয়মের রাগের আরেকটা কারণ। প্রিয়ম এত বলেও চাঁদকে ওর বাসায় পাঠাতে পারছে না, চাঁদ জেদ করে এখানে পড়ে আছে। আর প্রিয়মের জেদ সে চাঁদকে বউ হিসেবে মানে না আর মানবেও না।

তুয়া রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে। তুরাগ দরজা অবধি এসে তুয়াকে দেখে চলে গেল। তুয়াকে একা থাকতে দিয়ে, নিজের করা প্রশ্নের উত্তর নিজেকে খুঁজতে দিল। অন্য কেউ এসে কখনও কারো জীবনের সমীকরণ মিলাতে সক্ষম হয় না। নিজের জীবনের সমীকরণ নিজেকেই মিলাতে হয়, সেটা যতই কঠিন অথবা অসম্ভব হয়ে উঠুক না কেন।

আজকে আকাশে চাঁদ-তারা কোনোটাই নেই, শূন্য আকাশটা মেঘে ঢেকে আছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে, চারদিন সুনশান নিরিবতায় ছেয়ে গেছে। এই গভীর রাতে সুখী মানুষ গুলো সুখের নিদ্রায় মগ্ন হয়ে আছে। আর রাত জাগা পাখি গুলো রাত পাহারা দিচ্ছে। তুয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আল্লাহ, আমি ওকে পবিত্র ভাবে তোমার কাছে চেয়েছিলাম। আমাকে যখন দিলেই তাহলে ধর্ষিতার কালিমা লাগিয়ে দিলে কেন?”

To be continue….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here