সুদর্শন শঙ্খচিল’
[১৭]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
তুয়াও হেসে বলল, “এটাও দেখার বাকি ছিল। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হল আমাদের।”
চাঁদ আর তুয়াকে খেতে আসতে না দেখে, প্রত্যয়ের আম্মু ওদের ডেকে বললেন, “এই তোরা আসবি নাকি খুন্তি নিয়ে যাব? দুপুরে খাবার কখন খাবি শুনি?”
উনার কথা শুনে চাঁদও চেঁচিয়ে বলল, “আসছি মিথিলা ডালিং।”
চাঁদের কথা শুনে প্রত্যয়ের আব্বু উচ্চশব্দে হেসে
উঠলেন। প্রত্যয় মিটিমিটি হাসল। প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে মনে মনে চাঁদের গুষ্ঠী উদ্ধার করল। এই মেয়েটার লাগামহীন কথাবার্তা ওর খুব অপছন্দ। চাঁদের কথা শুনে প্রত্যয়ের আম্মু লজ্জা পেয়ে বললেন, “ফাজিল মেয়ে দাঁড়া তোর হচ্ছে।”
দু’জনে হাসতে হাসতে খেতে আসল। তুয়া এসে প্রত্যয়ের পাশে বসল। চাঁদ দাঁত বের করে হেসে, প্রিয়মের পাশে বসতে গেলে প্রিয়মের তাকানো দেখে ভয়ে তুয়ার পাশে গিয়ে বসল। প্রিয়ম একপ্রকার বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে খাওয়াতে মন দিল। চাঁদের অবস্থা দেখে তুয়া মিটিমিটি হাসছে। প্রত্যয়ের পায়ের খোঁচা খেয়ে তুয়া হাসি থামিয়ে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল, প্রত্যয়কে দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু জানেই না, কিছু করা তো দূরে থাক।
প্রত্যয়ের খেতে খেতে আম্মু বললেন, “দুইটা ছেলে পেয়েছি, ছেলেদের বউও পেলাম। এবার দুইটা করে নাতী- নাতনী পেলেই আমার জীবনের সব চাওয়া শেষ।”
চাঁদ একটা আলু মুখে পুরে বলল, “আম্মু, তোমার চাওয়া দ্রুতই পূরণ হবে। একটু আগে তুয়া আপু বলল।”
কথাটা শুনে তুয়া কাশতে শুরু করল। তুয়ার ঢপ এখন তুয়াকেই গিলতে হচ্ছে, তাও প্রত্যয়ের সামনে। তুয়াকে কাশতে দেখে প্রত্যয় তুয়ার দিকে পানি এগিয়ে দিল। তুয়া পানি খেয়ে মাথা নিচু করে নিল। প্রত্যয় তুয়ার পা আলতো করে আঁকড়ে ধরল। যার মানে,” আমি প্রস্তুত।”
প্রত্যয়ের আব্বু সবাইকে রাজশাহীতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললেন। প্রত্যয় বলল সে কালকে প্যারিস যাচ্ছে তাই যেতে পারবে না। প্রিয়ম বলল সে যাবে না। দুই ছেলের কথা শুনে প্রত্যয়ের আম্মু রেগে বললেন, “বউদেরও শখ আহ্লাদ বলে তো কিছু আছে। শশুড়বাড়ি ওরা দেখব না?”
প্রত্যয়ের আব্বু আম্মু চাঁদ আর তুয়াকে রাজশাহীর বাড়ি দেখাতে চাচ্ছে। দুই ছেলেরই বিয়ে হলো সাদামাটা ভাবে। কোনো অনুষ্ঠান করতে পারেননি,
ওখানে নিকটতম আত্মীয় স্বজনরা আছে। তাদের সঙ্গে পুত্রবধূদের পরিচয় করাতে হবে। কতদিনই বা বিয়ের কথা গোপন রাখবে? বিয়েটা যেমন ভাবেই হোক, হয়েছে তো।
চাঁদ , তুয়া , কেউ এই বিষয়ে কথা বলল না। যেহেতু বড়রা কথা বলছেন হুট করে কথা না বলাই ভালো। প্রত্যয়ের আব্বু প্রত্যয় প্রিয়মকে তুয়া আর চাঁদকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। এখানে দুই ভাই কেউ দ্বিমত পোষণ করল না। তবে প্রত্যয় স্বাভাবিক ভাবে বলল, “বাবা, গেলে সবাইকে নিয়েই যাও।”
প্রিয়মের বুঝতে বাকি রইল না প্রত্যয়ের ইঙ্গিত। প্রত্যয় চাই সে যাক তাই প্রিয়ম জানাল সে যাবে। প্রিয়ম বাসায় একা থাকলে ওকে একাকীত্ব এসে ঘিরে ধরবে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়াও করবেনা।
এজন্য প্রত্যয় ইঙ্গিত করে সবাইকে যেতে বলল।
বুদ্ধিমান ব্যাক্তিরা হাজারটা নয় বরং একটা কথাটাতেই কাজ সারে। প্রত্যয় যেমন এক কথাতেই প্রিয়মকে বুঝিয়ে দিল। প্রত্যয়ের আম্মু প্রত্যয়কে জিজ্ঞাসা করল সে কবে ফিরবে? প্রত্যয় জানাল এক সপ্তাহ লাগতে পারে। কথাটা শুনে তুয়া চমকে উঠে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তুয়ার দিকে তাকাল না। কেউ কথা না বাড়িয়ে খেয়ে যে যার রুমে চলে গেল।
প্রত্যয়ের আব্বু রুমে গিয়ে উনার সহধর্মিণীকে বললেন,”আজকে আমি খুব খুশি। এইরকম একটা জান্নাত গড়তে চেয়েছিলাম। যেখানে শশুড়, ভাসুর, দেবর, পুত্রবধূ, সবার সঙ্গে সবার সম্পর্কটা সহজ হবে। একে অন্যের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। আর তুয়া আর চাঁদকে একসঙ্গে দেখে মনে হয় দুই বোন। ওরা খুব তারাতারি একে অন্যের সঙ্গে মিশে গেছে। এই কয়েকদিনে ওরা দু’জন বাসাতে নতুন ভাবে প্রান এনেছে। ওরা জা নয় বরং বোন হয়েই থাকুক।”
প্রত্যয়ের আম্মুও হেসে বললেন, “তাই যেন হয়।”
**!!
রনিতের বড় ভাই রিয়াল বাসায় এসে দেখে রনিত পলককে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ওর মা ড্রয়িংরুমে বসে বিলাপ করে কাঁদছে। মায়ের কান্না দেখে রিয়াল রনিতকে ডেকে বললেন, “কাপুরুষের মত বাড়ি ছাড়ছিস কেন? মা কাঁদছে দেখছিস না?”
রনিত ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ” কাপুরুষ বলেই তোর মত এতদিন চুপ ছিলাম। মাকে কাঁদতে দেখে আঙ্গুল তুললি, আর মায়ের মুখের লাগামহীন কথাবার্তা শুনে কি বলবি?”
রিয়াল রনিতের কথা শুনে গলা নামিয়ে বলল, ” তাই বলে সামান্য শাড়ির জন্য মাকে কাদাবি?”
রনিত চুপ না থেকে বলল, ” হ্যাঁ! সামান্য শাড়ির জন্যই এত অশান্তি। তুই তো এখন অবধি পলককে কুটোটিও দিস না। তাহলে আমি কেন ভাবিকে শাড়ি দিব, উত্তর দে? বিশেষ দিনে নাহয় শাড়ি উপহার দিলাম। তাই বলে বউকে যখন যা দিব ভাবিকেও দিতে হবে? তুই না দিলে আমার বেলায় উল্টো নিয়ম কেন? কি ভাবিস, নতুন জবে আমাকে লাখ লাখ টাকা স্যালারি দেয়?”
রিয়াল রেগে দিশার দিকে তাকাল। দিশা মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ রনিত কারো বারণ না শুনে পলককে নিয়ে বেরিয়ে গেল। রনিতের মা কেঁদেও ছেলেকে আঁটকাতে পারলেন না।
রনিতের বাবা চুপ করে দেখলেন। কারন উনিও রোজকার ঝামেলা অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। পলক ছোট্ট একটা মেয়ে সবাই যেন ভুলেই গেছে। সারাটাদিন তাকে অনবরত কথা শুনাতে থাকে, সেও তো মানুষ। আর রনিত এতদিন ওর মাকে কড়া কথা শুনাতে পারেনা বলে চুপ ছিল। বউটাও তো এখানে থাকে তার ভরসাতেই। সেও তো ভাল থাকার জন্যই এখানে এসেছে। তাকেই বা কিভাবে অবিশ্বাস, অবহেলা, করে মাকে সাপোর্ট করবে?
রনিত পলককে নিয়ে ইচ্ছেদের বাসায় এলো। ইচ্ছের আম্মু রনিতের চাচাত বোন। কালকে এই বিল্ডিংয়ের আটতলায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে ফ্ল্যাটে উঠবে। রনিত আজকেই উঠতে চেয়েছিল কিন্তু ইচ্ছের আম্মু বাঁধা দিল। একটা রুম দেখিয়ে রনিতদের রুমে পাঠিয়ে দিল। ইচ্ছের আব্বু ঢাকায় থাকে ইচ্ছের আম্মু বাসায় একাই থাকে। উনি রনিতকে এখানে থাকার কথা বললে রনিত রাজি হয় না। তাই ইচ্ছের আম্মু খোঁজ নিয়ে আটতলা ফাঁকা থাকায় ওদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিল।
**!!
তুয়া রেগে আর প্রত্যয়ের রুমে না গিয়ে ওদের বাসায় গেল। তুরাগকে সামনে বসিয়ে এখন জেরা করা হচ্ছে। তার কোনো পছন্দ আছে নাকি? তুরাগ জানাই তার পছন্দ আছে। তুয়ার আম্মু মেয়ের বাসায় ঠিকানা জানতে চাই। তুরাগ মাথা চুলকে বলে, “মেয়ের নাম ইলা, সে ডাক্তারী পড়ছে।” তুয়ার আব্বু সব শুনে নাম্বার নিয়ে ইলার আব্বুর সঙ্গে কথা বললেন। ইলার বাবা মা তুরাগের কথা জানত। তুরাগকেই উনারা বলেছিলেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে।
তুরাগের আব্বু এই সপ্তাহে এনগেজমেন্ট করতে চাইল। কিন্তু ইলার বাবা বললেন ইলার তিনটে পরীক্ষা বাকি আছে। দুই সপ্তাহ পরে ওদের এনগেজমেন্টটা করলে ভাল হয়। তুরাগের বাবা উনার কথায় সম্মতি দিলেন। এবং দুই সপ্তাহ পরে তুরাগ আর ইলার এনগেজমেন্টট ঠিক করলেন।
তুয়ার অপেক্ষা করতে করতে প্রত্যয় ঘুমিয়ে গিয়েছিল। জামিলের ফোন পেয়ে সে উঠে ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে গেল। তুয়ার সঙ্গে প্রত্যয়ের আর দেখা হলো না। সন্ধ্যার পর প্রিয়ম রাজশাহী যাওয়ার জন্য এয়ার টিকিট কেটে আনল। কালকে প্রত্যয় চলে যাবে প্যারিস আর ওরা যাবে রাজশাহী। চাঁদ আর তুয়া ওদের জামা কাপড় গুছিয়ে নিল।
রাত দেড়টার দিকে প্রত্যয় বাসায় ফিরল। তুয়া তখন অন্ধকার বেলকনিতে বসে কাঁদছিল। কলি মাঝে মাঝে দুই একটা বুলি ছড়াচ্ছে। প্রত্যয় ফ্রেশ হয়ে এসে তুয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,” উহুম! উহুম! আমার মিষ্টি বধূটা শুনছেন?”
তুয়া কোনো প্রত্যুত্তর না করে নিজেকে ছাড়িয়ে রুমে চলে গেল। প্রত্যয় রুমে গিয়ে তুয়াকে ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল, “কাঁদছ কেন? আর এত রাত অবধি জেগে কেন, হুম?”
তুয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “এজন্য কি বিপদে পড়ে গেলেন?” প্রত্যয় শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “কালকে চলে যাব ভেবে না কেঁদে একটু ভালবাসলেও তো পার?”
প্রত্যয় দুষ্টু হেসে বলল সে গেলে আর ফিরবেনা। কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগও রাখবে না। ওখানেই একেবারে থেকে যাবে। এসব শুনে তুয়া প্রত্যয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছেন। প্লিজ, প্রত্যয় এমনটা কিছু করো না। আমি সত্যি মারা যাব।”
তুয়া প্রত্যয়ের টি- শার্ট খামছে ধরে অস্পষ্টভাবে কিছু বলছে৷ কিন্তু কান্নার ফলে কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। প্রত্যয় প্রত্যুত্তর না করে তুয়াকে জড়িয়ে ধরেই লাইট নিভিয়ে দিল।
তুয়াকে কিছু বলতে না দিয়ে দু’জনে পাড়ি দিল ভালবাসাময় এক অন্য ভুবনে। শুধু মন নয়। যতদিন দু’টো শরীর মিলে মিশে একাকার হচ্ছে, তুয়ার মনে এই প্রশ্নটাগুলোই রয়ে যেত। তুয়া ভাবত প্রত্যয় ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে বা ধর্ষিতা বলে দূরে সরিয়ে রাখছে। আর প্রত্যয় তুয়াকে সময় দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সময় দিতে গিয়ে ওদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হত। আর এটা প্রত্যয় কখনই চাইত না। তাই সীমাহীন ভালবাসায় দিয়ে তুয়াকে মুড়িয়ে দিল।
পরেরদিন সকালে খাবার টেবিলে সবাই খাচ্ছে।
চাঁদ অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে ওর দুই গালে হাত রেখে বিষ্মিত সুরে বলল, “আপু তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে কেন? কি মেখেছে তুমি?”
চাঁদের কথা শুনে সবার দৃষ্টি তুয়ার দিকে। প্রত্যয়ের আব্বু দু’জনের দিকে তাকিয়ে উনার সহধর্মিণী দিকে তাকালেন। উনাদের দু’জনের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। কিছু কিছু জিনিস কারো চোখ চোখ ফাঁকি দেওয়া যায় না। আর বাবা মায়ের চোখ তো নয়ই। তুয়া প্রত্যয়ের ফেসে অদ্ভুত সুখময় সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। এজন্যই চাঁদ বিষ্মিত সুরে কথাটা বলল।
প্রত্যয়ের আম্মুর চোখে তুয়ার চোখ পড়ে গেল। তুয়া লজ্জা পেয়ে উঠে রুমে চলে গেল৷ আর চাঁদের কথার প্রতিউত্তরে মনে মনে বলল, “অনেক আদর মেখেছি।”
প্রিয়ম ওর মুখ খাবারটুকু গিলতেও পারছেনা আবার ফেলতেও পারছেনা। এটা তো হওয়ারই কথা ছিল। তবুও বুকে একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে।
প্রত্যয় উঠে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। বাবা মায়ের সামনে সেও একটু লজ্জা পেয়েছে। তবে তুয়ার মত বুঝতে দেয় নি তাই।
প্রিয়ম মাথা নিচু করে রইল। কেউ মুখে কিছু না বলেও, যার যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। যুগ আপডেট মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এদিকে তুয়া আর প্রত্যয়কে চলে যেতে দেখে চাঁদ অবাক হয়ে বলল, “লে ব্যাপারটা কি হলো? এরা পালিয়ে গেল কেন?”
প্রিয়ম বিরক্ত হয়ে বলল, “আম্মু এই জংলীটাকে আমার চোখের সামনে থেকে যেতে বলো। নাহলে আমি ওরে তুলে আছাড় দিব।”
চাঁদ আরো একদফা বিষ্ময় নিয়ে বলল, “লেও ঠ্যালা আমি আবার কি করলাম?”
To be continue…..!!