সুদর্শন শঙ্খচিল’ [৩২] লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

0
48

‘সুদর্শন শঙ্খচিল’
[৩২]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)

পরেরদিন সকাল থেকে অঝরে বৃষ্টি ঝরছে। সেই সঙ্গে বইছে ঝড়ো বাতাস। এখন বাজে সকাল দশটা। অথচ অঝর বৃষ্টি আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখে মনে হচ্ছে সাঁঝ সন্ধ্যা বেলা। সাথে আকাশ কাঁপিয়ে ঘন ঘন মেঘের গর্জনও শোনা যাচ্ছে।

আজকে শুক্রবার। চাঁদ তুয়াসহ সবাই বাসাতেই আছে। প্রত্যয় রাতে তুয়াকে মেসেজে জানিয়েছে, ‘টেনশন না করতে। কাজ শেষ হলে সে শীঘ্রই ফিরবে।’ তুয়া বৃষ্টি দেখছে আর গুনগুন করে গান গাইছে। কলি কাঁচা মরিচ খাচ্ছে সাথে বুলি আওড়াচ্ছে। তুয়া মিষ্টি হেসে কলিকে বলল,”বলত কলি আমি কার বউ?” কলি চেঁচিয়ে বলল,’প্রত্তুয়! প্রত্তুয়! কলির উত্তর শুনে তুয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। হঠাৎ বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা এসে তুয়ার মুখে লাগল। ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেয়ে তুয়া কেঁপে উঠে চোখে বন্ধ করে মৃদু হাসল।

একটুপরে, চাঁদ এসে তুয়াকে ডেকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেল। প্রত্যয়ের আব্বু আম্মুর সঙ্গে ওরা লুডুর বাজি ধরল। চাঁদ আর প্রত্যয়ের আব্বু একদল। তুয়া আর প্রত্যয়ের আম্মু অন্যদল। ওদের সামনে আছে চানাচুর মাখা আর গরম চা। চারজনে মিলে খাওয়ার সঙ্গে খেলাতে মনযোগী হল।
প্রিয়ম কালকে রাত থেকে ঘুমায়নি। এখনও সে পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করছে। আর বার বার ফোন চেক করছে। প্রত্যয়ের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে ভেবে সে কলও দিতে পারছেনা। যদিও সে জানে প্রত্যয় সঠিক সিদ্ধান্তটাই বেঁছে নিবে। তবুও ওর টেনশন কমছেনা। টেনশনে প্রিয়মের পুরো শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। অন্যদিন হলে বৃষ্টির সময় সে গিটার নিয়ে বসত। প্রিয়ম বৃষ্টি খুব পছন্দ করে। অথচ আজ বৃষ্টি ওর কাছে বিরক্তির কারণ।

ওইদিকে প্রত্যয়ের হসপিটালে একটা পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে। পেশেন্ট হার্ট এ্যার্টাক করেছেন। এর আগে পেশেন্টের হার্টে দু’টো রিং পরানো হয়েছিল। সব মিলিয়ে পেশেন্টের শোচনীয় অবস্থা। এবার উনার হার্ট এ্যার্টাকের কারন, উনার ছেলের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট প্লাস আসেনি। এজন্য রাগের বশে ছেলেকে খুব মেরেছেন। ছেলে মার খেয়ে কাল রাতে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। মূলত এই টেনশনে উনি হার্ট এ্যার্টাক করেছেন। আজ পেশেন্টের চিকিৎসা শুরুর আগে ডক্টর উনার পূর্বের রিপোর্ট এবং সমস্যা জানতে চাচ্ছেন। পেশেন্টের সহধর্মিণী সহজ সরল মহিলা। উনি কথা বলতে গিয়ে থতমত খাচ্ছেন। বার বার হার্ট এ্যার্টাককে হার্ট স্টোক বলে ফেলছেন। উনি হয়তো স্টোক আর এ্যার্টাকের ব্যাপারটা বুঝতে আনাড়ি।

মহিলার মুখে ‘হার্ট স্টোক’ কথাটা শুনে ডক্টর কাউসার মিটিমিটি হাসছেন। এতে মহিলা টা অস্বস্তিতে পরে চুপ হয়ে গেলেন। উনি স্বামী সন্তান ছাড়া অকারণে বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন না। কিন্তু আজ স্বামীর জন্য হসপিটাল অবধি ছুটে এসেছেন। এখনও উনার ছেলেটার খোঁজ পাওয়া যায়নি। পাশের বাসার লোকদের সাহায্য নিয়ে উনি স্বামীকে হসপিটালে এনেছেন। লোকগুলো টাকা খরচের ভয়ে হসপিটালের ভর্তি করেই চলে গেছে। অগত্যা এখন মহিলাটিকেই ডক্টরের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে। মহিলাটার অবস্থা দেখে দুইজন নার্স বিরবির করে বলল,”এখানে প্রত্যয় স্যার থাকলে কখনও হাসতেন না। বরং সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতেন। আর দেখ, কাউসার স্যার কেমন করে হাসছে। বুঝলি তো? একেই বলে ডক্টর হওয়ার গরিমা।”

একজন নার্স গিয়ে একথা ডক্টর ঈশানকে জানিয়ে দিল। ডক্টর ঈশান ডক্টর কাউসারকে ডেকে সাবধান করে দিলেন। কারন ডক্টর ওয়াসিক এসব পছন্দ করেনা। এসব ব্যাপারে ওয়াসিকের কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। যেহেতু এটা ওয়াসিকেরই হসপিটাল। তাই সবাই ওর রুলস অনুযায়ী চলতে বাধ্য। আর ওয়াসিকের ভাষ্যমতে, ‘এখানে যারা আসে সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। অথবা পিএইচডি করা ডক্টর নয়, যে সব জানবে। যদি তারা সর্বজানতা হতো তাহলে এখানে আসত না। তাই হসপিটালের কোনো ডক্টর বা নার্স অকারণে যেন পেশেন্টের বাড়ির লোকদের হেনোস্তা না করে।’

ডক্টর কাউসার প্রত্যয়কে কখনই ভালো নজরে দেখেনি। তাই ঈশানের মুখে প্রত্যয়ের করা রুলস শুনে রাগ হলেও চেপে গেলেন। কারন এখন কিছু বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। পরে না হয় এর হিসাব চুকাবেন। ডক্টর ঈশান সুন্দর ভাবে মহিলাটার সঙ্গে কথা বললেন। এবং পেশেন্টের চিকিৎসা শুরু করলেন। আর ডক্টর কাউসার হাতের রিপোর্ট টা রেখে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

তিন্নি বেশ কয়েকবার ওর বাবার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। স্বামী, সংসার, শশুড়বাড়ি নিয়ে ওর কোনো অভিযোগ নেই। তুরাগ ওকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দেয়নি। একদম স্বাভাবিক ভাবে চলছে ওদের নতুন সংসার। তুরাগ ইলার কথা তিন্নিকে এখনও জানায়নি। সময় সুযোগ বুঝে পরে জানাবে ভেবে। আর বিয়ের পর আগ বাড়িয়ে প্রাক্তনের কথা বউকে জানানো এক প্রকার বোকামি। ঠিক! যেচে বাঁশ খাওয়ার মতো ব্যাপার। তবে এতোকিছুর পরে তুরাগ কষ্ট পায়নি বা পাচ্ছে না, তাও কিন্তু নয়। সে নিজের কষ্ট নিজে গিলে সবার চোখে স্বাভাবিক আছে।

এবং তিন্নিকে ওর প্রাপ্ত অধিকারটুকু দিয়েছে। পলকের মৃত্যুতে শুধু তুয়া নয়! আরো বেশ কয়েকজনের মনে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে তুরাগ একজন। সে কড়াভাবে তিন্নিতে বলে দিয়েছে, ‘এখন বাচ্চা নিবে না।’ তিন্নি তুরাগের কথা বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে।

চাঁদ গালে হাত দিয়ে রেগে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে, চাঁদ রুমে ডুকেই প্রিয়মের গালে ঠোঁটে ছোঁয়াল। প্রিয়ম রাগী চোখে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। সে ডুবে আছে অন্য চিন্তায়। চাঁদ সুযোগ পেয়ে একই কাজ পুনরায় করল। প্রিয়ম এবারও কিছু বলল না। তিনবারের বেলায় প্রিয়ম স্বজোরে চাঁদের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। চাঁদ রেগে গিয়ে প্রিয়মের কলার চেপে ধরে বলল,”একটু ভালবাসলে কি হয়? কিসের এতো অহংকার তোমার? আমাকে মানবে না তো ঢং করে আবার বিয়ে করলে কেন?” প্রিয়ম ওর কলার ছাড়িয়ে রেগে বলল,”চাঁদ অতিরিক্ত কোনো কিছু ভালো নয়। ভুলেও আর আমার কলারে হাত দিবে না।” চাঁদ এবার চেঁচিয়ে বলল,”এটা করব না, সেটা করব না। আসলে আমি করব টা কি বলবে আমায়? নাকি তুয়াকে চোখের সামনে দেখে আমাকে তোমার মনে ধরছে না?”

প্রিয়ম সর্বশক্তি দিয়ে আবার চাঁদের গালে থাপ্পড় বসাল। চাঁদ চিৎকার করার আগে প্রিয়ম ওর গলা চেপে ধরে বলল,”চুপ! আর ফাইনালি শুনে রাখ, থাকতে হলে এভাবেই থাক! নয়তো বেরিয়ে যা। আর একবার তুয়ার নাম নিলে সত্যিই তোকে মেরে পুঁতে দিব। ”

কথাটা বলে প্রিয়ম চাঁদকে ধাক্কা মেরে বেলকণিতে চলে গেল। তখন ওদের দরজার পাশে থেকে কেউ সরে গেল। সেই ব্যাক্তি এমন কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এদিকে চাঁদ মেঝেতে শুয়ে কাঁদতে লাগল। সে প্রিয়মের থেকে একটু ভালবাসা চায়। সবার মতো সেও সুখের সংসার গড়তে চায়। কিন্তু প্রিয়ম চাইলেও পারেনা স্বাভাবিক হতে। ওর নিষ্ঠুর মনটা ওর কথা শোনে না। কারন ওর বেহায়া মনটা এখনও কাউকে ভালবাসে।

রাত আট টার দিকে প্রত্যয় ওর কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাল। একটা বাসায় ঢুকে সে আশে পাশে চোখ বুলাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, “আপনি কি প্রত্যয়?” প্রত্যয় পেছনে ঘুরে একজন যুবককে দেখতে পেল। সে কিছু বলবে, তার আগে কেউ ওর নাম ধরে ডেকে উঠল। প্রত্যয় সামনে তাকিয়ে তাৎক্ষণিক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর ইচ্ছে দৌড়ে এসে প্রত্যয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ইচ্ছের কন্ঠে সেই আদুরে ডাক, “প্রত্তুয়! প্রত্তুয়! তুমি এছেছো?” প্রত্যয় ইচ্ছেকে ওর বাহুডোরে আবদ্ধ করল। সায়ন দুরে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনকে দেখছে। প্রত্যয় ইচ্ছেকে কোলে নিয়ে আদুরে সুরে বলল,” খুব দুঃখু পেয়েছ আমার ইচ্ছেমণিটা?”

ইচ্ছে ঠোঁটে উল্টো কেঁদে প্রত্যয়ের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখল। ইচ্ছের কপালে, হাতে,পায়ে, ব্যান্ডেজ দেখে প্রত্যয় খুব কষ্ট পেল। তখন সায়ন মুচকি হেসে বলল,”ইচ্ছেমনি রোজা ফুপির সঙ্গে যাও। আমি তোমার প্রত্যয়ের সঙ্গে একটু কথা বলি।” ইচ্ছে ভ্রু কুঁচকে বলল,”কেনু কতা বলবা? এতা তু আমাল প্রত্তুয়।” প্রত্যয় মৃদু হেসে বলল,”রাজকন্যা রা সব কথা শুনে। আর তুমি তো বেস্ট রাজকন্যা।” ইচ্ছে ঠোঁটে ফুলিয়ে কান্নারত কন্ঠে বলল,”তুমি চলে যাবা না? আমি কুন্তু তোমাল সাতে যাব।”

প্রত্যয় ইচ্ছের কপালে আদর দিয়ে বলল,”আমি যাব না সোনা। তুমি যাও! আমি এখানেই আছি।” ইচ্ছে ঘাত কাত করে সম্মতি দিয়ে রোজার কাছে গেল। সায়ন ইচ্ছের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রত্যয়কে জানাল। যদিও ইচ্ছের আব্বু আম্মুর এখনও নিখোঁজ। ইচ্ছের আব্বু আম্মু পাচার চক্রের খপ্পরে পড়েছে। যে মানুষ পাচার করত সে ইচ্ছেদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকত। তার নাম মাহিম। মাহিমের ছেলে ছিল ইচ্ছের খেলার সঙ্গী। দুই পরিবারে যাওয়া আসার মাধ্যমে ইচ্ছেদের অনেক তথ্য মাহিম জেনেছিল। তাছাড়া ইচ্ছের আম্মু সরল মনে অনেক গল্পই উনাদের কাছে করেছিল। এমনকি পরিবারের কারো সঙ্গে উনাদের যোগাযোগ নেই, একথাও বলেছিল।

দুইদিন আগে মাহিবের বউ ইচ্ছেদের দাওয়াত করেছিল। এবং খাবারের সঙ্গে কড়া ডোজের মেডিসিন মিশিয়ে ইচ্ছের বাবা মাকে খাইয়েছে। মেডিসিন মিশ্রিত খাবার খেয়ে উনাদের শরীর অসাড় হয়ে সেন্স হারিয়ে ফেলে। তারপর সুযোগ বুঝে মাহিম ওর লোকদের সাহায্য নিয়ে উনাদের গাড়ি তোলে। ইচ্ছেও তাদের সঙ্গে ছিল। ইচ্ছের কিডনিটাও ওদের টার্গেট ছিল। সমস্যা হল, ওদের বস বাচ্চা কিংবা বাচ্চার কান্না সহ্য করতে পারেনা। আর ইচ্ছে তখন বাবা মায়ের সাড়া না পেয়ে অনবরত কাঁদছিল। তাই মাহিম রেগে চলন্ত গাড়ি থেকে ইচ্ছেকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। ইচ্ছে ছিটকে পড়ে বুকে, পেটে, কপালে খুব আঘাত পেয়ে সেন্স হারিয়েছিল।

এক দিন পর ইচ্ছের সেন্স ফিরেছে। তারপর থেকে ইচ্ছে পুলিশ অফিসার সায়নের কাছে ইচ্ছে ছিল। পাচারকারী চক্রের মাহিমের খোঁজ পাওয়া যায় নি। তবে তদন্ত করে ইচ্ছেদের বাসা খুঁজে বাসার মালিকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এবং মালিকের থেকে ইচ্ছের আব্বু আম্মুর নাম্বার সংগ্রহ করা হয়। সেই নাম্বার হ্যাক করে প্রত্যয়ের নাম্বার বের করা হয়েছে। সায়ন আর প্রত্যয় মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে। আর ইচ্ছে রুমের দরজা থেকে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। সে খেয়াল রাখছে, যেন প্রত্যয় ফাঁকি দিতে না পারে। সায়ন ব্যাপারটা খেয়াল করেও কিছু বলল না। এসব ঘটনা
শুনে প্রত্যয় কিছু বলার ভাষা পেল না। একবার পেছনে ঘুরে ইচ্ছের দিকে তাকাল। ইচ্ছে তাকে ভুবন ভুলানো হাসি উপহার দিল।

সায়ন তখন অকপটে বলল,”মিঃ প্রত্যয় আমি ইচ্ছেকে দত্তক নিতে ইচ্ছুক।”

To be continue….!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here