প্রেমাসুখ #পর্ব_১৭ (হিংসে, অভিমান, অভিযোগ অতঃপর অধিকারবোধ) #লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

0
1

#প্রেমাসুখ
#পর্ব_১৭ (হিংসে, অভিমান, অভিযোগ অতঃপর অধিকারবোধ)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

সাঁঝ ও হৃদ উভয়েই এমন পরিস্থিতির জন্য বড্ড অপ্রস্তুত।

সাঁঝ ‘হেহে’ টাইপের হেসে বলল, “জানতাম না।”

বিপরীতে হৃদও একই ভঙ্গিতে বলল, “না জানাটাই ভালো ছিল।”

উদয় তখন বলে উঠল, “কেমন আছেন ভা… মানে সাঁঝ?”

‘ভা’ বলতেই সাঁঝ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল;আর হৃদ চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে ফেলেছিল, তখনই উদয় কথা ঘুরিয়ে ‘সাঁঝ’ বলল।

সাঁঝ উদয়ের দিকে ঘুরে বলল, “ভালো, আপনি?”

“একটু ভালো, ভাই বিয়ে করলে পুরোপুরি ভালো থাকব।”

সাঁঝ কপাল কুঁচকে বলল, “ভাইয়ের বিয়ের সাথে আপনার ভালো থাকার সম্পর্ক কী?”

“আরে বোঝেন না? আমিও বিয়ে করতাম আর কি।”

সাঁঝের আফিয়া আহমেদের বলা কালকের কথা মনে পড়ল। মুখের সামনে হাত নিয়ে হাসি আটকানোর প্রয়াস চালাল। ইতোমধ্যে আফিয়া আহমেদ ও রায়হান আহমেদ হাসছেন।

সাঁঝ এগিয়ে গিয়ে বসল। হৃদ বাঁকা চোখে সাঁঝকে দেখে নিজের রুমে চলে গেল।

সাঁঝ এখন ভাবনায় পড়ে গিয়েছে। এই অনয়ই কি তার ভার্চ্যুয়াল হাজব্যান্ড! তবে অনূভুতি অব্যাক্ত রাখল। ফেক মানুষ ভেবে স্বামী হিসেবে কবুল করে ফ্লার্ট করার পর যখন জানতে পারবে, সে জ্যান্ত একটা পুরুষ এবং তারই সামনে দাঁড়িয়ে ; ব্যাপারটা অনেক বাজে হয়ে যাবে।

________________
নিজের রুমে বসে সাঁঝ অস্থির ভঙ্গিতে তার ভার্চ্যুয়াল হাজব্যান্ডের প্রোফাইল ঘাটছে। তেমন কিছু পেল না। এমন রসকষহীন মানুষের সাথে সে কীভাবে এতদিন সংসার করতে পেরেছে, ব্যাপারটা তাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে।

খানিকক্ষণ বাদে ‘সি মোর এবাউট অনয়’-এ গেল। সেখান থেকে বিস্ময়কর একটা তথ্য পেল, জন্মসাল। ২২ শে জুন, ১৯৯৩! আফিয়া আহমেদ এর মতে হৃদের জন্মও এই বছরটাতেই হওয়ার কথা! সাঁঝ আবারও প্রোফাইল ঘাটতে লাগল। অনেকটা নিচে এসে একটা মেডিক্যাল কলেজের গ্রুপ ফটো দেখতে পেল, যার সামনেই হৃদ বসে আছে।

সাঁঝ সাথে সাথে ফেসবুক ক্লোজ করল। সেই রাতের কথা মনে পড়ল, যখন সে হৃদকে কবুল করে নিয়েছিল। অতঃপর তাদের ভার্চ্যুয়াল সংসার!

এক পর্যায়ে সাঁঝ বলে উঠল, “হৃৎপিণ্ডটা না জানলেই হলো, অনামিকা হাওলাদার আমিই।”

কেননা তার মতে, হৃদ জানতে পারলে যে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে তাকে। কিছুটা হতাশ হয়ে আবারও বলল, “এই খাটাশ হৃৎপিণ্ডকে জামাইজান বলেছিলাম! এখন তো তার সামনে গেলেই হাসি পাবে আমার।”

________________
এক সপ্তাহ বাদে, একদিন বিকেলে ইভকে নিয়ে ছাদে এসেছিল হৃদ। বিকেলের শেষাংশ এটা। সূর্য ঢলে গিয়েছে। তেজ সামন্যও নেই। তার মেজাজটাও এখন ঢলে পড়া সূর্যের মতো, একদম ঠান্ডা।

তার এই ঠান্ডা মস্তিষ্ককে দুপুর বারোটার সূর্যের মতো উত্তপ্ত করে তুলতে কিছুক্ষণ পর সেখানে আগমন ঘটল শর্মীর। এভাবেই ঘুরতে এসেছিল সে। কিন্তু হৃদের দেখা পেয়ে যেন সে হাতে আকাশের চাঁদ পেল।

শর্মীকে নিজের দিকে এগোতে দেখে হৃদ কপাল কুঁচকে ফেলল। দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান ঘটাতে চাইল।

ততক্ষণাৎ শর্মী বলে উঠল, “যাবেন না, প্লিজ!”

হৃদ থেমে গেল, শর্মীর দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করল, “কী?”

শর্মী মুচকি হেসে বলল, “আপনি আর কত ফেরাবেন আমায়?”

“আপনাকে তো বলেছি, আমি আপনার প্রতি ইন্টারেস্টেড নই।”

“কিন্তু কেন? কী নেই আমার?”

“সেটাই তো সমস্যা, আপনার সব আছে। সম্পূর্ণ রূপে পরিপূর্ণ আপনি। কিন্তু আমার তাকে চাই, যে আমাকে ছাড়া অপূর্ণ। আমি তার পরিপূরক হতে চাই।”

হৃদের কথা বুঝতে পারল না শর্মী। তবুও বোঝার ব্যর্থ কোনো চেষ্টা না করে বলে উঠল, “আমি আপনার জন্য আপনার মন মতো হয়ে যাব।”

“কোনো পুরুষের জন্য কেন নিজেকে পরিবর্তন করবেন? আপনাকে যে ভালোবাসবে, সে আপনার দোষ-গুন সবটাই ভালোবাসবে।”

“আপনি কেন ভালোবাসেন না?”

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই প্রশ্ন। হৃদ বিরক্ত হয়ে গেল। জোরাল কন্ঠে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।

প্রকৃতিতে সন্ধা নেমেছে। হৃদ প্রস্থান করতে গিয়ে দেখল, দরজার সামনে সাঁঝ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের মাঝে চিড়িক দিয়ে উঠল তার। নিজে থেকে সাঁঝকে বলল, “আপনি?”

সাঁঝ চোখ তুলে হৃদের নয়নজোড়ায় ডুবতে গেল। হৃদের চোখে কী আছে তা বোঝার ক্ষমতা সাঁঝের হয়নি। কেন এভাবে তাকাল সে নিজেও জানে না। সাঁঝ হৃদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আলগোছে প্রস্থান করল। আরেকটু এখানে থাকলে হয়তো ঠোঁট ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদেও দিত; যেন তার খেলার সাথী সে ব্যাতিত অন্য কারো সাথে খেলতে বসেছে।

হৃদও আর অপেক্ষা না করে বাসায় চলে গেল। তবে তার সন্ধাবতীর নয়নে আজ তার জন্য অভিমান জ্বলজ্বল করতে দেখল সে। অদ্ভুত এক ভালোলাগা সর্বাঙ্গে ঢেউ খেলে গেল।
আনমনে হেসে ফেলল। এটার অপেক্ষায়ই তো ছিল! এভাবে কীভাবে পেয়ে গেল?

________________
পড়তে বসেছিল উপমা। অনেক গভীর মনোযোগ দিয়েই। কেননা অর্ণব বলেছে, ‘ঢাবিতে চান্স না হলে রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব। শুধু শুধু বাড়িতে রেখে খাইয়ে-পরিয়ে কী লাভ?’

কথাটা অবশ্য মজার ছলেই বলেছিল! কিন্তু উপমার গায়ে লেগে যায়। মনে মনে বলে, ‘তুই প্রেমিক মানুষ, প্রেম করবি। ঘুরতে নিয়ে যাবি। ফুচকা খাওয়াবি। তা না করে আম্মা-আব্বার মতো শাসন করবি কেন? এইজন্যই মামাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করতে হয় না, এদের সাথে প্রেম করলে প্রেম-প্রেম টাইপের ফিলিংসই পাওয়া যায় না।’

কিন্তু একথা মুখে বলতে পারলে তো! তাই পড়ালেখা করছে। গভীর খেয়ালে পড়ালেখায় ডুব দিয়েছে। অর্ণব একটু পর পর কল দিয়ে খোঁজও নিচ্ছে।

তখন সেখানে মনোয়ারা বেগমের আগমন ঘটল। ধীর পায়ে সে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। সোজা এগিয়ে এলো উপমার দিকে। উপমা বইয়ের উপর ছায়া পড়তে দেখে, সেটা অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল।

নিজের মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বলল, “আরে আম্মু! কিছু লাগবে নাকি?”

“না। এমনিই এলাম। তোর খোঁজ নিতে। ”

উপমা বই ভাঁজ করে ঠিক করে বসে বলল, “বেশ করেছ।”

মনোয়ারা বেগম উপমার সামনে বসল। মিহি হেসে বলল, “কেমন আছিস, মা?”

উপমা কপাল কুঁচকে খানিকটা হেসে বলল, “কেমন আবার! আলহামদুলিল্লাহ! ভীষণ ভালো আছি।”

“প্রিপারেশন কেমন?”

“বেশ ভালো।”

মনোয়ারা বেগম মুখে একটুখানি গম্ভীরতার ছাপ আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তার হাস্যজ্বল মুখ সেটা আনতে নারাজ। তাই সামান্য হেসে বলল, “কিছু বলার ছিল তোকে।”

“হুম, বলো।”

মনোয়ারা বেগম সোজা প্রশ্ন করল, “তোর কোনো পছন্দ আছে?”

মুহূর্তেই উপমার ঠোঁটের হাসি নিভে গেল। অপ্রস্তুত হেসে বলল, “মানে?”

মনোয়ারা বেগম কিছু বুঝতে পারছে না কীভাবে এবিষয়ে সে আরও খোলামেলা আলোচনা করবে। একটু কেশে বলল, ”দ্যাখ মা, তুই আমাদের একমাত্র মেয়ে। ছোট থেকেই যা চেয়েছিস, দিয়েছি। এখন বয়স হচ্ছে আমাদের। তোর একটা ব্যবস্থা করে যেতে চাই। আর ক’দিনই বা বাঁচব, বল?

উপমা চুপ মেরে গেল। সপ্তাহখানিক আগেই না বিয়ের জন্য কত্ত খুশি ছিল!

মনোয়ারা বেগম আবারও বললেন, “আমি আর তোর বাবা মিলে ছেলে ঠিক করে রেখেছি। আমাদের খুব পছন্দের সে। এখন তোর সম্মতি পেলেই আমরা এগোব। তিন-চার মাস বাদেই বিয়ে দেব।”

উপমা কিছু বলতে পারছে না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। কোনো শব্দ করছে না।

মনোয়ারা বেগম উপমার নির্বাক থাকাটাকে লজ্জা ভেবে মুচকি হাসল। আরও ভেবে নিল, চুপ থাকাটা সম্মতির লক্ষণ। এটা ভাবতেই তার ঠোঁট থেকে হাসি সরছে না। মিষ্টি হেসে বলে উঠল, “আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই।”

________________
সাঁঝ ছাদ থেকে ফিরে এসে কিছুক্ষণ ড্রয়িং রুমে পায়চারি করল। তার শান্তি লাগছে না। যতক্ষণ না হৃদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে ততক্ষণ সে শান্তি পাবে না।

রান্নাঘর থেকে পায়েসের বাটি নিয়ে বের হলো মনোয়ারা বেগম। উপমার সাথে কথা বলেই মনের আনন্দে পায়েস বানিয়েছে। বড়ো বড়ো দু’টো বাটিতে পায়েস নিয়ে দরজার দিকে মনোয়ারা বেগমকে এগোতে দেখেই সাঁঝ বলে উঠল, “কোথায় যাচ্ছ ফুপ্পি?”

মনোয়ারা বেগম বলল, “ সব ভাড়াটিয়াদের জন্য পায়েস বানিয়েছিলাম। দোতলার আপারা কেউ নেই এখন। ছুটির দিন, তাই তারা সবাই ঘুরতে বেরিয়েছে। তিন তলায় গিয়ে দিয়ে আসব।”

সাঁঝ হঠাৎ একটা সুযোগ পেল যেন।
মনোয়ারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল, “চলো, যাই। তুমি শর্মী আপুদের ফ্লাটে দিয়ে এসো, আমি আফিয়া আন্টিদের ফ্লাটে দিয়ে আসি।”

“আচ্ছা চল।”

_______________
কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে আফিয়া বেগম দরজা খুলল। সাঁঝ মুচকি হেসে বলল, “আন্টি আবারও চলে এলাম।”

“ভীষণ ভালো করেছ। ভেতরে এসো।”

সাঁঝ ভিতরে আসতে আসতে হাতের বাটিটা আফিয়া আহমেদের হাতে দিয়ে বলল, “ফুপ্পি তোমার জন্য পায়েস পাঠিয়েছে, নাও।”

“এসবের কী প্রয়োজন ছিল? মোনা আপাও না!”

সাঁঝ জবাবে মুচকি হাসল। মনোয়ারা বেগমকে অনেকে ‘মনা’ বলেও সম্বোধন করে থাকে।

আফিয়া আহমেদ সাঁঝকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে বলল, “একটু বোসো। উদয়ের সাথে গল্প করো, আমি রান্নাটা সেরে আসছি।”

আফিয়া আহমেদ রান্নাঘরে চলে গেল। সাঁঝ এগিয়ে এসে সোফায় বসল। তার সামনে সিঙ্গেল সোফাটিতে বসে উদয় ফোন টিপছে। সাঁঝের দিকে তাকিয়ে দেখল সেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উদয় অপ্রস্তুত হাসল। বিপরীতে সাঁঝ জোর পূর্বক হাসল। উদয়কে প্রশ্ন করল, “আপনার ভাই কোথায়?”

উদয় সাঁঝের প্রশ্নে ফট করে হেসে দিল। ‘আপনার ভাই’-কথাটা ভীষণ রোমান্টিক লেগেছে উদয়ের কাছে। হাত দিয়ে হৃদের রুমের দিকে উদ্দেশ্য করে বলল, “রুমেই আছে।”

সাঁঝ কিছু না বলে সেদিকেই পা বাড়াল। রুমে প্রবেশ করতেই একটা মিষ্টি সুগন্ধ তার ঘ্রানেন্দ্রিয় বরাবর প্রবেশ করল। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিল। এতটা পরিপাটি কোনো ছেলের রুম হয়? সাঁঝ এটা মানতে পারছে না। ভালো করে তাকাতেই লক্ষ করল হৃদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে। পা’দুটো গতিশীল করে সেদিকে এগোল। দরজার মুখ বরাবর আসতেই থেমে গেল। দেখল হৃদ ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। মুখের আদল একদম নিরামিষ। এক্সপ্রেশন ছাড়া কেউ কীভাবে কথা বলতে পারে! লাইক এ রোবট!

কথা শেষ করে ফোন রাখল হৃদ। রুমে প্রবেশের উদ্দেশ্য পিছু মুড়তেই দরজার সামনে সাঁঝকে দেখে চোখ দুটো বড়ো-সড়ো করে ফেলল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

সাঁঝ হৃদকে নিজের দিকে তাকাতে দেখেই খেই হারিয়ে ফেলেছিল। চোখ দু’টো বন্ধ করে পরপর দু’টো শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে নিল। ফিরে পেল আগের তেজ। কয়েক কদম এগিয়ে হৃদের মুখোমুখি দাঁড়াল। বক্ষস্থলের কাঁপাকাঁপিকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠল, “আপনার সাথে ঝগড়া করতে এসেছি।”

হৃদের দু’ঠোঁট আলগা হয়ে বেরিয়ে এলো একটা শব্দ, “ঝগড়া!”

সাঁঝ তেজী কণ্ঠে বলল, “আপনি শুধু আমার সাথে ঝগড়া করবেন। আজ আপনার ঝগড়া করার সাধ মেটাব!”

হৃদ সাঁঝের দিকে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
সাঁঝ হৃদের আরও কাছাকাছি হলো। নিশ্বাস গুনতে পারছে একে অপরের।

সাঁঝ অভিমানী গলায় বলল, “আপনি কেন ঐ শর্মীর সাথে ঝগড়া করতে গেছেন?”

হৃদ অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। সাঁঝ হৃদের বুকের বা পাশে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, “আমার এইখানে যন্ত্রণা হয় তো।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here