#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_১৫
বাড়িতে ফিরে আরেক কান্ড, শুভ্রের ফুফু এসেছেন। রবীউল সাহেবের একমাত্র বড় বোন। রবীউল সাহেব যতটা শান্ত এই মহিলা অতটাই অশান্ত। ভাইয়ের বাড়িতে এসেই হুলোসস্তর শুরু করে দেয় সে। গাড়ী বাড়ির সামনে থামতেই হিয়া নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রের দিকে তাকালো পর্যন্ত না। লোকটা তাকে অনেক কিছু বলছে, এনার সাথে সে আর কথাই বলবে না।
বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে শুভ্রের ফুফুর মুখোমুখি হলো হিয়া। শুভ্রের ফুফুকে সে এর আগে দেখেনি। খুব সাস্থ্যবান মহিলা। গালের দুপাশে বয়সের ছাপ পড়লেও মাথা ভর্তি কালো কেশ। গায়ের রং শ্যামলা।
পাশে সাহারা খাতুন কড়াইয়ে তেল দিচ্ছিল। হিয়াকে দেখে শুভ্রের ফুফু রাবেয়া আক্তার বললেন,” সাহারা.. কে এই মেয়ে।” মহিলার কণ্ঠ এমন যা শত আওয়াজের মাঝেও আপনার কানে বাজবে। হিয়া থমকে দাড়ালো। তারপর সৌজন্যের জন্যে হালকা হেসে তাকালো। সাহারা খাতুন হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” ও আপনার ভাইয়ের বন্ধুর মেয়ে।”
মহিলাটা আর কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগে সাহারা খাতুন হিয়াকে বললেন,” জার্নি করে এসেছো। যাও রূমে গিয়ে রেস্ট নেও।” হিয়া চুপচাপ সিড়ি বেয়ে উপরে নিজের রূমে চলে গেলো।
হিয়া চলে যেতেই রাবেয়া আক্তার বললেন,” মেয়েটা সুন্দর। বড় বড় চোখ। কি সুন্দর ব্যাবহার! আমার পছন্দ হয়েছে।”
রাবেয়া আক্তারের মুখে এমন কথা শুনে পরক্ষনেই সাহারা খাতুনের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
✨
ক্লাস শেষে ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে ভার্সিটির সামনে দেখে শুভ্র এগিয়ে আসলো। শুভ্রের পিছু পিছু প্রভাও এলো। শুভ্র ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,” কি ব্যাপার তুমি এইখানে কি করছো? তোমাকে আমি কি বলেছিলাম?”
ড্রাইভার মলিন গলায় বললো,” গিয়েছিলাম কলেজের সামনে। আপামনি আসে নাই।”
হিয়ার এমন আচরণে শুভ্রের রাগ হচ্ছে। কোনো কথা শুনে না, নিজের যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়। শুভ্র ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসলো। প্রভা হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
” কলেজে।”, বলতে বলতে সিট বেল্ট পরে নিল শুভ্র।
প্রভা গাড়ীর অন্যপাশের দরজা খুলে শুভ্রের পাশের সিটে বসে পড়তেই শুভ্র অবাক হয়ে তাকাতেই প্রভা বললো,” আমিও যাবো। বাই দ্যা ওয়ে তুই এতো অস্থির হয়ে আছিস কেনো?”
শুভ্র গাড়ির স্টার্ট দিতে দিতে বললো,” অস্থির হয়ে থাকতে যাবো কেনো?”
” নাহ্ তোকে দেখে মনে হলো। কিন্তু কলেজে যাচ্ছিস কেনো?”, মনের কোনের ক্ষীণ সন্দেহ থেকে প্রশ্ন করলো প্রভা।
শুভ্র দৃষ্টি সামনে রেখে বললো,” ওইদিন রাস্তায় কিছু ছেলে নাকি হিয়ার পিছু নিয়েছিলো। তাই সেফটির জন্য গাড়ি পাঠালাম কিন্তু মহারানী তো আবার সোজা কথার মানুষ না।”
শুভ্রের মুখে এমন কথা শুনে প্রভার বুকটা ধক করে উঠলো। শুভ্রের হিয়ার জন্যে এতো অস্থির হয়ে আছে। কই তার জন্যে তো শুভ্রকে কখনো এমন অস্থির হতে দেখেনি। প্রভা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো,” তোর কি হিয়ার জন্যে চিন্তা হচ্ছে?”
শুভ্র হা বা না কিছু বলার আগেই শুভ্র জোরে ব্রেক কষলো। তারপর গাড়ী থেকে নেমে গেলো। প্রভা অবাক হয়ে শুভ্রের ছুটে যাওয়া দেখছে।
আজ ছেলেগুলো ফাঁকা জায়গা পেয়ে হিয়ার পথ আটকে দাড়িয়েছে। হিয়া ভয় পেলেও চোখে মুখে সে ভয়ের ছাপ প্রকাশ করেনি। তিনজনের মাঝের সুন্দর ছেলেটা এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” কি ভেবেছো? কয়েকদিন কলেজে না আসলে আমরা ভুলে যাবো যে তুমি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলে।”
হিয়া দু পা পিছালো। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে।ছেলেটা আরো বললো,” এতদিন কিছু করিনি কিন্তু আজ করবো।”,বলেই পাশের ছেলেটাকে ঈশারা করতেই সে এসে হিয়ার হাতের কব্জি চেপে ধরলো।
ভয়ে হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। তারপর কড়া গলায় বললো,” আমি কে তোমরা জানো? আমার যদি কিছু হয়েছে না তোমাদের এমন হাল হবে ভাবতেও পারছো না। আমাকে ছেড়ে দেও।” আত্মরক্ষায় বানিয়ে বানিয়ে কিছু মিথ্যে কথাও বললো। তাতে কোনো লাভ হলো না। ছেলে গুলো উচু গলায় হাসতে লাগলো। তারপর হিয়ার হাত ধরে টানতে লাগতেই হিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো। তবুও সাহস করে ছেলেটার হাতে সজোরে এক কামড় বসিয়ে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে দৌঁড়াতে শুরু করলো। পিছনে ছেলে গুলোও ছুটছে, হিয়ার পায়ে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে কিন্তু এ ব্যাথা এখন তার কাছে কিছুই না।
চিপা গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় আসতেই হটাৎ একটা বাসের সামনে এসে পড়লো হিয়া। হিয়া চোখ মুখ কুচকে ফেলতেই মনে হলো কে যেনো তাকে নিজের বাহুতে জড়িয়ে নিয়েছে।
শুভ্র দৌড়ে এসে হিয়াকে নিজের বুকে টেনে সরিয়ে আনলো বাসের সামনে থেকে। হিয়া শক্ত করে শুভ্ররের শার্ট চেপে ধরলো, শুভ্রের বুকে মাথা রাখতেই হিয়া শুভ্রের হৃদ কম্পন অনুভব করতে পারলো। প্রচন্ড গতিতে শুভ্রের হার্ট বিট করছে।
বাস চালক ব্রেক কষে জানালা দিয়ে মাথা বের করে কড়া গলায় বললো,” এমন রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করেন কেন? যত্তসব,পরে দুর্ঘটনা হইলে তো ড্রাইভারের দোষ।” বলেই তিনি বাস স্টার্ট দিলেন।
বাস চালকের এমন উক্তিতে হিয়ার হুস ফিরল। হিয়া শুভ্রের বুক থেকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো। শুভ্র চোয়াল শক্ত করে রাগে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। শুভ্র হিয়ার দুই বাহু শক্ত করে ধরে ধমক দিয়ে বললো,” তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? এভাবে কেউ রাস্তার মাঝে দৌড়ায়?”, হিয়া মাথা নিচু করে রইলো কোনো উত্তর দিলো না খালি একবার ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চিপা গলিটার দিকে তাকালো। হিয়ার এই তাকানোতেই শুভ্র সবটা বুঝে গেলো। শুভ্র সেদিকে তাকালো কিন্তু আসে পাশে কাউকে দেখলো না।
শুভ্র আরো রেগে গিয়ে বললো,” গাড়ি পাঠিয়েছিলাম না। এতো কিসের জেদ তোমার?”
এতক্ষণে প্রভা গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এলো। প্রভাকে দেখে হিয়া শুভ্রের শার্ট ছেড়ে কিছুটা পিছিয়ে দাড়ালো। এর মাঝেই শুভ্র আবার ধমক দিয়ে বললো,” চুপ চাপ দাড়াও। এক পাও নড়বে না।”
হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। হিয়ার ভয় লাগছে। এমন রেগে আছে কেনো লোকটা? হিয়ার কেমন জানি লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরটা কাপছে, পায়েও প্রচুর ব্যাথা হচ্ছে। দাতে দাত চিপে সে ব্যাথা সহ্য করছে হিয়া।
প্রভা এগিয়ে এসে বলল,” কি হয়েছে? হিয়া তুমি ঠিক আছো?” বলেই শুভ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলো শুভ্রের রক্তিম চেহারা।এসব ব্যাপারে শুভ্র একটু বেশি রাগী। শুভ্র যদি হাতের কাছে ছেলেগুলোকে পেতো তাহলে প্রথমে মেরে হাড় ভেঙ্গে তারপর নিজেই ব্যান্ডেজ করে বাড়িতে পাঠাতো।
শুভ্র তো এমনই রাগী। প্রভা এগিয়ে গিয়ে হিয়ার হাত ধরে ওকে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতেই হিয়া এক পা ফেলেই ব্যাথায় আর্তনাদ করে, আবার ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করলো।
প্রভা বললো,” তুমি কি ব্যাথা পেয়েছো কোথাও? ওরা কি কিছু করেছে?” তারপর পাশেই একটা বেঞ্চ দেখতে পেয়ে হিয়াকে সেখানে বসালো। তারপর প্রভা ভালো করে দেখলো হিয়ার হাতে চাপের দাগ পরে গেছে। কেউ শক্ত করে ধরলে যা হয়।
হিয়া পায়ে হাত দিয়ে ব্যাথায় নাক মুখ কুচকে আছে। উফফ অসহ্য এই ব্যাথাটা আবার শুরু হয়েছে। শুভ্র কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে নিশ্চুপে তাকিয়ে থেকে নিজের শার্টের হাতা ভাজ করে এগিয়ে এসে হিয়াকে কোলে তুলে নিতেই, হিয়া হকচকিয়ে উঠলো। ভরা রাস্তায় লোকটা কি করছে? হিয়া লজ্জায় মাথা নামিয়ে বললো,” নামান আমাকে, মানুষ দেখছে।”
শুভ্র হিয়ার দিকে একবার রাগী চোখে তাকাতেই হিয়া চুপ করে থেকে নিজের মুখটা শুভ্রের শার্টে লুকিয়ে ফেললো। আশেপাশের অনেকেই হা করে তাকিয়ে দেখছে, ব্যাপারটায় যেনো তারা খুব মজা পাচ্ছে।
প্রভা সেই মানুষের ভিড়ে দাড়িয়ে আছে নিশ্চুপে। হটাৎ কেমন একটা অদৃশ্য ব্যাথা তার শরীরে বয়ে যাচ্ছে। ব্যাথাটা আরো তীব্র হলো যখন শুভ্র হিয়াকে প্রভার জায়গায় বসালো। সময় যেনো সেইখানেই থমকে গেছে প্রভার। শুভ্র ড্রাইভিং সিটে বসার আগে প্রভাকে খুঁজলো কিন্তু হটাৎ প্রভা এই ভিড়ের মাঝে নেই। তাহলে কি প্রভা চলে গেছে।
শুভ্র ড্রাইভিং সিটে বসে একবার হিয়ার দিকে তাকালো। ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে মাথা নুইয়ে আছে সে। শুভ্র গাড়ি থামতেই হিয়া চোখ খুললো। তারপর বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। এইটা তো বাসা না, ক্লিনিক। হিয়া কৌতূহল চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো ততক্ষনে শুভ্র গাড়ি থেকে নেমে গেছে। হিয়া চুপ চাপ শুভ্রের কান্ড দেখছে। শুভ্র কিছুক্ষণ পর এসে হিয়ার পাশের দরজাটা খুললো। দরজা খুলে বের হতে গিয়ে দেখলো শুভ্র একটা হুইলচেয়ার সামনে এনে রেখেছে। হিয়া হকচকিয়ে তাকালো তারপর বললো,” এটা এনেছেন কেনো? আমি এটাতে বসবো না। আর ক্লিনিকেও যাবো না।”
শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” তুমি যাবা না তোমার ঘাড় যাবে।”
” নিয়ে যান। আমার ঘাড় নিয়ে যান কিন্তু আমার পা যাবে না।”, আসে পাশে তাকিয়ে বললো হিয়া।
শুভ্র ধমকের সুরে বললো,” সাট আপ।”
হিয়া হুইলচেয়ারে বসতে একদম পছন্দ করে না। এর আগেও তাকে বসতে হয়েছে। আর সে তো হাঁটতে পারে তাহলে কেনো হুইচেয়ারে যাবে। হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” ধমক দিয়ে কাজ হবে না। আমি হুইলচেয়ারে করে যাবো না, ব্যাস।”
” বসতে বলেছি। নাহলে সবার সামনে কোলে তুলে নিবো।”,বলেই শুভ্র এগিয়ে আসতেই হিয়া ফট করে হুইলচেয়ারে বসে পড়লো। এই ছেলের কোলে বসার তার কোনো শখ নেই। যে ভরা রাস্তায় কোলে নিতে পারে সে যে এইখানে নিবে না তার কি গ্যারেন্টি!
[ #চলবে ]
আজ গল্পের পনেরো পার্ট সম্পূর্ন করলাম। মাঝখানে কোনো গ্যাপ দেই নি। কিন্তু আমার একটু বিরতি প্রয়োজন গল্পটা নিয়ে ভাবার জন্যে। তাই কালকে গল্পটা দিবো না। আমার পাঠক পাঠিকারা প্লীজ রাগ করবেন না। 🥺