নীলচে_তারার_আলো #নবনী_নীলা #পর্ব_২৫

0
147

#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৫

শুভ্র তার প্রিয়দর্শিনীর লজ্জায় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে আরেকটু কাছে এসে বললো,” এরপর থেকে মনে রাখবে। শুভ্রনীল আহমেদ, তোমার হাসব্যান্ড।”
কথাটা শুনতেই হিয়ার শরীর শিউরে উঠলো। শুভ্র চোখে হাসলো তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,” তোমার পায়ে এমনিতেই সমস্যা আছে। তাই চুপচাপ রেস্ট নাও।”,বলেই শুভ্র তোয়ালে নিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো।

হিয়া এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। শুভ্র ওয়াশরুমে যেতেই ফট করে চোখে খুলে নিজের দুই গাল স্পর্শ করলো। গাল দুটো দিয়ে তাপ বের হচ্ছে। শুভ্র এই কয়েক মিনিটে যা করলো সেই ঘোর থেকে হিয়া এখনো বের হয়ে আসতে পারেনি। শুভ্র তাকে কিস করেছে? আবার বলেছে শুভ্রনীল আহমেদ তার হাসব্যান্ড মনে রাখতে। লোকটা কি তাকে পছন্দ করে? কথাটা ভাবতেই গাল দুটো আরেক দফায় লাল হয়ে গেছে। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে আছে। যেনো অনুভূতির এক ঘূর্ণিঝড় তার মাঝে বয়ে গেলো। কিন্তু তাকে কেনো পছন্দ করবে এই বদমাইস ডাক্তার?
প্রথম থেকে তাকে দেখলেই তো রেগে আগুন হয়ে গেছে। এখন আবার বলছে হাসব্যান্ড। কথাটা কি এমনেই বললো? তাহলে কি কিস……. না না আর ভাবা সম্ভব হচ্ছে না। পালাতে হবে। আজ রাত এই ডাক্তারের সাথে থাকলে নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাবে সে।

হিয়া সুযোগ বুঝে নিজের রূমে চলে গেলো। গিয়েই দরজা আটকে ফেললো। হিয়া কখনো রুমে দরজা আটকায় না ভয় লাগে কিন্তু আজ সে সব কিছু পরোয়া করে না সে।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখে হিয়া রুমে নেই। দরজাটাও খোলা, বাঁদরটা পালিয়েছে। হিয়ার এমন ছেলে মানুষী দেখলে সত্যি রাগ হয়। পায়ে এমনেই সমস্যা তাও একটু সাবধানে থাকতে পারে না। ঘুরে ফিরেই পায়েই বার বার চোট পেতে হয় মেয়েটার। রাগ দেখালে তো আবার সে খারাপ। কিন্তু নিজে যে সবসময় বাচ্চাদের মতন জেদ করে সেটা বুঝতে পারে না।

শুভ্র কাবাড খুলে বাদামি রঙের একটা টি শার্ট পড়লো তারপর নিজের বিছানায় তাকাতেই দেখলো একটা নূপুর পরে আছে। শুভ্র এগিয়ে এসে নূপুরটা হাতে নিলো। এই যে বাঁদরটা ফেলে গেছে পরে হারিয়ে গেলে তো আবার কেদে কেটে অস্থির হয়ে যাবে। শুভ্র নুপূরটা ট্রাউজারের পকেটে রেখে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

হিয়ার ঘরের দরজা বন্ধ, শুভ্র জানে তার ভয়েই দরজা বন্ধ করে বসে আছে সে। হিয়া যে কেনো শুভ্রকে এতো ভয় করে শুভ্র ভেবে পায় না। কবে যে এই মেয়ের ভয় দূর হবে?শুভ্র চাইলে এক্ষুনি তুলে নিজের রুমে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কি লাভ! নিয়ে এলে তো সেই জড়সড় হয়ে বসে বসে বির বির করবে।

শুভ্র এই মেয়ের প্রতি কিভাবে যে এতটা দুর্বল সে নিজেও জানে না। হিয়া কখন যে শুভ্রের নিজের হয়ে গেছে শুভ্র টের পর্যন্ত পায় নি। নিজের কাছের মানুষদের প্রতি শুভ্রের ভালোবাসার অভিব্যক্তি আলাদা। সে পারে না অন্য সবার মতো নিজের ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করতে। ভালোবাসা কি মুখে বলার জিনিস? সেটা তো একটা অনুভুতি। যাকে তুমি ভালোবাসো সে যদি তা অনুভবই না করে তাহলে তোমার সেই ভালোবাসা কি ব্যার্থ নয়?

শুভ্র সিড়ি বেয়ে নীচে এলো। সন্ধার পর থেকে রায়হানের হদিস নেই। ফোন নাকি ধরছে না এই নিয়ে রাবেয়া ফুফুর হইচই শুরু হয়েছে। ছেলেটা তার এমনই, ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ফটোগ্রাফিতে ব্যাস্ত।মাসের পর মাস ছেলের খোজ পায়না। পাহাড় জঙ্গল ঘুরে বেড়ায়। নেটওয়ার্ক থাকে না। ছেলে বিয়ে দেওয়ার পাগলামিটা এই মায়ের ক্ষুদ্র একটা চেষ্টা ছিলো, ছেলেকে মাসে মাসে হয়তো চোখের দেখা দেখতে পারবেন এই আশায়। ছোটো ছেলেটা তার বড্ড আদরের।

শুভ্র চুপ করে আছে। গ্রিকের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার এর পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রায়হান। এইটা রায়হানের ক্যারিয়ারের বড় একটা সুযোগ সে নিশ্চয়ই সেসব ছেড়ে মিথ্যে এক খেলায় নামবে না। শুভ্রের সবটা জানা ছিলো। তাই ঠান্ডা মাথায় সবটা হ্যান্ডেল করেছে সে। কিন্তু ফ্লাইট তো দুদিন পর তাহলে রায়হান এখন কোথায়? ফুফুকে কি কিছুই জানায় নি সে?

শুভ্র ফুফুর বিপি চেক করে, আপাদত ঘুমের ওষুধ দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। এই বয়সে তার ফুফুকে কম কষ্ট করতে হয় নি। শেষ বয়সটা মহিলা একাই কাটাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো কে কাছে পাচ্ছে না। সবাই বিদেশে সেটেল হয়ে গেছে। আর ফুফার বয়স হয়েছে। তিনি তার সূর্যের হাসি ক্লাব নিয়েই ব্যাস্ত থাকার চেস্টা করেন। সকাল সকাল ব্যায়ামে বের হয় সবাইকে নিয়ে। আর ফুফুর চিন্তায় চিন্তায় দিন কাটে। শুভ্র দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেললো। ফুফুকে এইভাবে কষ্ট পেতে দেখে খারাপ লাগছে তার।


সকালে শুভ্র অনেকবার প্রভাকে কল করেছে। সেই যে অ্যামিউজডমেন্ট পার্কের দিন দেখা হয়েছে তারপর না কোনো কল না কোনো ম্যাসেজ। অসুস্থ হয়ে গেলো নাকি। মেডিক্যাল থেকে শুভ্র সোজা প্রভাদের বাসায় এলো। প্রভা খুব নরম মনের মেয়ে। অল্প কিছুতে খুব ভেঙে পরে এই মেয়ে। কি হয়েছে কে জানে?

প্রভা নিজের রুমে ঘুমিয়ে ছিল। কড়া ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে সে। তাই এতো বেলা অবধি তার ঘুম হয়। ঘুম থেকে উঠতেই কাজের মেয়ে সুমি এসে বললো শুভ্র ভাইয়া এসেছে। প্রভা ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। শুভ্র ড্রয়িং রুমে বসে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো। সামনে চা নাস্তা দেওয়া। প্রভা স্বাভাবিক ভাবেই বেড়িয়ে এলো। এসে শুভ্রের সামনের চেয়ারে বসলো। প্রভার চোখ মুখের অবস্থা ভয়াবহ। শুভ্র চিন্তিত হয়ে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।

প্রভা হাসার চেষ্টা করলো তারপর বললো,” কি ব্যাপার? তুই হটাৎ আমার বাসায়?”

শুভ্র প্রভার এমন হাল এর আগে দেখেনি। ইমনের সাথে ব্রেকআপের পরো প্রভার এমন অবস্থা হয় নি। শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” কি হয়েছে তোর? এমন হাল করেছিস কেনো?”

প্রভা উত্তরে হাসার চেষ্টা করলো। তারপর বললো,”কিছু হয় নি। এমনেই ভালো লাগছে না। আসলে যেটা আমার না সেটা আকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। ভুলটা বুঝতে পেরেছি তাই নিজেকে সামলে নিচ্ছি।”

” সাহিত্যিক হয়ে গেলি কবে? যাই হোক ফোন ধরিস নি কেনো?”,রেগে বললো শুভ্র।

” আমি না একা থাকতে চাই। ভালো লাগছে না কিছু। তাই একা আছি।”, ক্লান্ত গলায় বললো প্রভা।

” আচ্ছা, তাহলে আমি আসি।”,রেগে উঠে পড়ল শুভ্র। প্রভাকে এমন অবস্থায় দেখে শুভ্র ধারণা করতে পারছে কড়া ঘুমের ওষুধ খাচ্ছে প্রভা। কি হয়েছে সেটাও বলছে না। শুভ্র জানতেও চাইলো না।

প্রভা সাথে সাথে উঠে দাড়িয়ে বললো,” রাগ করলি? এভাবে চলে যাচ্ছিস কেনো?”

” নাহ্, আসি। তুই রেস্ট নে।”,বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেল।

প্রভা এক দৃষ্টিতে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জীবনের বড় ধাক্কাটা সে পেয়েছে। ইমনের থেকে ধোঁকা পাওয়ার পরো এতটা কষ্ট তার হয়নি। শুভ্র সেই সময়ে যেভাবে প্রভার হেল্প করেছে। এরপর শুভ্ররকে ভালো না বেসে থাকতে পারলো না।

সেদিন শুভ্র আর হিয়াকে এতটা কাছাকাছি দেখে নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে প্রভা। যে শুভ্রের ধারে কাছে কোনো মেয়ে ঘেঁষতে পারতো না। যখন সেই শুভ্র কোনো মেয়েকে কাছে টেনে নিচ্ছে তার মানেটা অনেক আগেই হয়তো বোঝা উচিত ছিলো। ভুলটা তো তার। শুভ্র ভীষণ রাগী এই যে রাগ করে চলে গেলো। এই রাগ জমে অভিমান হবে। তারপর দুরত্ব বাড়বে।

✨ দিবার আজ ভীষণ মন খারাপ। তাকে এইবার এই বড় বাড়িতে বাবার সাথে থাকতে হবে। দিদি চলে যাচ্ছে গ্রামের বাড়িতে। এই ভয়েই ছিলো সে। হিয়া দিবার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলো কিন্তু দিবা বললো না। হিয়া জোর করতেই দিবা কেদে ফেললো। তারপর সবটা বললো।

হিয়া সবটা শুনে চুপ করে রইলো। পরক্ষণেই মনের কোণে একটা প্রশ্ন জাগলো। প্রভা শুভ্রকে নিজের মনের কথা কেনো জানালো না? যদি জানতো তাহলে কি শুভ্র তাকে ছেড়ে দিতো? জীবনের এই গণিত সে মিলাতে পারছে না। সবটা এতো জটিল কেনো?

প্রভা ট্রেনে বসে, জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। এই শহরে সে আর ফিরবে না। শেষবারের মত শুভ্রের সাথে আর দেখা করা হলো না। শুভ্রের সাথে তার আর দেখা হবে না কোনোদিন। এই শহরে থাকলে সে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। একা থাকা প্রয়োজন, সবটা ভুলে যেতে হবে।

গ্রামে গিয়ে সেইখানে একটা ক্লিনিক খুলবে গরীব মানুষগুলোর সেবা করেই সে কাটিয়ে দিবে বাকিটা জীবন। শুভ্রের কন্ঠটা শেষবারের মতন খুব শুনতে ইচ্ছে হলো। কাপাকাপা হাতে প্রভা শুভ্রের নাম্বারে কল করলো। তিনবার রিং হতেই শুভ্র ফোনটা ধরলো। ধরে হেলো বলতেই প্রভা ফোনটা কেটে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র আবার কল ব্যাক করলো। কিন্তু প্রভা তা কেটে দিয়ে সিমটা খুলে ফেললো।

তারপর ট্রেনের জানালা দিয়ে সেটা বাহিরে ফেলে দিলো। অঝোরে কান্না করতে লাগলো সে। শুভ্রকে তো বলাই হলো না সে তাকে কতটা ভালোবাসে। অবশ্য এখন বলার সুযোগটাও সে হারিয়ে ফেলেছে। হয়তো আরো আগে বলা উচিৎ ছিলো। কিন্তু সময় যে তাকে ফেলে অনেকটা পথ পার করে এসেছে।

প্রভার ফোন না ধরায় শুভ্র রেগে ফোনটা একপাশে রেখে দিলো। কিন্তু এই রাগী শুভ্রের তো জানাই হলো না, শান্ত নিশ্চুপ এই মেয়েটি তাকে কতোটা ভালোবেসেছিলো।

শুভ্রের তো এমনটাই পছন্দ যে, ভালোবাসা অনুভবে রবে। তবে কি এটা প্রভার ব্যার্থতা যে সে শুভ্রকে বোঝাতে পারে নি। সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। কিন্তু অপূর্ণ ভালোবাসার গল্পগুলো আমাদের কারোর জানা হয় না। সেগুলো শুধু অনুভবেই রয়ে যায়।

[ #চলবে ]

আমি একটু অসুস্থ তাই পার্টগুলো ছোট হচ্ছে। আজ আবার নেট ছিলো না সন্ধ্যা থেকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here