#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_২৬
নূপুরটা কয়দিন হলো হিয়া খুজেই পাচ্ছে না। আজ নিজের পুরো রুমটা ওলোট পালোট করে ফেলেছে সে। নূপুরটা তার বাবার দেওয়া। এটা সে হারিয়ে ফেললো কিভাবে? হিয়া ব্যাস্ত হয়ে সব জায়গায় খুঁজছে। আর ম্যারি চারিদিকে লাফাচ্ছে।
শুভ্র বইয়ের জন্যে সবে মাত্র রুমটায় ঢুকেছে। রূমের অবস্থা দেখেই থমকে গেছে। এই অবস্থা কেনো তার লাইব্রেরী রূমের। হিয়া ফ্লোরে শুয়ে বুকশেলফের নিচে নূপুরটা পড়েছে কিনা সেটা দেখতে ব্যাস্ত,হাতে ফোনের টর্চ।
শুভ্র ভ্রূ কুচকে বললো,” ফ্লোরে শুয়ে কি করছো তুমি?”
হটাৎ শুভ্রের আওয়াজ শুনে হিয়া ধড়ফড়িয়ে উঠতে গিয়ে কাঠের সাথে ঠাস করে একটা বাড়ি খেয়ে মাথায় হাত দিয়ে ব্যাথায় নিচেই শুয়ে রইলো। শুভ্রের উপর এইবার রাগ লাগছে। এখনই আসতে হলো এই হনুমানটাকে? মাথাটা মনে হচ্ছে ফেটে গেছে।
ব্যাথা পেয়েছে কোথায় উঠে বসবে তা না মুখ ফুলিয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে। শুভ্র হিয়ার সামনে এসে বুকের কাছে হাত ভাজ করে দাড়ালো। হিয়া আড় চোখে একবার শুভ্রের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।
শুভ্র হাত বাড়িয়ে মাথার উপর রাখা হিয়ার হাতটা ধরে ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে প্রথমে মাথাটা ধরে কাছে আনলো। তারপর মাথাটা এপাশ ওপাশ করে দেখলো ঠিক আছে কিনা।
হিয়া মুখ কালো করে শুভ্রের দুই হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,” মাথাটা কি ঘাড় থেকে খুলে নিতে চাচ্ছেন?”
শুভ্র হাত দুটো পকেটে ভরে একবার পুরো রুমটায় নজর দিতেই হিয়ার টনক নড়লো। এইবার তো তার খবর আছে। এই লোকটা তাকে একশো একটা কথা শুনাবে রূমের এই অবস্থার জন্য। শুভ্র কিছু বলার আগেই হিয়া ফট করে বলে উঠলো,” আমি আপনার বুকশেলফের একটা বই ও কিন্তু সরাই নি। একদম আমাকে রাগ দেখাবেন না।”
শুভরে মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে রুমটার এই অবস্থায় সে খুবই বিরক্ত। শুভ্র সে সব বাদ দিয়ে বললো,” এতো ব্যাস্ত হয়ে কি খুঁজছো?”
প্রশ্নটা শুনেই হিয়ার মন খারাপ হয়ে গেলো। হিয়া মন খারাপ করে বললো,” আমার নূপুর হারিয়ে ফেলেছি। এক পায়ে আছে অন্য পায়ের টা খুজে পাচ্ছি না।”
শুভ্র জানতো নূপুর হারিয়ে এই বাঁদরটা এমনই করবে। সে ইচ্ছে করেই নূপুরটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এবার সাড়া বাড়ি খুঁজে বেড়াও। হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। দেখে তো মনে হচ্ছে নুপূর হারিয়ে ফেলায় লোকটা খুব খুশি হয়েছে। হিয়া কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,” আমি নুপূর হারিয়ে ফেলায় আপনি খুব খুশি হয়েছেন তাই না? এটাই তো আপনি চেয়েছিলেন। আপনার কারণে আমি নুপূরটা হারিয়েছি। আপনার…আপনার নজর লেগেছে।”
শুভ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,” শাট আপ। জলদি এই রুমটা ঠিক করো। দেখে তো মনে হচ্ছে এই রুমে গরিলা অ্যাটাক করেছে।” বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে চলে এলো শুভ্র। হিয়ার নুপূরটা যেই প্যান্টের পকেটে ছিলো মা কোনো ভাবে সেই প্যান্ট ধোপার কাছে দিয়ে দেয় নি তো? শুভ্র ব্যাস্ত হয়ে নিজের কাবাড খুললো।
হিয়ার কেনো জানি মনে হচ্ছে নুপূরটা সে শুভ্রের রুমেই হারিয়েছে। তার সব জিনিস তো এই হনুমানের রুমেই হারায়। এই দুষ্টু ম্যারিটা সুযোগ পেলেই হনুমানের ঘরে হানা দেয়। ভেবেই কড়া চোখে ম্যারির দিকে তাকালো। ম্যারির কি? সে তার ছোট্ট লেজটা দেখিয়ে বসে আছে।
হিয়া আস্তে করে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে শুভ্রের রুমে উকি দিলো। শুভ্র নিজের কাবাডে কি করছে এতো মনোযোগ দিয়ে। অনেক খোজার পর শুভ্র সেই প্যান্টটা খুজে পেলো। পকেটে খুঁজতেই নুপূরটাও পেলো। নুপূরটা হাতে নিতেই হিয়া দরজার বাইরে থেকে দেখলো। দেখেই সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বললো,” এইটা আমার নুপূর।” বলেই ছুটে রূমের ভিতরে চলে এলো।
হিয়ার আওয়াজ কানে আসতেই শুভ্র সঙ্গে সঙ্গে কাবাডটা বন্ধ করে ফেললো। ততক্ষনে হিয়াও রূমের ভিতরে হাজির। হিয়ার মেজাজ ভালোই গরম হয়েছে। লোকটা তার নূপুর লুকিয়ে রেখেছে কেনো? সমস্যা কি তার।
শুভ্র কড়া গলায় বললো,” তুমি আমার রুমে এসেছো কেনো?”
” আপনি আমার নূপুর নিয়েছেন কেনো?” প্রশ্নের জবাবে প্রশ্ন ছুড়লো হিয়া। শুভ্র এগিয়ে আসতে আসতে বললো,” হোয়াট ননসেন্স? তোমার নূপুর আমি নিতে যাবো কেনো?”
শুভ্রের এইভাবে এগিয়ে আসতে দেখে হিয়া পিছাতে পিছাতে বললো,” আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনার হাতে আমার নূপুরটা ছিলো।”
” তুমি কি চোখে দূরবীণ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াও?”, ভ্রূ কুচকে বললো শুভ্র।
” হ্যা, আমার চোখ দূরবীণ। আপনার মতন চশমা পড়া লাগে না আমার।”,মুখ বাঁকিয়ে বললো হিয়া।
” তোমার মনে হচ্ছে না তুমি বেশি কথা বলছো?”, কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র।
” আমি জানি না। আমার নুপূর আমাকে ফেরত দিন।”, কথাটা শেষ না করতেই হিয়া পিছনের বিছানায় পরে যেতে নিলে শুভ্রের শার্টের কলার চেপে ধরে নিজেকে সামলে নিলো। পরক্ষণেই দেখলো শুভ্র হিয়ার দুই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। পড়ে যাওয়ার ভয়ে হিয়া যে শুভ্রের শার্ট চেপে ধরেছে সেটা বুঝতেই পারে নি। শুভ্রের চোখে চোখ পড়তেই হিয়ার বুকের ভিতরটায় ড্রাম বাজাতে লাগলো। হিয়া চোখ বন্ধ করে শার্টের কলার ছেড়ে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে বিছানায় পড়ে গেলো। পড়েই হিয়া চোখ বন্ধ করে রাখলো। তারপর চোখ খুলতেই দেখলো শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
কেমন জামাই এইটা? আবার বলে আমি তোমার হাসব্যান্ড মনে রাখবে। পড়ে গেছি একে তো ধরলো না এখন আবার তাকিয়ে আছে হাত টা বাড়িয়ে দিবে তা না। হিয়া রেগে বললো,” আপনি আমাকে ধরলেন না কেনো?”
শুভ্র হিয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলাতেই হিয়া চটপট উঠে পড়লো। অসভ্য একটা লোক। হিয়া রাগে ফুলতে ফুলতে বললো,” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো? আমার নুপূরটা আমাকে ফেরত দিন।”
” তোমার নুপুর আমি কেনো আমার কাছে রাখবো? আর ইউ ম্যাড?”, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললো শুভ্র।
হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো তারপর বললো,” তবে যে আমি আপনার হাতে নুপুর দেখলাম?”
” ভুল দেখেছো।”, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো শুভ্র। হিয়া এইবার সত্যি কনফিউজড হয়ে গেছে। তাহলে কি সে ভুল দেখেছে? নূপুর দেখলো তো সে। ধুর বাবা! কি একটা অবস্থা।
হিয়া আড় চোখে একবার তাকিয়ে বললো,” আমি আপনার কাবাডটা একবার খুলে দেখি।” সহজ মনে প্রশ্ন করতেই শুভ্রের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নজরে পড়লো। হিয়া ফট করে উঠে পড়ল তারপর ঘাবড়ে গিয়ে বললো,” থাক। থাক, চলে যাচ্ছি এইভাবে তাকাতে হবে না। তবে আমি নুপুর দেখেছি আপনার হাতে আর আমি সিউর ঐটা আমার নূপুর। আমি তো ঐটা নিয়েই ছাড়বো।”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে কি বলেছে সে নূপুর তাকে কোনোদিন দিবে না। সবকিছুতেই ঝগড়া করতে হবে এই মেয়ের।
✨ দুপুরের পর রায়হানের হটাৎ এমন আগমন সবাইকে অবাক করলো। সবচেয়ে বেশি অবাক করলো শুভ্রকে। আজকে তো রায়হানের ফ্লাইট ছিলো কিন্তু সে এইখানে কেনো? রায়হান প্রথমে এসেই এই বিয়েটা ভেঙে দিলো। তখন থেকে তার মায়ের সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। হিয়া এইসব থেকে দূরে সরে আছে।
রায়হানকে দেখে সে নিজের রূমে চলে এসেছে। নিচে কি হচ্ছে না হচ্ছে তার কোনো ধারণা নেই। কেনো জানি অকারনেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার। ম্যারিকে কোলে করে বসে আছে সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হিয়ার দরজায় নক পড়লো। হিয়া চমকে তাকালো। রায়হান দাড়িয়ে আছে মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি। হিয়া একটা ঢোক গিললো। রায়হান এগিয়ে এসে বললো,” ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিয়েটা ভেঙে গেছে। আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে না।”
হিয়া কি করবে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। হিয়া ম্যারিকে কোলে করে উঠে দাড়ালো। তারপর চুপ করে রইলো। রায়হান হাসলো, তারপর বললো,” আমি কিন্তু তোমার থেকে একটা জিনিস ফেরত নিতে এসেছি।”
হিয়া একটা ঢোক গিললো। কাপা কাপা কণ্ঠে বললো,” মানে?”
রায়হানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,” আমার নিজেকে বড্ড একা লাগছে। কাউকে খুব প্রয়োজন।”, এতটুকু শুনেই হিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে।
রায়হান থেমে বললো,” তোমাকে তো আমি আর চাইতে পারবো না। ম্যারিকে নিতে এসেছি।”
বলেই ম্যারির দিকে ঈশারা করতেই ম্যারি হিয়ার কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো। হিয়া ম্যারিকে আটকানোর সুযোগও পেলো না। হিয়া ছল ছল চোখে বললো,” আমি কি ওকে রাখতে পারবো না?”
রায়হান মায়ার চোখে তাকালো। তারপর বললো,” অ্যাম সরি , ভালো থেকো।” বলেই রায়হান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। যেতে যেতে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো সে। একটু এগিয়ে যেতেই সামনে শুভ্রের মুখোমুখি হলো। শুভ্রকে দেখে থেমে গিয়ে বললো,” কেমন আছিস?”
শুভ্র সেই প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে বললো,” তুই ফ্লাইট ছেরে কি করছিস এইখানে?”
” ফ্লাইট? ছেড়ে দিতাম। যদি হিয়া তোকে ছেড়ে দিতো।”, ব্যাথিত সুরে হাসি মুখে কথাটা বললো রায়হান। তারপর আরো বললো,” আজ রাতেই ফ্লাইট।”
“ফুফু জানে?”, গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো শুভ্র।
” নাহ্, মাকে জানাই নি। পৌঁছে কল করবো।”
শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ম্যারির দিকে তাকালো। তারপর বললো,” ওকে নিয়ে যাচ্ছিস?”
” হ্যা, কেনো রেখে যাবো? তাহলে তুই ওকে রেখে দে। আমি হিয়াকে নিয়ে যাই। রাজি তুই?”,বলেই হাসতে লাগলো রায়হান। শুভ্র কঠিন দৃষ্টিতে তাকালো। রায়হান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” ভালো থাকিস।”,বলেই শুভ্রকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। তারপর শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
রাতে হিয়া কিছু খেলো না। কিছুক্ষণ পর পর শুধু কাদঁছে। ম্যারির জন্যে খারাপ লাগছে তার। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। অনেক জোর করেও কেউ কিছু খাওয়াতে পারেনি তাকে।
সকালে ঘুম ভেঙে এমন এক চমক দেখতে পাবে হিয়া ভাবতেও পারে নি। তার ঘরে ছোট্ট এক কুকুরছানা। একদম সাদা পমেরিয়ান। এমন কুকুর নিয়ে সে অনেক পড়েছে, খুব আগ্রহ ছিলো তার এই কুকুর নিয়ে। হিয়ার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ঘুম থেকে উঠে এমন কিছু সে আশা করেনি। হিয়া লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। এটা কোথা থেকে এলো। কুকুরছানা কে কোলে নিতেই আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো তার। অন্য পায়ে নুপুর এলো কোথা থেকে তার? তাহলে কি শুভ্র রাতে তার রুমে এসেছিল?
[ #চলবে ]
🦋 সবাই কুকুরটার একটা সুন্দর নাম দিয়ে যাও।