#নীলচে_তারার_আলো
#নবনী_নীলা
#পর্ব_৪১
হিয়া ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো শুভ্র শাওয়ার সেরে বেরিয়েছে, শুধু ট্রাওজার পড়ে। গা বেয়ে বিন্দু বিন্দু মুক্তোর মতন পানি পরছে। ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সামনে এসে পড়েছে। হিয়া একটা ঢোক গিলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। উফফ লোকটা এইভাবে বের হয়েছে কেনো? সবাই মিলে তাকে মেরে ফেলার ধান্দা।
হিয়া শুভ্রের দিকে তাকাবে না আর, বইয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হটাৎ পানির বিন্দু টপ করে তার কাধে পড়তেই হিয়া কেপে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকিয়ে দেখে শুভ্র চেয়ার ধরে হালকা ঝুকে এসে তার বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আর পানির এই বিন্দু শুভ্রের চুল বেয়ে হিয়ার কাধে এসে পরেছে।
শুভ্র বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হিয়ার দিকে তাকালো। হিয়াকে এমন হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বললো,” কি দেখছো?” হিয়া সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে ফেললো। তারপর জড়ানো কণ্ঠে বললো,” আপনি এইভাবে দাড়িয়ে থাকলে আমি পড়বো কি করে?”
শুভ্র সরে আসতে আসতে বলল,” ইয়াহ, ক্যারি অন।” শুভ্র সরে দাড়াতেই হিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আজকে তার কিছুই পড়া হয়নি। সারাদিন ওই বুড়ির পিছনে সময় চলে গেছে। মুখে তো এত এত বড় কথা বলেছে কিন্তু করতে না পারলে এই মুখ সে দেখাবে কি করে? হিয়া প্রতিদিনের তুলনায় আরো বেশি সময় নিয়ে আজকে পড়লো। হিয়া টেবিল ছেড়ে উঠে দেখে শুভ্র আজও তার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
হিয়া শুভ্রের পাশে এসে শুয়ে পড়লো। হিয়ার ঘুম আসছে না, চাইলে আরো কিছুক্ষন পড়া যেতো কিন্তু শুভ্র ঘুমিয়ে পড়ায় তার একা একা লাগছে। টেবিল ল্যাম্পের নীল আলোয় শুভ্রের মুখে এসে পড়েছে। হিয়ার খুব ইচ্ছে করছে শুভ্রকে জাগিয়ে তুলে বলে, চলুন রাতের এই শহরের নির্জন রাস্তায় হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এক সাথে হাঁটবো।
কিন্তু আবার মায়াও লাগছে হিয়া এগিয়ে এসে একদম কাছ থেকে দেখতে লাগলো শুভ্রকে। তারপর একটু সাহস করে এসে শুভ্রের গালে একটা কিস করলো। সঙ্গে সঙ্গে শুভ্র চোখ মেলে হিয়ার দিকে তাকালো। হটাৎ শুভ্রকে চোখ মেলতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হিয়া ভয়ে ছিটকে সরে গেলো পরক্ষনেই রক্তিম বর্ন ছেয়ে গেল তার পুরো মুখে।
শুভ্র ভ্রু কুচকে উঠে বসলো, কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। তারপর চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছিল সে। হিয়াকে লজ্জায় জড়সড় হয়ে বসে থাকতে দেখে শুভ্র মনে মনে হাসছে। তারপর ধীরে ধীরে হিয়ার দিকে ঝুঁকে আসতে লাগলো। হিয়া শাড়ির আঁচল খামচে ধরে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। শুভ্র কিছুক্ষণ হিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বললো,” তুমি কি ঐ বৃদ্ধার কথা বেশি সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছো।” হিয়া বিস্ময় নিয়ে চোখ খুললো। তারপর লজ্জায় এদিকে সেদিন তাকালো। শুভ্র এটা কি বললো তাকে? এইবার হিয়ার নিজেকেই মারতে ইচ্ছে করছে কেনো যে সে এই বদ লোকটার কাছে গিয়েছে? লোকটার মুখে যা আসছে সেটাই বলে যাচ্ছে।
হিয়াকে লজ্জা পেতে দেখে শুভ্র আরো বললো,” যদিও বিষয়টা সিরিয়াসলি নিয়ে লাভ নেই, এখন তোমার পড়ার সময়। আর এমনিতেও এই মুহুর্তে আমার পক্ষে দুটো বাচ্চাকে সামলানো সম্ভব না। সো লেট দা মাদার গ্রওন আপ দেন উই উইল টক এবাউট ইট।” বলেই শুভ্র চোখে হাসলো।
হিয়া রাগে চোখ বন্ধ করে করছে। মানে কি বলতে চায় উনি? সে তো একেবারে খুবই অবুঝ বাচ্চা তাই না? তাকে বোঝাচ্ছে। মান সম্মান আর কিছু বাকি রইলো না তারপরও হিয়া ক্ষীণ স্বরে বলল,” একদম আজে বাজে কথা বলবেন না।” তারপর আরো বিড়বিড় করে বললো,” আমি আপনাকে এই মুহূর্ত থেকে বয়কট করলাম। বেশি ভাব দেখায় এই হনুমানটা। নিজের বরকে কিস করেছি, তাতেও তাকে এতো কথা শুনতে হচ্ছে। ঠিক আছে এনার ধারের কাছেও আমি আর যাবো না।” বলেই হুট করে চাদর মুড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে একপাশে শুয়ে পড়লো।
শুভ্র হা হয়ে রইলো, হটাৎ করে কি হলো বিড়ালটার? কোনো প্রতিবাদ করলে না,বেশী লজ্জা পেয়েছে নাকি!
⭐ সকালে শুভ্রের ঘুম ভেঙেছে রোদের কারণে। সকালের রোদটা একদম তার চোখের উপর এসে পরেছে। শুভ্র চোখ মুখ কুঁচকে ঘুম থেকে উঠে বসলো। উঠে বসে বিরক্তি নিয়ে জানালার দিকে তাকালো। পর্দা সরিয়েছে কে? পরক্ষনেই হিয়ার কথা মাথায় আসলো তার। শুভ্র পাশ ফিরে তাকালো, হিয়া নেই। শুভ্রের কপালে একটা ভাজ পড়লো। এই মেয়েকে যা করতে নিষেধ করা হবে সে সেটাই করবে। শুভ্র এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। তারপর বালিশের পাশ থেকে নিজের চশমাটা পরে ফেললো।
শুভ্র নিজের ফোনটা হাতে নিয়েছিলো কয়টা বাজে সেটা দেখবার জন্যে কিন্তু তার আগে শুভ্রের চোখ পড়লো ড্রেসিং টেবিলের দিকে। শুভ্র এগিয়ে এসে আয়নার দিকে তাকালো, তাকাতেই চোয়াল শক্ত করে ফেললো সে। তার মুখে মার্কার দিয়ে গালের দুপাশে বিড়ালের মতোন তিনটা দাগ আর নাকের উপর একটা গোল আকা। শুভ্রর বিষ্ময়ের সীমা রইলো না। শুভ্র ফোনটা একপাশে রেখে বিরক্তি নিয়ে বলল,” হোয়াট ননন্সেন্স? আচ্ছা এই জন্যে তাহলে সকাল সকাল ঘর ছেড়ে পালিয়েছে!”
শুভ্র চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে এলো। হিয়া রান্না ঘরেই ছিলো শুভ্রের উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসলো সে। আচ্ছা শিক্ষা দিয়েছে এই হনুমানটাকে। যদিও বিড়াল একেছিলো কারণ হনুমান কিভাবে আকে সে জানে না। জানলে ঠিকই হনুমান বানিয়ে আসতো।
হিয়ার একপাশে সাহারা খাতুন অন্যপাশে রহিমা খালা। হিয়ার মতে সে একটা সেফ জায়গায় আছে এতো চিন্তার কোনো কারণ নেই। এই লোকটা তার ধারের কাছেও আসতে পারবে না। শুভ্র এগিয়ে এসে তার মাকে কিছু একটা বলতেই সাহারা খাতুন চিন্তিত মুখে দোতলায় উঠে গেলো। হিয়া আড় চোখে তাকালো, কি বললো লোকটা?
শুভ্র আস্তে আস্তে এগিয়ে আসলো তারপর রহিমা খালাকে বলল,” খালা আমার কাপড়গুলো আয়রন করা হয়নি। আমি ক্লিনিকের জন্যে বের হবো, একটু জলদি লাগবে।”
হিয়া কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সব জামা তো আয়রন করাই আছে। আবার কিসের জামা আয়রন করবে রহিমা খালা। রহিমা খালা ব্যাস্ত হয়ে উপরে উঠে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে হিয়ার বুক ধুক করে উঠলো। সবটা শুভ্রের চালাকি বুঝতে পেরেই হিয়া আড় চোখে তাকালো। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার পাশে দাঁড়ালো। তারপর এক দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,” রূমে এসো। রাইট নাও ”
হিয়া শুভ্রের দিকে তাকালো পর্যন্ত পা টিপে টিপে এক কোনায় চলে গেলো। তারপর নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। হিয়া শুভ্রকে এড়িয়ে যাওয়ায় শুভ্রের রাগ আরো বাড়লো।
হিয়া চিনির বক্সটা নেওয়ার জন্যে পায়ের পাতায় ভর করে হাত উচু করলো। তারপর অনেক কষ্টে বক্সটা নামালো। তারপর চায়ে চিনি দিয়ে বক্সটা উপরে রাখতে যাবে শুভ্র হাত বেড়িয়ে বক্সের ঢাকনা খুলে নিতেই হিয়ার সারা গা চিনিতে ভরে গেছে। হিয়া শুভ্রের এমন ব্যাবহারে দাতে দাত চেপে রাগ সামলালো। শুভ্র বক্সের ঢাকনা একপাশে রেখে নিজের রুমে চলে গেল।
হিয়ার রাগে গা জ্বলছে। অসভ্য লোক একটা। সব সময় যা বলবে সেটাই করতে হবে তার।
রহিমা খালা কোনো জামা না পেয়ে ফিরে এলেন। এসে হিয়ার এই অবস্থা দেখে বললো,” ওমা ওমা, কি হইসে? ব্যাথা পাইলা নাকি?”
হিয়া গা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,” কিছু হয় নাই খালা।তুমি একটু থাকো আমি আসছি।” বলেই হিয়া কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। সারা গা চিটচিটে করছে। অসভ্য ডাক্তার একটা। হিয়া ভ্রু কুঁচকে রুমে এলো। শুভ্রের চোখে বিজয়ের হাসি। শেষমেষ লোকটার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে রুমে আসতেই হলো। হিয়ার রাগে ফুলতে ফুলতে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। তোয়ালে নেওয়ার সময় হিয়া নিজের জামা নিতে ভুলে গেছে। শুভ্র বিষয়টা খেয়াল করে ঠোঁট চেপে হাসলো।
হিয়া অনেক্ষন সময় নিয়ে গোসল করলো। গোসল ছেড়ে বের হয়ে যেনো তাকে শুভ্রের মুখোমুখি না হতে হয়। হিয়া গোসল সেরে বুঝতে পারলো সে কাপড়ই আনে নি। কি ভয়াবহ অবস্থা! যদিও হিয়ার কেনো জানি মনে হচ্ছে এতোক্ষণে শুভ্রের যাওয়ার সময়ে হয়ে গেছে। হয়তো বেরিয়েও পড়েছে। হিয়া দরজা হালকা খুলে পুরো রুমটায় চোখ বুলিয়ে নিলো। নাহ্ নেই, উফফ বাঁচা গেছে। হিয়া তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়ে এলো। চুল বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। হিয়া রুমে এসেই দরজাটা বন্ধ করে ফেললো।
তারপর কাবাড খুলে ড্রেস বের করে পিছনে ঘুরতেই দেখলো শুভ্র নিচের স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়ার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। সে তো দড়জা আটকে দিয়েছিলো তাহলে শুভ্র কি করে ভিতরে এলো। তাহলে কি শুভ্র বারান্দায় ছিলো?
হিয়া একটা ঢোক গিলে কাবাডের সাথে মিশে দাড়িয়ে রইলো। শুভ্র আস্তে আস্তে হিয়ার দিকে এগিয়ে আসতেই হিয়ার বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো। শুভ্র হিয়ার কাছে এসে ঝুকে দাড়ালো। হিয়া তোয়ালে শক্ত করে ধরে মাথা নিচু করে রইলো। শুভ্র দূরত্ব কমিয়ে হিয়ার কাছে চলে আসতেই হিয়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। শুভ্রের তপ্ত নিশ্বাসে তার শরীর শিউরে উঠছে। এমন নিরবতায় প্রচুর অসস্তি হচ্ছে হিয়ার।
হিয়া কিছু বলার আগেই শুভ্র একদম কাছে চলে এলো। দুজনের মাঝে ছিটে ফোঁটা দুরত্ব নেই। হিয়া একবার শুভ্রের চোখের দিকে তাকিয়ে, চোখ সরিয়ে নিলো। শুভ্র যেনো এক ঘোরের মধ্যে আছে। শুভ্রের চোখে সেটা স্পষ্ট। শুভ্র হিয়ার মুখের কাছে মুখ আনতেই হিয়া চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। কিন্তু হটাৎ শুভ্রের ফোন বেজে উঠলো।
শুভ্র ভ্রু কুচকে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে ধরলো। হিয়া আস্তে করে একটা চোখ খুলে তাকালো শুভ্রের দিকে। শুভ্র ফোনের ওপাশে থাকা লোকটাকে বললো,” আই উইল বি লেট টুডেয়।”
শুভ্রের কথাটা কর্নগচর হতেই হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। লেট হবে মানে? কি করতে চাইছে এই লোকটা? শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে কল কেটে ফোনটা পকেটে ভরে কাবাডের দুপাশে হাত রেখে ঝুকে এলো।
[ চলবে]
এইযে আমার ” নবপায়রা “, হ্যা তোমাদেরকেই বলছি। তোমাদের জন্যে অনেক ভেবে এই নামটা বের করেছি। তোমরা যারা আমাকে এতো ভালোবাসা দিয়েছ তারা সবাই আমার ” নবপায়রা “। 🕊️
একগুচ্ছ ভালোবাসা তোমাদের সবার জন্যে আর, যারা সুন্দর সুন্দর কমেন্টে দিয়ে কমেন্টবক্স সব সময়ভরিয়ে রাখো। 💕