#নিবিদ্রিতা_কাহন—-৩৩
®মেহরুমা নূর
★রাত প্রায় ১ টা ছুঁই ছুঁই।আদ্রিতা বিছানায় শুয়ে আছে। ডক্টর আঙ্কেল এসে আদ্রিতার পায়ের কাচ বের করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। তানি, আবিরসহ বাসার সবাই এসে চিন্তিত মুখে জড়ো হয়ে আছে তার চারপাশে। নেই শুধু নিবিড়। তানি তাকে অনুমতি দেয়নি আসার। ডাক্তার জানাল, আদ্রিতার তেমন গভীর ভাবে কাটেনি। চামড়ার কাছ দিয়ে কেটেছে শুধু। এতে ভয়ের কিছু নেই। তিন-চার দিনে ঠিক হয়ে যাবে কিছু ঔষধ প্রেসক্রিপশন করে দিলো আদ্রিতার জন্য।
দুই হাতে চুল টেনে ধরে মাথা চেপে ধরে বসে আছে নিবিড়। অপরাহ্ন এসে বসলো তার পাশে। বাবার সাথে সেও এসেছিল। অপরাহ্ন নিবিড়ের কাঁধ চেপে বলল,
“রিল্যাক্স, অরি ঠিক আছে। খুব বেশি লাগেনি। সালা এত রাগ কই পাস তুই! নিজেই ক্রোধ ছড়িয়ে যদি নিজেই তাতে জ্বলে মরিস তাহলে এতো রাগ দেখালেই হয়!”
নিবিড় মাথা তুলে বলল,
“তুই বুঝবিনা। কখনো এই অনলে জ্বলিসনিতো তাই বুঝবিনা। একবার এই অগ্নিতে পা রেখে দেখ তারপর বুঝবি কি দহন! এ পীড়ন, না বাঁচতে দেয়, না দেয় ম,রতে।”
অপরাহ্ন কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যকর হাসলো। সেকি আসলেই বোঝে না! আমার বন্ধুটা জানেই না আমিও এই দহনে কবেই জলাঞ্জলি দিয়ে ফেলেছি নিজেকে। এ দহনের যাতনা সেও কিছুটা পেতে শুরু করেছে। এখানে আসার পর যখন তানহাকে দেখলো তখন তার সাথে কথা বলার অনেকবার চেষ্টা করেছে অপরাহ্ন। আজ ওভাবে ক্লিনিক থেকে চলে আসার বিষয়টাতে চিন্তা হচ্ছিল তার। তাই কথা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু তানহা যেন ওকে দেখেও দেখছিলোনা আজ। অপরাহ্ন যখনই কোন সুযোগে তার সাথে কথা বলতে যাচ্ছিল তখনই সে অন্য কোন অজুহাতে তাকে এভয়েড করছিলো। অপরাহ্নের বিষয়টা ভীষণ রকম খটকা লাগছে। হঠাৎ তানহার এমন বিরুপ আচরণ তার বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়েটার কোন কারণে রাগ হয়েছে তার উপর! কিন্তু কি এমন করেছে সে! অন্তত অপরাধ জানারতো অধিকার তার আছে। তার আগেই কেন শাস্তি পাচ্ছে সে!
রাত তখন প্রায় ৩টা। আদ্রিতা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। তার পাশেই তানি শুয়ে আছে। অসুস্থতার কারণে আজ অরির কাছেই শুয়েছে সে। আদ্রিতার ঘুম অন্য দিনের মতো অতো গভীর হয়নি। আসলে তানির জোরাজুরিতে চোখ বুজেছে সে। নাহলে ওরজন্য সোনা মা-ও ঘুমাতোনা। তাই এমনি চোখ বুজে শুয়ে আছে। ঘুম আসবেই কি করে! মন মস্তিষ্কে এতো অশান্তি চললে কীভাবে ঘুম ধরবে! শরীর, মন দুটোতেই যেন বৈরি আবহাওয়া বিরাজ করছে। একটুও শান্তি পাচ্ছে না সে। ওই ক্রুর মানবটার উপর খুব করে অভিমান হচ্ছে তার। সবসময় শুধু রাগ দেখানো। এক মিনিট একটু কথাটা শুনলে কি হতো! ঠিক আছে, বলবে নাতো কথা! না বলল। আমিও আর কথা বলবো না। থাকুক সে তার রাগ নিয়ে। আর কক্ষনো যাবোনা তাকে মানাতে। দৈত্য দানব একটা।
আদ্রিতার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ নিজের মুখের উপর কারোর গরম নিঃশ্বাসের আভাস পেল। মুহুর্তেই মৃদু কম্পন সৃষ্টি হলো তার লোমকূপে। কারণ সে বুঝতে পারলো ব্যক্তিটা কে। এই নিঃশ্বাস যে তার চেনা,এই সুবাস তার শ্বসনতন্ত্রে মিশে আছে। কিছুক্ষণ পর গালে ওই হাতের কোমল আদুরে ছোঁয়া পেল আদ্রিতা। আর কপালে তার অধরের গভীর স্পর্শ। চোখের কোন দিয়ে লোনাজল গড়িয়ে পড়লো আপনাআপনি। আর চোখ বুজে থাকতে পারলোনা আদ্রিতা। টলমলে ভেজা নেত্রপল্লব মেলে তাকালো সে। মুখের উপর ঝুঁকে থাকা নিবিড়ের বিধ্বস্ত মুখ,লাল হয়ে উঠা ব্যাথিত নয়ন যুগলের মায়া ভরা চাহুনি দেখতে পেল।যে চাহুনিতে বারবার দ্রবীভূত হয়ে যায় আদ্রিতা। হঠাৎ অভিমান মোচড় দিয়ে উঠলো যেন আদ্রিতার মাঝে। সে মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তখনই নিবিড় তার ঠোঁটের উপর তর্জনী আঙুল চেপে ধরে চুপ থাকার ইশারা করলো। চোখের ইশারায় বুঝাল মা টের পাবে। আদ্রিতা ঘাড় হালকা বাঁকিয়ে দেখলো তানি ঘুমিয়ে আছে। আবার ফিরে নিবিড়ের তাকাতেই আচমকা নিবিড় দুই হাতে আদ্রিতাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গে আদ্রিতা। কিছু বলা বা বুঝে উঠার আগেই নিবিড় তাকে নিয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নিলেই আদ্রিতা বিস্মিত গলায় বলল,
“আরে আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন! নামান বলছি আমাকে। তখনতো খুব রাগ দেখাচ্ছিলেন! আমার কথাও শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কু,কু,র, বিড়ালের মতো তাড়িয়ে দিচ্ছিলেন! তাহলে এখন আবার আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন কেন!”
নিবিড় নিজের মতো অগ্রসর হতে হতে বাঁকা হেঁসে বলল,
“এখন আদর দিতে নিয়ে যাচ্ছি।”
প্রচন্ড ভাবে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল আদ্রিতা। সারাদিনের খালি পেট যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে একেবারে ভরে টইটুম্বুর হয়ে গেল। নিবিড়ের কাছ থেকে এধরণের কথা আজ অব্দি শোনেনি সে। নিবিড়ের এমন মুখফোড় কথা শুনে তব্দা খেয়ে গেল আদ্রিতা। ভীষণ রকম লজ্জাময় পরিস্থিতিতে পড়ে গেল যেন৷ কান গরম হয়ে উঠলো। অথচ জনাব দেখো কত নির্বিকার! যেন অতি সাধারণ একটা কথা বলেছে সে। এমন কথা সে দিনে তিনবেলা নিয়ম করে বলো থাকে। আদ্রিতার এবার অভিমানের সাথে কিছুটা রাগও হলো। সে তাতানো কন্ঠে বলল,
“কিসব যাতা বলছেন! ছাড়ুন বলছি আমাকে! আমি আপনার সাথে কোথাও যাবোনা। নামান আমাকে।”
নিবিড় ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“নট পসিবল। এই মুহুর্তে আমার হাতে শুধু তোলার ফ্যাসিলিটি আছে৷ নামানোর ফ্যাসিলিটি এখনো ডেবোলোপ হয়নি। সো আই কান্ট। তবে হ্যাঁ, বেশি প্যাকর প্যাকর করলে উঠিয়ে আছাড় মারার ফ্যাসিলিটিটা আমার ফাংশনে অলটাইম আপডেট থাকে। সেই ফ্যাসিলিটি নিতে না চাইলে চুপচাপ থাক।”
আবার অপমান! রাগ এবার টপ ফ্লোরে উঠে গেল। তাও আবার লিফটের গতিতে। এখনতো কিছুতেই যাবে না সে। আদ্রিতার কোনো সম্মান নেই নাকি! ভেতরের প্রতিবাদী সত্তা প্রতিত্তোরে বলল,”অফকোর্স আছে। আরে দ্রব্যমূল্যের বাড়ন্ত দামের চেয়েও বেশি তোর সম্মান আছে। তুই দমে যাস না। দেখিয়ে দে তোর দম।” আদ্রিতা তার ভেতরের সত্তার সাপোর্ট পেয়ে প্রতিবাদী কন্ঠে বলল,
“দেখুন, ভালোই ভালোই বলছি ছেড়ে দিন।”
“খারাপ খারাপ বললেও ছাড়বোনা।”
আদ্রিতা এবার রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল
“দেখুন, শেষবার বলছি ছেড়ে দিন। নাহলে কিন্তু সোনা মাকে ডাকবো আমি। তারপর পিঠে মার পড়লে কেমন লাগে বুইঝেন।”
নিবিড় বাঁকা হেঁসে বলল,
“যাকে খুশি ডাক। নিবিড় কাউকে ভয় পায়না।”
আদ্রিতা এবার সত্যি সত্যিই ডাক দেওয়ায় জন্য মুখ খুলে,
“সোনা………”
শুধু এতটুকু উচ্চারণ করতেই নিবিড় আদ্রিতার মুখ বন্ধ করে দিলো। আদ্রিতার খোলা অধর যুগলকে নিজের অধর দ্বারা চেপে ধরে মুখ বন্ধ করে দিলো তার৷ আচমকা নিবিড়ের এহেন ক্রিয়ায় স্থির হয়ে গেল আদ্রিতা। হৃদপিণ্ড ঝংকার তুলে কেঁপে উঠল। কম্পন ছড়ালো সমস্ত অঙ্গের শিরায় শিরায়। নিঃশ্বাস তার পথ ভুলে আঁটকে রইলো অজানা পথে। নিগূঢ় হয়ে উঠলো সারা অঙ্গ। নিবিড় প্রথমে আদ্রিতার মুখ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ওষ্ঠদ্বয় মিলিত করলেও পরে যেন আকাঙ্খা আরও তীব্র হলো। বুঝতে পারলো নেশার সমুদ্রে ঝাপ দিয়েছে সে। যে নেশায় কেবল হারানোর রাস্তা আছে, বের হবার পথ অনেক মুশকিল। নিবিড়ও হারাতে লাগলো আদ্রিতার নেশার ইন্দ্রজালে। এত বছরের দৃঢ়তা,ধৈর্য সব আজ এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। নিবিড়ের এই গভীর স্পর্শের ছোঁয়ায় আদ্রিতার সর্বস্ব যেন বিবশ, শক্তিহীন হয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এখুনি সব শক্তি হারিয়ে পড়ে যাবে সে। তাই নিজেকে টিকিয়ে রাখতে দুই হাতে নিবিড়ের টিশার্টের অংশ আঁকড়ে ধরলো আদ্রিতা। তবে নিঃশ্বাস যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার কি করবে সে! লোকটা কি তাকে নিঃশ্বাস আঁটকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে! কি সাংঘাতিক পরিকল্পনা! লোক বালিশ চা,পা দিয়ে মা,রে। আর এ ঠোঁট চাপা দিয়ে মারার প্ল্যান করছে! আপডেটেড মডার্ন মা,র্ডা,র প্ল্যান! না, এই প্ল্যান সে সফল হতে দিবেনা। মৃ,ত্যু,র ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচাতে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে লাগলো আদ্রিতা। কিন্তু পেশিবহুল, ইস্পাত-দৃঢ় মানবের সাথে কি আর ছোট্ট কোমল জান আদ্রিতা পেরে ওঠে!
নিবিড় তার নিজ ইচ্ছেতেই একসময় আদ্রিতার অধর যুগলকে রেহাই দিলো। তারপর বাঁকা হেঁসে বলল,
“ডাক আবার। তোর সোনা মা আছেতো আমার কাছেও হাতিয়ারের কমতি নেই। যতবার মুখ খুলবি ততবার এই হাতিয়ার ব্যাবহার করবো। এন্ড আই সোয়্যার, আই রিয়েলি লাভ টু ডু দিস। তো ডাক যাকে খুশি তাকে।”
আদ্রিতাতো নিবিড়ের কাজে এমনিতেই চুপসে গেছে। তারউপর এমন হুমকি শুনে মুখ খোলার সাহস নেই তার। এই মুহুর্তে ওই লোকটার দিকে তাকাতেও পারছেনা আদ্রিতা। নিবিড়ের কাঁধের উপর মুখ ঘুরিয়ে চোখ বুজে রইল সে।হৃদপিণ্ড এখনো প্রচন্ড বেগে ধুকপুক করছে তার। আর উনি! এমন একটা অসভ্য কাজ করেও কেমন ভাবান্তরহীন ভাবে চলে যাচ্ছে! আদ্রিতা বিড়বিড় করে বলল,
“দৈত্য দানব একটা।”
“আর তুই পেত্নীর রানী, পি,শা,চিনী।”
নিবিড় আদ্রিতাকে নিয়ে বাহিরে বেড়িয়ে এলো। বাহিরে এসে নিবিড়ের গাড়ি আনলক করে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিলো আদ্রিতাকে। তারপর নিজেও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো। আদ্রিতা অভিমান করে জানালার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বসে রইল। নিবিড় গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,
“সিট বেল্ট বাঁধবি! নাকি আমার বেঁধে দেওয়ার অপেক্ষা করছিস! মনে হচ্ছে আজকাল টিভি সিরিয়াল বেশি দেখছিস। নিজেকে নায়িকার ফিল দিতে চাস!”
এবারতো রাগে মাথা ফেটে গেল আদ্রিতার। সে তীব্র রাগে নিবিড়ের মুখের সামনে ঝুঁকে আসলো। তা দেখে ভয়ে পেয়ে মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে ফেললো নিবিড়। আদ্রিতা আঙুল দেখিয়ে ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
“পড়বোনা, পড়বোনা তোর ঘোড়ার ডিমের সিটবেল্ট। কি করবি তুই হ্যাঁ! আজ দরকার হলে এই গাড়ি উল্টে যাক, ভূমিকম্প এসে পৃথিবী দুই ভাগ হয়ে যাক, বাজ পড়ুক গাড়ির উপর তবুও এই অরি তোর গাড়ির সিটবেল্ট পড়বেনা তো, পড়বেনা। দ্যাট ইস ফাইনাল। লক করে দে।”
কিন্তু আপসোস, এসব শুধু আদ্রিতার মনে মনেই ঘটলো। বাস্তবে আদ্রিতা মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করতে পারলোনা। মনের মাঝে রাগের পাহাড় জমাতে জমাতে ঝট করে সিটবেল্ট পড়ে নিয়ে আবারও মাথা ঘুরিয়ে বসে রইল। যার দরুন নিবিড়ের ঝুলে থাকা হাসিটা দেখতে পেলনা সে।
গাড়ি কতক্ষণ ধরে চলছে তার খেয়াল নেই আদ্রিতার। কোথায় যাচ্ছে তাও জানা নেই। জানতে চায়ও না সে। ওই বদ লোকটার সাথে তার কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ওই কঠোর মানব শুধু আদ্রিতাকে কষ্টই দিতে জানে।তার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য, ‘দুনিয়াতে কষ্ট আছে যত, আদ্রিতার উপরেই সব করো বিসর্জিত।’ মনটা অভিমানে অভিমানে ফেঁপে উঠছে আদ্রিতার। কান্না আটকাতে সক্ষম হচ্ছে না সে। অবাধ্য লোনাজল নিজ পথ ধরে বেড়িয়ে পড়ছে। মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়েই রেখেছে এখনো। নিবিড়কে দেখাবেনা তার চোখের জল। তবে আদ্রিতা কি আর জানে তার মনোভাব বোঝার জন্য পাশের ব্যাক্তির চোখের দেখার প্রয়োজন হয়না। সেতো না দেখেও সবই টের পাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষা টের পেল আদ্রিতা। তবুও ফিরে তাকালো না। ওভাবেই বসে রইল সে। নিবিড় গাড়ি থেকে নেমে আদ্রিতার পাশে এসে দরজা খুলল। আদ্রিতা এবার অভিমানে উল্টো দিকে মাথা ঘুরিয়ে নিলো। চোখে এখনো নিরব বৃষ্টি ঝড়ছে তার। নিবিড় হাত বাড়িয়ে কোলে তোলার জন্য আদ্রিতার হাত ধরতে নিলেই আদ্রিতা হাত ঝটকা মেরে সরিয়ে নিলো। আবার ধরতে নিলে আবারও একই কাজ করলো। এভাবে কয়েকবার করার পর নিবিড় এবার জোর করেই আদ্রিতাকে কোলে তুলে নিলো। আদ্রিতা এবার একটু শব্দ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দুই হাতে নিবিড়ের বুকে এলোপাতাড়ি কিল মারতে মারতে কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগলো,
“ছাড়ুন আমাকে, ছাড়ুন বলছি। আপনি খুব পঁচা।খুব খুব খুব….। দৈত্য দানব একটা। থাকবোনা আমি আপনার কাছে। আপনি না আমাকে দেখতে চান না! আমিও তাই আপনার সামনে আসবোনা। ছাড়ুন বলছি…. ”
কথা বলছে আর ফোঁপাচ্ছে আদ্রিতা। নিবিড় সেসবের তোয়াক্কা না করে আদ্রিতাকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সামনে নির্জন নদীর কিনার। নিবিড় আদ্রিতাকে নিয়ে নদীর কিনারায় ঘাসের গিয়ে বসলো। ক্রন্দনরত আদ্রিতাকে বুকের মাঝে আগলে নিলো সে। আদ্রিতার হাতের প্রহার বন্ধ হয়ে এলো এবার। নিবিড়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে যেন আরও আবেগী হয়ে উঠলো সে। বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে তার অভিমান ব্যক্ত করলো। নিবিড় চুপচাপ শুধু আদ্রিতাকে বুকের মাঝে মিশিয়ে রাখলো।
কিছুক্ষণ পর নিবিড় আদ্রিতার মুখের দিকে ঝুঁকে উঁকি দিয়ে বলল,
“কিরে কান্দুনির মা, কান্না কি আজ থামবে! দজ্জাল শাশুড়ী যেমন তার ছেলের বউকে মারে, তেমন মেরে মেরে আমার কলিজা,ফুসফুসের তো ভর্তা বানিয়ে দিলি। তারপরও কাঁদছিস! এখনকি আমাকে গরম তেলে ফ্রাই করে ক্ষান্ত হবি! তুই তো আবার পেত্নী। কোন ভরসা নেই। আস্ত ফ্রাই করে খেয়ে ফেলবি তাও বিনা ঢেকুর তুলে।”
সুইচ বাটনের মতো কান্না থেমে গেল আদ্রিতার। রাগের সুইচ অন হয়ে গেল আবার। মানে একটা লোক কতটা বদ হতে পারে তার থার্মোমিটার তৈরি করার জন্য এই লোকটাকে নেওয়া উচিত। রাগে-অভিমানে আদ্রিতা নিবিড়ের কোল থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
“আমি পেত্নী না! ঠিক আছে ছেড়ে দিন আমাকে। কে বলেছে ধরে রাখতে!”
নিবিড় হঠাৎ গম্ভীর সুরে বলল,
“ছেড়ে দিবো! সত্যিই ছেড়ে দিতে বলছিস!”
বুকের মাঝে খচ করে ধারাল কোন কিছু বিঁধল যেন আদ্রিতার। ব্যাথা হলো ভীষণ রকম। আৎকে তাকালো নিবিড়ের দিকে সে। সেই চোখে চোখ রেখে নিবিড় আদ্রিতার গালে হাত বুলিয়ে মায়াবী সুরে বলল,
“বলনা,আমি ছেড়ে দিলে খুশি হবি তুই! আমি এতো খারাপ বুঝি!”
আদ্রিতার কি যেন হয়ে গেল। সে নিবিড়ের বুকে আবারও মাথা রেখে দুই হাতে নিবিড়কে জড়িয়ে ধরে করুন সুরে বলল,
“হ্যাঁ, খুব খারাপ আপনি। খুব খারাপ।আমার চাওয়া দিয়ে কি হবে! আপনি নিজেইতো বারবার আমাকে ছেড়ে যান। বারবার দূরে সরিয়ে দেন৷আগেও একবার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আবার সেদিন ওভাবে আমাকে রেখে চলে এলেন কিছু না বলে। একবারও আমার কথা ভাবলেন না। আমার কেমন লাগছিল তা একবারও জানতে চাননি। এই কয়টা দিন কীভাবে কেটেছে তা আমিই জানি শুধু।”
নিবিড় আদ্রিতার মুখটা ধরে কপালে চুমু খেয়ে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে মায়াময় সুরে বলল,
“তো কি করতাম! ওখানে থাকলে যে সব ধ্বংস করে দিতাম আমি। হয়তো তুইও রক্ষা পেতি না। তাইতো চলে গিয়েছিলাম। নিজেকে নিজের মতো নিয়ন্ত্রণে আনতে। এখানে থাকলে রাগের বশে কি করতাম আমি নিজেও জানি না।”
“আপনি ভুল বুঝছেন। আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না। আসলে সেদিন আমি জানতাম না জো…..”
এতটুকু বলতেই নিবিড় আদ্রিতার ঠোঁটে তর্জনী আঙুল চেপে বলল,
“হুঁশ, আমাকে সাফায় দিতে হবে না। তোর উপর কোন সন্দেহ নেই আমার।আমি জানি তুই ইচ্ছে করে ওর কাছে যাসনি। যদি তেমন কিছু হতো তাহলে হয়তো নিজ হাতে তোকে মে,রে আমি নিজেও ম,রে যেতাম। আমি সব সহ্য করতে পারি পুতুল। সব মানে সব। কঠিন থেকে বিষয়ও মেনে নিতে পারি। শুধু কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে তোর কিঞ্চিৎ পরিমানও দিতে পারবোনা। যদি তার মনে তোকে নিয়ে কোন বাসনা থাকে তাহলেতো কখনোই না। তোর প্রতিচ্ছবি কারোর চোখে ক্ষনিকের জন্যও থাকবে তা বরদাস্ত না আমার। কিছুতেই না। তুই আমার মন বাগানের ফোটা একমাত্র নিষ্পাপ ফুল। তোর উপর অন্য কারোর নজর সইবোনা আমি। আর এমন কিছু যখন ঘটে তখন নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি আমি। আমি চাইনি আমার দ্বারা ওই ব্যক্তির জান চলে যাক। অন্তত জুহি ভাবির জন্য হলেও আমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রয়োজনীয় ছিলো। তাই চলে গিয়েছিলাম। আর আজ তোকেও আমি একারণেই চলে যেতে বলছি। কারণ তুই আমার ভুল ধারণা দূর করার নামে বারবার ওই ইডিয়ট টার নাম নিচ্ছিলি। যা আমার রাগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল।”
আদ্রিতা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ রাগতো যেন উনার আবাদের ফসল। সারা বছর বাম্পার ফলন দিয়ে ভরে থাকে।”
নিবিড় আদ্রিতার কোমড়ে মুচড়ে ধরে চোয়াল চিবিয়ে বলল,
“কি বললি! জোরে বল!”
নিবিড়ের মুচড়ে ধরায় আদ্রিতা ব্যাথা পেয়ে বেখেয়ালিতে নিজের আঘাত পাওয়া পা নড়াতেই পায়েও ব্যাথা পেয়ে হালকা আর্তনাদ করে উঠলো। নিবিড় ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
“কি হলো! ব্যাথা পেয়েছিস! দেখি..
নিবিড় ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে আদ্রিতার পায়ের ক্ষত খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো। চাঁদের আবছা আলোতেও নিবিড়ের মুখের করুনতা স্পষ্ট দেখতে পেল আদ্রিতা। ভীতি আর অপরাধবোধ তার মুখমন্ডলে। আদ্রিতা এতক্ষণে খেয়াল করলো নিবিড়ের মুখটা এই কয়দিনেই কেমন বিবর্ণ, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। দাঁড়ি গোঁফ দিয়ে মুখ ভরে গেছে। সযত্নে রাখা চুলগুলোও কেমন অবহেলায় এলোমেলো হয়ে আছে। এই কয়দিন দূরে থেকে লোকটাও যে ভালো ছিলোনা তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে। আর বুঝতে পেরেই আদ্রিতার মন হু হু করে উঠছে। মায়া উপচে পড়ছে এই পুরুষের প্রতি।
নিবিড় আদ্রিতার পা দেখা শেষে আদ্রিতার গালে হাত বুলিয়ে অপরাধী সুরে বলল,
“খুব লেগেছে তাইনা! অনেক ব্যাথা হচ্ছে, বলনা!”
আদ্রিতা হাসিমুখ করে বলল,
“নাতো। ওই সামান্য একটু কেটেছিল। ডাক্তার আঙ্কেল বলেছে দুই দিনেই লাফাতে পারবো আমি।”
নিবিড় স্মিথ হাসলো। যেন সে বুঝতে পারলো আদ্রিতার প্রচেষ্টা। নিবিড় মায়াময় চোখে তাকিয়ে আদ্রিতার কপালে অধর ছোঁয়াল।দুই চোখের পাতায় চুমু খেল। দুই গালেও ভালোবাসার কোমল আদুরে পরশ বুলিয়ে আদ্রিতাকে শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো। হৃদপিণ্ডের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা যেন। বুকের উষ্ণতায় প্রাণ ভোমরাটাকে লুকিয়ে নিয়ে বলল,
“তোকে দেওয়া আঘাত হাজার গুণ বেশি হয়ে ফিরে আসুক আমার কাছে। আমার সব খুশি তোর নামে। তোর সব কষ্ট আমার নামে হয়ে যাক।”
চলবে……..