#নিবিদ্রিতা_কাহন—-৪৪
®মেহরুমা নূর
★আদ্রিতার মনে হচ্ছে সে কত দিন পর যেন ঘুম থেকে জেগেছে। যেন ঘুমের মাঝে কত দিন পার হয়ে গেছে তার। গত কিছুদিন কেমন ধোঁয়াসে তার স্মৃতিতে। সেগুলো ভাবতে গেলেও মাথা ঘুরে উঠে তার। শরীরটাও অসম্ভব দূর্বল মনে হচ্ছে। যেন কতদিন ধরে খাওয়া দাওয়া করেনা সে। চেহারাও একেবারে ভেঙে পড়েছে।আদ্রিতা নিজের মাঝের এমন পরিবর্তন ঠিকমতো বুঝতে পারেনা। সে পরিবারজনের কাছে জানতে চাইলে বলে তার নাকি জ্বর হয়েছিল তাই এমন লাগছে। যদিও আদ্রিতার তাদের কথায় পরিপূর্ণ কনভিন্স হয়না৷ তবে আপাতত তাদের কথায় মেনে নিচ্ছে সে। বেচারি আর করবেইটা কি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে এসব ভাবছে আর মাথার চুল আঁচড়াচ্ছে আদ্রিতা। চুলগুলো কেমন জট বেঁধে গেছে। আঁচড়াতে নিয়ে অনেক ব্যাথা করছে। নিজে নিজেই মুখে ব্যাথার হালকা আওয়াজ করছে আঁচড়াতে নিয়ে। তখনই হঠাৎ পেছন থেকে নিবিড় এসে আদ্রিতার হাত থেকে চিরুনিটা টান দিয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আঁচড়ে দিচ্ছি। এখানে বোস।”
বলেই আদ্রিতাকে বিছানায় বসিয়ে তার চুল ধীরে ধীরে আঁচড়ে দিতে লাগলো। এত সাবধানে করছে যেন চুল নিজেও টের পাচ্ছে না। আদ্রিতার হুঁশ আসার পর থেকে সে আরও একটা জিনিস খেয়াল করছে। যখন থেকে হুঁশ এসেছে তখন থেকে সে খেয়াল করছে নিবিড় ভাইয়া প্রায় সময়ই ওর রুমেই থাকছে।এমনকি সকালে যখন আদ্রিতা ঘুৃম থেকে জেগেছিল তখন নিজেকে সে নিবিড় ভাইয়ার রুমে পেয়েছিল। তা দেখে আদ্রিতা ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। সে তৎক্ষনাৎই দ্রুত নিজের রুমে চলে আসে। কিন্তু নিজের রুমে আসার পরেও নিবিড় ভাইয়া এখানেও হুটহাট চলে আসছে, বিছানায় শুয়ে পড়ছে।তাও বিনা নক করেই।যেন খুব স্বাভাবিক বিষয় এটা। বিষয়টা আদ্রিতাকে ভাবাচ্ছে। আগে কখনো নিবিড় এভাবে ওর রুমে আসতো না। আসলেও সবসময় নক করে আসতো। কিম্তু হঠাৎ কি হয়ে গেল উনার!
আদ্রিতার এই বিস্ময় আরও চরম পর্যায়ে বাড়লো যখন রাতের বেলায়ও শোবার সময় নিবিড় ভাইয়া ওর রুমে আরামে ঢুকে পড়লো। শুধু ঢুকে পড়লোনা। সোজা এসে ওর বিছানায় অনায়াসে শুয়ে পড়লো।যেন এই বিছানায় শোয়া তার রাষ্ট্রিয় অধিকার। শুয়ে পড়ে আয়েসি সুরে বলল,
“দরজাটা লাগিয়ে দে।”
আদ্রিতা হতভম্ব হয়ে গেল। যেন টুপ করে আকাশ থেকে বাজ এসে হালকার উপর ঝাপসা করে পড়লো তার উপর। সে বিস্মিত গলায় বলল,
“আরে আরে, দ….দরজা বন্ধ করবো মানে কি! আর আপনি এখানে আমার রুমে কি করছেন! কেউ দেখলে কি ভাববে! যান নিজের রুমে যান।”
আদ্রিতার কথায় নিবিড় ঠাস করে উঠে দাঁড়িয়ে এমনভাবে আদ্রিতার দিকে তাকালো যেন এহেন বিস্ময়কর কথা সে কস্মিনকালেও শোনে নি।ভাবটা এমন যেন, এখুনি হয়তো টিভি সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো দুই কান চেপে ধরে চিল্লিয়ে বলে উঠবে,”হে মা,মাতাজি!”। এমন কথা শুনে সে এখুনি অ্যাটাক ফ্যাটাক খেয়ে বসবে টাইপ । নিবিড় আদ্রিতার সামনে এসে বিস্মিত গলায় বলল,
“কি বললি তুই! আরেকবার বল!”
আদ্রিতা থতমত কন্ঠে বলল,
“আপনাকে যেতে বললাম। এত রাতে আমার রুমে কি করছেন আপনি!”
নিবিড় এবার হাতে তালি বাজিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“বাহ! কত সুন্দর করে বললি আমি এখানে কি করছি! এই কথা বলতে একবারও তোর কলিজা কাঁপল না! মানুষ ঠিকই বলে। একবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে মানুষ এভাবেই তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আজ আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তাই এখন রুম থেকে বেড়িয়ে যান তাইনা! এই ছিলো তোর মনে! তুই আজ প্রমাণ করে দিলি তুই আসলেই কতবড় ধান্ধাবাজ।”
আদ্রিতা বেচারি টাস্কি খেয়ে গেল। হতভম্ব কন্ঠে বলল,
“আরে! কি এমন বললাম আমি! কি আবোলতাবোল বলছেন আপনি! আর ধান্ধাবাজির কি করলাম আমি!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ তুইতো কিছু করিসইনা। সবতো আমারই দোষ। গলায় ছু,রি ধরে এই অবলা ছেলেটাকে বিয়ে করে ফেললি, আর এখন বলছিস আমি কেন এখানে! এই ছিল আমার কপালে!”
আদ্রিতা থ মেরে গেল নিবিড়ের কথায়।কিছুটা রাগী সুরে বলল,
“দেখুন, মজা করারও একটা লিমিট আছে। এটা কি ধরনের বেহুদা মজা! হুদাই এক কথা বলে যাচ্ছেন।”
“মজা আমি করছিনা। মজাতো তুই আমাকে নিয়ে করেছিস।ইচ্ছেমত মজা করে এখন আমাকো তাড়িয়ে দিচ্ছিস! আমি জানতাম তুই এভাবে ধোঁকা দিবি আমাকে। তাই প্রমাণ রেখেছি আমি। এই দেখ।”
নিবিড় ফেন বের করে ওদের বিয়ের ভিডিও দেখালো। তারপর অরির ছু,রি হাতে নিয়ে বিয়ে করার জন্য সেদিনের পাগলামিরও ভিডিও দেখালো। সেদিন তিন্নি কখন যেন এসব ভিডিও করেছিলো। সেটা নিবিড় ওর ফোনে নিয়ে নিয়েছিল। সেটাই আজ আদ্রিতাকে দেখাচ্ছে। আদ্রিতা ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো সে। এই কাজ কখন, কীভাবে করলো সে! নিবিড় তখন নেকি সুরে বলল,
“দেখলিতো! জ্বরের ঘোরের উছিলায় এই অবলা মাছুম ছেলেটাকে কীভাবে দাদাগিরি করে বগলতলা করে বিয়ে করে ফেললি তুই! আর বিয়ে করে….”
আদ্রিতা ধড়ফড়িয়ে উঠে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“আর বিয়ে করে কি?”
নিবিড় অতি অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
“আমারতো বলতেও দ্বিধা হচ্ছে। তুই যে এত ওয়াইল্ড তা জানা ছিলোনা আমার।কি পা,শ,বিক নির্যাতন করে আমাকে পুরো লুটে নিয়েছিস। ফালাফালা, ত্যানাত্যানা করে ফেলেছিস একেবারে আমাকে।”
আদ্রিতা এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,
“দে…..দেখুন, একদম বাজে কথা বলবেন না। আমি এমন করতেই পারিনা।”
“জানতাম মানবিনা।ধান্ধাবাজিতো তোর র,ক্তে। তবে আমিও তোর জুলুমের নিশানা রেখে দিয়েছি।”
নিবিড় নিজের শার্টের বোতাম একটানে খুলে বুকে আদ্রিতার দেওয়া কামড়ের দাগগুলো দেখিয়ে বলল,
“এই দেখ, কি হাল করেছিস আমার। জঙ্গলের হায়েনাও তোর সামনে কিছুনা।আজ হ্যান্ডসাম বলে আমাকে এভাবে খাবলে খেলি। আর এখন আমার সব রস চুষে নিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিস! তোর এই ধান্ধাবাজি আমি মানবো না। পুরুষ নির্যাতনের দায়ে যাবত জীবন জেল খাটাবো।”
আদ্রিতা স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো। হঠাৎ সারা বারি কাঁপিয়ে চিল্লিয়ে ডাকলো সে সবাইকে। তার গলা ফাটানো ডাকে সবাই তার রুমে এসে উপস্থিত হলো। আদ্রিতা তানির কাছে জানতে চাইলো নিবিড় যা বলছে তা কি সত্যি নাকি! তখন তানিসহ বাকিরাও জানাল আসলেই ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। আদ্রিতা ধপ করে আবারও থ মেরে বসে পড়লো। ওর বিয়ে হয়ে গেল অথচ সে নিজেই জানে না! এইটা কোনো কথা! মনের মাঝে কেমন অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। নিবিড় ভাইয়ার বউ হওয়াতো তার সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্যি সত্যিই স্বপ্নেই ঘটে যাবে তাকি জানতো সে!
একটু পর সবাই বেড়িয়ে গেল। থেকে গেল শুধু আদ্রিতা আর নিবিড়। বাকিরা বের হতেই নিবিড় দরজা আঁটকে দিলো। দরজা আটকানোর শব্দে আদ্রিতার বুকও কেঁপে উঠল। তার খেয়াল হলো নিবিড় ভাইয়া এখন তার স্বামী।তারমানে সে এখন ওর সাথে একই রুমে থাকবে। আর এটা মনে আসতেই হাত পা কাঁপতে লাগলো আদ্রিতার। বুকের ভীষণ রকম দুরুদুরু শুরু হলো। গলা শুঁকিয়ে হচ্ছে মরুভূমি। ভয়,লজ্জা আর জড়তার সংমিশ্রণে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছে। যা আদ্রিতাকে মিইয়ে দিচ্ছে একেবারে। নিবিড়ের দিকে তাকাতেও ভয় লাগছে তার। আদ্রিতা সোফার উপর জড়োসড়ো,শক্ত হয়ে হয়ে বসে রইল। ভাবটা এমন যেন আজ চায়,ভূমিকম্প আসুক,দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাক সে এই সোফা ছাড়বেনা। এই সোফাতেই জান দিয়ে দিবে তবুও ছাড়বেনা। সোফায় জমে বসে রইল সে। আদ্রিতার এহেন কান্ড দেখে বাঁকা হাসলো নিবিড়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“কিরে সোফায় বসে বসে আন্ডা দিবি নাকি! শুবিনা!”
আদ্রিতা থতমত কন্ঠে বলল,
“আ….আমার ঘুম ধরেনি। শুবোনা এখন। আপনি শুয়ে পড়ুন।”
নিবিড় হতাশাজনক সুরে বলল,
“কি কপাল আমার! ধুরন্ধর মার্কা একটা বউ পেয়েছি। কোথায় এসে স্বামীর সেবা করে ঘুম পাড়িয়ে দিবে তা না, বাংলা সিনেমার রিনা খানের মতো সোফায় পা তুলে বসে আছে। এখনই হয়তো বলবি তোর পা টিপে দিতে! ধান্ধাবাজিরও একটা লিমিট আছে। তুই তাও পার করে গেলি।আজ আমার মতো ভদ্রলোক বলেই পার পেয়ে গেলি। নাহলে আজই হাত পা ভেঙে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতো।”
এসব বলে নিবিড় বিছানায় গিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো। নিবিড়ের এসব ফালতু কথা আদ্রিতার কানের তিনহাত দূরত্বেই রয়ে গেল আজ। ওসবে ধ্যান নেই তার। সেতো নিজের মনের ভয় আর জড়েতায় শক্ত হয়ে রইলো। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারলোনা সে। রাতের খাবার পর ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খেয়েছিল সে। যার প্রভাবে এখন তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। একসময় টিকতে না পেরে সোফায়ই কাত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল সে। এই পর্যায়ে নিবিড় উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলো আদ্রিতার সামনে। দুই হাতে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে এলো বিছানায়। আদ্রিতাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুলো তার পাশে। আদ্রিতাকে কাছে টেনে এনে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেল। মুগ্ধ অপলক নয়নে তাকিয়ে থেকে আদ্রিতার গালে হাতের আঙুল বোলাতে লাগলো। আদ্রিতার এই মায়াবী,হৃদহরণীয় মুখটা, নিবিড়ের বেঁচে থাকার সকল অবশ্যকতা শুধু এই মুখটাতেই। আদ্রিতাকে সবসময় হাসিখুশিময় স্নিগ্ধ দেখতে চায় নিবিড়। এরজন্য সব করতে রাজি সে। কয়দিন আগের ওই ভয়াবহ দিনগুলোকে মনে করতেও দম বন্ধ হয়ে আসে তার। এন্টিডোট না পাওয়াই নিবিড়ের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে দেখছিল সে। তবে উপরওয়ালা তার উপর কৃো করেছিল। নিবিড়ের মনে পড়লো এক সপ্তাহ আগের কথা,
সেদিনের পরদিন সকালে হঠাৎ জেরিনের মা বাবা এসে উপস্থিত নিবিড়ের বাড়িতে। জেরিনের বাবা একটা বক্স নিবিড়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা ওই ড্রা,গ,সের এন্টিডোট। জেরিনের রুম থেকে আমরা পেয়েছি। ডক্টরকে দেখিয়েছিলাম। তারা জানাল এটাই এন্টিডোট।”
নিবিড়সহ পুরি পরিবারের ধরে যেন প্রাণ ফিরে এলো। জেরিনের মা বলল,
“আমার মেয়ের হয়ে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে মেয়েটা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। তাই এমন গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছে। পারলে ক্ষমা করে দিয়েন আপনারা।,
নিবিড় যেন আজ কদিন পর সুস্থ নিঃশ্বাস নিলো। এখন ওর পুতুল ঠিক হয়ে যাবে। এই খুশিতে সে জেরিনকেও মাফ করে দিলো। জেরিনের মা বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি জেরিনের কেস উইড্রো করে নিবো।তবে একটা শর্ত আছে। আপনাদের প্রমিজ করতে হবে আপনারা জেরিনকে নিয়ে এই দেশ ছেড়ে সারাজীবনের জন্য বিদেশে চলে যাবেন। আর কোনোদিন ফিরবেন না। কারণ আমি আর কোনো রিস্ক চাইনা।”
জেরিনের মা বাবা খুশি হয়ে বলল,
“ঠিক আছে তাই হবে। আপনাদের অনেক অনেক শুকরিয়া এই দয়া করার জন্য।”
এন্টিডোট পাওয়ার পর থেকে আদ্রিতা ধীরে ধীরে হুঁশে আসতে শুরু করে। এই কয়দিন আধো আধো হুঁশে থাকলেও। আজ সকালে পুরোপুরি হুঁশে আসে সে। আর হুঁশে আসতেই তার মাথায় এসব ঘোরে। নিবিড় আদ্রিতাকে স্বাভাবিক করার জন্যই ওসব মজা করে যাতে ও বেশি স্ট্রেস না নেয়। নিবিড় আবারও আদ্রিতার কপালে চুমু খেয়ে আদ্রিতাকে বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো। আদ্রিতাও ঘুমের ঘোরেই নিবিড়ের বুকের উঞ্চতায় বিড়াল ছানার মতো আরও মিশে তার সাথে। বুকের মাঝে লুকিয়ে নিয়ে শীতল প্রশান্তিতে নিবিড়ও চোখ বুজলো।
____
এরই মাঝে আরও দু সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আদ্রিতা এখন অনেকটাই সুস্থ। সবার জীবনে আবারও আগের ফুর্তি ফিরে এসেছে। কারণ বাড়ি মাথায় করে রাখা দুষ্টু আদ্রিতা আবারও ফিরে এসেছে। বাড়িতে যেন জান ফিরে এসেছে। এরই মাঝে সময় বুঝে আদিত্য আর নূরকেও, নিবিড়-আদ্রিতার বিয়ের কথা বলে দিয়েছে আরমান সাহেব। আদ্রিতার অসুখের কথা না বলে অন্য কথা দিয়ে বুঝিয়েছে তাদের। নূর-আদিত্যও তেমন কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করেনি। তারাতো জানতোই এটা আগে পড়ে হওয়ারই ছিলো। আবির আর তানিও তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তানহা-অপরাহ্ন, নূরান-তনয়া ওদেরও প্রণয় চলছে আপন গতিতে।
গতকাল ফাইজা আর তার হাসব্যান্ড বেড়াতে এসেছে আদ্রিতাদের বাসায়। তাদের দেখে আদ্রিতা ভীষণ খুশি। ওদের আসার উছিলায় আজ সবাই মিলে আদিত্যদের ফার্মহাউসে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করেছে। পিকনিকের মতো প্রোগ্রাম করবে এমনটাই প্ল্যান। তবে বড়রা কেউ যেতে চাইলো না। তাই শুধু ইয়াংস্টাররাই যাবে। আদ্রিতাতো ভীষণ খুশি। সে সোনা মায়ের কাছে তাদের ইয়াং বয়সে ফার্মহাউসে গিয়ে আড্ডা দেওয়ার গল্প শুনেছে। ওই সময় তারা ফার্মহাউসে অনেক মজা করতো। আর মা-বাবার ওখানে কাটানো অনেক স্পেশাল মুহুর্তও আছে। তাদের বিয়েও ফার্মহাউসেই হয়েছিল। তাইতো আদ্রিতার ফার্মহাউসে গেলে সেসব মনে হয়। তার অনেক ভালো লাগে। ফার্মহাউসে যাওয়ার জন্য আদ্রিতা দ্রুত তৈরি হতে লাগলো। মিষ্টি কালারের একটা টপ আর জিন্স পড়েছে সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিকের চুল বাঁধছে। তখনই নিবিড় ঢুকলো রুমে। আয়নার তার প্রতিবিম্ব দেখে প্রতিবারের মতো বুকের মাঝে ধুকপুক করতে লাগলো আদ্রিতার। যেদিন থেকে সে জেনেছে নিবিড় তার স্বামী সেদিন থেকেই এমনটা হচ্ছে। নিবিড়কে দেখলেই তার হাত পা কাঁপতে থাকে। এখনতো ওদের রুমও এক হয়ে গেছে। নিবিড়ের রুমেই আদ্রিতার জিনিসপত্র নিয়ে এসে সব সেটেল্ড করে দিয়েছে নিবিড়। যাতে নানান বাহানায় আদ্রিতা বারবার তার রুমে না চলে যায়। তাতে আদ্রিতার ধুকপুকানি আরও বেড়েছে যেন। সবচেয়ে বেশি রাত হলে তার এই সংকট যেন আরও বেড়ে যায়।সারাদিন নানান অজুহাতে এদিক ওদিক ঘুরলেও রাতে রুমে আসতেই হয়। তখন গলা শুঁকিয়ে যায় তার। নিবিড় ঘুমানোর পড়েই আস্তে করে গিয়ে চুপচাপ একপাশে শুয়ে পড়ে। তবে রোজই সকালে সে নিজেকে নিবিড়ের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ পায়। সেটা যেমন লজ্জা এনে দেয় তেমনি সাথে একরাশ ভালো লাগায় শিহরিত করে দেয় আদ্রিতাকে। এমন না যে, নিবিড়ের ঘনিষ্ঠতা সে চায় না। তার অবচেতন মনও নিবিড়ের সান্নিধ্য পেতে চায়। তবে ওইযে দস্যু লজ্জা আর ভয় ওরাইতো আদ্রিতাকে দমিয়ে রাখে। তাদের জন্যইতো আদ্রিতার এতো জ্বালাতন।
নিবিড় রুমে ঢুকে সামনে তাকাতেই চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল তার। যেন এখুনি চোখের মনি দুটো খুলে হাতে চলে আসবে। বিস্ফোরিত চোখে সে তাকালো সামনে। তার নিট এন্ড ক্লিন রুমটার পোস্ট মর্টেম হতে দেখে হার্ট যেন ফটাস ফটাস ফেটে যেতে লাগলো। মনে হচ্ছে সে ভুলে কোনো মাছ বাজারে চলে এসেছে। নিবিড় এগিয়ে গিয়ে হতবাক চোখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“অরি! কি করেছিস এসব! এটা কি ঘর নাকি সিটি করপোরেশনের আবর্জনার গোদাম!”
আদ্রিতা চকিত নজরে পেছনে ফিরে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“মানে! কি বলছেন এসব! আবর্জনা কোথায় দেখলেন আপনি!”
নিবিড় চোয়াল চিবিয়ে ধমকের সুরে বলল,
“আচ্ছা! আবর্জনা কোথাও নেই তাইনা! তাহলে এগুলো কি! বিছানায় কাপড়-চোপড় আর কসমেটিকসের বাজার বসিয়েছিস কেন? রুমটাকে কি রাস্তার দোকান মনে হয় তোর! আর মেঝেতে চিপস, চকলেটের প্যাকেট দিয়ে কি ডিজাইন বানিয়েছিস!”
আদ্রিতা এক গাল হাসিমুখে বলল,
“আরে এসবতো আমি রেডি হচ্ছিলামতো তাই! এতে এত হাইপার হওয়ার কি আছে!”
“শাট আপ ইডিয়ট! জলদি এগুলো পরিষ্কার কর।”
“পরিষ্কার করার কি দরকার। আবার অন্য সময়তো পড়তেই হবে। এখান থেকেই নিয়ে পড়বো। শুধু শুধু আলমারিতে রাখার ঝামেলা করতে হবে কেন!”
“অরি,রাগাস না আমাকে। জলদি সব কাপড়চোপড় ভাজ করে রাখ সুন্দর করে।”
আদ্রিতা বোকার মতো মুখ করে বলল,
“ভাজ! সেটা আবার কি! কাপড়চোপড় আবার ভাজও করে নাকি! আমিতো কাপড়চোপড় এভাবেই ফেলে রাখি। নাহলে জড়ো করে আলমারিতে ঠুসে রাখি। ভাজ ফাজ করিনা। আমার এত ঢং ভাল্লাগে না।”
নিবিড়ের মাথায় হাত। বলে কি এই মেয়ে! এই মেয়ে যে তার নিট এন্ড ক্লিন রুমটাকে শহীদ করে দিবে এতে সন্দেহ নেই তার৷ নিবিড় এবার উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে বলল,
“পাঁচ মিনিট, জাস্ট পাঁচ মিনিট অরি।পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসব পরিস্কার না করলে তোর ফার্মহাউসে যাওয়া ক্যান্সেল।”
আদ্রিতা এবার ভয় পেয়ে বলল,
“না না প্লিজ এমন করবেন না। আমি এখুনি পরিস্কার করছি সব।”
আদ্রিতা দ্রুত সব পরিস্কার করতে লাগলো। নিবিড় তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘এই এক নারীতেই নিবিড়ের সব বিনাশ,
তবুও এই নারীতেই সর্বদা তার হৃদনিবাস।’
চলবে…